ছবি : ইন্টারনেট |
বাংলা সাহিত্যে দেশভাগ প্রসঙ্গ
তুষার ভট্টাচাৰ্য
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত ভাগের পর (বাংলা এবং পাঞ্জাবকে খণ্ডিত করে ) দেশভাগের করুণ কাহিনী বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি উঠে আসেনি l হঠাৎ করে দেশভাগের কারণে তৎকালীন পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় এককোটি বাঙালি ছিন্নমূল উদ্বাস্তু ( হিন্দু ) নিজেদের অনিচ্ছাসত্বেও ভিটে মাটির মায়াত্যাগ করে এপারের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন l তাঁদের নাম দেওয়া হয়েছিল -বাঙাল, রিফিউজি,জার্মান পার্টি, সমুন্দির পুত, সার্কাসের জন্তু প্রভৃতি ব্যাঙ্গার্থক শব্দে বিশেষিত করে l সেই সময়ে স্থানীয় মানুষরা ভীষণ অনুকম্পার চোখে দেখতেন পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের l এবং বিরূপ মনোভাবও পোষণ করতেন l এইরকম মনোভাবের উল্লেখ পাওয়া যায় ' রিফিউজিরা এমনিতেই বড় নোংরা, এক ঘরে গাদাগাদি করে থাকে, শোওয়ার ঘরে উনুন জ্বেলে রান্না করে ( অর্জুন উপন্যাস - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ) l ' বাঙাল নাকি তুই? কী ভাষা হাউ মাউ খাঁউ ( মাধব ও তার পারিপাশ্বিক ( শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ) l
এই প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে সর্বস্ব হারানো বাঙালি উদ্বাস্তু মানুষদের জীবনের দুঃখ, যন্ত্রনা, বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ের কথা তুলে ধরে বাংলা ভাষায় কোনও ক্লাসিক উপন্যাস কিংবা নাটক আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি l যদিও সেই সময়ের বাঙালি উদ্বাস্তু জীবনের মর্মান্তিক করুণ আখ্যান কিছুটা তুলে ধরেছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাঙালি লেখক l অমলেন্দু চক্রবর্তী তাঁর অধিরথ সূতোপুত্র নামক গল্পে উদ্বাস্তু জীবনের দুঃখের আখ্যান তুলে ধরেছেন অনায়াস নৈপুণ্যে - গল্পের নায়ক সনাতন নিজের বুকের রক্ত দিয়ে লেখে - 'বুঝিয়াছি আমার স্বদেশ নাই l স্বদেশহীন মানুষের স্থান এই মর্তভূমি কি করিয়া হইতে পারে l ' শেষে এই বোধ তাঁকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে যায় l
অমলেন্দু চক্রবর্তীর আরেকটি গল্প' ইচ্ছামতী বহমান' গল্পেও চিত্রিত হয়েছে গল্পের নায়িকা মৃন্ময়ীর দেশভাগের যন্ত্রণা lকথা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' উপায় ' গল্পেও উদ্বাস্তু জীবনের চরম দুঃখের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে l মানিকের ' সুবালা ' নামক গল্পে উদ্বাস্তু সুবলার স্বামীকে যখন পুলিশ ছিনতাইয়ের অপরাধে ধরে নিয়ে যায় তখন ধৃত স্বামী সুবলাকে বলে - ভিখ মাইগো না l আমাগো অপরাধ নাই, ভিখ মাইগা অপরাধী সাইজো না l তার চেয়ে মরণ ভাল lএই কথা শুনে সুবলা শপথের ভঙ্গিতে বলে - 'এত বড় পৃথিবীতে মাথা গোঁজনের ঠাঁই আদায় কইরা নিমু l'
