...অভিষেক ঘোষ
(১)
সেবার আমারও খুব
জ্বর হয়েছিলো, সেবা করার কেউ ছিলো না । ঊর্মি এসে বসেছিলো আমার মাথার কাছে, সারা বিকেল ।
সকলে নিশ্চই ওকে বলেছিলো, 'ঊর্মি ভাইরাল ফিভার, ছোঁয়াচে... !' ঊর্মি কিন্তু শোনে নি । তখন তো সবে ক'দিন হলো ওর সাথে
আলাপ, যার কপালে কেউ
কখনো হাত রেখে জ্বর মাপে নি, যার গোটা শরীর, সমস্ত মন একটা অদ্ভুত খিদেয় আগাগোড়াই জ্বলছে, একটা অলীক
স্বপ্নের মতো সেই তারই কাছে রাজকন্যা এসে বসলো যেন, বললো কত কথা । শব্দগুলো বরফের টুকরো হয়ে ঝরে
পড়লো রুগীর বিছানায়, ঘাম জমলো কপালে, নিমেষে জ্বর সেরে গেলো । সেদিন বুঝিনি, বোঝা অসম্ভব ছিলো, এই জ্বর ভোগাবে, কোনোদিন সারবে না
। বুঝি নি, নিজেকে এই যে জন্মলগ্ন থেকে বোঝানো, 'একা বেঁচে থাকতে শেখো প্রিয়....', তা সেদিনের পর
থেকেই অসংলগ্ন জ্বরে-ভোগা রুগীর প্রলাপে পর্যবসিত হবে !
(২)
নবোকভের 'লোলিতা'-য় কীসব
উরুসন্ধির আগুন ফাগুন ছিলো, না ! ঊর্মি তাহলে কী ?
আর কেন ? কারণ ওর এনে
দেওয়া এই জ্বরটা শুধু শরীরে নয়, মনেও বিকার এনে দিয়েছিলো ! আগে ভাবতাম, হৃদয়ে আমার
কেবলই শীত ঋতু-র বসবাস, 'প্রেম' শব্দটা নিজেরই কাছে অন্ধকার থেকে ভেসে আসা
বিদ্রূপের মতো শোনাতো । একা থাকাটা উপভোগই করতে শুরু করেছিলাম বলা যায় । আমার
বন্ধু বলে মনে হতো না কাউকে, খালি মনে হতো সব সম্পর্কই দরকারের, প্রয়োজনের ।
স্ব্ভাবতই লোকে এড়িয়ে চলতো আমায় । তবু কিছু আমারই মতো হাভাতে জুটেছিলো !
তথাকথিত বন্ধুদের আড্ডায় ইতর ইয়ার্কির মধ্যেও মনে হতো, প্রজনন ও তার আনুষঙ্গিক সব কিছুই জৈবিক
প্রয়োজন-মাত্র - তার অধিক কিছু নয় । কিন্তু তারপর ঊর্মি এলো, তুফান উঠলো, বুকে ঘোর তরঙ্গ
তুললো, পাষাণে প্রাণ
জাগলো, হৃদয়ের
জাহাজ-ডুবি হলো, কোথাও সশব্দে মূ্র্খের আত্মাভিমানের কাচের দুর্গ খানখান হয়ে ভেঙে পড়লো, তার শব্দ শুনতে
পেলাম । ওমা ! তারপর হঠাৎ দেখি আমার কতকগুলি অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় গজিয়েছে - এই যে
এতকাল জড়বস্তুতুল্য আমি, স্বার্থপরের মতো নিজেকে আগলে বেঁচে এসেছি, তারও নাকে ফুলের
সুবাস আসছে, কানে আসছে পাখির ডাক, ত্বকে সূর্যের আলো পড়লে, তা অনুভব করার
ক্ষমতাও তাহলে এই হতভাগার আছে ! আর ঊর্মি ! সে যেন সুইস আল্পস থেকে ক্রমশ হয়ে
উঠতে লাগলো উত্তর বাংলার চেনা পাহাড়, যে বরফ-গলা ঝরণা-কে দূর থেকে মনে হতো বিপজ্জনক, দেখা গেল তার
