1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

ম্যাজিক উদয়

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

ম্যাজিক উদয়
রবীন বসু


অপার শূন্যতা। ব্যালকনিতে বসে যতদূর চোখ যায় আবছা ধূসরতা। একটু আগে সকাল হয়েছে। আলো ফুটছে ধীরে ধীরে। দিন এবার তার ব্যস্ত দৌড় শুরু করবে। ডানায় লাগবে রঙের ছোপ। তার আগে একটু ওয়ার্ম আপ সেরে নিচ্ছে। খুব সকালে ঘুম ভাঙে আদিত্যর। প্রথমে পুব দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে সূর্যপ্রণাম করেন। ছোটবেলায় বাবা সবার আগে ঘুম থেকে উঠতেন। তারপর তাদের চার ভাইকে ডেকে তুলতেন। উঠোনে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে সূর্যমন্ত্র বলতে হত। সে অভ্যেস এখনও আছে। তারপর কিচেনে গিয়ে নিজের হাতে এক কাপ চা করে ব্যালকনিতে এসে বসেন। দু'চোখ ভরে সকাল দেখেন। কত মানুষ মর্নিং ওয়াকে বের হয়। কিছু মানুষ সাইকেলে বাইকে হেঁটে তাদের রুজি-রোজগারের খোঁজে ছোটে। আদিত্য দার্শনিক নন, সামান্য ব্যাঙ্ককর্মী ছিলেন। যৌবনে কিছু কবিতা  লিখেছেন  মনের  খেয়ালে।  কিন্তু  ইদানিং  সকালে  ব্যালকনিতে বসে দূরের দৃশ্যমান প্রকৃতি আর মানুষজনের যাতায়াত দেখে তাঁর মধ্যে কেমন একটা বোধ কাজ করে। বহমান জীবন, তার এই অন্বেষণ কোথায় যেন অনির্দেশ। বড় ক্লান্ত লাগে। একা লাগে।

রোদ বেড়েছে। আলো ফুটেছে। তবু দৃষ্টি সীমার মধ্যে অনেক কিছু নড়েচড়ে কিন্তু ঠিক ঠাওরে আসে না। চোখটা এবার আর না দেখালে চলছে না। তিন চার মাস লকডাউনের পর আনলক হয়েছে। কিন্তু যাবে যাবে করেও এনার্জি পাননি। ডক্টর বসাককে ফোন করেছিলেন। তিনি হেসে  বলেন, "চোখের ব্যাপার, চেম্বারে আসতেই হবে। অনেক ইক্যুইপমেন্টস্ লাগে। সেগুলো নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।"

নিউটাউন এমনিতেই ফাঁকা ফাঁকা। তবে প্রচুর সবুজ আছে।নতুন গড়ে ওঠা উপনগরী। আদিত্য রায় যে ব্লকে থাকেন, সেটা অনেকটা ভিতরে। এদিকটায় এখনও তেমন ভাবে নির্মাণ শুরু হয় নি। গাছপালা জলাভূমি বেশি। তাই পাখি আসে নানা প্রজাতির। সকালে জেলেরা জাল কাঁধে মাছ ধরতে আসে জলাভূমিতে। আদিত্য রায় অনেক দিন নিচে গিয়ে ওদের কাছ থেকে ছোট মাছ কিনেছে। চারাপোনা, পুঁটি, বেলে, ন্যাদোস,মৌরলা। দাম কম অথচ একেবারে লাফাচ্ছে। এসব মাছ মার্কেটে খোঁজ করে পান না। পেলেও দাম বেশি, এত টাটকাও না। বরফ দেওয়া। কলকাতায় চলে আসার আগে ছোটবেলা কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মজিলপুর। বড় চকবন্দি দোতলা বাড়ি। মাঝখানে অনেকটা উঠোন। এক পাশে ঠাকুরদালান। দুর্গাপূজা হত প্রতি বছর ধূমধাম করে। গ্রামের কত লোক ভোগ খেতে আসত। একান্নবর্তী পরিবার । তিন চারটে পুকুর ছিল। ফলের বাগান। বাবা সনাতন কাকাকে ডেকে জাল ফেলিয়ে মাছ ধরাত। ছোট বড় অনেক মাছ। কী অপূর্ব স্বাদ সে মাছের। কী অপূর্ব স্মৃতিঘন ছিল শৈশব। বাবার ওকালতিতে পসার বাড়ল। গ্রাম থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করে কোর্টের কাজে অসুবিধা হচ্ছিল। তার উপর তিনি চাইছিলেন ছেলেমেয়েরা কলকাতার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ুক। তাই শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামের পাট চুকিয়ে শহরে চলে আসবেন। কোন এক মক্কেলের দৌলতে একটা পুরনো দোতলা বাড়ি পেলেন সস্তায়। গড়িয়াহাটের কাছে ফার্ন রোডে। এখান থেকে বাবার কোর্ট আলীপুর খুব কাছে। সঞ্চিত টাকা আর পৈতৃক সম্পত্তির ভাগের কিছু জমি বিক্রি করে বাবা বিমলভূষণ ফার্ন রোডের বাড়িটা কিনে নিলেন। তারপর কিছু মেরামতি ও রঙ করার পর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে তারা চলে এসেছিল নতুন বাড়িতে। দুই কাকা আর খুড়তুতো ভাইবোনেরা থেকে গেল। দেশে যাওয়া মানে বছরে ওই একবার, পারিবারিক দুর্গাপুজোতে। বাবার মৃত্যুর পর এখন অবশ্য সে পুজো বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের বাড়িতে অনেক দিন আর যান না আদিত্য।


