ছবি : ইন্টারনেট |
বিস্মৃত বিপ্লবী - শ্রী দীনেশচন্দ্র মজুমদার
অর্ণব ব্যানার্জী
পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য বাংলার যে সকল দামাল ছেলেরা প্রতিনিয়ত নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের নাস্তানাবুদ করে তুলেছিল, সেই সমস্ত দুঃসাহসী বিপ্লবীদের মধ্যে অধিকাংশের নামে আজ বিস্মৃতপ্রায়। এই সমস্ত বিস্তৃত বিপ্লবীদের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া এক তরতাজা তরুণ বিপ্লবী হলেন শ্রী দীনেশ চন্দ্র মজুমদার। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিযুগের শহীদ এই বিপ্লবী একাধারে ছিলেন অসীম সাহসী, অকুতোভয় এবং ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের এক তরুণ সৈনিক।
১৯০৭ সালের ১৯-শে মে ( বাংলার ৫-ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৪ বঙ্গাব্দ ) উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে দীনেশ চন্দ্র মজুমদারের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার এবং মাতা বিনোদিনী দেবী। পূর্ণচন্দ্র এবং বিনোদিনী দেবীর চার ছেলের মধ্যে দীনেশ ছিলেন মেজো।
দীনেশ চন্দ্রের ছাত্রজীবন শুরু হয় বসিরহাট হাইস্কুলে। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর জীবন কেটেছে নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। মাত্র চার দিনের জ্বরে বাবা পূর্ণচন্দ্র মজুমদারের অকাল মৃত্যুতে চার ভাইকে নিয়ে অকুলপাথারে পড়লেন মা বিনোদিনী দেবী। পিতার মৃত্যুর পর দারিদ্র্য আর নিঃসীম অন্ধকারের বিরুদ্ধে শুরু হয় দীনেশের মা বিনোদিনী দেবীর অসীম সংগ্রাম । তবুও স্রোতের প্রতিকুলে সংগ্রাম করে বসিরহাট হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষা ( আই.এ. )-য় উত্তীর্ণ হন দীনেশ। এরপর সাফল্যের সঙ্গে সিটি কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করার পর ১৯২৮ সালে বি.এস.সি. পাস করেন । এরপর শুরু হয় তাঁর আইন নিয়ে পড়াশোনা।
১৯২১ সাল থেকে যে সমস্ত বিপ্লবী দলের কার্যকলাপ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তিকে আলোড়িত করেছিল তার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য দুটি বিপ্লবী দল ছিল পূর্ববঙ্গের ‘ অনুশীলন সমিতি ’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘ যুগান্তর দল ’। আই.এ. পড়ার সময় থেকেই প্রতিবেশী বিপ্লবী অনুজাচরণ সেনের মাধ্যমে দীনেশ চন্দ্রের যোগাযোগ হয় এই ‘ যুগান্তর ’ বিপ্লবী দলের সাথে। বিখ্যাত বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী ছিলেন তাঁর বৈপ্লবিক জীবনের দীক্ষাগুরু ; তাঁর কাছ থেকেই দীনেশচন্দ্র শিখেছিলেন বিপ্লবের আদর্শবাদ, নিয়েছিলেন বিপ্লবের পাঠ।
