1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

অভিশপ্ত পাণ্ডুলিপি

ছবি : ইন্টারনেট 


 অভিশপ্ত পাণ্ডুলিপি

সৌরভ নাগ

“কিউরিও শপের লোকটা আমাকে বলেছিলেন যে এটা নাকি প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো। এরপর এ জিনিস কেনার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না মশাই। তবে আমার এখন মনে হচ্ছে জিনিসটা বোধহয় অতটা পুরোনোও নয়। আপনার কি মনে হয় সুবিমলদা?” অলকেশ জিজ্ঞেস করলেন।

সুবিমল জিনিসটা একনজরে দেখেই বুঝতে পারলেন জিনিসটা পাঁচশো বছরের পুরনো কোনোমতেই হতে পারেনা। জিনিসটা তার থেকেও অনেক বেশি পুরনো! কমপক্ষে তিনহাজার বছরের পুরনো তো বটেই। অলকেশকে কিউরিও শপ থেকে এটা পাঁচশো বছরের বলে বিক্রি করার কি কারণ থাকতে পারে সেটা ভাবাটা সত্যিই দুষ্কর। আর যে দামে অলকেশ এটা কিনেছেন সেটাও খুব একটা বেশি নয়। কিউরিও শপের লোকটার বোধহয় জিনিসটার প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে খুব একটা পরিষ্কার ধারণা ছিল না।

জিনিসটি আর কিছুই নয়, একটি পুরনো পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপিটির দুই পিঠ উইলো কাঠের দ্বারা বাঁধানো। ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো বেশ পুরনো হলেও এখনো লাল হয়ে যায়নি, তার কারণ এটি কোনও প্রাণীর চামড়া দ্বারা নির্মিত। পৃষ্ঠাগুলোতে বেশ অদ্ভুত ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে এবং তার সাথে কিছু অদ্ভুত ছবিও রয়েছে। ছবিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই জীবন ও মৃত্যুকেন্দ্রিক। এছাড়া বইতে মরচে-লাল কালির অতিরিক্ত ব্যবহার রক্তের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। 

সুবিমল বললেন, “দোকানদার বোধহয় এটার মূল্য আন্দাজ করতে পারেননি। এটা প্রায় অমূল্যই বলা যায়। এটা পাঁচশো বছর নয়, তার চেয়েও ঢের বেশি পুরনো; কমপক্ষে তিনহাজার বছর তো হবেই। তবে বইটিতে কিন্তু জীবন ও মৃত্যুর বেশ ভালো বর্ণনা দেওয়া রয়েছে। বইটা বেশ রহস্যময় অলকেশ।”

“বইটা যে রহস্যময় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দোকানদার আমাকে ও বলেছিলেন যে এটি নাকি অভিশপ্ত এবং এ নাকি যে কোনো ব্যক্তির তিনটি ইচ্ছা পূরণ করে। তবে সেই ইচ্ছাগুলোর বিনিময়ে এও কিছু গ্রহণ করে। আমাকে অবশ্য এটা প্রায় জলের দরেই বিক্রি করে দিলেন। মাত্র পাঁচশো টাকায় তিনহাজার বছরের পুরনো পাণ্ডুলিপি ― ভাবা যায়? তবে আমার যেন মনে হল উনি এটা আমাকে বিক্রি করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।” অলকেশ বললেন। 

“ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারটা সত্যি কিনা পরখ করে দেখবে নাকি?” সুবিমল মজার ছলেই জিজ্ঞেস করলেন।

“হ্যাঁ। ব্যাপারটা পরখ করে দেখাই যায়। আজ তো আপনিও এখানে রয়েছেন। তাহলে এর সত্যমিথ্যা যাচাই হয়ে যাক।”

অলকেশ পাণ্ডুলিপিটি হাতে নিয়ে বললেন, “আমি দশ কোটি টাকা পেতে চাই।”

অলকেশ পাণ্ডুলিপিটি রাখতেই সুবিমল বললেন, “দশ কোটি চাওয়াটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?”