এই প্রসঙ্গেইলেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'মর্যাদা ' গল্পটির কথা উল্লেখ করতে হয় l গল্পের নায়ক দরিদ্র পন্ডিত মশাই দেশ ভাগের ফলে ভিটে মাটি সব হারিয়েছেন কিন্তু নিজের আত্ম মর্যাদা হারাননি l মাঝে মাঝে দেশের কথা মনে পড়লে ছাত্রদের দুঃখ করে বলেন - আছি রে ভালোই আছি l শুধু বুড়ো বয়েসে দেশের জন্যে একটু কষ্ট হয়, আর তো কখনও পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারব না l
বাংলা সাহিত্যের বিপ্রতীপে,বিশ্ব সাহিত্য ক্ষেত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় কিন্তু প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উদ্বাস্তু মানুষদের জীবন যন্ত্রনাকে তুলে ধরে রচিত হয়েছে অনেক মানবিক উপন্যাস ছোট গল্প, নাটক প্রভৃতি l জার্মানি দু'ভাগে ভাগ হয়ে যাবার সময়কালকে পটভূমি ধরে আমেরিকান সাহিত্যিক জন স্টেইনবেক লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ' দ্য গ্রেভস অব ৱ্যাথ l যাতে লেখা হয়েছে জার্মানির উদ্বাস্তু মানুষদের জীবনের করুণ কাহিনী l পার্ল বাকের ' দ্য রিফিউজিস ' উপন্যাসেও রয়েছে উদ্বাস্তু মানুষদের বাসভূমি হারানোর বেদনার্ত কাহিনী l এরিখ মারিয়া রেমার্কের' দ্য নাইট ইন লিসবন ' উপন্যাসে হিটলার শাসিত নাৎসীদের অত্যাচারের ফলে দেশত্যাগের করুণ চিত্র আখ্যায়িত হয়েছে l
প্যালেস্টাইনের লেখক গাজি ডানিয়াল তাঁর 'তিরিশ লাখের একজন' গল্পের শুরুতেই লিখেছেন - আজ আমার নিজের দেশ বলতে কিছু নেই l ইজাজ হামমদ নামের একজন প্যালেস্টাইনের কবি তাঁর 'রাতের জেরুজালেমবাসী ' কবিতায় লিখেছেন - হে রাত্রি তুমি বল কেন ছাড়তে হল আমার সেই ছোট্ট ঘর l কবি মহমুদ দারবিশ ' একজন নির্বাসিতের চিঠি ' শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন - রেস্তোরায় কাজ করি, এঁটো ডিস ধুই /আমার দুঃখী মুখে ঝুলিয়ে রাখি কৃত্তিম হাসি l
অন্যদিকে ভারতের হিন্দি ভাষার বিশিষ্ট সাহিত্যিক যশপাল লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত গল্প 'ঝুঠা সচ' l এই মানবিক গল্পটির পটভূমি হল লাহোর থেকে অমৃতসরে উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসার মর্মান্তিক কাহিনী l
উর্দু লেখক রাজিন্দর সিং বেদি দেশবিভাগের করুণ আখ্যান তুলে ধরেছেন তাঁর লাজবন্তী গল্পে l সাদাত হাসান মান্টো লিখেছেন ' নিয়তি' নামের গল্প l যার পরতে পরতে রয়েছে দেশ ভাগের কারণে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়ে যাওয়া জীবনের বেদনার কাহিনী l পাঞ্জাবী সাহিত্যিক গুরুমুখ সিং মুসাফিরের খসমা গল্পেও রয়েছে উদ্বাস্তু মানুষের করুণ আত্মকথন l বলা ভাল দেশভাগ নিয়ে হিন্দি, উর্দু ভাষায় অনেক মানবিক গল্প, উপন্যাস লেখা হয়েছে l
কিন্তু দেখা যাচ্ছে দেশভাগের সুদীর্ঘ ৭৫ বছর পেরিয়ে যাওয়া সত্বেও পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ ) ছিন্নমূল উদ্বাস্তু প্রায় এক কোটির বেশি মানুষের জীবনের করুণ স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস নির্ভর করে আজ পর্যন্ত তেমন ভাবে বাংলা ভাষায় খুব বেশি উপন্যাস, , নাটক বা কবিতা লেখা হয়নি l
যদিও কেন দেশভাগ হল, কাদের জন্য হল, সেই সব রাজনৈতিক হঠকারিতা, ক্ষমতার চক্রান্ত প্রভৃতি উল্লেখ করে লেখা হতে পারত সেই সময়ের বাস্তব ঘটনা সমন্বয়ের দলিল হিসেবে কোনও মানবিক উপন্যাস বা ছোটগল্পের আখ্যানলিপি কিংবা নাট্য সাহিত্য l