ছাত্রাবস্থাতেই তিনি বিপ্লবীনেতা বাঘাযতীনের সংস্পর্শে আসেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঘাযতীনের নেতৃত্বে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময় বালেশ্বরের গুপ্ত ঘাঁটির পরিচালক শ্রী শৈলেশ্বর বসু যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলে দীনেশ চন্দ্র , অনুজাচরণ সেনের সঙ্গে রাত জেগে তাঁর সেবা করেন। আই.এ. পড়ার সময় থেকেই শুরু হয় তাঁর নিয়মিত শরীরচর্চা এবং যোগাভ্যাস। এরপর যুগান্তর দলে যোগদানের পর শুরু হয় তাঁর লাঠি ও ছোড়া চালনার শিক্ষাপর্ব। ধীরে ধীরে দীনেশ হয়ে ওঠেন দেহে-মনে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর এক আদর্শ লাঠিয়াল। সেসময় যুগান্তর দলের পক্ষ থেকে সিমলা ব্যায়াম সমিতিতে ছাত্রী সঙ্ঘের মেয়েদের লাঠি খেলা শেখানো হত। দলের পক্ষ থেকে এই ভার দেওয়া হয় দীনেশ চন্দ্রকে। এখানেই তাঁর আলাপ হয় বিপ্লবী কমলা দাশগুপ্তের সঙ্গে। দীনেশ চন্দ্রের সংগ্রামী মনোভাবের কারণে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি দীনেশকে স্নেহশীলা দিদির মতো আপন করে নেন তিনি। শুধু কমলা দেবীর কাছেই নয়, তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্ব , দক্ষতা এবং নিষ্ঠার গুণে দীনেশ চন্দ্র শীঘ্রই যুগান্তর দলের এক জনপ্রিয় নাম হয়ে ওঠেন ; যে দলের মধ্যে ছিলেন কল্যাণী দাস ( ভট্টাচার্য ) , শান্তিসুধা ঘোষ ( পরবর্তীকালে হুগলী মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ ) , সুলতা কর , নলিনী দেবী , লীলা কামলে , আভা দে , সুরমা মিত্র ( ছাত্রী সংঘের সভাপতি ) , সুহাসিনী দত্ত , কল্পনা দত্ত এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মতো বীরাঙ্গণা মহিলা সদস্যেরা।
এরপর দলনেতার নির্দেশে তিনি বগুড়া ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় বিপ্লবী সংগঠনের কাজে হাত লাগান। পরবর্তীকালে তাঁকে দলের পক্ষ থেকে তাঁর জন্মস্থান বসিরহাটে পাঠানো হয়। এখানে আসার পর ডঃ যতীন্দ্রনাথ ঘোষালের সক্রিয় সহযোগীতায় দীনেশ চন্দ্র , নিবেদিত প্রাণ দেশপ্রেমিক যুবকদের একত্রীকরণ এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। ওইখানকার স্টেট ব্যাংকের তৎকালীন পুরানো বাড়ির মাটির নীচের একটি ঘরে দীনেশের উদ্যোগে একত্রিত হন সাহসী যুবকরা। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল তরুণ বিপ্লবীদের নিয়ে একটি গোপন ও প্রশিক্ষিত দল গঠন করা , যারা মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের জন্য আদর্শ এবং দেশপ্রেমের উচ্ছ্বাসে অনুপ্রাণিত হবে।
১৯৩০ সালে দীনেশ চন্দ্র বসিরহাটে ‘ জাতীয় পাঠাগার ’ এবং ‘ ব্যায়ামপীঠ ( যোগ কেন্দ্র ) ’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ব্যায়ামপীঠ আসলে ছিল তরুণ বিপ্লবী সৈন্যদের তালিকাভুক্ত করার একটি গোপন কেন্দ্র । এখানে আগ্নেয়াস্ত্র, লাঠি,ছুড়ি প্রভৃতি চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এমনকি এখানে বোমা তৈরীর অনুশীলনও করা হত ।
বাংলা মায়ের এই দামাল সন্তানের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কলকাতার তৎকালীন নৃশংস পুলিশ কমিশনার চার্লস অগাস্টাস টেগার্টের উপড় বোমা নিক্ষেপ। ঘটনাটি ঘটে ১৯১৯ সালের ২৫-শে আগস্ট। ঐদিন দীনেশ তাঁর দুই সহযোগী শৈলেন নিয়োগী এবং অনুজাচরণ সেনকে নিয়ে উপস্থিত হন কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে। এরপর সেখানে টেগার্টের গাড়ি এসে উপস্থিত হলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐ গাড়ি লক্ষ্য করে বোমাটি নিক্ষেপ করেন দীনেশ চন্দ্র মজুমদার। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায় চার্লস টেগার্ট। দলের পক্ষ থেকে আগেই নির্দেশ দেওয়া ছিল দীনেশের বোমা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে উল্টোদিক থেকে বোমা নিক্ষেপ করবেন অনুজা সেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার আগেই বোমাটি তাঁর হাতে ফেটে যায় এবং তৎক্ষনাৎ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন অনুজা সেন। এই ঘটনার পর দীনেশের অপর সহযোগী শৈলেন নিয়োগী ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও দীনেশ ধরা পড়ে যান। একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিচার হয় এবং IPC-র 307/120B , 307/34 ,4B , 3(6)-এর ধারায় বিস্ফোরক দ্রব্য রাখার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শাস্তি স্বরূপ তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে মেদিনীপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়।
এই ঘটনার পর পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য বিপ্লবীদের খানাতল্লাশি শুরু করে এবং বহু লোককে গ্রেফতার করে এই ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে শোভারাণী দত্ত, কমলা দাশগুপ্ত, শৈলরাণী দত্ত , ডঃ নারায়ণ রায় , ভূপাল চন্দ্র বসু , অদ্বৈত দত্ত , অম্বিকা রায় , রসিকলাল দাস , সতীশ ভৌমিক , সুরেন্দ্রনাথ দত্ত , রোহিনী অধিকারী সহ বহু বিপ্লবী গ্রেপ্তার হন। বিচারে নারায়ণ রায় এবং ভূপাল বসুকে ১৫ বছরের দ্বীপান্তর, সুরেন্দ্রনাথ দত্তকে ১২ বছর , রোহিনী অধিকারীকে ৫ বছর এবং সতীশচন্দ্রকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি অভিযুক্তদের মুক্তি দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য , এই ঘটনায় অভিযুক্ত অধিকাংশ বিপ্লবীরাই ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক।
এদিকে মেদিনীপুর জেলে কিছুদিন থাকার পর দীনেশকে আন্দামানে পাঠানোর প্রস্তুতি শুরু করে ব্রিটিশ সরকার ।১৯৩২ সালের ৮-ই ফেব্রুয়ারী দীনেশ ঐ জেলেই বন্দী অন্য দুই বিপ্লবী শচীন করগুপ্ত এবং সুশীল দাশগুপ্তের সাথে রাতের অন্ধকারে মেদিনীপুর জেলের লৌহকপাট গলে উঁচু প্রাচীর টপকে জেল থেকে পালিয়ে যান । তবে এই পরিকল্পনা সফল হলেও উঁচু প্রাচীর টপকানোর সময় দীনেশের পা ভেঙে যায়। এই দুঃসাহসিক ঘটনা জানাজানি হলে চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়। দীনেশের নামে হুলিয়া ঘোষণা করা হয় যে , ধরিয়ে দিতে পারলে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়া হবে । এরমধ্যে বক্সা, হিজলি ও মেদিনীপুর জেল থেকে পালানো বেশিরভাগ বিপ্লবীরা ধরা পড়ে গেলেও ধরা পড়লেন না শুধু দীনেশ। ব্রিটিশ পুলিশ পাগল কুকুরের মতো তাঁর খোঁজ চালাতে লাগল । একের পর এক ডেরা বদলে তিনি ছদ্মবেশে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে আত্মগোপনকালে কুলির কাজও করেছেন দীনেশ। কিছুদিন ইতস্ততঃ ঘোরাঘুরি পর অবশেষে চন্দননগরে তাঁকে আশ্রয় দেন বিপ্লবী শ্রীশ চন্দ্র ঘোষ।
পলাতক দীনেশ তাঁর কমলাদি ( কমলা দাশগুপ্ত )-র সঙ্গে দেখা করে আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে। তাঁর এই কর্মকান্ডের কথা পৌঁছে যায় বাংলা তথা ভারতের মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসুর কাছে। সমস্ত খবর জানার পর রাসবিহারী বসু তাঁকে নিরাপত্তার কারণে অবিলম্বে জাপানে চলে আসতে বলেন। কিন্তু দীনেশ তখন আগের থেকে আরো বেপরোয়া। তিনি রাসবিহারী বসুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন । তখন তাঁর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ভারতের মাটিতে বিপ্লবকে যতদূর সম্ভব ছড়িয়ে দেওয়া আর যদি তাতে প্রাণ যায় তো যাক ।
এই সময়ে যুগান্তর দল ঠিক করে ব্রিটিশ সরকারের মুখপত্র স্টেটসম্যান পত্রিকার সম্পাদক মিঃ অ্যালফ্রেড ওয়াটসনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ বিপ্লবীদের প্রতি সরকারী প্রতিহিংসাকে স্টেটসম্যান খোলাখুলি সমর্থন করেছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৩২ সালের ৫-ই আগস্ট ওয়াটসনের উপড় আক্রমণ করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিপ্লবী অতুল সেনের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং ওয়াটসন প্রায় অক্ষত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যায়। এরপর ঐ বছরেরই ২৮-শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যেবেলা দীনেশের নেতৃত্বে আবার ওয়াটসনের উপড় আক্রমণ করা হয়। এবার ওয়াটসন প্রাণে বেঁচে গেলও গুরুতর আহত হয়। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ পুলিশ হত্যার ষড়যন্ত্রী হিসাবে শীঘ্রই দীনেশকে চিহ্নিত করে এবং সেইসাথে তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করে ১৫০০ টাকা।
এই ঘটনার পর দীনোশ আবার আত্মগোপন করেন চন্দননগরে। সে সময় চন্দননগর ছিল ফরাসিদের অধীনে। কিন্তু তা সত্বেও ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের পারস্পরিক সমঝোতার কারণে ইংরেজ সরকারের নির্দেশ মতো চন্দননগরের তৎকালীন ফরাসি পুলিশ কমিশনার মঁসিয়ে ক্যুঁইনের নেতৃত্বে পুলিশ তাঁর চন্দননগরের আস্তানা ঘিরে ফেলে ।কিন্তু দীনেশের অভ্রান্ত নিশানায় পুলিশ কমিশনার ক্যুঁইন নিহত হয় এবং দীনেশ সেখান থেকে আবার পালিয়ে যান। এরপর যুগান্তর বিপ্লবী দল সমর্থিত মহিলাদের সংগঠন ছাত্রী সংঘের সদস্যাদের সহায়তায় কখনও তাঁদের মধ্যে কারও ভাই সেজে, কখনো আবার তাঁদের মধ্যেরই কারো স্বামী সেজে ব্রিটিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে কখনো টালিগঞ্জের কোনো মেসবাড়ি তো পরের দিনই মেছুয়াবাজারের কোন ভাড়াবাড়ি - এইভাবে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করতে থাকেন।
দিনের পর দিন এইভাবে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকার ফলে দীনেশ ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন। গায়ে জ্বর, রাতবিরেতে কাশি কিন্তু সেইসঙ্গে অর্থাভাব ; এর ফলে বিনা চিকিৎসায় ক্রমশ নির্জীব হতে শুরু করেন দীনেশ। বন্ধুর এই বিপদের দিনে চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে এগিয়ে আসেন গ্রীন্ডলে ব্যাংকের কর্মচারী কানাই ব্যানার্জী। বন্ধুর চিকিৎসার জন্য তিনি ২৭ হাজার টাকা ব্যাংক জালিয়াতি করে দীনেশের হাতে তুলে দিলেন। এই ঘটনার অনুসন্ধানে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু দীনেশ ? তিনি কি করলেন সেই টাকা নিয়ে ? রক্তে যার বিপ্লবের আগুন জ্বলছে , সে কি কখনো দেশের আগে নিজের কথা ভাবতে পারে ? ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ভগ্ন শরীরে ছটফট করছিলেন দীনেশ ; আর টাকা হাতে পাওয়ার পর নিজের চিকিৎসার বদলে পুরো টাকাটাই তিনি দান করে দেন বিপ্লবাত্মক কর্মের জন্য। এরপর দীনেশ , বিপ্লবী নলিনী দাস ও জগদানন্দ মুখার্জীর সঙ্গে কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের এক ভাঙ্গা বাড়িতে আত্মগোপন করেন । গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ১৯৩৩ সালের ২২-শে মে , ভোর পাঁচটার সময় সশস্ত্র ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী বাড়ি ঘিরে ফেলে। বীরের মতো লড়াই করেও বুলেট শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ধরা পড়লেন তিনজন বিপ্লবীই।
বিচারে বাকি দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলেও u/s 370/74 IPC , 6 Bengali criminal Law Amendment act এবং 19(f) under the arms act-এর অধীনে দীনেশকে মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত করা হয়। এই বিচার ছিল বিচারের নামে প্রহসন।
এই আদেশ যখন দেওয়া হয় তখন দীনেশ ক্ষয়রোগে আক্রান্ত মুমূর্ষ রোগী। গায়ে তাঁর ধূম জ্বর। সেই সাথে অবিরাম কাশির সাথে রক্ত ওঠে মাঝে মাঝেই।
১৯৩৪ সালের ৯-ই জুন, দীনেশের জ্বর সেদিন একটু কম ছিল। সুযোগ বুঝে ঐ অসুস্থ, দুর্বল মানুষটিকে বিন্দুমাত্র মানবিকতা না দেখিয়ে ফাঁসীর আদেশ কার্যকর করে ব্রিটিশ সরকার। ফাঁসির সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে তিনি তাঁর দাদা বৌদিকে দুটি চিঠি লিখেছিলেন। ‘ প্রিজনার্স লেটার ’ ছাপ মারা জেলখানার বিশেষ চিঠি লেখার কাগজে ১৯৩৪-এর ১৪-ই এপ্রিল যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে ছিল পয়লা বৈশাখের নববর্ষের স্পর্শ আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দিন কয়েক আগের নতুন বর্ষা ধোয়া পৃথিবীর রূপের বর্ণনা।
শ্রীচরণেষু,
পয়লা বোশেখ। শনিবার।
নতুন বছর আসবে বলেই বুঝি বুধবারে রাত্রি এবারো প্রথম বৃষ্টি এসে সব কিছু ধুয়ে দিয়ে গেল। একদিনের বৃষ্টিতেই যেন পৃথিবীর রং, গন্ধ বদলে গেল। হাওয়ার গর্জন এসে বাজে কানে। বুঝি কাল বোশেকের হাওয়া। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজ মনটা তেমনি ভাবে নাচতে চাইছে না। যেমন নেচে উঠত আগে – কত সব না বলে চলে যাওয়া বন্ধুদের জন্য। বিদায় -দিতে -না -চাওয়া বন্ধুর জন্য। আজ ঝোড়ো হাওয়ার ভিতরেও এক শান্তি, গভীরতর শান্তি দেখছি। গর্জনের ভিতরেও এক নীরব, শান্তি ভরা সুর শুনছি। দারুণ কোলাহল, কত রকমের আওয়াজের ভিতরেও যেন সেই এক সুর এসে বাজছে কানে, ঝংকৃত হচ্ছে হৃদয়ের তারে তারে। আজ নববর্ষে তোমাদের প্রণাম করছি সকলকেই। ছোটদের জানাচ্ছি ভালোবাসা।
ইতি
শ্রী দীনেশচন্দ্র মজুমদার পু : ননীবাবু আসেনি । ১১ তারিখ magistrate-এর Court থেকে personal ** disposal হওয়ার কথা ছিল ।কি হল জানি না ।
ইতি দী”
অপর চিঠিটি ছিল এইরূপ-
চিঠির নং :২৩
ফাঁসীর আসামী
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল
রবিবার ১৬ই বৈশাখ ১৩৪১
শ্রীচরণেষু বৌদি ,
অনেকদিন ইচ্ছে হয়েছে তোমাদের চিঠি লিখি। দোষ হবে ভেবে লিখিনি। আজ মনে হচ্ছে একদিক দিয়ে দোষ হলেও কিছু লেখা আমার উচিত।আজ আর দোষ নেবে না নিশ্চয়ই (বিশেষতঃ তুমি যখন দেখা করে গিয়েছ তখন দোষ নেবে না ) আজ হয়ত কেউ কেউ আমায় দোষ গুণের অতীত বলেই মনে করবে। দাদা ,ছোড়দা ,রাংদাকে আমার প্রণাম জানিও। তুমি , ছোট বৌদি, নতুন বৌদি ,দিদিরা প্রণাম জেনো। মানিক , * * ,পরীকে আমার ভালোবাসা জানিও। তোমাদের ছেলে মেয়েদের আমার আন্তরিক স্নেহাশীষ জানিও। তারা যেন নিজেদের স্বার্থ ছাড়িয়ে উঠতে পারে। অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানব সমাজের ব্যথা যেন মনে প্রাণে অনুভব করতে পারে। অত্যাচারিতদের সঙ্গে যেন নিজেদের এক বলে বুঝতে পারে। সেই ব্যথা বুঝতে পেরে যেন তা দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে পারে। নিজেদের যেন ফাঁকি না দেয়। সত্যিকারের যেন কর্মী হতে পারে। এমনি মন এমনি হৃদয় যেন তাদের হয়। তারা যেন এমনই শিক্ষায় গড়ে ওঠে।
ইতি শ্রী দীনেশচন্দ্র মজুমদার
খাতায়-কলমে সুসভ্য ইংরেজ সরকার ফাঁসীর আগে যেমন কাউকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি , তেমনি তাঁর মৃতদেহও ফেরত দিল না। তাদের ভয় ছিল যদি শহীদ দীনেশ চন্দ্র মজুমদারের শরীর থেকে অসংখ্য দীনেশের জন্ম হয় । একজন দীনেশকে সামলাতেই যে পরিমাণ নাজেহাল হতে হয়েছিল, পরবর্তীতে লক্ষ লক্ষ দীনেশের জন্ম হলে যে কি হবে তা জানতে বুঝতে তাদের একটুও বাকি ছিল না ।
যুগটা অগ্নিযুগ ছিল বলেই বোধহয় অন্যান্য শহীদের মতো ঐ অসুস্থ শরীরেও ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে দীনেশ ছিলেন নির্বিকার, নিরুদ্বিগ্ন ও নির্লিপ্ত ।
দেশ, স্থান, কাল নির্বিশেষে বিচার করলে দেখা যাবে বিপ্লবীদের রাস্তা সবসময়েই কণ্টকাকীর্ণ। সেখানে সুখ-স্বাচ্ছন্দ, ভালোবাসা, পরিবার কোনকিছুরই কোন স্থান নেই । সেখানে আছে কেবল খিদের কষ্ট , শাসকের অকথ্য নির্যাতন এবং ফাঁসীর দড়ি। এই কন্টকাকীর্ণ রাস্তায় সম্বল একমাত্র অফুরান দেশপ্রেম এবং ঈশ্বর প্রদত্ত অসীম সহ্যশক্তি । তবে জীবনের সমস্তটুকু নিংড়ে অর্পন করার পরও আত্মবিস্মৃত বাঙালি ঐতিহাসিক রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের কারণে বিনয় বসু এবং বাদল গুপ্তের সঙ্গে দীনেশ গুপ্ত কে মনে রাখলে মনে রাখেনি দীনেশ মজুমদারকে। লজ্জা তাঁর নয়, এ লজ্জা আমাদের।
তথ্যসুত্র -
বিপ্লবী দীনেশচন্দ্র মজুমদার জীবন ও সাধনা - নির্মল কুমার নাগ
Chintannews.com ৯ জুন ২০২০ বিপ্লবী দীনেশ মজুমদার শ্রদ্ধায় স্মরণ - রঞ্জন মুখার্জী
medinikotha.in
Dinesh Chandra Majumder - amritmahotsav.nic.in
‘ এবার তবে আসি মা ’ - anandabazar.com
স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং অগ্নিযুগের বিপ্লবী শহীদ দীনেশ চন্দ্র মজুমদার - Bharat today ( ritambangla.com )
dailynewsreel.in/letter-dinesh-chandra-majumdar/
No comments:
Post a Comment