1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 6, 2021

বাংলার লোকখাদ্য

 

ছবি : ইন্টারনেট 

বাংলার লোকখাদ্য

মহুয়া মিত্র

      বাংলাদেশের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে তার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বোধ, শালীনতা যেখান থেকে বাংলা পেয়েছে এক স্বকীয় পরিচয় যা শুধুই বাংলার এবং বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি এর ওপরেই নির্ভরশীল। এখানকার প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে লোকসংস্কৃতি। দৈনন্দিন জীবন তথা জীবন চর্যা লোকসংস্কৃতিকেই ভিত্তি করে এগিয়ে চলে। বাঙালি যতই আধুনিক হোক না কেন সে কোন অবস্থাতেই তার মাটির সংস্কৃতিকে ভুলতে পারে না। তাই তো আজও বাংলার ঘরে  সন্ধ্যাবেলা প্রদীপ জ্বলে, পূণ্যি পুকুর ব্রত হয়, পৌষে নবান্ন আর চাল গুড়োর আলপনায় সেজে ওঠে কোজাগরীর সন্ধ্যা। আজও কিন্তু বাঙালি দর্শক হিসেবে দেখে গম্ভীরা, বনবিবির পালা, শণ, কুষান বা ছৌ নৃত্য। চিরন্তন বাউল গানের পাশাপাশি মন ছুঁয়ে যায় ভাটিয়ালি সুর। ছেলে ভোলানো ছড়ার পাশে স্থান পায় রূপকথা। এখানেই শেষ নয়, সব কিছুর পরেও থাকে রসনা তৃপ্ত বাংলার খাদ্য ভান্ডার যেখানে উপচে পড়ছে লোকখাদ্যের হরেক সম্ভার। কোনটা মিঠা কোনটা তিতা কোনটা পাচন আবার কোথাও নিছক মায়ের হাতের ছোঁয়া। শেকর বাকড় থেকে শুরু করে গাছের ছাল, ডাল, পাতা, লতা সমস্ত কিছুর মেলবন্ধন এই লোকখাদ্য।

পান্তা ভাত :

শস্য শ্যামলা বাংলাদেশের নদী প্লাবিত উর্বর পলি মাটিতে প্রধানত যে শস্য সারা বছর ধরে চাষ হয় তা হল ধান। তাই এই দেশের প্রধান খাদ্য ভাত। গরম ভাতের সাথে পান্তা ভাতের যথেষ্ট চাহিদা আছে। একদম বাংলার মাটি ঘেঁষা খাদ্য পান্তা। আগের দিনের ভাত বেচে গেলে তাতে ঠান্ডা জল মিশিয়ে সারা রাত রেখে দিতে হবে। সকালে সেই ভাত খেলে শরীর যথেষ্ট ঠান্ডা থাকে, বিশেষ করে গরম কালে খেলে খুব উপকার পাওয়া যায়। পান্তা ভাতের আনুষঙ্গিক হিসেবে থাকে বড়ি ভাজা, আলু ভাজা, বেগুন পোড়া, নানান রকম ভর্তা, পোস্ত, মাছ ভাজা ও টক, শুকনো লঙ্কা ভাজা ইত্যাদি। আর থাকতেই হবে কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা ও গন্ধ লেবু। অবিভক্ত বাংলার পাতে পান্তার দোসর শুঁটকি মাছের ঝাল। শৌখিন টেবিলে নয়, মাটিতে বসে স্বাদ নিতে হয় পান্তার।

আচার :