অলকেশ বললেন, “ইচ্ছাপূরণের ব্যাপারে কোনও সীমা পরিসীমা থাকে না। সেরকম হলে বোঝা যাবে এটি আদৌ কল্পতরু নয়।”

“আমি কি এটার একটা ছবি তুলতে পারি?” সুবিমল বইটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করলেন।

অলকেশ হেসে বললেন, “নিশ্চয়ই।”


দুদিন পর সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই টেলিফোনের ঝংকার। সুবিমল ঘুমজড়ানো কণ্ঠে হ্যালো বলতেই ওপ্রান্ত থেকে  অলকেশের গলা ভেসে এল, “সুবিমলদা, ইউ ক্যান্ট বিলিভ দিস। ইটস মিরাকল। অনবদ্য, অভাবনীয়, অকল্পনীয় ―”

অলকেশ আরও কয়েকটা বিশেষণ ব্যবহার করার আগেই সুবিমল বললেন, “অভাবনীয় আর অকল্পনীয় দুটি সমার্থক শব্দ, অলকেশ। ব্যাপারটা কী?”

“আজ সকালেই একটা টেলিগ্রাম পেলাম। মাসদুয়েক আগে বোধহয় একটা লটারির টিকিট কিনেছিলাম। টেলিগ্রামে দেখলাম আমি সেই লটারিতে দশ কোটি টাকা জিতেছি। অকল্পনীয় ব্যাপার সুবিমলদা।”

সুবিমলের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগল। তিনি গুগল খুলে ফটোটা সার্চ করলেন। বেশিক্ষণ লাগল না, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বইটার ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য মনিটরে ফুটে উঠল।

‘বুক অফ ডেথ’ অর্থাৎ মৃত্যুর বই। এটি ইজিপ্টের একটি পিরামিডের গোপন কক্ষে পাওয়া গিয়েছিল। এটির উৎপত্তিকাল আনুমানিক ১৬০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ। এটি মৃত্যুর দেবতা আনুবিস নাকি নিজে লিখেছেন। এখানে বইটার কিছু কথার অনুবাদ দেওয়া রয়েছে। দুটি অনুবাদে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হল। ‘মৃত্যুই জড় ও জীবনের চরম সত্য’ এবং ‘মৃত্যুর বদলে মৃত্যুই ন্যায়’। এটি নাকি অভিশপ্ত বই। এটি যে কোনও ব্যক্তির নাকি তিনটি ইচ্ছাপূরণ করতে পারে। এর লোভে নাকি অনেকেই তাঁদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে। এরপর দুশো বছর আগে এটাকে নিষিদ্ধ বইয়ের তকমা দিয়ে ইজিপ্টের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত করে রাখা হয়। কিন্তু কয়েক বছর পরেই সেটা মিউজিয়াম থেকে চুরি হয়ে যায়। এরপর এটার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। বর্তমানে বইটি অমূল্য। 

সুবিমল ভাবলেন, প্রথম ইচ্ছাপূরণ তো হয়েছে অলকেশের। এর বদলে বইটি কি নেবে? পৃথিবীতে এরকম অলৌকিক ব্যাপারের অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? নাহ, তাঁর একবার অলকেশের বাড়ি যাওয়া দরকার। অলকেশের এই বইয়ের ইতিহাসটাও জানা দরকার। তাঁর এখন মনে হচ্ছে সেদিন মজার ছলে অলকেশকে ইচ্ছাপূরণ করতে না বললেই হত। 

সুবিমলের আশঙ্কা যে অমূলক নয় সেটা অলকেশের বাড়ি পৌঁছতেই তিনি বুঝতে পারলেন। অলকেশ থমথমে মুখে ড্রইং রুমে বসে রয়েছেন। তিনি সুবিমলকে টেবিলে রাখা একটি চিঠি দিয়ে বললেন, “সুবিমলদা, এটা পড়ে দেখ।” 

চিঠিটা অলকেশের পারিবারিক ডাক্তার মি. শ্যামল চক্রবর্তীর। চিঠির বক্তব্য অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। অলকেশ দিনসাতেক আগে ব্লাড টেস্টসহ আরও কিছু টেস্ট করিয়েছিলেন। এটা একটা রিপোর্ট। ক্যান্সার থার্ড স্টেজ!

