1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

স্বপ্ন পূরণ

ছবি : ইন্টারনেট 
স্বপ্ন পূরণ 

জয়দেব বেরা

     বৃন্দাবনপুর নামক একটি গ্রামে রমা ও প্রফুল্ল নামে এক দম্পতি বসবাস করত। তাদের আকাশ নামে বছর দশেক বয়সী এক ছেলেও ছিল। রমার স্বামী প্রফুল্ল ছিল পেশায় একজন শিক্ষক। আর রমা ছিল গৃহিণী। তাদের দুজনেরই অনেক স্বপ্ন ছিল এই আকাশকে নিয়ে। ধীরে ধীরে আকাশও বড় হতে লাগলো। আকাশের মায়ের স্বপ্ন ছিল আকাশকে বড় ডাক্তার করে তোলা। এই স্বপ্ন পূরণের জন্য রমা তার নিজের সমস্ত শখ- আল্লাদ কে বিসর্জন দিয়ে সমস্ত টাকা ব্যাংকে জমাতে থাকলো। এইভাবে আকাশকে নিয়ে রমা ও প্রফুল্লের স্বপ্নের সংসার খুব সুখেই ভরে থাকত। কিন্তু একদিন হঠাৎই রমার জীবনে দুঃখের অভিশাপ নেমে আসে। তার স্বামী প্রফুল্ল একদিন গাড়ির দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। তখন থেকেই শুরু হয় রমার জীবনে দুঃখের দিনগুলি। ভাগ্যের এই পরিহাসকে মেনে নিয়ে রমা তার ছেলে আকাশের মুখ চেয়ে বেঁচে থাকল। আর এদিকে নেমে আসল অভাবের অন্ধকার। স্বামীর পেনশনের টাকা দিয়ে কোনোরকমই তাদের দিন চলে যায়। কিন্তু রমা ভাবতে লাগলো এই টাকায় সে কী করে ছেলেকে ডাক্তার করে তুলবে। সে চিন্তায় যেন জরাজীর্ণ হয়ে যায়। তাই রমা ঠিক করল যে সেও কোনো কাজ করবে ,নাহলে আকাশকে মানুষ করতে পারবে না। তাই সে একটি সেলাইয়ের দোকানে কাজ করতে থাকলো। রমা কষ্টে থাকলেও সে  আকাশকে কখনো এই কষ্টের ভাগীদার হতে দেয়নি। আকাশের সমস্ত শখ-আল্লাদ সে পূরণ করত। 

      এইভাবে রমার সংসার কোনোরকমে চলে যায়। এইদিকে আকাশও বড় হতে থাকে। রমাও দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করেই চলেছে। আকাশকে মানুষ করার জন্য রমা তার সবটুকু শক্তি দিয়েই অর্থ উপার্জন করতে থাকলো। ছেলে এইবার উচ্চমাধ্যমিকও পাশ করেছে, ভালো রেজাল্টও হয়েছে। এইবার রমার স্বপ্নপূরণের দিন প্রায় চলে এসেছে। রমা তার এতদিনের জমানো সমস্ত অর্থ দিয়ে ছেলেকে কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে পাঠালো। আর এদিকে সে হাড়ভাঙা কঠোর পরিশ্রম করতে থাকলো। রমারও ধীরে ধীরে বয়স হতে থাকল। আগের মতো আর এতো কঠোর পরিশ্রম করতে পারে না। তবুও রমা তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে রাতদিন পরিশ্রম করেই চলেছে। এইদিকে ছেলেরও ডাক্তারি পড়া চলতেই থাকে। এইভাবেই দিনগুলো কোনোরকমেই চলে যায়।

         তারপর বছর তিনেক পর আকাশ ডাক্তারি পড়ে গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে আসে। ছেলেকে দেখে রমার যে খুশির বহিঃপ্রকাশ তা যেন পৃথিবীর কোনো জিনিসের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ছেলেকে কাছে পেয়ে মায়ের দিনগুলি খুবই খুশিতে কাটতে থাকে। ছেলে কিছুদিন পর একটি ভালো হাসপাতালে চাকুরিও পায়। তাই ছেলের বলাতে রমা আর কোনো কাজ করে না। সেলাইয়ের দোকানের কাজটা সে ছেড়ে দিলো। এইভাবে রমার দিনগুলি খুব সুখেই চলে যায়। কিন্তু রমার জীবনে এই সুখ ছিল খুব স্বল্পস্থায়ী।

        একদিন আকাশ কলকাতা থেকে বিয়ে করে গ্রামে আসে। মা তো দেখেই অবাক! তবুও রমা কিছু না বলে হাসিমুখে ছেলে ও পুত্রবধূকে বরণ করে বাড়িতে তোলে। এরপর থেকেই আবার শুরু হয় রমার জীবনের দুঃখের দিনগুলি। পুত্রবধূ অকারণে রমাকে অপমান করতো। আকাশের কাছে মায়ের নামে মিথ্যে নালিশ জানাতো। একরেই দিনগুলি চলতে থাকল। আকাশের আবার ছেলে হলো। রমা তো নাতিকে পেয়ে খুব খুশি। 

