1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

পূজার আয়োজনে বোধন থেকে দশমী

ছবি : ইন্টারনেট

পূজার আয়োজনে বোধন থেকে দশমী

রূপম চক্রবর্ত্তী

শুভ ষষ্ঠী তিথিতে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে মায়ের মূর্তির উন্মোচন করা হয়। সকালে বিল্ব বৃক্ষে দেবীর মঙ্গল বোধন করা হয়। বোধন অর্থ জাগরণ অর্থাৎ বোধনে দেবী জাগরিত হন।  আমন্ত্রণ মানে দেবীকে নিয়ে আসা। বোধন, আমন্ত্রনের পর সন্ধ্যায় অধিবাস করা হয়। অকালবোধন হল শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি অথবা শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে হিন্দু দেবীপার্বতীর দুর্গা রূপের পূজারম্ভের প্রাক্কালে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, শরৎকাল দেবলোকের রাত্রি দক্ষিণায়নের অন্তর্গত। তাই এই সময় দেবপূজা করতে হলে, আগে দেবতার বোধন (জাগরণ) করতে হয়। একাধিক পুরাণ ও অন্যান্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, রাবণ বধের পূর্বে রাম দেবী পার্বতীর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে বিল্ববৃক্ষতলে বোধনপূর্বক দুর্গাপূজা করেছিলেন। অধিবাস মানে দেবীর অবস্থান করা।  মহাষষ্ঠীর দিন নয়টি কোলস্ঘট জলপূর্ণ করে দেবীর নবশক্তিকে আহ্বান করা হয়। এই দিনই বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসবের শুভারম্ভ হয়।

মা দুর্গা বিভিন্ন নামে পরিচিত।  সপ্তমী থেকে দশমী পূজার সংক্ষিপ্ত আলোচনার আগে মায়ের বিভিন্ন নাম স্মরণ করছি। অগসূতা, অগাত্মজা, অতসীপুষ্পবর্ণাভা, অদ্রিজা, অদ্রিতনয়া, অনন্তা, অনাদ্যা, অন্নদা, অন্নপূর্ণা, অপরাজিতা, অপর্ণা, অব্যয়া, অভয়া, অমোঘা, অম্বা, অম্বালা, অম্বালিকা, অক্বিকা, অষ্টভুজা, অসুরনাশিনী, আদিদেবী, আদিভুতা, আদ্যা, আদ্যাশক্তি, আনন্দময়ী, আর্যা, ঈশানী, ঈশ্বরী, উমা, কপর্দিনী, কাত্যায়নী, কাণ্ডবারিণী, কামাক্ষী, কৈলাশবাসিনী, কৌশিকী, ঈশানী, গিরিকুমারী, গিরিজা, গিরিনন্দিনী, গিরিবালা, চণ্ডবতী, জগদক্বা, জগদ্ধাত্রী, জগন্ময়ী, জগন্মাতা, জয়ন্তী, জয়া, গিরিসূতা, গৌতমী, গৌরী, চণ্ডী, চামুণ্ডা, জগজ্জননী, জগদ্গৌরী, জ্বালমালিনী, তারিণী, ত্রিগুণা, ত্রিনয়না, ত্রিনয়নী ত্রিশূলধারিণী, ত্রিশূলিনী, দক্ষকন্যা, দক্ষজা, দশভুজা, দাক্ষায়ণী, দনুজদলনী, দানবদলনী, দুর্গা, নগনন্দিনী, নন্দা, নিস্তারিণী, পরমাপ্রকৃতি, পরমেশ্বরী, পর্বতদুহিতা, পর্বতসূতা, পার্বতী, প্রকৃতি, বভ্রবী, বাভ্রবী, বাসন্তী, বিজয়া, বিন্ধ্যবাসিনী, বিশ্বেশ্বরী, ভগবতী, ভদ্রকালী, ভদ্রাণী, ভবতারিণী, ভাস্বতী, মঙ্গলা, মহাদেবী, মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহাশক্তি, মঙ্গলচণ্ডী, মহিষাসুরমর্দিনী, মহেশানী, মহেশী, মোক্ষদা, যোগমায়া, রাজরাজেশ্বরী, রুদ্রাণী, সতী, সর্বজ্ঞা, সাবিত্রী, শঙ্করী, শরণ্যা, শর্বাণী, শাকক্ভরী, শারদা, শিবপত্নী, শিবপ্রিয়া, শিবা, শিবানী, শুভঙ্করী, শুভচণ্ডী, শূলিনী, শৈলজা, শৈলসূতা, শৈলেয়ী, সনাতনী, সর্বজয়া, সর্বমঙ্গলা, সর্বাণী, সর্বার্থসাধিকা, সাত্তি্বকী, সিংহবাহিনী, সুরেশ্বরী, হিমালয়নন্দিনী, হৈমবতী।