নিউটাউনের ফ্ল্যাটে চলে আসার পর আদিত্য আবার সেই পুকুরের মাছের স্বাদ ফিরে পেয়েছেন। ফিরে পেয়েছেন তাঁর হারানো শৈশব। সবুজ সকাল। আর পাখির ডাক। মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয়ে যায় । যখন ভাবেন কয়েক বছরের মধ্যে এই সবুজ লোপাট হবে। পাখিরা আর এসে বসবে না, ডাকবে না। ব্যালকনিতে বসে আদিত্যর চোখ আর সুদূর খুঁজবে না। বড় বড় হাইরাইজ উঠে তাঁর দৃষ্টিসীমাকে আড়াল করবে। তখন কী নিয়ে বাঁচবেন? জীবনের যিনি সঙ্গী ছিলেন অনেক আগেই আচমকা বিদায় নিয়েছেন। যাবার আগে জোর করে এই ফ্ল্যাট বুক করিয়ে ছিলেন। সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বলে না, একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে। ফ্ল্যাটের কনট্র্যাক্ট সই হবার পর একদিন অফিস থেকে ফিরতেই সেই মারাত্মক কথাটা  শুনল। চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে সুধা বলেছিল, "তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।"

বিয়ের আগের নাম ছিল সুবর্ণা। খুব সুন্দর রবীন্দ্র সংগীত গাইত । বিয়ের পর আদিত্য বলেছিল, "এত ভালো গান গাও। তোমাকে সুধা নামে ডাকব।" সুবর্ণা হেসে ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিল। আজ সুধার গলা শুনে চমকে ওঠে আদিত্য। কেমন বিষণ্ণ আর আর্ত শোনাল।

"কী কথা, বল।"

"আমাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? বুকটা ভার ভার ঠেকে। ঘুমের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যথা। বাঁ বুকটায় শক্ত ঢিলের মত কী একটা যেন। এতদিন বলিনি। আজ আবার নিপল থেকে রস বের হচ্ছে। তাই বলছিলাম…."

সুধা কাঁদছে। আদিত্য স্ত্রীকে হাত ধরে পাশে সোফায় বসান। সান্ত্বনা দেন।

"ঠিক আছে নিয়ে যাব। কিন্তু অমন করে বলছ কেন? কিচ্ছু ভেবো না । সব ঠিক হয়ে যাবে, সুধা।"

এরপর প্রথমে গাইনি, তারপর একজন অনকোলজিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। তিন চার ধাপ পরীক্ষার শেষে ব্রেস্ট ক্যানসার পজিটিভ। লেডি ডাক্তার  আটটা কেমোর পর অপারেশন করবেন বলে দিলেন। সুধা শুধু মেয়ে অহনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে আর কাঁদে। বাড়ির পরিবেশ তখন বিষণ্ণ শূন্যতায় ভরা। চারটে কেমোর পর সুধাকে আর চেনাই যাচ্ছিল না। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। মাথায় চুল নেই। সারারাত তীক্ষ্ণ ব্যথায় ঘুম হয় না। পাঁচ নম্বর কেমো নিতে গিয়েই হার্ট অ্যাটাক। সঙ্গে সঙ্গে এডমিট। প্রথমে আইসিইউ। তারপর ভেন্টিলেশনে। দু'দিনের মধ্যেই সব শেষ। চোখে অন্ধকার আর অন্ধকার। আদিত্য একমাত্র মেয়েকে নিয়ে অথৈ বিষাদ সাগরে। এমন আচম্বিতে অকস্মাৎ ঘটে গেল সব ঘটনা, যেন ভোজবাজি। মেয়ে অহনা তখন সবে তেরোয়। 

গ 

'সখি, বহে গেল বেলা, শুধু হাসি খেলা

        একি আর ভালো লাগে…''

মৃতা স্ত্রীর সিডি চালিয়ে শুনছিলেন আদিত্য। মনে হচ্ছিল সুধা পাশে ডিভানে বসে গাইছে। তাঁর গায়ের গন্ধ, চুলের গন্ধ তিনি যেন পাচ্ছেন। চোখ বন্ধ করে একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। স্ত্রী চলে যাবার পর অনেক দিন কেটে গেছে। মেয়ে অহনা এখন কলেজে পড়ে। আদিত্য চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। মেয়ে কলেজ চলে গেলে শূন্য বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করে। সুধার ছবিটার দিকে তাকাতে পারেন না। ওর গানের ঘর তালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। কোন কাজে স্পৃহা পান না। একটা অবসাদ মোটা চাদরের মত গায়ে সব সময়  লেপটে থাকে। আদিত্য দম নিতে চায়, পারে না। বন্ধু সত্যসুন্দর একদিন বাড়িতে এসেছিল। তার অবস্থা দেখে বলল, "আদিত্য, অবসাদ বড় খারাপ জিনিস। একবার চেপে ধরলে অন্ধকার গহ্বরে টেনে নিয়ে যাবে। ওকে পাত্তা দিলে চলবে না। বি প্র্যাকটিক্যাল। তুই বরং আমাদের পার্কের ক্লাবে আয়। দেখবি, হাসিতে মজাতে গল্পগুজবে সব মন খারাপ উধাও হয়ে গেছে। বিপর্যয়ের পর পৃথিবী আবার নতুন করে সাজে।''

অহনা কলেজের পর নাচের ক্লাসে যায়। তারপর এক প্রফেসরের কাছে কোচিং সেরে বাড়ি ফিরতে রাত হয়। আদিত্য ভাবে আজ সে পার্কের ক্লাবে যাবে। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে যতীন দাস পার্ক। হাঁটতে হাঁটতে বিকেলে গিয়ে হাজির হল। ওদের দলটা বেশ ভারী। আদিত্যর চেনা বন্ধুরা আছে আবার অচেনা অনেক। সবাই অবসর নিয়েছে। গোল হয়ে বসে গল্প, গান, কবিতাপাঠ সব চলছে। ক্লাবের নামটা সুন্দর। "বিকেলের জলসা"। তাকে দেখে বন্ধু  সত্যসুন্দর এগিয়ে এল। ও ক্লাবের সেক্রেটারি। "এসো, এসো, তোমাকে সুস্বাগতম্।"

তারপর সবাইয়ের দিকে তাকিয়ে পরিচয় করিয়ে দিল, "এ আদিত্য। আদিত্য রায়। ফার্ন রোডে থাকে। আমাদের বৈকালিক ক্লাবের নতুন সদস্য।"

সবাই গোল হয়ে পার্কের সবুজ ঘাসে বসেছে। আদিত্যও বসল। খোলা আকাশের নিচে বিকেলের শান্ত বাতাস। চারপাশে সবুজ। দূরে দূরে বাচ্চারা খেলছে। তার মনে পড়ল ছুটির দিনে সুধা প্রায়ই বলত, "যাওনা, মেয়েকে একটু পার্ক থেকে ঘুরিয়ে আনো।" ছোট অহনা ফ্রক পরে লাফিয়ে লাফিয়ে পার্কের নরম ঘাসের উপর খেলত। বাবা আদিত্য দু'চোখ ভরে দেখত। কতদিন হয়ে গেল। সুধা আজ আর নেই।

"এবার আপনাদের সামনে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে শোনাবেন, আদিত্য রায়।" সত্যসুন্দরের গলা শুনে চমক ভাঙে। 