আম, লঙ্কা, রসুন , তেঁতুল ও আদার আচার বাংলার বাইরেও মেলে। কিন্তু কুল, চালতা, আমড়া ,জলপাই, কামরাঙা, আমলকির আচার বা আমতেল, আমসুট, কাসুন্দি এগুলো নিতান্তই বাংলার লোকখাদ্য। অত্যন্ত যত্ন সহকারে বাংলার ঘরে ঘরে মা, বোনেরা এগুলো তৈরি করে। ঘরোয়া উপাদানে এগুলো সমৃদ্ধ। নিজের হাতে বানিয়ে রোদে রেখে সারা বছরের জন্য সংরক্ষিত হয় এই জিনিস। স্বাদ উচ্চ মানের। ঘুরতে ফিরতে বাড়ির লোক এর ব্যবহার করেন। ভাত ডালের সাথে একটু আচার বা আমতেলে মাখা বা শাকের সঙ্গে কাসুন্দি যেন অমৃত। যত যাই হোক, আজও বাংলার ঘরে আচার তৈরি হয়। বাংলা ছাড়া এর স্বাদ আর কোথাও মিলবে না।

আমতেল :

কাঁচা আম টুকরো টুকরো করে খোসা সহ কেটে বিভিন্ন ধরনের উপাদেয় মশলা মিশিয়ে সর্ষের তেলে দিয়ে রোদে রেখে তৈরি আমতেল বাংলাদেশের লোকজ খাদ্যের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

আমসত্ত্ব :

বাংলাদেশের বাইরে যে আমসত্ত্ব পাওয়া যায় যাকে আম পাঁপড় বলে তার সাথে আমাদের আমসত্ত্ব আকাশ পাতাল তফাত। পাকা আম হরেক উপায়ে আমসত্ত্ব বানানোর কাজ নেহাতই বাংলার।

বড়ি :

বাংলাদেশের লোকজ খাদ্য সম্ভারের এক বিশেষ উদাহরণ হল বড়ি। গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে আজকের দিনেও তৈরি হয় বড়ি। এই বড়ি কিন্তু বাংলার বাইরে খাওয়ার প্রচলন নেই। মূলতঃ শীতকালে বড়ি দেওয়া হয়। বড়ির মূল উপাদান হল বিভিন্ন ধরনের ডাল যেমন মুগ, মুসুর, বিউলি ইত্যাদি। খুব মিহি করে শিলে বাটতে হবে ডাল। তারপর এর মধ্যে স্বাদ মতো নুন ও অন্যান্য দরকারি মশলা মিশিয়ে খুব ভালো করে ফোটাতে হবে। প্রথম দুটো বড়ো মাপের বড়ি দেওয়া হয় যাদের বলে বুড়ো বুড়ি। এদের তেল হলুদ সিঁদূর ফুল মালা ধান দুর্বা সহযোগে পূজো করে বাকি বড়ি ছোট ছোট করে তৈরি করে পরিষ্কার সাদা কাপড়ে দিয়ে চড়া রোদে রাখতে লাগে শুকনো হবার জন্য। তারপর সেই বড়ি খাওয়া হবে সারা বছর ধরে ভাজা, শাকে, তেতোতে,মাছের ঝোলের মধ্যে দিয়ে। কোথাও কোথাও লাউ দিয়েও বড়ি দেওয়া হয়।

গয়না বড়ি :

পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে দেওয়া হয় এই গয়না বড়ি যেখানে বড়ির আকার বিভিন্ন অলংকারের মত। এগুলো পোস্ত দানার ওপর রেখে আকার দিয়ে শুকানো হয়। এই বড়ি ভাজা খাওয়া হয়।

পোস্ত :

লোকখাদ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল পোস্ত। পোস্ত কাঁচা ও শুকনো লঙ্কা সহ বেটে বিভিন্ন সব্জি দিয়ে রান্না করা হয়। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পোস্ত বড়ার জয় জয়কার। বিউলি ডাল সহ আলু পোস্ত একটা প্রধান লোকখাদ্যের উদাহরণ।

মাছের টক :

