ছবি : ইন্টারনেট |
বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তরের- ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ
সাগ্নিক বন্দ্যোপাধ্যায়
সুকান্ত ভট্টাচার্য 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতায় লিখেছেন,
"আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়;
আমার বিনিদ্র রাত্রে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়।"
১৯৪৩ সাল! বাংলায় ১৩৫০ বঙ্গাব্দ! বাংলা দেখল এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের চিত্র। এর ঠিক ১৭৪ বছর আগে ইংরেজি ১৭৭০ এবং বাংলায় ১১৭৬ সালে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হয়েছিল। ১৯৪৩ সালের এই দুর্ভিক্ষ ইতিহাসে 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়েছিল বাংলার দুর্ভিক্ষ দিয়ে এবং শেষও হয় দুর্ভিক্ষ দিয়ে। 'কথামুখ' পত্রিকার সম্পাদক লিখেছিলেন, "তেরোশো পঞ্চাশ কেবল ইতিহাসের একটা সাল নয়, নিজেই একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস। সে ইতিহাস একটা দেশ শ্মশান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস, দোরে দোরে কান্না আর পথে পথে মৃত্যুর ইতিহাস, আমাদের অক্ষমতার ইতিহাস।" ১৩৫০ সালটি ছিল এক কথায় বাংলার ধ্বংসের সাল। পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদরা গবেষণা করেছেন।
বিভিন্ন কৃষি অর্থনীতিবিদরা তৎকালীন বাংলায় মোট কৃষকের ৪৮ শতাংশ বর্গাদার ও ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক বলে উল্লেখ করেছেন। এবার কেউ আমাকে প্রশ্ন করতেই পারেন দুর্ভিক্ষের সঙ্গে কৃষির কি সম্পর্ক? দুর্ভিক্ষের সাথে অর্থনীতির উৎপাদনের নিবিড় সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। ফলত, কৃষি ব্যবস্থা দুর্ভিক্ষের পশ্চাতে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। 'ভূমিরাজস্ব কমিশন' বাংলার কৃষকদের সঙ্গে অন্যান্য প্রদেশের তৎকালীন কৃষকদের অবস্থার একটি তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরেছিল। এই তুলনা করে 'ভূমিরাজস্ব কমিশন' বলেছিল যে, বাংলা তৎকালীন কৃষকদের অবস্থা ও অন্যান্য প্রদেশের কৃষকদের অবস্থার তুলনায় অনেক ভালো। কারণ, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশের কৃষকদের তুলনায় বাংলার কৃষকেরা কম পরিশ্রমে বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারতেন। কিন্তু এই মতের বিরোধিতা করেছে ১৯৪৪ সালের 'দুর্ভিক্ষ কমিশন'। 'দুর্ভিক্ষ কমিশনের' মত হল, দুর্ভিক্ষের পূর্ববর্তী সময়ে বাংলার অর্থনীতি যখন সুস্থিত ছিল তখনও বাংলার কৃষকদের অবস্থা শোচনীয় ছিল। তাছাড়া প্রচুর দরিদ্র কৃষকেরা পর্যাপ্ত খাদ্য পেতন না। চিকিৎসক বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন, বাঙালি কৃষকদের প্রধান খাদ্য যেহেতু ভাত তার পুষ্টিগুণ অনেক কম ছিল; ফলে বাংলার জনসংখ্যার মাত্র ২২ শতাংশ পুষ্টিকর আহার্য পেত, শতকরা ৩১ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগত।
কৃষি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কৃষির গতিহীনতার বিষয়টিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই গতিহীনতার পশ্চাতে বিশেষজ্ঞগণ বেশ কয়েকটি কারণের অবতারণা করেছেন। সেগুলি হল,
১) বাংলার মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলি গভীরতা হারিয়ে ক্রমশ বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়। ফলে বন্যা না হওয়ায়ে আশপাশের জমিগুলি পলিমাটির অভাবে অনুর্বর হয়ে পড়ে। আর নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়ায় ফসলের ক্ষতি হয়।
২) বাংলায় বর্গাপ্রথার প্রসার ঘটলে বর্গাদারের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। এই ব্যবস্থায় উৎপন্ন ফসলের ৫০ শতাংশ বর্গাদারদের মালিককে দিতে হতো। আর ৩৩ শতাংশ কৃষির ব্যয় বাবদ খরচ হতো ফলে বর্গাদারদের কাছে বাকি প্রায় কিছুই থাকতো না বলা চলে। এ দরুন বর্গাদাররা জমির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন।
৩) জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায় জমির উপর চাপ বাড়তে থাকে ফলে অনেক পতিত জমিকে কৃষি জমির আওতায় আনায় জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়।
৪) জল সেচের ভালো ব্যবস্থা, সার ও ভালো বীজের ব্যবহার না থাকায় জমির উর্বরতা নষ্ট হয়।
বাংলায় ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালে জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক হারে বেড়ে যায়। এই মূল্যবৃদ্ধির পশ্চাতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি। যুদ্ধ পরিস্থিতির দরুন আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দ্রব্য পাওয়া যায় না। তাছাড়া সরকার পূর্ব বাংলায় 'পোড়ামাটি নীতি' অনুসরণ করে সেখানকার পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে দেয় যাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শত্রু দেশ ভারত আক্রমণ করলে সহজে রাজধানীতে পৌঁছাতে না পারে। এই নীতির জন্য খাদ্যশস্যের স্থানান্তরণে সমস্যার সৃষ্টি হওয়ায় জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে।
১৯৪০ এর দশকে বাংলায় প্রতিবছর জনসংখ্যা প্রায় ১০ লক্ষ হারে বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমানভাবে ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ না বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। তাছাড়া এক শ্রেণীর মানুষের হাতে প্রচুর টাকা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। আর কিছু ব্যবসায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কালোবাজারি, মজুতদারি, ফটকা বাজি করতে থাকে।
বাংলার অসামরিক সরবরাহ সচিব পঞ্চাশের মন্বন্তরের বারটি কারণ দিয়েছিলেন। তা এপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন। সেগুলি হল,
১) ১৯৪২ সালে আউশ ধানের কম ফলন।
২) ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালে আমন ধানের কম ফলন।
৩) মেদিনীপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উৎপাদন কম হয়।
৪) কীটের উপদ্রবে ফসল নষ্ট হয়।
৫) সরকারের নৌকা নিয়ন্ত্রণ নীতি।
৬) সমুদ্রকুল থেকে লোক অপসারণের ফলে উৎপাদনের ক্ষতি।
৭) ব্রহ্মদেশ থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীদের ভিড়।
৮) যুদ্ধের প্রয়োজনীয় বিমান ঘাঁটি তৈরি হওয়ার জন্য চাষের ক্ষতি।
৯) ব্রহ্ম দেশ থেকে চাল আমদানি বন্ধ হওয়ায় ঘাটতি পূরণের অসুবিধা।
১০) শিল্প কেন্দ্রগুলিতে বিভিন্ন প্রদেশের মজুরের সংখ্যা বৃদ্ধি।
১১) অন্যান্য প্রদেশ থেকে খাদ্যশস্যের কম আমদানি।
এইসব কারণগুলিকে আধুনিককালের গবেষকগণ গৌণ কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।
আমেরিকার গবেষক পল. আর. গ্রিনো পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে গবেষণা করে জানিয়েছেন যে, ১৯৪৩ সালে খাদ্যশস্যের দুষ্প্রাপ্যতার জন্য বাংলায় দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়নি। তাছাড়া ওই বছর বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য জলপথে বাইরেও পাঠানো হয়নি। ব্রহ্মদেশ জাপান দ্বারা অধিকৃত হলে ওই দেশ থেকে শরণার্থী বাংলায় এলে, এতে বাড়তি খাদ্যের চাহিদা তৈরি হলেও খাদ্যের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে কোন ফারাক ছিল না। ফলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তাছাড়া বাংলার সামরিক কর্তৃপক্ষ জোরপূর্বক খাদ্যশস্য সংগ্রহ করেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ আমেরিকা বা ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে চাল ভোজীদের সংখ্যা ছিল খুব কম। তবে পূর্ব উপকূলের কিছু কিছু অঞ্চল থেকে ১৯৪২ সালের এপ্রিল মে মাসে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে অসামরিক অফিসারদের তত্ত্বাবধানে উৎকৃষ্ট খাদ্যশস্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যাতে উদ্বৃত্ত খাদ্য শত্রুদের হাতে না যায়।
বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের উপর যথেষ্ট গবেষণা করেছেন। তাঁর প্রবর্তিত তত্ত্ব "Failure of Exchange Entitlement" নামে খ্যাত। এই তত্ত্বে দুর্ভিক্ষকে কেবলমাত্র খাদ্যশস্য যোগানের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেননি। তাঁর মতে, নানান কারণে জনগণের কিছু গোষ্ঠীর খাদ্যশস্য সংগ্রহ বা ক্রয়ের ব্যাপারে কোন ক্ষমতা থাকে না বা ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সেই গোষ্ঠী দুর্ভিক্ষ জনিত পরিস্থিতির সরাসরি শিকার হয়। এর দরুন সমস্ত শ্রেণী এবং গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষের প্রভাব একরকম হয় না। এক একটি গোষ্ঠী একেক রকম ভাবে প্রভাবিত হয়।
পেথিক লরেন্স ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দুর্ভিক্ষ বিষয়ের বিতর্ক সভায় একটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেন। তিনি বলেন যে, "বাঁচিয়া থাকিবার জন্য যে খাদ্যশস্যের প্রয়োজন তাহাকে নিবার ক্ষমতা অসংখ্য লোকেরই নাই। অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ। ইহার জন্য আর কেহ নয় একমাত্র ভারত গভর্নমেন্টই দায়ী"। তিনি আরো বলছেন, "সমস্যাটা হইতেছে অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্যশস্যের অপ্রতুলতা। জনসাধারণের হাতে কি নিবার মত টাকা ছিলনা ইহা ঠিক। তাহা হইলে অবস্থাটা আজিকার মতো এমন শোচনীয় হইয়া উঠিতে পারিত না।"
বিশিষ্ট গবেষক মধুশ্রী মুখার্জি ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত জ্ঞাপন করেছেন। তাঁর মতে, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল পুরোপুরিভাবে মনুষ্য সৃষ্ট। ব্রিটিশ আধিকারিকরা লন্ডনের নির্দেশে বাংলার গ্রামাঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য বলপূর্বক সংগ্রহ করে যুদ্ধক্ষেত্রের সামরিক বাহিনীর জন্য প্রেরণ করেছিল। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল দুর্ভিক্ষ। এই দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত ভারতীয় নেতৃবর্গ এমনকি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে নিম্নতন আধিকারিকরাও জানিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের লন্ডনের কর্তৃপক্ষ এইসব গুজব না ছাড়ানোর নির্দেশ দেয়। তাছাড়া একটি কমিশন তৈরি করে কিন্তু সেই কমিশন সরকারের মতো রিপোর্ট দেয়। মধুশ্রী মুখার্জি, "Nanavati Papers" -এর উপর নির্ভর করে দুর্ভিক্ষের কারণ সম্পর্কে তাঁর মতের স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী তাঁর 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' গ্রন্থে দুর্ভিক্ষের কারণ প্রসঙ্গে তৎকালীন বাংলার প্রাদেশিক সরকারের দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি সরকারের কাছে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দাবি করেন। সেগুলি হল,
১) ইস্পাহানি কোম্পানিকে মোট যে টাকা দেওয়া হয়েছিল সেই টাকা দেওয়ার তারিখ এবং তার পরিমাণ জানতে চান।
২) গভর্মেন্ট ও ইস্পাহানির মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তাহা আসল নাকি নকল তা জানতে চান।
৩) বাংলা সরকারের পক্ষে বাংলার বাইরের যে স্থান থেকে যে মূল্যে ইস্পাহানি কোম্পানি খাদ্যশস্য ক্রয় করেছিল তার পূর্ণ বিবরণ তিনি চেয়েছিলেন।
উপরিউক্ত এই বিষয়গুলির কোন উত্তর তৎকালীন সরকার দিতে পারেনি। তাছাড়া সরকার ইস্পাহানি কোম্পানিকে সাড়ে চার কোটি টাকা দিয়েছিল। সেই টাকার কোন হিসাব রক্ষা করা হয়নি। ফলে খাদ্যশস্য কেনা নিয়ে সরকার এবং কোম্পানির মধ্যে যে দুর্নীতি হয়েছিল তার ফলে দুর্ভিক্ষের পথ প্রশস্ত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তখন খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী ছিলেন সুরাবর্দি।