"না, না। আমি কেন? তাছাড়া কবিতা তো সঙ্গে নেই। আমি মনেও রাখতে পারিনা যে।" কলেজ লাইফে এক সময় নিয়ম করে কবিতা লিখত আদিত্য। তখনকার কিছু নামকরা লিটলম্যাগ ও বাণিজ্যিক পত্রিকা বা দৈনিকের রবিবার সাপ্লিতে তা ছাপাও হয়েছিল। ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢোকার পর কাজের চাপে সব আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেছে।

"মনে নেই কোন কবিতা? তাছাড়া মোবাইলটা দেখ্ না, কিছু পেতে পারিস।" সত্যসুন্দর বলে।

প্রথম এসেছে। বন্ধুর অনুরোধ না রাখলে ও কি ভাববে। অন্যরাও। অগত্যা মোবাইলের ডকস্ ফাইল হাতড়ে একটা কবিতা বের করল। সুধা মারা যাবার পর লিখেছিল। সেটাই পড়তে শুরু করল :


এই আলো এই মায়া পৃথিবীর পর

জীবন টানে এক আশ্চর্য বাজিকর।

তার হাতে ছড়ি আছে ম্যাজিক উদয় 

তোমাকে ঘোরায় শুধু অবাক বিস্ময়।

যত সুখ হাতে ধর প্রত্যাশা অধিক

মায়া-জন্ম তার থেকে নয় অনধিক।

চেনা ছায়া চেনা রোদ সম্বন্ধ ব্যতীত

কবরের ঢাকা খোলে গল্পের অতীত।

যত গল্প যত কথা ইতিহাস বলে

সময় তাকে নিয়েই ধীরে ধীরে চলে…


অনেকদিন পর সে কবিতা পড়ল।  ভালো লাগলো খুব আজকের বিকেলটা ‌। বদ্ধ গুহার অন্ধকার থেকে আলোময় প্রকৃতির মাঝে এসে  নিজেকে সুস্থ সতেজ লাগছে। ক্রমে সন্ধ্যার বাতাস ভারি হল। এক কাপ কফি খেয়ে অনুষ্ঠান শেষ হতে বাড়ির পথ ধরল আদিত্য।


সুধা নেই। অথচ মেয়ে বড় হয়ে উঠছে। মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর ভাবল, এবার ওর বিয়ে দেওয়া দরকার। নেট সার্চ করে নানান ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট ঘেঁটে মেল করে যোগাযোগ করল কিছু পাত্রপক্ষেরস সঙ্গে। কিন্তু মন সায় দেয় না। আজকাল খবরের কাগজে বা নিউজ চ্যানেলে যা সব ঘটনা পড়ছে বা দেখছে, ভয় হয় মনে। কত ফন্দি নিয়ে যে লোক ঘোরে । কত বিয়ের পরিণতি শেষ পর্যন্ত মর্মান্তিক করুণ হয়!  শেষে এক বন্ধুর মাধ্যমে তারই পুরনো অফিস কলিগের ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক করল। অহনা আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, "বাবা, ভাবছি নেট দেব। পিএইচডি-টা করি।"

আদিত্য বলেছিল, "তা সে তো বিয়ের পরেও করতে পারবি। আসলে কী জানিস মা, আমার তো বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। কখন কী হয়ে যায়। তাই তোর বিয়েটা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছি।"

মেয়ে কী বুঝল, শেষে রাজি হল ছেলে দেখতে। বাবা-মেয়ে দু'জনেরই ছেলে পছন্দ হল। ওরা থাকে দুর্গাপুর। ছেলের অফিস কলকাতায়। অহনা ওর এক মাসির সাহায্য নিয়েই বিয়ের সব কেনাকাটা নিজেই সারল‌ । বাকি বন্দোবস্ত আদিত্য তার বন্ধু সত্যসুন্দরের সাহায্যে করল। বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল। কনে বিদায়ের সময় বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। ঠিক সুধা চলে যাবার সময় যেমন হয়েছিল। অহনাও তাকে জড়িয়ে খুব কাঁদছিল। "বাবা, তুমি তো একা হয়ে যাবে। কে দেখবে তোমাকে! বিয়েতে রাজি না হলে ভালো হত।"

আদিত্য মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলছিল, "একা কেন রে। সুখেন তো রোজ অফিস আসবে। কোন অসুবিধা হলে ওকে ফোন করব। কিছু দেবার থাকলে ওর হাতে গিয়ে দিয়ে আসব।"


সেই মেয়ে বিয়ের পর বছর ঘুরতে এসে বলল, "বাবা, তোমার জামাইয়ের পক্ষে দুর্গাপুর থেকে প্রতিদিন অফিস করা খুব টাফ হচ্ছে। আমি বলছিলাম কি…"

" হ্যাঁ, বল কী বলবি?"