বঙ্গ দেশের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল ও খরা প্রধান অঞ্চলের খাদ্য মাছের টক। প্রধানত পূর্ব মেদিনীপুর ও সুন্দরবন, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বর্ধমান জেলার মানুষ এই ধরনের খাবার খেতে অভ্যস্ত। রুই বা কাতলা জাতীয় বড়ো মাছ কাঁচা আমের টুকরো দিয়ে রান্না হয়, ফোড়ন থাকে কালো জিরে। আবার কোথাও মাছের ডিমটাও এভাবে রান্না হয়। টক খাবার প্রচন্ড গরমে শরীর শীতল রাখে।

অম্বল :

চাটনি বা আচার বাদে বাংলা লোকখাদ্য হিসেবে পরিগণিত হয় এই অম্বল। আম,কুল, জলপাই ইত্যাদি কালো সর্ষে ফোড়ন দিয়ে অল্প মিষ্টি ও অনেকটা জল দিয়ে এটা করা হয়। গরমকালে ভাত খেয়ে এই অম্বলে চুমুক দিলে নিমেষে শরীর ঠান্ডা।

তাল :

কথায় আছে ভাদ্রের তাল পাকা গরম। ভাদ্র মাসে যখন তাল পাকে তখন ঘরে ঘরে তাল গুলে কাথ্ বের করে তাতে চাল গুড়ো , আটা, চিনি, নারকেল, কলা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয় তাল ফুলুরি, তালের লুচি, ক্ষির,মালপোয়া ও আরোও কত কিছু। ভাদ্রের জন্মাষ্টমীর গুরুত্ব পূর্ণ উপাদান হল তাল।

বেলপানা :

গরমের দিনে বাংলা লোকখাদ্য হিসেবে গৃহীত হয় বেলপানা। বীজ বাদ দিয়ে পাকা বেল দুধে গুলে চিনি মিশিয়ে খাওয়া হয়।

পিঠে :

শীতকালে বাংলা জুড়ে নতুন ধানের চাল আর গুড়ের রমরমা। যদিও পৌষে নবান্ন দিয়ে পিঠে উৎসবের সূচনা কিন্তু সারা শীত ধরেই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে তৈরি হয় নানান রকম পিঠে। চাল গুঁড়ো, দুধ ও নারকেল হল পিঠের প্রধান উপকরণ। এর সাথে আরও অনেক উপকরণ মিশিয়ে বাংলা লোকখাদ্যে স্থান পেয়েছে পাটিসাপটা, ভাজা / ভাপা/ দুধ পুলি, আসকে পিঠে, গোকুল পিঠে, গোলাপ পিঠে, চিতই পিঠে এমন হরেক কিসিমের পিঠে।

পায়েস :

পিঠের যমজ ভাই যেন পায়েস। দুধে সুগন্ধি চাল ফুটিয়ে তৈরি করা এই পায়েস, অনুষঙ্গ হিসেবে থাকে এলাচ, তেজপাতা, কাজু-কিশমিশ। শীতকালে ঘরে ঘরে বানানো হয় নতুন গুড়ের পায়েস। শুধু বা রুটি, লুচি, পরোটা বা মুড়ি দিয়ে খাওয়া হয়। পূজো পার্বণে বা জন্মদিনে বাংলার মানুষ তৈরি করে পায়েস।

ফেনা ভাত :

আতপ চালের ভাত ফেন না ঝরিয়ে গরম গরম ঘি সহযোগে খাওয়া বাংলাদেশের লোকখাদ্যের আরেক উদাহরণ। সারা বছর খেলেও বিশেষ করে শীতকালে নতুন আলু সেদ্ধ দিয়ে এটি খাওয়া হয়।

মুড়ি :

মুড়ি হল বাংলা লোকখাদ্যের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন। চাল থেকে মুড়ি তৈরি করে তা বিভিন্ন ভাবে খাওয়া হয়। এদেশে ভাতের পরেই মুড়ির স্থান। শুধু মুড়ি না, মুড়ি থেকে তৈরি মোয়াও যথেষ্ট জনপ্রিয়।

নারকেল :