আসলে বাঙালি সাহিত্যিকরা ১৯৪৭এর দেশ ভাগের অপরিসীম যন্ত্রণা, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, স্বপ্ন, এবং স্বপ্নভঙ্গের চালচিত্র নিয়ে সম্ভবত তেমন করে লেখার কোনও আগ্রহই
দেখাননি lতাঁদের নির্লিপ্ততার জন্য বাংলা ভাষায় রচিত হয়নি কোনও দেশ ভাগের বেদনার আখ্যান l
অথচ সাহিত্য হচ্ছে সমাজের দর্পণ l এব্যাপারে কবি নাজিম হিকমত বলেছেন - ' সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে মানুষের জীবন প্রতিফলিত হয় l সেই শিল্পের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে সাংঘাত আর প্রেরণা, জয় ও পরাজয় আর জীবনের প্রতি অফুরান ভালবাসা l খুঁজে পাওয়া যাবে একজন মানুষের জীবনের সব'কটি দিক l
সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প, যা জীবন সম্পর্কে কোনও মিথ্যা ধারণা দেয় না l ' ( গ্রন্থ সূত্র :বাংলা উপন্যাসে উদ্বাস্তু জীবন - ড: তাপস ভট্টাচাৰ্য l প্রকাশক - পুস্তক বিপনী l কলকাতা ) l
বাংলা সাহিত্যে দেশ ভাগ এবং ছিন্নমূল উদ্বাস্তু জীবনের বঞ্চনা, অবহেলা, বেঁচে থাকার লড়াই প্রভৃতি নিয়ে তেমন করে কোনও সাহসী উপন্যাস কিংবা ছোট গল্প লেখা হয়নি l এছাড়া লেখা হয়নি কোনও কাল জয়ী নাটক কিংবা কবিতা l
যদিও তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে কয়েকজন মুষ্টিমেয় ঔপন্যাসিক দেশভাগের নির্মম যন্ত্রণা নিয়ে কিছু উপন্যাস বা গল্প লিখেছেন l এব্যাপারে সর্বাগ্রে নাম উল্লেখ করতে হবে সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের l তাঁর লেখা - নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, অলৌকিক জলযান, ঈশ্বরের বাগান, মানুষের ঘরবাড়ি, মৃন্ময়ী, আবাদ প্রভৃতি উপন্যাসে উদ্বাস্তু জীবনের করুণ কাহিনী ফুটে উঠেছে l 'নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে ' উপন্যাসে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
এক জায়গায় লিখেছেন -
জেঠিমার এই মুখ দেখলে সোনা চোখের জল রাখতে পারে না l মা না খেয়ে শীতের কাঁথায় শুয়ে থাকলে তার পড়াশুনা করতে ভাল লাগে না...... l বাবার চোখ মুখের দিকে তাকানো যায় না ....... l অন্নহীন এই সংসারে সোনার নিজেকে বাড়তি লোক মনে হয় l
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের - অর্জুন উপন্যাসের এক জায়গায় উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অর্জুন বলছে - লজ্জা পেয়েছিলাম আমি সতেরো বছর বয়েসে, কলকাতায় এসে l আমার দাদা তখন পাগল হয়ে রাস্তায় ঘোরে, দুবেলা মা আমাদের ভাত রেঁধে দিতে পারে না বলে বিরলে কাঁদে l
