![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
টবের গন্ধরাজ
দেবাশিস দত্ত
- এখন থাকনা। ইদানীং তোর কাজের এত চাপ। আমার তো খুব কিছু অসুবিধা হচ্ছে না।
- না না, তুমি কাল সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই তৈরী হয়ে থাকবে। আমি কালকের দিনটা ছুটি ম্যানেজ করেছি। তাছাড়া এরপর আবার ডাক্তার বিশ্বাসও বেশ কিছুদিন থাকবেন না। তুমি আর কোনও দোনামনা কোরও না।
- হ্যাঁরে মেডিক্লেম পাবি তো? এখন তোর এত খরচ যাচ্ছে। তাই বলছিলাম আর কিছুদিন যাক না, তুইও একটু সামলে নে।
- পাব,পাব। তোমাকে বলেছি না ওসব নিয়ে একেবারেই চিন্তা না করতে।
- তুই না বললেই কি আর আমার চিন্তা দূর হবে রে? আমি তো তোর অবস্থাটা বুঝি।
দেশপ্রিয় পার্কের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে এইসব সাতপাঁচ ভাবছিল ঋতব্রত। অদ্ভুত মানুষ এই সরিৎশেখর। নির্বিরোধ, নির্লোভ, দুঃখে সুখে অচঞ্চল। একসময় বিরাট যৌথ পরিবারের যাবতীয় দায় সামলেছেন প্রায় একাহাতে শিক্ষকতার সামান্য রোজগারটুকু সম্বল করে। কখনও কোনও অভিযোগ করেন নি। কদাচিৎ দেখা গেছে তাঁকে উচ্চস্বরে কথা বলতে। মফস্বলের শিক্ষিত নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনধারা সচরাচর একটা নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যেই আবর্তিত হয়। এখানে যাপনের সুর ও স্বর নীচুতারেই বাঁধা থাকে। তাতে পৌণপৌনণকতার একঘেয়েমি নিশ্চিত থাকে, থাকে না যাত্রাপালার অতিনাটকীয়তা। সংসারের সব কিছুর সাথে সম্পৃক্ত থেকেও যেন তিনি স্পর্শের নাগালের বাইরে। এক নির্মোহ নিরাসক্তি তাঁর জীবনায়নে। তাঁকে শ্রদ্ধা করা যায় কিন্তু.....। সরিৎশেখরকে কখনোই ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি ঋতব্রত। মা যখন চলে যান ঋত তখন ক্লাস সিক্সে। মাত্র আগের বছরই পুরুলিয়ার মিশনে ভর্তি হয় সে। মারই আগ্রহ ছিল বেশী। সেভেনে উঠে বাড়িতে ফিরে আসতে চেয়েছিল ঋত। রাজী হননি সরিৎশেখর। মাসে একবার করে হোস্টেলে তাকে দেখতে যেতেন বাবা, কোনও কোনও মাসে দুবার। খুব বেশী কথা হতনা। গ্রীষ্মের, শীতের আর পূজোর ছুটিতে বাড়িতে ফিরত ঋত। তাছাড়া সে বাড়ি এসেছে কখনও সখনও কোনও পারিবারিক আচারঅনুষ্ঠানে। কখনও তা আনন্দের, কখনও বা বিষাদের। সেইসব আয়োজনে সরিৎশেখর কখনও নিষ্ঠাবান পুত্র, কখনও অসীম দায়িত্বশীল বড়দাদা। সেই দিনগুলোয় বাবার সাথে শারীরিক দূরত্ব হয়ত কমত, কিন্তু মনের পাঁচিল ভাঙত কি? বাবার ওপর রাগ হত? নাকি অভিমান? আজও এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে পায়নি সে।
মফস্বলের একান্নবর্তী পরিবারের আবহে তার বেড়ে ওঠা। সরিৎশেখর পরিবারের সব সদস্যের জন্য একটা অলিখিত 'কোড অফ কনডাক্ট' চালু রেখেছিলেন। বাড়ির কারোরই উপায় বা সাহস ছিল না সেই নিয়মের বেড়াজালকে অবজ্ঞা করার। বিজ্ঞানের শিক্ষকতার পাশাপাশি ছিল মুদ্রিত অক্ষরের মাধ্যমে এক বলিষ্ঠ আত্মানুসন্ধান। পরিবারের অত্যন্ত কাছের হয়েও তিনি যেন এক দূরের জ্যোতিষ্ক। শহরতলির সাবেককালের লম্বা বারান্দাওয়ালা একতলা বাড়ির সামনের ঘরটা ছিল তাঁর লাইব্রেরী। ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন ওই ঘরেই। পরিবারের একজন মাত্র নন,পরিবারের প্রধান তবু কেমন যেন মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন। সবের মধ্যেই আছেন কিন্তু সবার মধ্যে নেই। ইতিহাস, দর্শন, এবং অবশ্যই বিজ্ঞানের ব্যঞ্জনায় সৃষ্ট এক পৃথিবীর এক এবং একমাত্র নাগরিক। সেই ঘরের দক্ষিণের প্রশস্ত বারান্দায় তাঁর সঙ্গী রবীন্দ্রনাথ অথবা রম্যা রঁলা কিংবা লিও টলস্টয়। ঋত কদাচিৎ সেই ঘরে ঢুকেছে। পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে আশৈশব স্নেহ প্রীতির প্রবল জোয়ারে ভেসেছে ঋত। কিন্তু সেই জোয়ার কখনোই বন্যা হতে পারেনি। মাধুরীর অকালপ্রস্থানের পর সবাই চেয়েছিল ঋত ফিরে আসুক। কানে তোলেননি সরিৎশেখর। মিশনের নিয়মানুবর্তিতা ও স্বাবলম্বনের শিক্ষাকে অঅগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে যাদবপুর। পাঠ্য বইয়ের বাইরের কোনও পড়ালেখায় তেমন আকর্ষণ কোনদিনই বোধ করেনি ঋত। চেষ্টার ত্রুটি করেননি সরিৎ কিন্তু নিজের পৃথিবীর বাইরে এসে হোস্টেল নিবাসী মাতৃহীন সেই বালকের কতটুকু কাছে পৌঁছনোর উদ্যোগই বা ছিল তাঁর? নিজের কাছে জবাবদিহি করতে একরকম অস্বস্তি বোধ করেন সরিৎশেখর।
যাদবপুরের পরের ধাপগুলো ছিল ছকেবাঁধা। পিলানিতে এম টেক। প্রাইভেটে কয়েক মাস। চাকরি বদল।ভিলাইতে ফার্স্ট পোস্টিং। ট্রান্সফার। কলকাতা। বিয়ে। পাটুলীর ফ্ল্যাট। বিদিশা। এরমধ্যে শহরতলির সেই বাড়ীতে ঋত গেছে কয়েকবার মাত্র। ক্রমশই নিঃসঙ্গ হয়েছেন সরিৎশেখর। অবশ্য এটা ঋতর ধারণা। ওঁর মতো মানুষরা কি বড় একটা মানুষের সঙ্গ চান? এই প্রশ্ন সম্প্রতি ভাবায় জগৎনারায়ণ এইচ এস ইন্সটিটিউটের সেকেন্ড স্যারকেও। মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে মাধুরীর মায়ামাখানো মুখটা। স্কুলের অ্যানুয়াল ফাংশান থেকে সরস্বতীপূজো কোনকিছুই সুষ্ঠুভাবে হয়না, হতে পারে না সরিৎস্যারকে ছাড়া। তবুও সহকর্মীদের থেকে সম্ভ্রান্ত দূরত্বেই থেকেছেন তিনি বরাবর। শিক্ষকতা নামক পেশার, শিক্ষাজগতের অবক্ষয়কে প্রত্যক্ষ করেছেন নৈর্ব্যক্তিক নিরাসক্তি থেকে। ক্ষুব্ধ নয়,আহত হয়েছেন কিন্তু কোনও আলোচনায় যান নি। অংশ নেননি কোনরকম বিতর্কে। স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন বই আর পাণ্ডুলিপির দ্বীপরাজ্যে।
মাধুরীর ছবিটা পরিষ্কার করা হয়নি কতদিন। ঋতর মুখে মাধুরী বসানো। দীঘল চোখ, গোলাকৃতি চিবুক। ঠিক পঁচিশ বছর আগে এমনই এক বৃষ্টিমুখর রাতে চলে গিয়েছিল মাধুরী। আজ কিছুতেই মন থেকে সরে না চিন্তাটা। কদিন ধরেই অল্পস্বল্প পেটে ব্যথার কথা বলছিল মাধুরী। পাড়ার ডাক্তারবাবুর ওষুধে কমেওছিল কিছুটা। রবিবারের সন্ধ্যার পরপরই ব্যথা বাড়তে শুরু করল। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ। বাড়ির কেউ কেউ আভাসে বলেছিল কলকাতা নিয়ে যেতে। তখন সামনেই জয়েন্ট এন্ট্রান্স। পারিজাতদের ব্যাচটাও ছিল তুখোড়। দুদিন আগে কলকাতায় নিয়ে গেলে কি বাঁচানো যেত তাকে? পরদিন হোস্টেল থেকে ঋতকে নিয়ে এসেছিল ওর ছোটকাকা। ওর চোখেমুখে ক্ষোভ, হতাশা আর অবিশ্বাসের ভাষা পড়তে অসুবিধা হয়নি সরিৎশেখরের। বারো বছরের ছেলেকে সেই প্রথম বুকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন। বাহুবন্ধন শিথিল করে বালক ছুটে গিয়েছিল ছোটকাকার দিকে। মুখে বাড়ির কেউই কিছু বলেনি তাঁকে কিন্তু সবার সপ্রশ্ন চোখকে সেদিন এড়িয়েছিলেন সরিৎশেখর।