প্রথমে ডাবের জল ও শাঁস তারপর নারকেল - এভাবেই বাংলাদেশে খাওয়া হয় নারকেল। মুড়ি ও নারকেল খুব জনপ্রিয় খাবার। বাংলার ঘরে তৈরি হয় নারকেল নাড়ু, তক্তি। বিভিন্ন রকম রান্না করা হয় নারকেল দিয়ে। নারকেল বেটে তার থেকে দুধ বের করে রান্না হয় মালাই কারী ধরনের খাবার। তারপর ছিবড়ে নারকেল দিয়ে তৈরি হয় নারকেল বড়া। অনেক বাড়িতে কোজাগরীর দিন ঠাকুরকে নারকেল জল দেবার নিয়ম আছে।

মুড়কি :

খৈ, মুড়ি, চিঁড়ে, বাদাম, তিল ইত্যাদি গুড় বা চিনির রসে মিশিয়ে তৈরি হয় মুড়কি যা বাংলাদেশের লোকজ খাদ্যের অন্তর্গত।

গুড় :

আখ বা খেজুর রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানো হয়। এই গুড় দিয়ে অনেক রকম খাবার বানানো হয়।

ফলার :

সকালের জলখাবারে খৈ, চিঁড়ে বা মুড়ি দুধ বা দৈ আর আম বা কলা দিয়ে, চিনি গুড় মোয়া মুড়কি বাতাসা সহযোগে খাওয়া হয়।একে ফলার বলে। বাংলা লোকখাদ্য তালিকায় এই ফলারকে রাখতেই হবে।

সিন্নি :

পূজোর দিন বাংলাদেশের ঘরে কাঁচা দুধে আটা বা সুজি দিয়ে বিভিন্ন ফল, মিষ্টি, নারকেল মিশিয়ে তৈরি হয় সিন্নি। বিশেষ করে নারায়ণ পূজো ও বারের পূজোয় সিন্নি নিবেদন করতেই হয়।

বাটা :

বাংলার বাইরেও পাতা বেটে খাওয়ার চল আছে কিন্তু সেটা রুটি পুরির সাথে চাটনি হিসেবে। বাংলা লোকখাদ্যে যে বাটা স্থান পেয়েছে তা গরম ভাতে প্রযোজ্য। ধনেপাতা, পটল খোসা, কাঁচকলা  খোসা, লাউপাতা,পোস্ত, ঝিঙে ইত্যাদি বেটে গরম তেলে কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে সেটা নেড়ে খাওয়া হয়।

পোড়া :

আলু, বেগুন, টমেটো এসব আগুনে পুড়িয়ে কাঁচা সর্ষের তেল ও লঙ্কা সহ গরম ভাতের সাথে খাওয়া আরেক লোকখাদ্যের উদাহরণ।

সেদ্ধ :

যে কোন সবজি সেদ্ধ করে নুন, তেল ও কাঁচালঙ্কা সহ খাওয়া বাংলাদেশের লোকখাদ্যের তালিকা ভুক্ত।

বড়া :

ডাল, সব্জি, মাছ, মাংস ইত্যাদি বেসনে ডুবিয়ে চপ ফুলুরি ভাজা বাংলা লোকখাদ্যের অন্তর্গত।

ঘন্ট :

সব্জি মিহি করে কেটে এক রকম তরকারি রান্না হয়।একে বলে ঘন্ট। কখনো এতে বেসন ফুলুরি ভেঙে মেশানো হয়।

লাবড়া/ছ্যাঁচড়া :

হরেক সব্জির মেলবন্ধন হল এটি। নিরামিষ লাবড়া আর তাতে মাছের মাথা দিয়ে ছ্যাঁচড়া বাংলা লোকখাদ্যের জগত আলোকিত করেছে।

বিভিন্ন খাদ্যের সমাহারে বৈচিত্র্যময় বাংলা লোকখাদ্যের ভান্ডার। কত যুগ ধরে চলে আসছে এবং আগামীতেও চলবে।


mahuyamitra827@gmail.com

No comments:

Post a Comment