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের - মাধব ও তার পারিপার্শ্বিক, প্রফুল্ল রায়ের - নোনা জল মিঠে মাটি, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর - নিশ্চিন্তিপুরের মানুষ, অমিয়ভূষণ মজুমদারের - নির্বাস, অমলেন্দু চক্রবর্তীর - গোষ্ঠবিহারীর জীবনযাপন, জরাসন্ধের - মানস কন্যা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের - বিপাশা, দুলালেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের - ওরা আজও উদ্বাস্তু, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের - দূরভাষিণী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের - বকুলতলা পি এল ক্যাম্প, বল্মীক, অরণ্যদণ্ডক, প্রবোধ কুমার সান্যালের - হাসুবানু, বনফুলের - পঞ্চপর্ব, ত্রিবর্ণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের - সার্বজনীন, শক্তিপদ রাজগুরুর - তবু বিহঙ্গ, সোনা ফসলের পালা, মেঘে ঢাকা তারা, শঙ্করের - স্থানীয় সংবাদ, শঙ্কর বসুর - শৈশব, সমরেশ বসুর - সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা, সরোজ কুমার রায়চৌধুরীর - নীল আগুন, লোকনাথ ভট্টাচাৰ্য'র - দু'একটি ঘর, দু'একটি স্বর প্রভৃতি উপন্যাসেও দেশভাগ জনিত বাঙালি ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের জীবনের মর্মন্তুদ কাহিনী চিত্রিত হয়েছেl
এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের -জাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের - আত্মপ্রকাশ, জ্যোতির্ময়ী দেবীর - এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা প্রভৃতি উপন্যাসেও উদ্বাস্তু জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এবং চরিত্রের নিপুন আলেখ্য প্রকাশিত হয়েছে l
বাংলা উপন্যাসে দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু প্রসঙ্গ কিছুটা উঠে এলেও, বাংলা কবিতায় খুব বেশি উদ্বাস্তু জীবনের কথা চিত্রিত হয় নি l
যদিও কবি বিষ্ণু দে'র ' জল দাও ' কবিতায় ( ১৯৪০)কবি লিখেছেন -
' এখানে - ওখানে দেখ দেশছাড়া লোক ছায়ায় হাঁপায় l পার্কের ধারের শানে পথে পথে গাড়ি বারান্দায় l
ভাবে ওরা কী যে ভাবে l
ছেড়ে খোঁজে দেশ l
এইখানে কেউ বরিশালে কেউ বা ঢাকায় l '
বিষ্ণু দে তাঁর ' গান ' শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন -
মন চাই জ্ঞানে কাজে আপিসে
বাজারের কলে মিলে
দপ্তরেচত্বরে উল্লাসে সংকটে
গান চাই
প্রাণ চাই, গান চাই
শেয়ালদার বাস্তুহারা শেডে l
অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত - 'উদ্বাস্তু '(১৩৭২)শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন -
জলা জংলার দেশ, দেখবার আছে কী!
আসল জিনিস দেখবি ওপারে
আমাদের নিজের দেশে, নতুন দেশে,
নতুন দেশের নতুন জিনিস -মানুষ নয়,
জিনিস সে জিনিসের নাম কী?
নতুন জিনিসের নতুন নাম উদ্বাস্তু l
কবি মণীন্দ্র রায় 'চিঠি 'কবিতায় লিখেছেন -
'পাবনায় বাড়ি তার উদ্বাস্তু রমণী
সেই বাড়ি
এত টুকু হতে যারে চিনি
আর সেই ঘর পুব দুয়ারী
সিঁদুরে আমের সেই চারা
সবই আজ পরের অধীনে '
মণীন্দ্র রায়ের ' নকসি কাঁথার কাহিনী' কবিতাতেও রয়েছে উদ্বাস্তু জীবনের অপরিসীম লাঞ্ছনার করুণ চিত্র -
'কে দেখেছে জীবনের অপচয় বেশি তার চেয়ে?
কে সয়েছে এত গ্লানি রানাঘাটে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে, পথে
উড়িষ্যার তেপান্তরে, জনহীন দ্বীপান্তরে আর হাওড়ার স্টেশনে?
অচল পয়সার মতো পরিত্যক্ত ------
-----তবু বার বার
কে এমন ফিরে আসে, ঘর বাঁধে, কার এত আশা?
