1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, August 1, 2020

একটি রাতের ঘটনা

                                                                                                ...সুপর্ণা হালদার


             চারিদিক সব অন্ধকার । একটু আগেই প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেছে। কারেন্টটাও সেই কখন চলে গেছে । গ্রামবাংলায় এই লোডশেডিং একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার ।  ঝড় বৃষ্টি থামার পরেও কারেন্ট আসার নামগন্ধ নেই। কাজেই বিমর্ষ হয়ে বসে রইলাম বারান্দায়। সবে আটটা বাজছে তাও যেন মনে হচ্ছে নিশুতি রাত । আকাশে চাঁদ তারা কেউই নেই যে ওদের সাথে গল্প করব। কিছুক্ষণ আগে মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে'পড়ে শেষ করেছি। সত্যি বলতে ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ার মধ্যেও একটা বিশেষ রকমের অনুভূতি আছে। মাথার মধ্যে মির্চা আর অমৃতার আখ্যান এখনও ঘুরঘুর করছে। সময় কাটছে না। তাই ঠিক করলাম বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখি। ল্যাম্প জ্বালিয়ে লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি এমনসময় হঠাৎ দরজায় টোকা পরল....

এত অন্ধকার । এখন কে এল কী জানি...নানা সাতপাঁচ ভেবে দরজাটা খুলতে গেলাম। খুলে দেখি আমাদের বৃদ্ধ পরিচারক শম্ভুদাদু দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তার পাশেই কে যেন একটা অস্পষ্ট অবয়ব মাটিতে মূর্ছিত হয়ে আছে।শম্ভুদাদু আমাকে দেখেই একটা বড়ো সেলাম ঠুকে বলতে শুরু করল..
-"খুকী, এই ছোকরা দেখলাম আমাদের বাড়ির পিছনের ওই আমগাছটার গোড়ায় পরে আছে। প্রথমে দেখে তো থমকে গেলাম ভাবলাম বোধহয় মরেটরে গেছে । কাছে যেতেই দেখি বেচারা তখনও মরেনি । দিব্যি শ্বাস নিচ্ছে। গায়ে হাত দিতেই দেখি ধুম জ্বর। বেচারা বোধহয় জ্বরের ঘোরেই অজ্ঞান হয়ে পরে ছিল। আমি তারপর কয়েকটা লোক ডেকে ওকে তুলে  তোমার কাছে নিয়ে এলাম। একেতেই ছোকরার জ্বর তার ওপর এই ঝড়বৃষ্টির রাত। ওকে ওখানে ফেলে রাখতে মন চাইল না। তোমার কাছে কী কিছু ওষুধপাতি আছে নাকি? থাকলে দাও তো ছোকরাকে খাইয়ে দিই। "
আমি কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।এতরাতে অচেনা একটা মানুষ এখানে কেন আসবে? ভিতরে বেশ ভয়ভয়ও করচ্ছিল। ভয় পাওয়াটাও অমূলক নয়। চোর ডাকাতের তো অভাব নেই। শম্ভুদাদু সেকেলে লোক ওনার আর এখনকার কাল সম্পর্কে কতটাই বা আইডিয়া থাকবে। আবার মনে হল তবে মানুষটা যেই হোক না কেন সে তো অসুস্থ। তাছাড়া সত্যিই তো এইভাবে একটা সন্দেহের বশে কোনো অসুস্থ মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করাটাও আর যায় হোক মানবিক বলে হয় না। যাক গে ,একটা রাতেরই তো ব্যাপার।
 তারপর ওষুধের বাক্স থেকে একটা প্যারাসিটামল বের করে শম্ভুদাদুর হাতে দিয়ে বললাম- "এটা খাইয়ে দিও। আর তোমার ঘরেই রেখো ওকে। জলপট্টি দিও মাথায়। এখন তো কোনো ডাক্তার পাওয়া যাবে না। যদি রাত্রে তেমন দরকার লাগে তো আমায় ডেকো।"
সে রাতের মতো আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার ভূত মাথা থেকে চলে গেল। শম্ভুদাদু ছেলেটাকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমিও দরজা বন্ধ করে ল্যাম্প নিভিয়ে ঘুমোতে চলে গেলাম।তবে ঘুম কী আর অত সহজে আসতে চায়। তাকে টেনে হেঁচড়ে আনতে হয়। অনেকক্ষণ জেগে জেগে ঘুমিয়ে ১২টা নাগাদ চোখটা বুঝলাম।
তখন হয়তো রাত ২টো মতো বাজবে। দরজায় আবার টোকা পরল। ধুড়মুড় করে উঠে বসলাম।রীতিমত ভয়ও পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখি শম্ভুদাদু।
-"খুকী ছোকরার তো জ্বর কমার কোনো লক্ষণই দেখছি না । উল্টে তো বেরেই চলেছে । কার ছেলে জানা নেই শেষে কিনা এখানে এসে অঘোরে প্রাণ দেবে? বড্ড ভয় করছে।"
 আমারও যে ভয় লাগছে না সেটা নয়। সত্যি তো যিনি অসুস্থ তিনি তো এখন আমাদের আশ্রিত। অন্তত আজকের রাতটার জন্য হলেও আমাদের তো একটা ওনার প্রতি দায়িত্ব আছে এটা তো অস্বীকার করা চলে না। বললাম - "চলোতো আমি দেখি ছেলেটাকে। আর লক্ষণকাকুকে ফোন করছি দেখি উনি কী বলেন। "
তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে শম্ভু দাদুর ঘরে চললাম। দেখি ছেলেটি খাটের এককোণে অস্পষ্ট অবয়বের মতো পরে রয়েছে। দেখে খুব মায়া হল। ঘরের ল্যাম্পের আলোটা একটু বাড়িয়ে ছেলেটির পাশে গিয়ে বসলাম।এই চব্বিশ কী পঁচিশ বছর মতো বয়স হবে।ভাবলাম একবার কপালে হাত দিয়ে দেখি। একটু ইতস্তত হল বৈকি,তা সত্ত্বেও দিলাম।
 কপালে হাত দিতেই আশ্চর্যরকম একটা অনুভূতি হল। গা দিয়ে একেবারে আগুন ছুটছে। জ্বরের ঘোরে কোনো জ্ঞানই নেই। কুঁকড়ে পরে রয়েছে চৌকিটির ওপর। ভিতরে ভিতরে পাপবোধ কাজ করতে লাগল। ইসস!! কী না কী ভাবছিলাম। এইরকম একটা অসুস্থ মানুষকে নিয়ে আমার ওইসব ভাবা মোটেই উচিত হয়নি। তাড়াতাড়ি শম্ভুদাদুর কাছে থেকে জলপট্টির কাপড়টি নিয়ে মাথায় দেওয়ার জন্য প্রবৃত্ত হলাম।শম্ভুদাদু ছেলেটাকে ধরে সোজা করে চৌকিতে শোয়ালো । আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলাম।
এবার ছেলেটির মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একি! এতো অরণি!!! ও এখানে!!! অরণিকে দেখে যেন পায়ের তলার মাটি সরে গেল। ভিতরে ভিতরে যেন একটা দমবন্ধ কান্না প্রবল শক্তি নিয়ে বাইরে আসতে চাইল। অস্ফুট স্বরে একবার আনমনেই উচ্চরণ করে ফেললাম-অরণি!!

 আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ওই আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিল। কলকাতায় থাকাকালীন ওকেই প্রথম আপন বলে মনে হয়েছিল। একসাথে কত বার ভিক্টেরিয়া, ঢাকুরিয়া,প্রিন্সেপ ঘাটে ঘুরতে গেছি। কতবার দুজন দুজনকে নিজ নিজ বাহুডোরে আবদ্ধ করেছি। কতবার হাতে হাত রেখে একে ওপরের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা কেবল আমি ও আর ঈশ্বরই জানি। মনে মনে স্বপ্নও দেখতাম দুজন দুজনকে বিয়ে করে একসাথে থাকার। একটা ছোট্ট পরিবার হবে আমাদের। সবাই মিলে কত আনন্দে থাকব। কিন্তু আর সেসব কিছুই হল নাহ্। ওই যে মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। আমাদেরও তাইই হল। একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমাদেরও এই সাজন্ত সম্পর্ক ভেঙে যায়। হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় ও। তারপর থেকে ওর আর খোঁজ পাইনি। অনেক খোঁজ করেছিলাম। পরে বন্ধুদের কাছে শুনেছি ও নাকি আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না। ও অন্য একটি মেয়ের সাথে জীবন শুরু করেছে। সেই খবরটি শুনেই আমি গ্রামে ফিরে এসেছিলাম। আর কলকাতামুখো হইনি।হয়তো চেয়েছিলাম একা থাকাটাকে মেনে নিতে। রাগও হয়েছিল ওর ওপর।কিন্তু আজ ওকে এইভাবে দেখতে পাবো ভাবতে পারিনি। ভাবতেই ভাবতেই হঠাৎ চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগল । আজ বুঝলাম হয়তো ওর ওপর আমার রাগ ছিল না। ছিল একটা জমাট বাঁধা অভিমান।
 কোনোরকমে সামাল দিয়ে লক্ষণকাকুর পরামর্শ অনুসারে সারারাত জলপট্টি দিয়ে সে রাতের মতো তাকে সুস্থ করে তুললাম।
তখন সকাল ৬ বাজে। একবার গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরটা আর নেই।অরণি তখনও ঘুমোচ্ছে। আমি সেখান থেকে উঠে আস্তে আস্তে উপরে চলে গেলাম। শম্ভুদাদুকে বলে এলাম ও ঘুম থেকে উঠলে কিছু খাইয়ে আর কিছু খাবার ও ওষুধ সাথে দিয়ে ট্রেনে তুলিয়ে দিয়ে আসতে।
এই জন্মে হয়তো আমার সাথে এটাই ওর শেষ সাক্ষাৎ। হয়তো আর কোনোদিনই দেখব না দুজন দুজনকে।জানতেও পারব না ঠিক কী কারণে ও এখানে এসেছিল। জানতেও অবশ্য চাই না। আজ ওর আর আমার মাঝে লক্ষযোজন দূরত্ব।এই দূরত্ব আর কোনোদিনই হয়তো মিটবে না। সব দূরত্ব কী আর ইচ্ছে করলেও মেটানো যায়!!
ভাবতে আজও অবাক লাগে সত্যি কিছু কিছু রাত এমনও হয়....
(সমাপ্ত)
suparnahalder208@gmail.com
নদীয়া

No comments:

Post a Comment