জলেও ঝাঁপিয়ে পড়া যায় ! চিরকাল কবিতা এড়িয়ে গেছি, বোঝা তো দূরের কথা, উপমা-অনুপ্রাস মাথায় বোঝা বলেই ঠেকেছে । আর
এখন ! ঊর্মির বাড়িতে পিয়ানো আছে, একদিন সারা বেলা শুনিয়েছিলো সে । মনে হলো, পিয়ানো-তে
ক্ষণেক্ষণে যে সুর-টা বেজে ওঠে আর সেই সুরের অভ্র-কণা গায়ে মেখে যে মেয়েটি চোখের
সামনে চলে-ফিরে বেড়ায়, ওই সুর আর ওই জীবন্ত সুরা, উভয়ের যৌথ
প্রয়াসে হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর বল্গাহরিণ ছুটে বেড়াচ্ছে । হায় ! এসব
ভাবতে বসলেই, একটা পুরনো বাতাস ঢুকে পড়ে মনের গোপন ঘরে, সব হিসেব এলোমেলো করে দেয় । অনিচ্ছুক স্মৃতিগুলো ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায়, বুক চিনচিন করে
ওঠে । বুকের ভেতর ক্রীসমাস চলছিলো । এই পরিবর্তন... প্রথম প্রথম একেবারে অসহনীয়
বলে মনে হতো । কিন্তু দেখলাম, ফুল ফুটলে গাছের ভালোই লাগে ।
(৩)
স্বভাবতই এরপরই
প্রশ্ন আসে, এত করে বলছি যার কথা, যার কথা ভেবে হৃদয় খুঁড়ে অন্তহীন বেদনা জাগিয়ে
তুলছি, সে কেমনধারা
মানুষ ! সত্যি বলতে তা আমিও জানি না । জ্বরতপ্ত মানুষ যেমন টের পায় না, কখন কে তার কপালে
জলপট্টি দিয়ে গেল, শুধু একটা শীতলতার অনুভূতি জাগে মাত্র, ঊর্মি আমার জীবনে
অমনই ছিলো — খুব বেশি দিন যে, তাও তো নয় ! কোনো এক বিকেলে দুর্গা পুজোর
ভাসানে মাতালের মতো নাচছিলাম পুকুরঘাটে, দুপাশে ভিড় করে আমোদ লুটছিল অসংখ্য নারী-পুরুষ, বাচ্চা-কাচ্চা ।
প্রতি বছরই এমনটা হয়ে থাকে — আমরাও বয়সগুণে একটু বাড়াবাড়ি করে থাকি এইসব দিনে ।
কিন্তু সেই দিনটা ছিলো আলাদা, কারণ সেদিন জনসমুদ্রে ঊর্মি ছিলো । নাচতে নাচতে
ঘেমে নেয়ে যখন মুখে ফেনা ওঠার উপক্রম, তখনই সূর্যাস্তের আলোয় সেই ঢেউ দেখলাম —
ফসফরাসের মতো পড়ন্ত আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো ক্ষণে ক্ষণে ! ইচ্ছে করছিলো ছুঁয়ে দিই
— অনেকবার একটা সুযোগ নিতে খুব কাছাকাছি চলে যাচ্ছিলাম । কিন্তু কোথাও যেন একটা
আভিজাত্য ছিলো — অনাহূত স্পর্শ যেন তাকে কলুষিত করে দিতে পারে ! যখন উপায় খুঁজছি —
তখনই বিসর্জন ও আবাহন দুইই একসাথে ঘটলো... । আমার হাত ছিলো প্রতিমার দড়িতে । 'আসছে বছর.. আবার
হবে'- ধ্বনিতে প্রতিমা
সপরিবারে কাঠমা-সহ জলে ঝুলে পড়তেই বাম হাতের উপরদিকে, কনুইয়ের কিছুটা উপরে,
তীব্র জ্বালা অনুভব করলাম
। তাকিয়ে দেখি সেই মেয়েটা — মনে হল আমি যেন এক নাম-না-জানা নক্ষত্রের ছায়াপথে
প্রবেশ করেছি হঠাৎ । তারপর সে নিজেই আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেল । আমি কি সৌভাগ্যবান
যে আমার বাহুতেই ওর কানের দুল বিঁধলো ! আর এতটাই বিঁধলো যে সোজা ওর বাড়ি চলে গেলাম
! সেখানে কেউ বলে ‘আহারে’, কেউ বলে ‘বেচারা’, ঊর্মির মা বললেন, “কি যে করিস না তুই - বুঝিনা !” ঊর্মি ম্লান
হেসো বললো, “খুব জ্বলছে না ? ইস্ আজকের দিনে... আপনি প্লিজ বসুন, আমি ডেটল লাগিয়ে
দিচ্ছি ।” কিন্তু ঊর্মি টের পায় নি, আমার শরীরের তাপমাত্রার পারদ চড়ছিলো । আমি কেমন
অসংলগ্ন বকছিলাম — কোনোমতে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম । বারবার চোখে ভেসে উঠছিলো ওই
প্রশস্ত কপাল, স্বাভাবিকের তুলনায় কিঞ্চিত বড়ো দুটো চোখ, গভীর চাহনি, তার পর নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম সাইকেলে ।
খালি চক্কর কাটছিলাম ওর বাড়ির আশেপাশে, মনে হয়েছিলো এটাই তো স্বাভাবিক — নক্ষত্রের
আশেপাশে চক্কর কাটাই যে আমার মতো উপগ্রহের কাজ । কিন্তু সেই নক্ষত্র আমায় চিনে
ফেললো, কাছে টানলো । আমি
আমার কাঙ্ক্ষিত কক্ষপথ সেদিন খুঁজে পেলাম । পরের কয়েকদিনে আমার জানা হয়ে গেল, ওর বইয়ের তাকে
কারা কারা থাকে । সেখানে ‘শেষের কবিতা’-র পাতার ভাঁজে আবিষ্কার করলাম পুরনো একটা
চিঠি — কোনো অর্বাচীন প্রেমিকের । ঊর্মি দেখে উদাসীন ভঙ্গিতে বললো, “কাজ নেই কর্ম নেই, খালি মেয়েদের
চিঠি লেখা !” আমি ভেবে দেখলাম, আমার তো এখন অনেক কাজ ! ওর বইয়ের তাক পরিষ্কার
করতে গিয়ে একদিন পেলাম, ‘বিবর’ । মনে মনে স্থির করলাম, বইটা ভ্যানিস করে
দেবো — এসব বই পড়লে মেয়েদের সমূহ অকল্যাণ, সঙ্গে পুরুষেরও । কিন্তু ঊর্মি জানতে পেরে বললো, “তিনবার পড়েছি, ধুলো ঝেড়ে ভালোই
করেছো — তিনবারে শত্রু হয় — আরেকবার পড়তে হবে !” আমি হতভম্বের মতো চেয়ে রইলাম ।
একদিন ওর বাড়িতে ইউনিভার্সিটি-ফেরতা গিয়ে পড়েছিলাম, সেদিন বাড়ি ছিলো ফাঁকা । ও নিজের হাতে শশা আর
আপেল কেটেছিলো । ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিলো, আমি বারান্দার দড়ির দোলনায় বসে দুলছিলাম ।
ঊর্মি এসে কাঁটা চামচে খাইয়ে দিতে লাগলো — আমি সেই ছেলেবেলায় অমনভাবে দোলনায় দুলতে
দুলতে মায়ের হাত থেকে ছোঁ মেরে খাবার মুখে
নিয়ে, দোলনায় দুলতে দুলতে সরে যেতাম — ঊর্মি সেই স্মৃতি ফিরিয়ে দিলো । সেদিন বাড়ি
আসার পর জ্বরটা আরো বাড়লো । বেঁচে থাকার আনন্দে মানুষ যেমন বুঝতে চায় না, প্রতিটি জন্মদিনই
আসলে মৃত্যুর আরো নিকটবর্তী হওয়া, ঠিক তেমনি আমিও বুঝতে পারছিলাম না আমি জ্বলে
যাচ্ছি — নক্ষত্রের বুকে ঝলসে যাচ্ছি । বড্ড কাছে চলে এসেছিলো ও... পুড়ে যাওয়ার মতন
কাছে । দারুণ সুখে ছিলাম — মনে হয় নি, আমি ওর যোগ্য নই, এত সুখ ধর্মে সইবে না । ঠিক তাই হলো — সেদিন
বিরোধী পার্টির ডাকা ধর্মঘট ছিলো — সরকার কঠোরভাবে বিপক্ষ দলের সমস্ত সমাবেশে জারি
করেছিলো নিষেধাজ্ঞা । আমরা হাঁটতে বেরিয়েছিলাম । আমার সুনসান ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে
দারুণ লাগে । বাতাসে ছিঁড়ে গিয়ে রাজনৈতিক বিজ্ঞপ্তিগুলো পতপত শব্দ করে উড়ছিলো, সাইরেনের শব্দ
শোনা যাচ্ছিলো মৃদু । মোড়ের মাথায় ও ছুটে পেরিয়ে গেল সড়ক — এবার আমার পালা । সমস্ত
মনোযোগ তখন ওর দিকে — ঊর্মির শাড়ির আঁচল তখনো হাওয়ায় অধরা মাধুরী হয়ে ভেসেছিলো — আমার
হাত আপনা থেকেই এগিয়ে চলেছিলো — সঙ্গে পা-দুখানা-ও । কোথাও রাজনৈতিক শ্লোগান ভেসে
আসছিলো বাতাসে, হয়তো ছিলো পথবাসী শিশুর ক্রন্দনও তাতে মিশে । আমি খেয়াল করি নি — খেয়াল করা
সম্ভব ছিলো না বলেই — নয়তো কেউ পুলিশের জিপে চাপা পড়ে ! কিন্তু কিছুই বোধগম্য হয়
নি বহুক্ষণ ! আমার মনে হচ্ছিলো কীসের এত হইচই ! ঊর্মি-ই বা দুহাতে মুখ ঢেকে অমন
আকুল হয়ে কাঁদছে কেন ! কেন-ই বা ওর হাত, শরীর অত কাঁপছে ! পুলিশ, মিডিয়া -সব এলো ।
ঊর্মি-কে অনেকে প্রশ্ন করতে লাগলো । আমি তীব্র আপত্তি জানালাম । একজন রিপোর্টার
-কে ধাক্কা দিয়ে দিচ্ছিলাম প্রায় । কিন্তু আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, কেউ ভ্রূক্ষেপও
করছে না । আর আমার কানে হঠাৎ আর কোনো শব্দ আসছিলো না । ঘটনাগুলো ঘটছে, দেখতে পাচ্ছি
কিন্তু কেউ যেন স-অ-অ-ব মিউট করে দিয়েছে ! আমি বার চারেক বললাম, “ঊর্মি কী বললে ?” কথাগুলো কেন ওর
কানে ঢুকছে না বুঝতে পারছিলাম না । আমিই বা বধির হয়ে গেলাম নাকি ! বাবা ছেলেবেলায়
শিখিয়েছিলো, কীভাবে কান বন্ধ হয়ে গেলে নাক চেপে দুই কান দিয়ে বাতাস বের করে দিতে হয় । মা
হেসে বলতো, “আরেকবার চেষ্টা করো, ঠিক হয়ে যাবে ।” অনেকবার চেষ্টা করলাম কিন্তু
নিজেকে কেমন ফাঁপা ফাঁপা লাগছিল — মনে হচ্ছিলো আমিই বাতাস । তারপর ভ্রম ভাঙলো যখন
স্পষ্ট দেখলাম, ঊর্মি আমাকে ভেদ করে বেরিয়ে চলে গেল — লাল বাতি জ্বলা গাড়িতে উঠে বসলো —
শব্দহীন রাজপথে গ্রহণ লেগে গেলো আমার উপগ্রহ-শরীরে ।
(৪)
আমাদের বাড়িতে
একখানা চীনামাটির বেলনাকার ফুলদানি ছিল, তাতে আঁকা ছিল এক নারীর ছবি — যার বসনপ্রান্ত
উড়ছে, পাত্রটা ঘুরিয়ে
ধরলে একটি পুরুষের ছবি — যার হাত বাড়ানো রয়েছে সামনের দিকে । কিন্তু চিরবিষাদ
ছড়িয়ে ছিলো পাত্রটির ছবিটাতে — কারণ কেউ কোনোদিন ঐ বেলনাকার পাত্রের গায়ে একে
অপরকে ছুঁতে পারবে না । ঊর্মি কখনো ভাবিনি, আমাদের পরিণতিও
অমন হবে ! কিন্তু শব্দশূন্য অবস্থাতেও আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম এই ভেবে যে, তোমার গলিত সোনার
মতো মুখখানি আমি প্রাণভরে এখনো দেখতে পাচ্ছি । তোমার দু-চোখে বিশ্বাস খুঁজছিলাম
তখনো, আমার প্রতি
অপেক্ষা খুঁজছিলাম । সেই যে সাইকেলে চক্কর কাটতাম তোমার বাড়ির চারপাশে, সেই দিনগুলো
বোধকরি আবার ফিরে এলো । কিন্তু ক্রমশ আমার হিসেব গুলিয়ে যেতে লাগলো, সময়ের এবং
স্থানের । বুঝতে অসুবিধা হতে লাগলো যে আমি কোথায়, কতক্ষণ আছি । অনুভব করলাম আমার আর কোনো জৈবিক
তাড়না নেই — ক্ষিদে নেই, তেষ্টা নেই, শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন নেই, রেচন নেই, ক্লান্তি নেই, এমনকি সবচেয়ে
ভয়ানক যেটা — অনুভূতি বলেই কিছু নেই । যেন একটা ছিপি আঁটা বোতলে শক্ত করে বন্ধ করে, আটকে রাখা হয়েছে
আমার সমস্ত আবেগ আর অনুভূতি । কোথাও কিছু বাকি নেই, শুধু তুমি আছো — ঠিক যেমন ঐ পাত্রের গায়ে
পুরুষটি চিরকাল হাত বাড়িয়ে থাকবে তার অধরা প্রেয়সীর প্রতি,
তেমনি আমিও তোমার দিকে
এমনই চেয়ে থাকবো অনন্তকাল... । কিন্তু দ্রুত ভুল ভাঙলো — আমি বহুক্ষণ ধরে তোমার
মুখের ওপর থেকে এলোমেলো চুলগুলি সরিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিলাম — কিন্তু
আমার হাত বিশ্বাসঘাতকতা করে চলেছিলো । তুমি থেকে থেকে ফুলে ফুলে উঠছিলে । বুঝলাম
কাঁদছো, ঝড়ের মাঝে পাখি
যেমন কাঁদে । দেখলাম তোমার মা তোমাকে স্নান করালেন, আমার কোনো অনুভূতি হচ্ছিলো না — কেবল ভাবছিলাম
জলের ফোঁটাগুলো কেমন তোমার নগ্ন ত্বক বেয়ে আপন খেয়ালে হারিয়ে যাচ্ছে ! দেখতে দেখতে
আমার মনে পড়ছিলো এক রাত্রের কথা, তখনো তোমায় সেভাবে পাই নি । একটা স্বপ্ন
দেখেছিলাম সেই রাত্রে — আমি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলাম — রাস্তাটা সম্পূর্ণ সবুজ ।
হঠাৎ মনে হলো প্রতিটি পথচারী আমার দিকে থমকে দেখছে — আমি ভয় পেলাম — দৌড়তে লাগলাম
জোরে । কিন্তু দেখলাম আগে-পিছে-ডাইনে-বাঁয়ে সবাই আমার দিকে দৌড়চ্ছে । আমি সামনের
দিকে সর্বশক্তি নিয়ে দৌড়চ্ছিলাম — সহসা দেখলাম, সামনের রাস্তাটা ভাঁজ হয়ে আমাকে একটা সবুজ থলির
মধ্যে বন্দি করে ফেলছে — আমি চিৎকার করতে চেষ্টা করলাম — অনেকবার — কিন্তু আমার
গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুলো না । সেদিন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখেছিলাম, আমার শরীরে
বিন্দু বিন্দু ঘাম ঠিক তোমার স্নানরতা শরীরে আজকের জলবিন্দুর মতোই ঝরছে । বিশ্বাস
করো তোমায় খুব ডাকতে ইচ্ছা করছিলো অনেকক্ষণ — যাকে আমরা ইচ্ছা বলে চিনি, আজ তার কিছুই আর
অবশিষ্ট নেই — শুধু ঐটুকু ছাড়া । কিন্তু একি ! আমার চোখের সামনে সবকিছু ধীরে ধীরে
এমন বর্ণহীন হয়ে যাচ্ছে কেন ! উফফ্ আজ মানুষের শরীরে থাকলে বলতাম, “ঈশ্বর” ! কিন্তু
নাহ্ এক বোধশূন্য অহেতুক চেয়ে থাকাই দেখছি আমার ভবিতব্য । ক্রমশ সমস্ত, সবকিছু ফিল্মের
নেগেটিভের মতো হয়ে গেল । আমার আর কিছুই করার ছিলো না — চেয়ে থাকা ছাড়া ।
(৫)
ঊর্মি, আমি জানি তোমার
জ্বর হয়েছে । এই অদ্ভুত বিকৃত দৃষ্টিতেও বুঝতে অসুবিধা হয় নি, তোমার মা, তোমার বোন ও
অন্যান্যরা একটি থার্মোমিটার নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন — জ্বর মাপছেন । আমি চেয়ে থাকি, বোঝার চেষ্টা
করতে থাকি যে, তুমি আমায় ডাকছো কিনা । আমার কেমন মনে হচ্ছিলো তুমি যদি আমায় একবার, শুধু একটিবার
জোরে, চিৎকার করে ডাকো, আমি আবার মানুষ
হয়ে যেতে পারি ! ডাকো না ঊর্মি, ডাকো না আমায় ! এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি তুমি
সোজা তাকিয়ে আছো — আমার দিকে — কিছু বলছো ঊর্মি ? তোমার ওষ্ঠাধরে কোনো শব্দ কি উচ্চারিত হলো ? আমি চেয়ে আছি —
কী বললে ! আর একটু জোরে বলো ঊর্মি । ধীরে বলো । কী বললে ?
না — এ হতে পারে না ।
তুমি এ কথা আমায় বলতে পারো না ! আমি বুঝতে পেরেছি তোমার ঠোঁঠের রেখা থেকে বাতাসে
কোন্ কুঠার ঠিকরে বেরুলো ! তুমি আমাকে চলে যেতে বলছো ঊর্মি ? আমি চলে যাবো !
তোমার ফিল্ম নেগেটিভের মতো বর্ণ-বিপর্যস্ত ঠোঁট উচ্চারণের অনড় জেদে স্ফীত ও অবারিত
হয়ে রয়েছে — আমি বুঝেছি তোমার তর্জনী উঁচিয়ে রেখেছো আমার দিকে — ইশারা স্পষ্ট । কে
না জানে, ক্রোধ
দুর্বিনীত-ই হয় । আমি চেয়ে থাকি আর অনুভব করি আমার লজ্জা ফিরে আসছে — ভয়, আমার জ্বর ফিরে
আসছে — পরাজয় — আহ্ মুক্তি ।
abhisek1988ghosh@gmail.com
কলকাতা
No comments:
Post a Comment