দারিদ্রের কাঁটাগাছে দুরন্ত স্বপ্নের রাঙাফুল
ফোটাতে কে জানে '
কবি দীনেশ দাশ তাঁর 'পনেরই আগস্ট ' কবিতায় লিখেছেন -
এখন তো শাঁখের করাতে
দিনগুলি কেটে যায় করাতের দাঁতে
সীমানার দাগে দাগে জমাট রক্তের দাগ
কালনেমী করে লঙ্কাভাগ l
বিশিষ্ট কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর 'স্বপ্নে দেখা ঘরদুয়ার'
কবিতায় লিখেছেন ফেলে আসা দেশের বাড়ির কথা -
পুকুর, মড়াই, সবজি বাগান,
জংলা ডুরে শাড়ি
তার মানেই তো বাড়ি l
তার মানেই তো প্রাণের মধ্যে প্রাণ,
নিকিয়ে নেওয়া উঠোনখানি
রোদ্দুরে টানটান l
কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস লিখেছেন -
তোমরা বিচার কর ভাই
কেন আমি দেশছাড়া,
আত্মীয় স্বজন হারা
কেন সে জনমভূমি
দেখিতে না পাই l
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি শামসুর রাহমান তাঁর ' যাবার মুহূর্তে ' শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন -
নিজের নিবাস থেকে যাবার মুহূর্তে
কেন যে বার বার মনে পড়ে তার
রেকাবিতে রাখা কিছু ফুল
স্টেনলেস চায়ের চামচ, তালা,
ছাইদানি, দরজার কড়া
যারা জানবে না কোনদিন,
কোথায় সে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে এমন ?
বাংলা সাহিত্যের আরেকটি ধারা নাট্য সাহিত্যেও খুব বেশি বাঙালি উদ্বাস্তু জীবনের আখ্যান কাহিনী প্রতিফলিত হয়নি l নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের - এই স্বাধীনতায়, সলিল সেনের -নতুন ইহুদি, বিজন ভট্টাচাৰ্য'র - গোত্রান্তর, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের - বাস্তু ভিটা, মন্মথ রায়ের - ভাঙাগড়া, ঋত্বিক ঘটকের -দলিল প্রভৃতি নাটকে বাঙালি উদ্বাস্তু জীবনের অন্তহীন সমস্যা, ব্যর্থতা, হতাশার করুণ আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে l
বস্তুতপক্ষে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৪৭সাল বা তার পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের জীবনালেখ্য নিয়ে বাংলা সাহিত্যের কোনও ধারাতেই তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য কালজয়ী উপন্যাস, ছোট গল্প কিংবা কবিতা আদৌ লেখা হয় নি l
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে উদ্বাস্তু জীবনের সমস্যা, বেঁচে থাকার সংগ্রামের কথাও তেমন করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেন নি কোনও বাঙালি লেখক, কবি নাট্যকার l
মানুষ কেন উদ্বাস্তু হয়, কাদের দোষে উদ্বাস্তু হয়, কীভাবে শাসক শ্রেণীর নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য উদ্বাস্তু হতে হয় সাধারণ ছাপোষা মানুষকে, সেইসব বাস্তুহারা ছিন্নমূল মানুষের জীবনের ব্যাথা, বেদনা, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, পুনর্বাসনের জন্য নিরন্তর লড়াই প্রভৃতি ব্যাপার নিয়ে সম্ভবত এপারের বাঙালি লেখকরা দেশ ভাগ পরবর্তী সময়ে খুব বেশি সজাগ ছিলেন না l দেশভাগ নিয়ে সজাগ এবং সচেতন থাকলে নিশ্চয়ই ধ্রুপদী, চিরায়ত উপন্যাস, গল্প, কবিতা কিংবা নাটক লেখা হত l
এব্যাপারে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য l সুনীল লিখেছেন - দেশভাগ নিয়ে কোনও সার্থক উপন্যাস লেখা যায় না, কেন না সেরকম লেখা আর একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উসকে দিতে পারে ( রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকা,১৩মার্চ ১৯৮৮ )l
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment