![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
শত্রু
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
আমার গল্প পড়ার
আকর্ষণের কথা বন্ধু মহলে বেশ পরিচিত।তাই সেদিন ঠেকে স্বরূপ আমাকে একটা বেশ পুরোনো
ডায়রি দিয়ে পড়ে দেখতে বলল।ঠেকটা সেদিন বেশ জমে উঠেছিল।তাই স্বরূপ কে কিছু জিজ্ঞাসা
না করে ডায়রিটা নিয়ে নিলাম।ঘরে এসে রাত্রে শুতে যাবার আগে ডায়রিটা খুলে দেখি তারিখ
ধরে সবাই যেমন লেখে এটা তেমন না।কিছু ঘটনার কথা পরপর লেখা।ডায়রির প্রথম কয়েকটা
পাতা পড়ে বুঝলাম এটা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করত এমন কারো ডায়রি।বেশ ভালো লাগছিল
পড়তে।কিন্তু যে ঘটনাটা আমার মনের মধ্যে দাগ কাটলো সেটাই তোমাদের বলব।আমি ডায়রির
লেখাটা সরাসরি তোমাদের সামনে তুলে ধরলাম।
আমি ভারতীয়
সেনাবাহিনীতে চাকরি করি।সে বার জুন-জুলাই মাসে আমি বেশ কিছু দিনের ছুটিতে বাড়ি
আসি।হঠাৎ একদিন পাড়ার এক বন্ধু এসে শুধাল,'তোর রক্তের গ্রুপ তো বি-নেগেটিভ?'আমি হ্যাঁ বলতেই
আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে ওর গাড়ির পিছনে বসিয়ে হাসপাতাল নিয়ে গেল।'কী হয়েছে?'জানতে চাওয়ায় ও
বলল,'একজনের রক্ত
লাগবে'।আর কথা না
বাড়িয়ে হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে আমি রক্ত দিলাম।পরে ওর থেকে জানতে
চাইলাম-কার কী হয়েছে?ও বলল,ওদের ফ্ল্যাটের পাশে খানসাহেবের ফ্ল্যাটে
পাকিস্তান থেকে এক আত্মীয় তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন।বেড়াতে আসা সেই
মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোকটির অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তারই রক্ত লাগবে।এই বলে বন্ধুটি হাসপাতালে
উপস্থিত খান সাহেব ও ওনার পরিবারের সদস্যদের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে
দিয়ে আমার রক্ত দেওয়ার কথাটা ওনাদের বলল।ওনাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ পরিচয় ও বিশেষ
কিছু কথোপকথন হল।এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল।তারপর ডাক্তার এসে জানালেন পেসেন্টের
বিপদ কেটে গেছে।একথা শুনে তো সেখানে উপস্থিত খানসাহেব ও তার পরিবারের সকল সদস্য
আমাকে জড়িয়ে ধরে কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকলেন।তারপর আমি বন্ধুর গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরে
এলাম।
এর কিছুদিন পর
আমার সেই বন্ধু আমাকে জানাল যাকে আমি রক্ত দিয়েছিলাম সে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে
আর আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে।আমিও দেখা করতে রাজি হলাম।সেই মতো বন্ধুটি
দু-তিনদিন পর আমাকে নিয়ে গেল খানসাহেবদের ফ্ল্যাটে।যাবার সময় প্রথম কারো বাড়ি
যাচ্ছি তারপর একজন অসুস্থ মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি এইসব ভেবে আমি ওনাদের জন্য
কিছু ফল,মিষ্টি, বিস্কুট কিনে
নিলাম।খানসাহেবের ফ্ল্যাটের ডোর বেল
বাজাতেই দরজা খুললেন খানসাহেব।ওনার হাতে আমার সাথে করে নিয়ে যাওয়া জিনিস গুলো
দিতেই উনি বললেন,'এ সব আবার আনতে গেলে কেন?' খানসাহেব জিনিস গুলো নিতে খুব আপত্তি করছিলেন
কিন্তু আমি জোর করাতে সেগুলো নিলেন।প্রায় হাতে ধরে আমাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে
গেলেন।সেই ভদ্রলোক যে রুমে শুয়ে আছেন সেই রুমে আমাদের চেয়ার দেওয়া হল বসার জন্য।রুমে
ঢুকতেই ভদ্রলোক আমাদের দেখে নমস্কার করে বসতে বললেন।আমিও নমস্কার করলাম।ভদ্রলোক
আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলতে শুরু করলেন।চাকরি সূত্রে হিন্দিটা আমি এখন ভালো বলতে
ও বুঝতে পারি।তাই আমাদের কথোপকথনে কোনো সমস্যা হল না।ভদ্রলোক আমাকে 'বড়োভাই' সম্বোধন করে রক্ত
দিয়ে ওর প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ওকে 'আপনি' বলতে নিষেধ করল।ওর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম
ওর নাম সাকিব।আর ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত।সাকিব কে দেখে আমার থেকে বয়সে
ছোটোই মনে হল।তাই ওর কথা মতো আর ওকে আপনি বললাম না,সঙ্গে আমাকেও আপনি বলতে নিষেধ করলাম। ওর
স্ত্রীও আমাকে 'বড়োভাই' সম্বোধন করে ইসলামীয় রীতিতে সেলাম করে 'ধন্যবাদ'জানাল।আর ওদের পাঁচবছরের ছোট্ট মেয়ে লিসা আমাকে
'আঙ্কেল' বলে ডেকে আমার গা
ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে 'থ্যাঙ্ককিউ' বলল।সাকিবের বাবা-মাও আমার সাথে ফোনে কথা
বললেন।রক্ত দিয়ে তাদের ছেলের জীবন বাঁচানোর জন্য আমাকে অনেক আশীর্বাদ করলেন।খানসাহেব, সাকিব ও পরিবারের
অন্য সদস্যদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বার্তা বললাম দেশ-বিদেশ,পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন
নিয়ে অনেক গল্পটল্প করলাম।সেনাবাহিনী তে চাকরি করার সুবাদে জাতপাতের ব্যাপারটা
আমার নেই।তাই ওনাদের বাড়িতে সামান্য লুচি মিষ্টি সহ জলযোগও করলাম।তারপর ওখান থেকে
চলে এলাম আমাদের বাড়ি।
এরপরও দু-একবার
খানসাহেবদের ফ্ল্যাটে গিয়েছি।একদিন সাকিব তার স্ত্রী আমিনা ও কন্যা লিসাকে নিয়ে
আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে চাইল।মুসলিম বলে ওদের আসার কথা শুনে মা প্রথমে অনেক
আপত্তি করেছিল।অনেক বোঝানোর পর মা কে রাজি করানো গেল।একদিন বিকালে আমি গিয়ে ওদের
নিয়ে এলাম।ওরা এসে আমার বাবা-মা,স্ত্রী র সঙ্গে পরিচয় করল।অনেক গল্প করল।আমার
পরিবারের সদস্যদের ভুল হিন্দি ওদের বাংলা বলার চেষ্টা সব মিলে মিশে একটা অদ্ভুত
পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন।ওরা অনেকক্ষণ ছিল আমাদের বাড়িতে।ওদের জন্য যে
খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল তা থেকে সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়া করল।ওরা আমার মা ও
স্ত্রী-র জন্য খুব দামি দুটো শাড়ি উপহার হিসেবে নিয়ে এসেছিল।অনেক দিন বিয়ে হলেও
আমাদের কোনো সন্তান হয়নি।তাই লিসা কে পেয়ে আমার স্ত্রীকে খুব খুশি দেখাচ্ছিল।নিজে
মা হতে পারেনি তাই অন্যের বাচ্চা পেলে ও খুব খুশি হয়,খুব আপন করে নেয়।আর বাচ্চারও দেখেছি ওকে খুব
ভালোবাসে।তবে মাকে বাইরে খুশি দেখালেও ভিতরে ভিতরে যে বেশ বিরক্ত হচ্ছে তা ঠিক
বুঝতে পারছিলাম।কারণ মায়ের ছোঁয়াছুয়ির একটা বাতিক আছে।
আমার ছুটি শেষ
হওয়ার আগেই ওরা চলে গেল পাকিস্তান।ওদের যাওয়ার দিনও আমি গিয়েছিলাম দেখা করতে।লিসার
জন্য কয়েকটা খেলনা ,একটা দামি পোশাক, আমিনার জন্য শাড়ি, সাবিকের জন্য রেডিমেড পোশাক উপহার হিসাবে নিয়ে
গিয়েছিলাম।এই কয়েকদিনে ওদের সঙ্গে কেমন যেন একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়ে
গিয়েছিল।কখনও মনে হয়নি ওরা পাকিস্তানি আমাদের
জাতের বা দেশের কেউ নয়।ওদের যাওয়ার সময় মনটা বেশ খারাপ লাগছিল, বিশেষ করে
বাচ্চাটার জন্য।এই কয়েকদিনে বাচ্চাটা আমাকে খুব আপন করে নিয়েছিল।আমারও খুব ভালো
লাগত ওর সঙ্গে সময় কাটাতে।
দেখতে দেখতে
আমারও ছুটি শেষ হয়ে গেল।আমিও
চলে এলাম আমার
কাজের জায়গা জম্মু তে।আমি বি.এস.এফ-এ কর্মরত।কাজে যোগ দেওয়ার বেশ কিছুদিন পর একদিন