“একটি ইচ্ছাপূরণের জন্য আমাকে এত বড় মূল্য চোকাতে হবে ভাবিনি আমি।” অলকেশ ভেঙে পড়েছেন।

সুবিমলের মাথায় হঠাৎ একটি বুদ্ধি এসে গেল। তিনি অলকেশকে বললেন, “তুমি ক্যানসার নির্মূল করার জন্য বইটিকে দ্বিতীয় ইচ্ছা জানাতে পারো।”

অলকেশ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তাই তো, এটা তো ভেবে দেখিনি আমি।” 

অলকেশ পাণ্ডুলিপিটি স্পর্শ করে তাঁর দ্বিতীয় ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। 

“আমার মনে হচ্ছে এবার আরও ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে।” অলকেশের উদ্বিগ্নভাবে বললেন।

পরদিনই ড. চক্রবর্তীর কাছ থেকে একটি চিঠি আর একটি পার্সেল এল। চিঠিতে ড. চক্রবর্তী যা লিখেছেন তা অনেকটা এইরকম ―

মি. অলকেশ সরকার, আমি ক্যান্সারের উপর গত পাঁচ বছর ধরে রিসার্চ করছিলাম। সেই গবেষণা আজ পরিণতি পেল। আমি আশা করছি আমি ক্যান্সারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পেরেছি। তবে মানুষের দেহে এটা ঠিক কতটা কার্যকর তা আমি জানিনা। সেজন্যই আমি আপনাকে প্রতিষেধকের একটি স্যাম্পল পাঠালাম। এটা ব্যবহার করে দেখুন। কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হলে যথাসম্ভব শীঘ্র আমাকে জানাবেন।

অলকেশ প্রথমটায় ইতস্তত করলেও কিছু পরে পার্সেল থেকে স্যাম্পলটা বের করে খেয়ে নিলেন। এর বদলে তাঁকে কি মূল্য দিতে হবে কে জানে!

পরদিন সকালে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়লেন অলকেশ। সুবিমল খবর পেয়েই হাসপাতালে ছুটলেন অলকেশকে দেখতে। গিয়ে যা শুনলেন অলকেশের বেশ সঙ্কটজনক অবস্থা। তবে তাঁর ক্যান্সার নাকি আশ্চর্যজনকভাবে সেরে গিয়েছে।

অলকেশের সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় মাসদুয়েক লেগে গেল। অলকেশ ঠিক করলেন ওই পাণ্ডুলিপিটি পুড়িয়ে ফেলবেন। ওই অভিশপ্ত পাণ্ডুলিপিটি আর বরদাস্ত করা যাচ্ছে না। সুবিমলকে ডেকে আজকালের মধ্যেই ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে হবে।

সুবিমল জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি সত্যিই এটা পুড়িয়ে ফেলতে চাইছ?”

অলকেশ বললেন, “ হ্যাঁ। এ বিষয়ে অনেক ভেবেছি আমি। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আমি চাইনা যে এটা আর কারও ক্ষতি করুক।”

পাণ্ডুলিপিতে আগুন ধরিয়ে দিলেন অলকেশ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার এই যে একটানা ১০ মিনিট ধরে আগুন জ্বললেও পাণ্ডুলিপিটি সম্পূর্ন অক্ষত রয়ে গেল। রয়ে গেল একটি হালকা সবুজ অপার্থিব আভা।

ব্যাপারটা দেখে সুবিমল ও অলকেশ এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে মিনিটদুয়েক তাঁরা কেউই পাণ্ডুলিপির থেকে চোখ সরাতে পারলেন না।

সুবিমলই প্রথম কথা বললেন, “এর মৃত্যুর জন্য এর কাছেই ইচ্ছা চাইলে কাজ হয়ে যেতে পারে। অলকেশ তুমি ―”

পাণ্ডুলিপির কাছে ফের ইচ্ছা চাইতে হবে শুনে অলকেশ পিছিয়ে গেলেন, “আমার ওই জিনিস ব্যবহার করার আর কোনও ইচ্ছে নেই। এই ইচ্ছের বদলে আমার প্রাণটাই না দিয়ে বসতে হয়।”

সুবিমল বললেন, “ঠিক আছে। আমিই নাহয় এ ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করছি।”

তিনি এগিয়ে গিয়ে পাণ্ডুলিপি স্পর্শ করে ‘বুক অফ ডেথ’-এর মৃত্যুকামনা করতেই ঘরটা কাঁপতে শুরু করল। পাণ্ডুলিপিটির ভেতর থেকে কতগুলি কালো অবয়ব বেরিয়ে গেল এবং অবশেষে পাণ্ডুলিপিটি সম্পূর্ণরূপে জ্বলে ছাইয়ে পরিণত হল।

এবং প্রায় তার সাথে সাথেই অলকেশ সুবিমলের দিকে তাকিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। 

সুবিমলের দেহটি ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যেতে লাগল। সুবিমলের হঠাৎই অনুবাদ দুটির কথা মনে পড়ে গেল। ‘বুক অফ ডেথ’ তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করে গেল। 

সুবিমল অলকেশের দিকে একটি চিরকুট এগিয়ে দিলেন। মৃদু হেসে তিনি সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।


সেদিনের শকটা কাটিয়ে উঠতে অলকেশের বেশ কিছুদিন সময় লেগে গিয়েছিল। সুবিমলের শেষ চিরকুটটি পড়ে তিনি যতটা না আশ্চর্য হয়েছিলেন তার থেকে হতবাক হয়েছিলেন অনেক বেশি। 

‘অলকেশ তুমি হয়ত জানোনা যে আমি আগে পুরাতাত্ত্বিক ছিলাম। কয়েক মাস আগে আমিই এই পাণ্ডুলিপিটি দিল্লিতে একজনের কাছ থেকে কিনে কলকাতায় নিয়ে আসি। এটার উপর রিসার্চ করার জন্যই জিনিসটা সংগ্রহ করেছিলাম। তবে আমার বাড়ি থেকে এটি চুরি হয়ে যায়। থানায় এফ আই আর করা সত্ত্বেও এটিকে আর ফেরত পাইনি আমি। এরপর মাসদুয়েক আগে এটাকে তোমার কাছে দেখার পরই আমি তোমার অলক্ষ্যে বইটির শেষ পৃষ্ঠাটি নিয়ে চলে আসি। সেটা যে কতবড় ভুল ছিল সেটা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝতে পারি। পাঠোদ্ধার করে জানতে পারি ওই পৃষ্ঠাতে মৃত মানুষদের কিভাবে দেখা যায় তার পদ্ধতি লেখা ছিল। এরপর আমার জীবন সত্যিই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। যেখানে যেতাম দেখতে পেতাম মৃত মানুষের দল। তাঁরা আমাকে যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে। ট্রেনে, বাসে, রাস্তায়, রেস্তোরাঁয় ― চারিদিকে মৃত মানুষের ভিড়। এই অসহ্য যন্ত্রণা নিরাময়ের একমাত্র উপায় ছিল মৃত্যু। ওই বুক অফ ডেথে অন্তত তাই লেখা ছিল। এর উপর এই বইয়ের ইচ্ছাপূরণ শক্তি কোনও কাজ করবে না। কিন্তু আত্মহত্যা করার মত সাহসও ছিল না আমার। এর একমাত্র উপায় একটাই।’

চিরকুটটি পড়ে অলকেশ টেবিলে পড়ে থাকা ছাইয়ের দিকে তাকালেন। টেবিলের নিচেও অল্প কালো ছাই পড়ে রয়েছে। ওটা বোধহয় ওই শেষ পৃষ্ঠারই অবশেষ। 

পাঁচশো টাকার একটি পাণ্ডুলিপি কেনার বেশ কড়া মূল্যই চোকাতে হল তাঁদের দুজনকে।

sav811998@gmail.com
কলকাতা

No comments:

Post a Comment