হর্ণের শব্দে সম্বিত ফেরে ঋতর। এত ভোরেও রাস্তায় এত গাড়ী। শরৎ বোস রোডে উঠে গতি বাড়ায় সে। জি পি এস দেখাচ্ছে এক ঘণ্টা বাইশ মিনিট। পিছন থেকে বাড়ানো স্যান্ডুইচে কামড় দিতে দিতে নিজের ভাবনার জালে আচ্ছন্ন হয় ঋত। মায়ের মুখটা মনে পড়ে। আবাল্য শুনে এসেছে মাতৃমুখী ছেলেরা নাকি সুখী হয় না। সুখী কি সে? মাত্র বারো বছর বয়সে হারিয়েছে মাকে। ততদিনে পিসিদের গোত্রান্তর হয়ে গেছে। শ্রীরামপুরের বাড়িতে ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল ছোটকা। কতবার এসেছে যাদবপুরের হোস্টেলে। যখনই আসত সঙ্গে থাকত অনাদির মোগলাই কিংবা বিজয়ী গ্রীলের ফিশফ্রাই। ডালহৌসিতে একটা প্রাইভেট ফার্মের অ্যাকাউন্টান্ট। হাসত আর বলত আমার মতো বেহিসেবী লোকের কি এইকাজ পোষায়? বহিসেবি তো বটেই। সেই ছোটকা কাউকে কিছু না জানিয়ে বিশ্বাসবাড়ির ছন্দাদিকে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে একদিন পাড়া ছাড়ল। প্রথমে শুনে বিশ্বাস করতে পারেনি ঋত। এমন তো কতই হয়। বাড়ি না ছাড়লেও তো চলত। মনের গহন কোণে বাবার বিরুদ্ধেই ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল। অনেকদিন পরে একটা চিঠি এসেছিল ওর হোস্টেলের ঠিকানায়। পূজোর ছুটিতে বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার আছিলায় পৌঁছে গেছিল সিন্ধ্রির সার কারখানার কোয়ার্টারে। চারপাশের জঙ্গল ঘেরা পরিবেশের মধ্যে ছোট সুন্দর বাসা। সামনের দরজায় লতানো বোগেনভিলিয়ার সমারোহ। ঋতকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিল ছোটকা। কাকিমা কম কথার মানুষ,যদিও আপ্যায়নের ত্রুটি ছিল না। দুদিনের মধ্যে কাছেপিঠে বেশ কিছু জায়গা ঘুরিয়েছিল ছোটকা। তার বেশী থাকা সম্ভব হয়নি। শ্রীরামপুরে চিন্তা বাড়ত। ফেরার দিনে ধানবাদে ট্রেনে তুলে হাতে জোর করে একটা একশ টাকার নোট গুঁজে দিয়েছিল ছোটকা। গলার কাছে কি একটা দলা পাকিয়ে উঠছিল। একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি ঋত। যতক্ষণ দেখা যায় প্ল্যাটফর্মে একজায়গায় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়েছিল দীপশেখর। এর অনেক অনেক বছর পরে একদিন যখন লাইব্রেরীঘরে নতমস্তকে বিদিশাকে জীবনসঙ্গী করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল ঋত, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অস্ফুটে বলেছিলেন সরিৎশেখর "দীপু একবার অন্তত আমাকে জানাতে তো পারত"। এক লহমায় এত বছরের জমে থাকা অভিমান ভেঙে খানখান হয়ে গেছিল ঋতর।
- ওই দেখ দক্ষিণেশ্বর মন্দির, হাত তুলে প্রণাম কর। বিদিশার নির্দেশ মেঘনাকে।
- ওই মন্দিরে কোন ঠাকুর আছে মা?