"আমরা যদি কলকাতা এসে থাকি।"

"বেশ তো। কিন্তু তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির মত নিয়েছ?"

"হ্যাঁ বাবা, সুখেন কথা বলেছে। তবে শনিবার করে ও বাড়ি যাবে ।"

"তবে তোমরা নিউটাউনের ফ্ল্যাটে যাও। তোমার মা তো তোমাদের কথা ভেবেই ওই ফ্ল্যাট নিয়েছিল।"

"না বাবা, ওখানে গেলে ওর অফিসে যাতায়াতে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া আমার সব বন্ধুরা এদিকে থাকে। আমার নাচের স্কুল। ভাবছি এমফিলে ভর্তি হব। আমরা এই বাড়িতে থাকি?"

মেয়ের কথায় মান্যতা দিয়ে আদিত্য রায় রাজি হলেন। 

এরও এক বছর পর অহনার কোলে এলো ফুটফুটে টুবলু। ভালো নাম রৌনক। সপ্তাহ খানেক আর পার্কের ক্লাবে যাওয়া হল না। নার্সিং হোম আর বাড়ি করতে হল। নবজাতকের অনেক জিনিস তাকেই কিনে আনতে হল। রাতে স্বপ্নে সুধা এল। মিটিমিটি হাসছে। মুখে কোথাও রোগশোকের চিহ্ন নেই। "কিগো, ক্যামন মজা। দাদু হয়েছ, এটুকু করবে না।" মজা করতে করতে সুধা মিলিয়ে গেল। টুবলু বছরখানেক হতেই অহনার আবার বায়না ধরল। জন্মদিনে পায়েসের বাটি সামনে রেখে বলল, "আমাকে কিছু উপহার দেবে না, বাবা!"

"বল্,  কী চাই।"

"টুবলু বড় হচ্ছে। ওকে ভালো স্কুলে দিতে হবে। টাকার খুব দরকার।"

"হ্যঁ, টাকা তো লাগবেই। যখন সময় হবে আমিই দেব।"

"তুমি আর কত দেবে। এই তো বিয়ের এতবড় খরচ গেল। তার উপর নার্সিং হোমের বিল মেটালে। সুখেন বলছিল, আমার কিছু করা উচিত।"

"ভালো তো, চাকরির চেষ্টা কর।"

"না বাবা, চাকরি করলে টুবলুকে কে দেখবে। আমাকে বাড়িতে থেকে কিছু একটা করতে হবে।‌ যাতে আর্ন হয়। আবার আমার নিজের আইডেন্টিটি তৈরি হয়।"

 পরিষ্কার করে বল্, কী চাইছিস।"

অহনা একটু থামল । তারপর সময় নিয়ে বলল, "আমাদের নিচের দুটো ঘর নিয়ে আমি একটা নাচের স্কুল করতে চাইছি বাবা। তাতে আমার বাড়িতেও থাকা হবে আর উপার্জন।"

"কিন্তু নিচে তো আমি থাকি। উপরের ঘরদুটো তোদের ছেড়ে দিয়েছি।"

"সেটাই তো বলছি। যদি রাগ না করে, একটা কথা বলি। তুমি নিউটাউনের ফ্ল্যাটে চলে যাও। তাহলে আমি স্কুলটা করতে পারি। দেবে না, আমাকে এ উপহার!"