রাতে আমাদের তিনজনের ডিউটি পড়ল চেক পোস্ট-এ।সাধারণত তিনজন করে ডিউটি পড়ে ক্যাম্প
থেকে বহুদূরে চেক পোস্টে।সেখানে চেক পোস্টের কাছে তাঁবুতে একজন করে ঘুমায় আর বাকি
দুজন বাইরে পাহারায় থাকে।সেদিনও আমরা তিনজনে ডিউটি করছি।তাঁবুর ভিতরে একজন
ঘুমাচ্ছে আর আমরা বাইরে তাঁবু থেকে একটু দূরে ডিউটি করছি।শীতের সময়,তাই বরফ পড়ছে।রাত
ক্রমে গভীর হলো।এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছি।বেশ ঠান্ডাও লাগছে।হালকা আলোয় হঠাৎ যেন
মনে হল আমাদের কেউ ঘিরে ধরেছে।বন্দুক তাক করে পিছনে ঘুরতেই দেখি পাকিস্তানি সেনা
আমাদের ঘিরে ধরেছে।এইভাবে এর আগেও সীমান্ত পেরিয়ে চোরা পথে ওরা প্রবেশ করে কয়েকজন
ভারতীয় সেনা কে হত্যা করেছে।আজও সেইভাবেই ঢুকে আমাদের ঘিরে ধরেছে জনা পাঁচেক
পাকিস্তান সেনা।আমারা তিনজন ওদের বন্দুকের নিশানায়।কিন্তু এ কি!আমার দিকে বন্দুক
তাক করে থাকা ছেলেটার মুখের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম।উভয়ের মুখ ঢাকা থাকলেও
আমাদের একে অপরকে চিনতে কোনো অসুবিধা হল না।একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে
গেলাম বাক্ রুদ্ধ হয়ে।শুধু মনে পড়ছিল একদিন রক্ত দিয়ে আমি একে মৃত্যুর মুখ থেকে
ফিরিয়ে নতুন জীবন দিয়েছি;মনে পড়ছিল বাচ্চা মেয়ে লিসার মুখটা,আমাকে বড়ো দাদা
মনে ওরা স্ত্রী আমিনার কথা,যাকে আমি বোন বলে ডেকেছি;মনে পড়েছিল ওর মা
বাবার কথা ,যাদের সাথে ফোনে পরিচয় হয়েছে,যারা আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসেছে;আল্লাহর কাছে
আমার ও ওনাদের সন্তানের দীর্ঘায়ুর জন্য প্রার্থনা করেছেন,মনে পড়ছিল খান সাহেবের কথা।হয়তো ওরও সেদিন কার
কথা গুলো মনে পড়ছিল।আমরা একে অপরকে গুলি করতে ভুলে গেলাম।শুধু একচোখ জল নিয়ে একে
অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম বন্দুক তাক করে।এমনকি আমাদের পাশে কী ঘটছে সেদিকেও কোনো
ভ্রূক্ষেপ ছিল না।
এখানেই ডায়রির
পাতা শেষ।তাই এরপরে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে কিছু জানা গেল না।শুধু ডায়রির শেষের
দিকে যেখানে ফোন নম্বর লেখার জায়গা থাকে সেখানে কবিতার আকারে লেখা-
আমিও সৈনিক, তুমিও সৈনিক
পেটের তাগিদে
দেশের জন্য
গায়ে পরেছি সেনার
পোশাক।
একে অপরকে দেখিনি
কখনও
চিনিনা কেউ কাউকে
তবু চির শত্রু দু'জনায়।
তোমার মতো আমারও
ঘরে
আছে অসুস্থ মা,বয়স্ক বাবা
অবিবাহিত বোন ,বেকার ভাই
কিংবা সদ্য
বিবাহিত বউ
অথবা পুরোনো, দু-ছেলের মা কেউ।
না জানি তোমার
নাম, না জানি ধাম
না আছে কোনো
পরিচয়
তবু শত্রু আমরা
কেন দু-জনায়?
কে বানাল শত্রু
আমাদের?
আমরা তো চিনিনা
কেউ কাউকেই।
এরপর ডায়রিতে আর
কোথাও কিছু লেখা নেই।ডায়রিটা পড়া যখন শেষ হলো তখন ঘড়িতে তিনটে ঘন্টা পড়ার আওয়াজ
পেলাম।লেখাটা পড়ে মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল।তাই সিগারেটের পেকেট থেকে একটা
সিগারেট আর লাইটারটা নিয়ে রুমের বাইরে বারান্দায় রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলাম।সিগারেটটা
ধরিয়ে টান দিতে দিতে ভাবছিলাম লেখাটার মধ্যে কতটা বাস্তব লুকিয়ে আছে।এখানে হয়তো
ওরা একে অপরকে চিনতো কিন্তু সচরাচর তো দুই দেশের সৈনিক কেউ কাউকে চেনে না তাও একে
অপরের শত্রু তে পরিনত হয়েছে।সত্যি কেন এই শত্রুতা? কে বানাল একে অপরকে শত্রু?কবিতার প্রশ্ন
গুলো বারবার মনে পড়ছিল।দেখতে দেখতে ভোরের স্নিগ্ধ আলো ফুটলো;পাখিরা ডেকে
উঠল।মনটা আবার ভরে উঠল সেই মনোরম পরিবেশে।সকাল হতেই ডায়রি হাতে ছুটলাম স্বরূপের
বাড়ি ,ডায়রিটার বিষয়ে
ওর কাছে অনেক কথা জানার আছে।
No comments:
Post a Comment