- মা কালী।
- ওই মন্দিরটাই রাণী রাসমণি তৈরী করেছিলেন?
- হ্যাঁ।
- রাণী রাসমণি, মথুরবাবু ওঁরা এখনও আছেন?
- বোকা মেয়ে, ওঁরা কবেই স্বর্গে চলে গেছেন।
- কি সুন্দর মা, কতগুলো মন্দির। বাপি চলনা মন্দিরে যাই।
- আজ হবেনা সোনা, দেরী হয়ে যাবে। ওদিকে দাদাভাইও তৈরী হয়ে থাকবে। পরে একদিন নিয়ে যাব। মেয়ের আবদার প্রশমিত করার চেষ্টা করে ঋত।
- তুমি কখনও গেছ ওই মন্দিরে?
- হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার।
- কবে বাপি?
- আমার ছোটবেলায়। তখন আমার মা, পিসিমারা মাঝে মাঝে দক্ষিণেশ্বরে পূজো দিতে যেত। সেই দিনগুলোয় খুব মজা হত। কখন যাব,কখন যাব এই ভাবনায় আগেরদিন রাতে ভালো করে ঘুম হতো না। সকাল হলেই মা আর ছোটকার তাগাদায় তাড়াতাড়ি চানটান সেরে তৈরী হয়ে যেতাম। সবাই মিলে ভোর ভোর পৌঁছে পূজো দিয়ে দ্বাদশ মন্দিরের মাঝের ঘাটে গঙ্গার জলে পা ভেজাতাম। ছোটকা শক্ত করে আমার হাত ধরে রাখত।
- বাঃ দারুণ তো। আর কি করতে বাপি?
- নৌকোয় চাপতে খুব ইচ্ছে করত। মাঝিরা বলত একটাকায় আধঘণ্টা ঘুরিয়ে দেবে কিন্তু মা কিছুতেই রাজী হত না। তবে আসল মজাটা হত তার পরে।
- কি সেটা বাপি?
- মন্দিরে ঢোকার সময় কোনও একটা দোকানে জুতো খুলে রেখে সেখান থেকে ডালা নিতে হত। পরে আবার সেখানে ফিরে এসে ছোলার ডাল দিয়ে গরম গরম কচুরী খাওয়া হত। তার স্বাদ যে কি অপূর্ব তোকে কি বলব।
- তোমরা সবাই মিলে যেতে বাপি?
- না দাদাভাই যেত না কখনও।
- কেন বাপি?