একটা প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিল মেয়ে। মা চলে যাবার পর কত মায়া আর যত্নে তাকে বড় করেছে। উপহার তো দিতেই হবে। কিন্তু মন ভরে গেল অভিমানে। চোখ ঝাপসা। বুকের গভীরে কোথাও শিকড় ছিঁড়ছে। ছোঁয়ানো জলের শব্দ। হয়তো বেদনার। সঙ্গীহীন নিঃসঙ্গ আদিত্য আরো নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। আস্তে উচ্চারণ করল, "বেশ, তাই-ই হবে।"


সুধার গাওয়া একটা গান মেয়েকে দিয়ে সিডি  থেকে ল্যাপটপে নিয়ে ইউএসবি থ্রু মোবাইলের রিংটোন করে নিয়েছে আদিত্য। কেউ ফোন করলে বাজে। তখন সুধার কথা মনে পড়ে। বিষণ্ণতা কিছুটা কমে। তবু যখন ফার্ন রোডের বাড়িতে ছিল, মনে হত কলকাতা। বন্ধুদের মাঝে আছেন। নিজেদের বাড়ি আর সুধার স্মৃতি মেখে আছেন।  কিন্তু এখন মনে হয় যেন কলকাতার বাইরের আর এক কলকাতা। একে ঠিক চেনেন না। ঝাপসা জীবনানন্দের সেই দূরতর দ্বীপের মত।

বেলা বেড়ে গেছে। রোদে তেজ। আদিত্য ব্যালকনি থেকে ঘরে এলেন। মেয়ের সংসারে উটকো ঝামেলা হবেন না বলে একরকম অভিমান নিয়েই সরে এসেছিলেন। সুধার স্মৃতিকে পিছনে ফেলে। একাই থাকেন। শুধু লক্ষ্মী নামে এক বিধবা মাঝবয়সী একটু বেলার দিকে এসে কাজ ও রান্না করে দিয়ে যায়‌। খুব সকালে নিচে নেমে একটু হাঁটেন। মাঝেমধ্যে মার্কেটে যান। কিন্তু এই করোনা আর লকডাউন এসে সব ওলোটপালট করে দিল। মানুষ সব কেমন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল। নিজের মধ্যে বড় একা। যেমন আদিত্য। চারপাশে এত আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। চ্যানেলে, সংবাদপত্র খুললে, বন্ধুদের ফোনে প্রতিনিয়ত আত্মহননের খবর আসছে। মাঝরাতে কখনও হঠাৎ ঘুম ভেঙে আদিত্য চেয়ে থাকে সিলিং ফ্যানের দিকে। অনিশ্চিত অর্থহীন মনে হয় এ জীবন। এই বেঁচে থাকা। যেমন এখন হচ্ছে। আবছা অবসাদ আর অনুচ্চারিত বিষণ্ণতা নিয়ে। মাথাটা অল্প ঘুরছে। টাল সামলে সোফাতে  বসলেন। সুগার না প্রেসার কোনটা যে বাড়ল। টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে এক ঢোক জল খেলেন আদিত্য।  একটু ধাতস্থ হলেন। এমন সময়...

"সখি, বহে গেল বেলা, শুধু মিছে খেলা…"

সোফাতে রাখা ফোনটার রিংটোন বাজছে সুধার গলায়।‌ তাড়াতাড়ি ধরলেন। 

"হ্যালো, দাদুন, আমি টুবলু বলছি।"

"হ্যাঁ, বল দাদু। তোমার গলা তো আমি চিনি।"

"তুমি কেমন আছো?"

"আমি ভালো। তোমরা কেমন?"

"আমি ফাইন। মম, বাপি সব্বাই ভালো। সব্বাই ফাইন। তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।''

"তাই নাকি ! তা শুনি সু-সংবাদটি কী।"

"আমি তোমার নিউটাউনের ডিপিএস স্কুলে চান্স পেয়েছি। ওখানেই ভর্তি হব। লকডাউন পুরো উঠে গেলে  যখন স্কুল শুরু হবে নতুন করে, আমি আর মা তোমার ওখানে তোমার সঙ্গে থাকব। ওখান থেকে স্কুল কাছে। বাপি এখানে থাকবে। আমরা শুক্রবার করে চলে আসব। কী মজা ।"

আদিত্যর চোখ জলে ভিজে গেল। তিনি  অভিমান ভুলে গেলেন। হারানো শৈশব ফিরে এল । যাবতীয় অবসাদ বেপাত্তা।  সিলিং ফ্যানটার দিকে একবার তাকিয়ে ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালেন। ঋজু মনে অনেকটা  জোর পেলেন। একটা ভাঙা সাঁকো আবার জুড়ে গেছে। টুবলুর ফোনটা সেই ম্যাজিক উদয়। কানে বাজছে… "সখি বহে গেল বেলা…''

rabindranathbasu616@gmail.com
কলকাতা



1 comment:

  1. আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই "বইসই"। সুন্দর সংখ্যা হয়েছে।

    ReplyDelete