সুরাবর্দি ১৯৪৩ এ ১৫ ই সেপ্টেম্বর আইনসভায় দুর্ভিক্ষের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি প্রাকৃতিক কারণ এবং সামরিক কারণ উভয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। তার উল্লিখিত কারণগুলির সাথে পূর্বে উল্লেখিত বাংলার অসামরিক সরবরাহ সচিবের বারোটি কারণের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ভারতের খরা ও দুর্ভিক্ষের বিষয়টির কারণ অনুসন্ধানের জন্য গান্ধীনগর আইআইটির অধ্যাপক বিমল মিশ্র মহাশয় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করেছেন এবং তার গবেষণালব্ধ ফল 'জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস' -এ প্রকাশিত হয়েছে। বিমল মিশ্রের নেতৃত্বাধীন গবেষক দলটি আবহাওয়া স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং মাটির আর্দ্রতা মাপতে একটি মডেল তৈরি করেন। সেই মডেলের দ্বারা ১৮৭০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারতের কৃষিজাত খরার বিশ্লেষণ করেছেন। এই গবেষণা পদ্ধতিটিকে অধ্যাপক বিমল মিশ্র "আংশিক ইতিহাস, আংশিক বিজ্ঞান" বলে অভিহিত করেছেন।
অধ্যাপক বিমল মিশ্রের এই গবেষণায় ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৫ সালের এই কাল খন্ডকে "প্রকোপ, এলাকা এবং মেয়াদের ভিত্তিতে খরা কবলিত সময়" বলে উল্লেখ করেছেন। অধ্যাপক মিশ্র আরো বলছেন, "আমরা দেখি, ১৯৪১-এর অগাস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে, অর্থাৎ মন্বন্তরের আগে, খরার প্রকোপ সবচেয়ে বিস্তৃত ছিল। কাজেই এটি সম্ভবত একমাত্র দুর্ভিক্ষ যার সঙ্গে মাটিতে আর্দ্রতার অভাব বা কৃষি উৎপাদনের ব্যর্থতার কোনো যোগ নেই।” পঞ্চাশে মন্বন্তরের কারণ প্রসঙ্গে তিনি ঐতিহাসিকদের মতনই মন্তব্য করেছেন, "আমরা যা পেয়েছি, তাতে এটাই মনে হয় যে বাংলায় দুর্ভিক্ষের কারণ অনেকটাই এশিয়ার ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, যার জেরে দেখা দেয় ম্যালেরিয়া, অনাহার, এবং অপুষ্টি। ১৯৪৩-এর গোড়ার দিকে সামরিক এবং রাজনৈতিক ঘটনাবলীর কুপ্রভাব বেশ ভালভাবেই বোঝা যাচ্ছিল বাংলার অর্থনীতিতে, যার ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হয়েছিল বর্মা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কারণে। এছাড়াও, যুদ্ধকালীন শস্য আমদানির ওপর নানারকম বিধিনিষেধ জারি করেছিল ব্রিটিশ সরকার, যা দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছিল।” সাম্প্রতিককালের এই গবেষণাটি পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটি অন্য দিক উন্মোচন করেছে।
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বাংলার পঞ্চাশের মন্বন্তরকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা, ১) ১৯৪২ এর শুরু থেকে মার্চ ১৯৪৩।
২) মার্চ ১৯৪৩ থেকে নভেম্বর ১৯৪৩।
৩) নভেম্বর ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৪৪ সালের শেষ অবধি।
প্রথম পর্ব থেকে শেষ পর্ব পর্যন্ত দুর্ভিক্ষের পথ প্রশস্তের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে ১৯৪৪ সালের শেষ অবধি মৃত্যুহার বৃদ্ধি হয়।
ব্রিটিশ সরকার দুর্ভিক্ষের হাত থেকে কলকাতাকে বাঁচানোর জন্য জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য কিনে কলকাতায় পাঠায়। ফলে গ্রাম বাংলার নিরন্ন মানুষেরা দলে দলে কলকাতায় এসে ভিড় করতে থাকে। কলকাতা দ্রুত অপরিচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং নিরন্ন মানুষের আর্তনাদে কলকাতার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উক্ত কাল খণ্ডে জাপান কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলে বোমাবর্ষণ করায় মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় ভয়ে কলকাতা ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয় চলে যায়। ফলে কলকাতায় আর্থিক অবস্থার সমস্যার সৃষ্টি হয়। নিরন্ন মানুষের মৃতদেহ কলকাতাকে বদ্ধভূমিতে পরিণত করে। বিখ্যাত কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র তাঁর 'ফ্যান' কবিতায় লিখলেন,
"রাজপথে কচি কচি এসব শিশুর কঙ্কাল
মাতৃস্তন্যহীন
দধীচির হাড় ছিল এর চেয়ে আরো কি কঠিন?"