- দাদাভাই ওসব ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস করত না। বলতে বলতে ঋত ভাবে মেঘনাকে এটা বলা ঠিক হল কিনা।
ভিলাইতে ওর সহকর্মী ছিল সুপ্রতীকদা। জে ইউ। ওর চার বছরের সিনিয়র। আসানসোলের কাছে বরাকরে বাড়ি। প্রথম থেকেই খুব স্নেহ করত ওকে। হাতে ধরে সব কাজ শিখিয়েছে। সেবার পূজোয় জোর করে ধরে নিয়ে গেছিল ওকে। চারটে দিন খুব আনন্দে কাটল। ওরা দুভাইবোন। বিদিশার তখন হিস্ট্রি অনার্স ফাইনাল ইয়ার। এরপর ভিলাই আর বরাকরের দূরত্ব ক্রমশ কমতে শুরু করল। কিভাবে যেন ধীরে ধীরে এই পরিবারের সাথে একাত্ম হতে থাকল কৈশোরে মাতৃহীন ঋতব্রত। এম এ পাশ করে বিদিশা জয়েন করল দুর্গাপুরের এক প্রাইভেট স্কুলে। স্যালারি আহামরি কিছু নয়, তবে নামকরা স্কুল। ততদিনে সুপ্রতীকদা ভিলাইয়ের মেস ছেড়ে স্থান নিয়েছে ফ্যামিলি কোয়ার্টারে। কলকাতায় ট্রান্সফার পেল ঋত। বাড়ি ভাড়া নিল যাদবপুরে। সরিৎশেখর শুধু জানতে চেয়েছিলেন ওর সংসার চালাতে কোনও অসুবিধা হবে কিনা। বিদিশা এম এ তে ফার্স্ট ক্লাস শুনে চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
শ্রীরামপুরের সেই সাবেক আমলের বাড়িতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন সরিৎশেখর। লাইব্রেরীর দক্ষিণের বারান্দার পাশেই গন্ধরাজ গাছটা। পরম মমতায় গাছটার গায়ে হাত বোলান। মাধুরী লাগিয়েছিল এটা। ইদানীং শরীরটা প্রায়শই অসহযোগিতা করে। প্রেসার মাঝেমধ্যেই নামাওঠা করে। চোখেও ভালো দেখেননা আজকাল। তবু ছাড়তে মন চায় না চারপুরুষের ভিটে। ছাত্রছাত্রীরা সময় সুযোগমত খবরাখবর নেয়। একরকম ওদের ভরসাতেই এখানে এতগুলো বছর কাটিয়েছেন। এবার বোধ হয় ছেড়ে যেতে হবে এই গন্ধরাজের আশ্রয়। কদিন আগে ভোরবেলা হঠাৎই মাথাটা ঘুরে গেল। সাথে কপালময় বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফোন পেয়েই ছুটে এসেছিল অনির্বাণ। ডাক্তার অনির্বাণ রায়। ওনার স্কুলেরই ছাত্র। ইসিজি, রক্তপরীক্ষা সব ব্যবস্থা করেছিল কয়েক মিনিটের মধ্যেই। ইসিজিতে কিছু সমস্যা ছিল। ঋতকে ফোন করে অনির্বাণই। ঈদের ছুটি ছিল সেদিন। বেলা দশটার মধ্যেই পৌঁছল ঋত।
- তোমার আর এখানে থাকাটা নিরাপদ নয় বাবা। কলকাতায় চল আমাদের কাছে।
- এই বয়সে আর ঠাঁইনাড়া হতে ইচ্ছে করে না।
- বাবা এই বয়সে এভাবে একা থাকা যায় না। লোকেরাই বা কি ভাবে? এটাই নিশ্চিত ভাবে যে আমি তোমার দায়িত্ব নিতে চাই না। এবার অনির্বাণ সময়মত পৌঁছে গেছিল। তাই কোনও বিপদ হয়নি। সবসময় সেটা সম্ভব নাও হতে পারে।
- আমি এখন অস্তাচলের পথে। আমাকে নিয়ে বেশী ভাবিস না। আমার ছাত্রছাত্রীরা, প্রতিবেশিরা যথেষ্টই খেয়াল রাখে। এই ঘর, এই বারান্দা, এই গন্ধরাজ গাছ আমার সত্ত্বার অংশ হয়ে গেছে। তিল তিল করে গড়া এই লাইব্রেরী, এত্ত বই। ছেড়ে যাই বল কেমন করে? তাছাড়া আমাকে নিয়ে তোদের অসুবিধাই হবে।