       রমা নাতির নাম রাখলো শুভ। আকাশের স্ত্রী শুভকে তার ঠাকুমার কাছে বেশি আসতে দিতো না। আর বাড়ির সব কাজ রমাকে দিয়ে করাতো আকাশের স্ত্রী। তবুও রমা মুখ বুজে সবটাই সহ্য করত। আকাশও তার স্ত্রীকে কিছু বলতো না। আকাশের ছেলে শুভও ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। এবং আকাশ কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকতো আর শনিবার করে বাড়ি ফিরত। আর এদিকে শুভর মা আকাশ বাড়ি ফিরলেই রমার নামে নালিশ জানাতো। আকাশও তার স্ত্রীর কথা শুনে মাকে খুব বকাবকি করতো। এদিকে আকাশের ছেলে শুভ কিন্তু রমাকে খুব ভালোবাসতো। ঠাকুমা ছাড়া সে থাকতে পারতো না। আর এগুলি আকাশের স্ত্রী ডলি সহ্য করতে পারতো না। ডলি ছিল খুবই আধুনিক। ডলি রমাকে সবসময় অপমান করে যেত। এগুলি কিন্তু আকাশের ছেলে শুভ সব দেখতে পেত। কিন্তু শুভ ভয়ে কিছু বলতে পারত না।

      একদিন শনিবারে যখন আকাশ বাড়ি ফেরে তখন ডলি আকাশকে বলল যে, সে আর এই বাড়িতে থাকবে না। সে তার ছেলেকে নিয়ে শহরে চলে যাবে। এই নিয়ে কিছুক্ষন আকাশের সাথে ডলির কথা কাটাকাটি হতে থাকলো। সেখানে তাদের ছেলে শুভ ভয়ে চুপ করে সবকিছু দেখছিল ও শুনছিল। ডলি আকাশকে বলছিল যে, তোমার এই বৃদ্ধ মায়ের পাশে থাকলে আমাদের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের আর কোনো স্ট্যাটাস বলে কিছু থাকবে না। তাই  বলি, শোনো তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা সবাই কলকাতা চলে যাবো। ঐখানেই বাড়ি করে থাকবো। স্ত্রীর কথায় আকাশও নিরুপায় হয়ে তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখবে সিদ্ধান্ত নেয়। আকাশ যথারীতি তার মাকে জানায় যে তাকে এবার বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে থাকতে হবে। 

        রমা এইকথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে আকাশের কাছে গিয়ে হাতজোড় করে অনুরোধ করলো যে, সে এই বাড়ি, সংসার, নাতিকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু আকাশের মনে এতটুকুও দুঃখের ছোঁয়া আসেনি। তার মনে পড়েনি পুরোনো সেই দিনগুলির কথা। আকাশ তার মাকে জানিয়ে দিল যে, সে এই বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে যাবে। আর তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিয়ে আসবে। এই শুনে রমা তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সেই পুরোনো দিনগুলির কথা মনে করছে। আর সেই ছোট্ট আকাশের মুখটি। চোখ ভরা জল নিয়ে রমা তখন ভাবলো আমার আকাশ আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। এই দিনটি দেখার জন্য আমি আমার সব কিছু দিয়ে স্বপ্ন পূরণ করেছিলাম! এই বলে রমা সেখান থেকে চলে যায়। এদিকে শুভ ঠাকুমাকে ছেড়ে যাবে না বলে কান্না করতে থাকে। কিন্তু শুভর মা ডলি তাকে জোর করে নিয়ে চলে আসে। 

         এইভাবে আকাশ ডলির কথা শুনে বাড়ি বিক্রি করে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে। রমার জীবন যেন ক্রমশ দুঃখের অন্ধকারে ভরে যায়। আর এইদিকে তারা সবাই কলকাতাতে চলে আসে। আর রমার শেষ ঠিকানা হয়ে উঠে বৃদ্ধাশ্রম। এইভাবে চলে যায় পাঁচটা বছর। এদিকে শুভ অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। শুভও প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে তার ঠাকুমাকে, সে ঠাকুমার ভালোবাসাকে কখনোই ভুলতে পারেনি। তাই সে প্রতিদিন স্বপ্ন দেখতে থাকে যে, সে কবে তার ঠাকুমার কাছে যাবে, কবে সবাই একসাথে খুশিতে থাকবে। একদিন হঠাৎ শুভর মা শুভকে বলছে বাবা তুমি বড় হয়ে কী হবে? শুভ তখন বললো আমি বাবার মতো ডাক্তার হবো। ডলি তখন বললো বা:, খুব ভালো। তুমি ডাক্তার হলে আমরা সবাই খুবই আনন্দে থাকবো। শুভ তখন তার ঠাকুমার প্রতি অন্যায়ের দিনগুলির কথা মনে করে বললো -- আমি তো আমি তোমাদের আমার পাশে রাখবো না মা। ডলি আর আকাশ একথা শুনে অবাক! ডলি বললো কেন বাবা এমন কথা কেন বলছো? শুভ তখন বললো তোমাদের পাশে রাখলে আমার বউয়ের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হয়ে যাবে তো?

         তাই তোমাদের পাশে রাখবো না। তোমাদের যদি আমার ঠাকুমাকে পাশে রাখলে স্ট্যাটাস নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তোমাদের পাশে রাখলেও আমার আর আমার স্ত্রীর স্ট্যাটাস নষ্ট হয়ে যাবে। এই শুনে আকাশ ও ডলি হতাশ হয়ে বসে রইল। আর কান্না করতে করতে নিজেদের ভুল বুঝতে পারলো। আর তখনই আকাশ তার স্ত্রী ও পুত্রকে নিয়ে তার মায়ের কাছে গেল। আর রমার পা ধরে ডলি ও আকাশ ক্ষমা চাইলো ও নিজেদের ভুল স্বীকার করল। তারপর আকাশ সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়িটি আবার কিনে সেখানে ফিরে গেল। আর সবাই খুব সুখে বসবাস করতে থাকলো। এই ভাবে শুভরও স্বপ্ন পূরণ হল আর রমারও দুঃখের দিনগুলি দূর হয়ে গেলো।

joydevbera997@gmail.com
পূর্ব মেদিনীপুর

No comments:

Post a Comment