১৯৪৩-র অক্টোবরের রিলিফ সমিতি গুলি ৩৩৬৩টি মৃতদেহ সৎকার করেছিল। এই মাসে কলকাতায় দারিদ্র পীড়িত অনাহারি মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ। সরকার অনেক নিরন্ন মানুষদের দরিদ্র আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কলকাতা কলেরা, ম্যালেরিয়া ও বসন্ত রোগের আঁতুড়ঘড় হয়ে ওঠে।
অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের বেশ কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন। সেগুলি হল,
১) বাংলায় যুদ্ধের সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটে। এর পশ্চাতে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি, টাকার যোগান বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি অন্যতম কারণ ছিল।
২) ১৯৪৩ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর মাসে আমন ফসলের ঘাটতির জন্য কৃষকেরা খাদ্য মজুত করে রাখেন।
৩) জনগণ আতঙ্কিত হয়ে শস্য ক্রয় তাছাড়া ব্যবসায়ীদের মজুমদারি, কালোবাজারি, সরকারের চাল সংগ্রহের নীতির ব্যর্থতা প্রভৃতির জন্য দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়।
৪) ভারত সরকার আন্তঃরাজ্য খাদ্যশস্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করলে বাংলায় খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি।
৫) বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর আয়ের অসম বিস্তার, দুর্ভিক্ষকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
৬) চালের দাম যত বাড়তে থাকে কারিগর, মৎস্যজীবী, পরিবহনকর্মী ইত্যাদি শ্রমের চাহিদাও তত কমতে থাকে; অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের প্রকোপ যত বাড়ে দিনমজুর, কৃষি শ্রমিক, কারিগরদের চাহিদা কমে। কাজ থাকলে এরা খেতে পায় কাজ না থাকলে এরা অনাহারে থাকে।
অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষের পশ্চাতে প্রায় সব ধরনের কারণকেই তিনি তাঁর বক্তব্যের মধ্যে তুলে ধরেছেন।
দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকার কোন সদর্থক ভূমিকা নেয়নি। এক্ষেত্রে ১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসে স্যার বদ্রিদাস গোয়েঙ্কা, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও বিধানচন্দ্র রায় এগিয়ে আসেন এবং 'বঙ্গীয় ত্রাণ কমিটি' গঠন করেন। এই কমিটি কলকাতা ও বিভিন্ন জেলায় দুর্গতদের জন্য অন্ন জোগানের পাশাপাশি দুধ ও বস্ত্র বন্টন করে; তাছাড়া ৫০০ এর বেশি অস্থায়ী হাসপাতাল খুলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এদের পাশাপাশি রামকৃষ্ণ মিশন ও অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও সেবামূলক কাজ শুরু করে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলে বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী ৩০ থেকে ৪০ লাক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে দুর্ভিক্ষ কমিশনের মতে এই সংখ্যাটি ছিল মোট ১৫ লক্ষ। কমিশনের অন্যতম সদস্য ড. অ্যাকরয়েড গবেষণা করে মৃতের সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ লক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে কে. পি চট্টোপাধ্যায় ২৭ লক্ষ, অমর্ত্য সেন ৩০ লক্ষ এবং ভবতোষ দত্ত ৩৫ লক্ষ বলে উল্লেখ করেন।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলে সমাজ ও পারিবারিক জীবনে এক অবক্ষয় দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের বছরে দরিদ্র পিতা-মাতা তার সন্তানদের সামান্য টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতে থাকেন এবং অনেকে পুত্র কন্যা ফেলে পালিয়ে যান। তাছাড়া পেটের জ্বালায় অনেক গৃহবধূ অসামাজিক কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে যান। এমতাবস্থায় দেশের কালোবাজারি ও মুনাফা শিকারিরা অবৈধ বাণিজ্য করে দেড়শ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের ফলে পূর্বতন অভিজাততন্ত্র যুগের শেষ হয় এবং শুরু হয় বণিক তন্ত্রের যুগের। এর সাথে সাথে পূর্বতন সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, আদর্শ প্রভৃতির অবক্ষয় সূচিত হয়। যার উল্লেখ তৎকালীন বিভিন্ন সাহিত্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে। যেমন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'মন্বন্তর', বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অশনি সংকেত', গোপাল হালদার -এর 'ত্রয়ী', 'উনপঞ্চাশী' ও 'তেরশো পঞ্চাশ' প্রভৃতি। এছাড়া বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' নাটক, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের 'পঞ্চাশের মন্বন্তর' গ্রন্থ বিশেষ ঐতিহাসিক দলিল।
পঞ্চাশের মন্বন্তর ব্রিটিশ শাসনের নিষ্ঠুরতম প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এই মন্বন্তরের কারণ এবং ফলাফল নিয়ে গবেষক মহলে বিভিন্ন গবেষণা এবং আলোচনা চলে আসছে। বর্তমানে গান্ধীনগর আইiটির মতো প্রতিষ্ঠানও এ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ নিদর্শন রেখেছে। ফলে পঞ্চাশে মন্বন্তর ভারত তথা বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে পরিগণিত হয়েছে।
তথ্যসূত্র:-
১) Bengal Famine of 1943 An Appraisal of the Famine Inquiry Commission- MADHUSREE MUKERJEE
২) Hunger Habitus: State, Society, and Starvation in Twentieth-Century Bengal - Janam Mukherjee
৩) পঞ্চাশে মন্বন্তর- শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী
৪) বাংলার আর্থিক ইতিহাস -সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়।
No comments:
Post a Comment