- কেন ভাবছ আমাদের অসুবিধা হবে? আমি এখন কামালগাজির নতুন যে ফ্ল্যাটে গেছি সেখানে চারটে ঘর। কারোর কোনও অসুবিধা হবে না বাবা। চকিতে ঋতর মনে ঝিলিক দিয়ে যায় বহু যুগ আগের বিবর্ণ একটা ছবি। দক্ষিণের বারান্দার ঠিক পাশেই মা গন্ধরাজের চারা লাগাচ্ছে আর খুরপি হাতে মাটি সমান করছে ছোটকা। এত স্নেহ করে বাবা গাছটাকে।
পরের কয়েকদিন নানারকম ব্যস্ততায় কাটল। বেশ কয়েকবার এল ঋতব্রত। বেশিরভাগ বই দান করা হল স্কুলের লাইব্রেরীতে। ঝাড়াই বাছাই করে শপাঁচেক নিয়ে গেল ঋত দফায় দফায়। ব্যাঙ্ক, পোষ্টঅফিসের কাজ মেটাতে হল এরই মধ্যে মধ্যে। ছাত্রছাত্রীরা কটা দিন আগলে রাখল সরিৎস্যারকে।
- তোমাদের সব যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিয়েছ তো? গাড়ী চালাতে চালাতে প্রশ্ন করে ঋত।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
- একটা একস্ট্রা লাগেজ নিয়েছ তো শেষ দফার বইগুলোর জন্য?
- বলেছিনা ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
- দেখ বিদিশা আমি বইপত্র বিশেষ পড়ি না, কিন্তু বাবার জন্য কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে।
ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। ওরা পৌঁছে গেল শ্রীরামপুরের বাড়িতে। বারান্দায় চুপ করে বসে আছেন সরিৎশেখর। দৃষ্টি সুদূরে নিবদ্ধ। কি দেখছেন বা আদৌ দেখছেন কি কিছু? প্রায় নিঃশব্দে বাগানে নামে ঋত। এই বাড়িতে আর কি কোনও দিনও আসা হবে? ধীর পায়ে খানিক দূরে পাতাবাহার গাছটার নীচ থেকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখে সরিৎশেখরকে।
- এবার তৈরী হয়ে নিন বাবা মৃদুস্বরে আর্জি জানায় বিদিশা।
- আমি তো প্রস্তুত মা। মহাকালের আহ্বানকে অমান্য করার সাধ থাকলেও সাধ্য কোথায় বল?
- আপনার মনে এখন কি হচ্ছে বুঝতে পারি বাবা।
- তুমি "কোমল গান্ধার" ছবিটা দেখেছ মা?
বাবার কালির দোয়াত, ফাউন্টেন পেন গুছিয়ে নিতে নিতে বিদিশার মনে হয় কোনও একজন মানুষ নয় আসলে ছিন্নমূল একটা সময়কে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। তাকে স্পর্শ করা যায় না, পাওয়া যায় অনুভবে। একে একে এসে হাজির হল অনেকে। প্রতিবেশী, সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে বেরোতে বেরোতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। ফেরার পথে গাড়িতে সামান্যই কথা বললেন সরিৎশেখর। তারও সিংহভাগ নাতনির সাথে। কামালগাজির কমপ্লেক্সে যখন পৌঁছল গাড়ি তখন আকাশে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা।
এই ঘরটা আপনার বাবা। দেখুন তো বইগুলো ঠিক মত রাখা হয়েছে কিনা? বৃদ্ধ সরিৎশেখরকে সন্তর্পনে হাতে ধরে নতুন ঘরে পৌঁছে জিজ্ঞেস করে বিদিশা। চারতলায় পূব-দক্ষিণ খোলা মাঝারি মাপের ঘর। এখানে আকাশ বেশ নীল। কিছু দূরে ঝাপসা দেখা যায় একসারি টালির চালের ঘর। ছোট বড় পুকুরের পারে সার দিয়ে নারকেল গাছ। মফস্বলের গন্ধ মাখা। দাদাভাইকে ঘরের লাগোয়া দক্ষিণের একচিলতে বারান্দায় নিয়ে যায় মেঘনা। বিদিশা সেখানে তখন ব্যস্ত মাটির টবে শ্রীরামপুর থেকে আনা গন্ধরাজের কলম পুঁততে।
No comments:
Post a Comment