মহাসপ্তমী তিথির সকাল থেকে মূল পূজার আয়োজন শুরু হয়ে যায়। পূজা কমিটি সদস্যদের মধ্যে কাজের বন্টন করে দেন কে কি কাজ করবেন। যারা ফুল তোলার দায়িত্বে থাকেন তারা ফুল সংগ্রহের কাজে চলে যান। কেউ থাকেন মন্ডপের দায়িত্বে আবার কেউ থাকেন কেনাকাটার দায়িত্বে।  

মৃন্ময়ী প্রতিমায় চক্ষুদান, প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও আবাহন মন্ত্রে মা মৃন্ময়ী হতে  চিন্ময়ীরূপে পূজিতা হন। সকালে নব পত্রিকা স্নানের মাধ্যমে দুর্গাপূজার সূচনা হয়। নব পত্রিকা হল দেবী দুর্গার প্রতিনিধি।  নয় ধরণের উদ্ভিদের পুজোর প্রাচীন প্রথা হল নবপত্রিকা স্নান। এই উদ্ভিদগুলো হচ্ছে এগুলি হল - কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান ও ধান। নবপত্রিকার চারদিকে শ্বেত অপরিজিতা লতা ও হরিদাক্ত ডোর (সুতা) দিয়ে বাঁধার নিয়ম আছে।  নবপত্রিকার আর এক নাম কুলবৃক্ষ। এই কুলবৃক্ষের প্রধান অধিষ্ঠিত দেবতা ও যোগিনীরা হলেন দেবীর সহচরী। জলপূর্ণ কলস বা ঘটকে  দেবীর প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়। ঘটের গায়ে সিঁদুরের পুত্তলিকা, ঘটের  মাথায় চালপূর্ণ  সরা ও নারিকেল, ঘটে জল ও ঘটের মুখে পঞ্চপল্লব রাখা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পরেই দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। মূল পূজা, ভোগ,  মাতৃ চরণে অঞ্জলি দেওয়ার মাধ্যমে পরের দিন অর্থাৎ অষ্টমী পূজার প্রস্তুতি নিয়ে আলাপ আলোচনা শুরু হয়ে যায়।

সপ্তমী পূজার পরের দিন সকাল থেকে উপবাস করে মায়েরা মহাঅষ্টমী তিথিতে পূজা দেওয়ার জন্য মাতৃমন্ডপে চলে আসেন।  অষ্টমী পূজার পরই হয় সন্ধিপূজা। দুর্গাপুজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সন্ধিপূজা। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট এবং নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিটকে বলা হয় সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণে তন্ত্রমতে করা হয় সন্ধিপূজা। ঠিক এই সময়েই দেবী দুর্গা চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুরের নিধন করেছিলেন।  এই সন্ধিক্ষণেই মা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন।  এই ঘটনাটি মনে রাখার জন্যই প্রতি বছর অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধিক্ষণে এই সন্ধিপূজা করা হয়। অসুরশক্তির বিনাশকালের এই শুভক্ষনেই সন্ধিপূজা করা হয়। ত্রেতা যুগে লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করার জন্য সন্ধিপূজার শেষে শ্রীরামচন্দ্র দেবীর পায়ে ১০৮টি পদ্ম উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। তাই ভক্ত হনুমানকে পাঠিয়েছিলেন দেবীদহে। কিন্তু দেবীদহ থেকে ১০৭টি পদ্ম নিয়ে ফিরেছিলেন পবনপুত্র। কারণ দেবীদহে আর পদ্ম ছিল না। সুতরাং মহামায়ার পায়ে দেওয়ার জন্য একটি পদ্ম কম পড়েছিল । সন্ধিক্ষণ চলে যাওয়ার উপক্রম হলে শ্রীরামচন্দ্র ধনুর্বাণ দিয়ে নিজের নীল পদ্মের ন্যায় চক্ষু দুটির মধ্যে একটি উৎপাটন করে মায়ের পায়ে অর্পণ করতে চেয়েছিলেন ১০৮তম পদ্ম হিসেবে । চক্ষু উৎপাটনের মুহূর্তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন দেবী দুর্গা । মায়ের বরে বলীয়ান শ্রীরামচন্দ্র এই অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণেই রাবণ বধ করেছিলেন । এইদিন  কোথাও কোথাও কুমারী পূজাও করা হয়। বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা চালু করেছিলেন।

কুমারী পুজা শারদীয়া দুর্গোৎসবের এক বর্ণাঢ্য পর্ব।  তান্ত্রিক মতে কুমারী পুজো চলে আসছে বহু প্রাচীন কাল থেকে। কিন্তু এই পুজোর পরিচিতি সেভাবে সাধারণ মানুষের কাছে ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে কুমারী পুজোর আয়োজন করার পর থেকে এই পুজো নিয়ে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। তন্ত্র শাস্ত্র অনুযায়ী কুমারী পুজো বলতে বোঝায় এক থেকে ষোলো বছরের কম বয়সী অরজঃসলা কুমারী মেয়ের পুজো। বয়স অনুসারে কুমারীর বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। এক বছরের কন্যার নাম =  সভ্যা, 

দুই বছরের কন্যার নাম  =  সরস্বতী, তিন বছরের কন্যার নাম  =  ত্রিধমূর্তি, চার বছরের কন্যার নাম  =  কালিকা, 

পাঁচ বছরের কন্যার নাম =  সুঙ্গা, ছয় বছরের কন্যার নাম  = উমা, সাত বছরের কন্যার নাম = মাতঙ্গিনী, আট বছরের কন্যার নাম = কুষ্টিকা, নয় বছরের কন্যার নাম  =  কাল সন্দভা, দশ বছরের কন্যার নাম = অপরাজিকা, এগারো বছরের কন্যার নাম  = রুদ্রাণী, বারো বছরের কন্যার নাম = ভৈরবী, তেরো বছরের কন্যার নাম = মহালক্ষ্মী, চোদ্দ বছরের কন্যার নাম = পঠনায়িকা, পনেরো বছরের কন্যার নাম  = ক্ষেত্র, ষোলো বছরের কন্যার নাম  = অম্বিকা

মহানবমী হল দুর্গা পূজার শেষ দিন।  সন্ধিপূজার পর শুরু হয় মহানবমীর পূজা। এই  দিন ষষ্ঠী থেকে যত দেবদেবীর পূজা করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেককে আহুতি দিতে হয়। এই দিনের অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে বলিদান।  শাস্ত্রমতে ছাগ বা মহিষাদি বলির রীতি আছে।  কিন্তু বর্তমানে অনেক পূজাতে পশুবলি করা যায় না, তার পরিবর্তে কুস্মান্ড, ইক্ষুদান বলি দেওয়া হয়।

তিনদিনের পুজার পর  বিষাদের দিন।  দশমীর পুজা শেষ করে মহাস্নানের যে দর্পণ ছিল সেটিতে মাকে  চিন্ময়ীরূপে বিসর্জন দেওয়া হয়।  বেজে ওঠে বিসর্জনের বাদ্যি। মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দশমী পুজোর পর শুরু হয় দেবীকে বরণ করার পালা।  এই দেবীবরণের মাধ্যমে মাকে জানানো হয় মনের সব কামনা। বলা হয় "মা তুমি  আবার এসো, তুমি আমাদের রূপ দাও, যশ দাও, শত্রূকে জয় করার শক্তি দাও।  তোমার আশীর্বাদ আমাদের  নিত্য পাথেয় হোক "। বিজয়ার বিষাদের  সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে সিঁদুর খেলার নিয়ম। এটা হল স্ত্রী আচার। মানুষের বিশ্বাস দুর্গামায়ের সিঁথির সিঁদুর নিয়ে মাথায় ঠেকালে সধবাদের সিঁথির সিঁদুর দীর্ঘস্থায়ী হয়। মাকে সিঁদুর দানের পর একে অন্যের সিঁথি সিঁদুরে রাঙিয়ে দেয়। দেবীবরণের মাধ্যমে আনন্দময় সমাপন ঘটে। চারদিনের প্রানঢালা আনন্দস্রোত পৌঁছে যায় শেষ লগ্নে। বিষাদসিন্ধুতে ডুবে যাওয়ার আগে সিঁদুরখেলার মাধ্যমেই  অন্তরের সব আবেগ উজাড় করে দেওয়া হয়। মর্ত্যেও  মিষ্টি মুখের সাথে অশুভের উপর শুভের বিজয়া উদযাপিত হয়।  সবাই মেতে ওঠে এই মিষ্টতার উৎসবে।  পূর্বে এই উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল "কোলাকুলি" করা, যা বর্তমানে খুব একটা দেখা যায় না। দুর্গাপূজা আনন্দময় মহামিলনের  উৎসব। যা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক।  এই পূজা এখন আর শুধু হিন্দুদের জন্য আনন্দ বয়ে আনে না, সব  জাতির মধ্যেই আনন্দ, শান্তি ও ভালোবাসা বয়ে নিয়ে আসে।  এ যেন এক সৌভ্রাতৃত্বের মিলনোৎসব। তাই দুর্গাপুজা শুধু ধর্মীয় কৃত্য নয়, তা সার্বজনীন উৎসবও বটে।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment