1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ


ছবি  : ইন্টারনেট

 

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ
শুভায়ন বসু

             প্রীতম ফোনটা রেখে উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছিল ।অনন্যা আসছে ওর ফ্ল্যাটে,আর ফ্ল্যাটে সে এখন একা। অনন্যাই ক’দিন ধরে বলেছিল, “তোমাদের ফ্ল্যাটটা দেখতে যাব। কবে যাব, বল।প্রীতম বলেছিল, “ফ্ল্যাটে যাবে! বাবা মা তো সন্দেহ করবে তাহলে। কি পরিচয় দেব?” বোকার মত কথা বলছ কেন ?তোমার বাবা-মা যখন থাকবে না ,তখনই যাব। তাহলেই হল তো?”

,তাহলে ঠিক আছে“,বলেই ঢোঁক গিলল প্রীতম। বলছে কি মেয়েটা! প্রেমিকের ফ্ল্যাটে প্রথম আসবে ,তাও যখন প্রেমিক একা !কি সাহস! কি হল ?ভয় পাচ্ছ নাকি? আমি বাঘ ভাল্লুক নই, যে তোমাকে খেয়ে ফেলব।“ অনন্যার গলায় শ্লেষ।না, না, ভয় পাব কেন? ঠিক আছে। বাবা মা তো দু’একদিন পরেই ছোটমাসির বাড়ি যাবে। তখন আমি তোমাকে ফোন করে দেব। তুমি চলে এস।“ বাহ,দারুন মজা হবে।তোমার সব কবিতার বই দেখব সেদিন।“

সাবধানে আসবে কিন্তু, কেউ যেন কিছু জানতে না পারে ।শেষে কে কি ভাববে!” ঠিক আছে, ঠিক আছে,অত বলতে হবে না। ভীতুর ডিম একটা।“ এসে গেল সেই দিন । সকাল থেকেই খালি ভেবেছে প্রীতম,কখন সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টা আসবে, গতকাল রাতে টেনশনে ভাল ঘুম পর্যন্ত হয়নি। বিকেলে ওদের ফ্ল্যাটের কমন ফোন থেকে অনন্যার বাড়ির নীচের পিসিও বুথে ফোন করে ওকে ডেকে নিল প্রীতম। জানিয়ে দিল “চলে এস, বাবা মা নেই, রাস্তা ক্লিয়ার।“ অনন্যা বলল, “ওকে, ডার্লিং। এখনই আসছি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে।“ প্রীতমের বুকের মধ্যে হার্টটা যেন তখন উত্তেজনা আর আনন্দে লাফাচ্ছে।

     বাবা-মা তো এই সবে বেরোলেন। আসতে এখনও ঘন্টা দুয়েক। ছোট মাসির বাড়িতে ওদের গুরুদেব আসছেন, কি সব ধর্মীয় অনুষ্ঠান হবে। সকালেই প্রীতম জিজ্ঞেস করেছিল, দুরুদুরু বুকে “মা ,ছোটমাসির বাড়ির অনুষ্ঠান কবে যেন?” মা বলেছিলেন “আজই তো, তুই যাবি নাকি? তাহলে চল, সবাই একসঙ্গেই যাই।“ প্রীতম বলেছিল “না, না, আমার পড়া আছে। আর তাছাড়া ঐসব গুরুদেবের গানটান আমার ভাল লাগে না।“ বলেই ভাবল বাবা-মা কিছু আবার সন্দেহ না করে! প্ল্যানটা না বিগড়ে যায়। এ সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।

       শেষ পর্যন্ত অবশ্য কোন সমস্যা হয়নি। বাবা-মা বিকেল বিকেলই বেরিয়ে গেলেন । প্রীতমকে বলে গেলেন, ”বাইরে বেরোবি না কোথাও। এখানেই পড়বি। আর না দেখে কাউকে দরজা খুলবি না।আমরা এক দেড়ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসছি।“ প্রীতম জানে দেড় নয়, পাক্কা দু’ঘণ্টা লাগবে। তবুও সাবধানের মার নেই, এক ঘণ্টার মধ্যেই অনন্যাকে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এই একঘন্টা কি করবে দুজনে? অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে কিস করবে? ধুর, সে তো কতই করেছে। আজ আরও বেশি কিছু চাই। কিন্তু অনন্যা যদি রাজি না হয়? যদি বাবা-মা এসে যায়? আগামী একটা ঘন্টা কি কি ঘটতে পারে, ভাবতেই পারছিল না প্রীতম।

     আর মাত্র পাঁচ মিনিট। তাড়াতাড়ি বারমুডাটা ছেড়ে জিন্সটা পড়ে নিল প্রীতম, উপরে একটা দারুন দেখতে হলুদ টিশার্ট পরল, কদিন আগেই কেনা। এখন বেশ দেখাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, চুলটায় হাত চালিয়ে আলগাভাবে গুছিয়ে নিল, একটু কেয়ারলেস থাক। হঠাই ও ভাবল, আরে এত সেজেগুজে কি কেউ বাড়িতে থাকে নাকি? তার চেয়ে সাধারণ নীল স্যান্ডো গেঞ্জিটাই ভাল, ওর ব্যায়াম করা পেটানো চেহারা, বেশ স্মার্ট আর সেক্সি দেখাবে, ঘরোয়াও। আবার টি শার্ট ছেড়ে ও স্যান্ডো গেঞ্জিটা পড়ে ফেলল। ডিও মাখবে নাকি? নাঃ, সেটাও থাক। অনন্যা যেন না ভাবে, ও আসবে বলে প্রীতম সেজেগুজে রেডি হয়ে রয়েছে। খুব লজ্জার ব্যাপার হবে সেটা। অনন্যা যা স্মার্ট মেয়ে, ওকে ল্যাজেগোবরে করতে ছাড়বে না। তার চেয়ে সাধারণভাবে থাকাই ভাল। কোন ঘরে বসাবে? খুবই সাধাসিধা ফ্ল্যাট। সামনের ঘরটাই ভাল।একটা চেয়ার আর বড় খাটটা আছে। খাটেই বসবে দুজনে, তারপর খাটেই........। আর ভাবতে পারেনা প্রীতম। বারান্দার কাছে গিয়ে আলতো উঁকি মেরে বাইরে দেখে, অনন্যা আসছে নাকি। কেউ দেখে ফেলবে না তো ওর ফ্ল্যাটে আসতে, তাহলেই চিত্তির। যদি বাবা-মার কানে যায় সর্বনাশ হবে, ভাবতেই শিউরে উঠল ও। কিন্তু এখন আর ফিরে যাবার উপায় নেই, একটু রিস্ক তো নিতেই হয়। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করল প্রীতম। ধুর, কেউ জানতে পারবে না, মাত্র তো এক ঘণ্টার ব্যাপার।

        কি করবে দুজনে? খাটে বসে গল্প? কিসের গল্প ? নতুন কেনা কবিতার বইগুলো তো কবে থেকেই অনন্যা দেখতে চেয়েছিল। ফ্ল্যাটটাও দেখতে চেয়েছে, কি যে দেখার আছে এই ম্যাড়মেড়ে ফ্ল্যাটটাতে! দুটো ঘর, ডাইনিং, কিচেন বাথরুম আর বারান্দা। তার মধ্যে বারান্দায় বের হওয়া যাবেনা, ওপাশের ফ্ল্যাটগুলো থেকে সবাই দেখে ফেলবে। বারান্দার দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল প্রীতম। বার বার ঘড়ি দেখতে থাকল। পাঁচ মিনিট তো হয়ে গেছে, এখনও আসছে না কেন অনন্যা? আসবে তো! যদি না আসে কোন কারনে? ইস্, তাহলে তো সুযোগটাই নষ্ট। আর এমন দিন আসবে?

   আর বারান্দা দিয়ে বাইরে দেখা যাবে না, দরজা বন্ধ করা দিয়েছে। সদর দরজার কাছে সিঁড়িতে, কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করে প্রীতম। কেউ কি আসছে? সিঁড়িতে পায়ের শব্দ ওকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। এই বুঝি আসছে অনন্যা, আর মাত্র কয়েকটা মিনিট। বুক দুরদুর করে অজানা আশঙ্কায়, কি হয়, কি হয়।

     এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতে আর স্বপ্নের জগতে ভাসতে ভাসতে, হঠাৎই কলিংবেলের শব্দ।ওফ্, হার্টঅ্যাটাক হল বুঝি, নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে আসছে। এত জোরে শব্দ! পাড়া-প্রতিবেশী সব শুনে ফেলল বুঝি। অনন্যা এসে গেছে। ছুটে যেতে চায় প্রীতম। তারপর নিজেকেই বোঝায়, শান্ত হতে হবে, সবকিছুতে তাড়াহুড়ো ভাল নয়। ধৈর্য ধরে সব ট্যাকল করতে হবে, ভদ্র ছেলে হতে হবে। অনন্যার কাছে নিজেকে ছোট করতে পারবে না।

      কয়েক মুহূর্তেই দরজা খুলে দিল প্রীতম। “এসে গেছি”, ফিসফিস ক’রে ব’লে, দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল অনন্যা। বাইরে এক ঝলক উঁকি মেরেই দরজা বন্ধ করে দিল প্রীতম। যাক, কেউ দেখেনি।অনন্যা ঘরে ঢুকেই চেয়ারটায় বসে পড়ল। প্রীতম মনে মনে ভাবল, আহা,চেয়ারটা বুঝি ওর স্পর্শে সোনা হয়ে গেল। “বাঃ,কি সুন্দর ফ্ল্যাট গো তোমার।কই ঘুরিয়ে দেখাও।“ অনন্যা বলে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না প্রীতম। অনন্যা তারই ঘরে বসে আছে, নীল চুড়িদার, সাদা ওড়না, কি সুন্দর লাগছে ওকে। সেই অনন্যা, ওর প্রেমিকা অনন্যা। ফ্ল্যাটে শুধুমাত্র দুজনে, আর কেউ নেই । ঋষি কাপুরের ববি সিনেমার গানটা ওর মনে পড়ে গেল ‘হাম তুম এক কামরেমে বন্ধ হো’। অবশেষে সেই দিন, সেই মুহূর্ত উপস্থিত। উত্তেজনায় সব গুলিয়ে যায় ওর, গলাটা কেঁপে যায় একটু। তবু নিজেকে বোঝাতে, গোছাতে চেষ্টা করে প্রীতম। বলে “হ্যাঁ, এস, দেখবে এস ।“ দুজনে এ ঘর ও ঘর, ঘুরে বেড়ায়। কিচেন, ডাইনিং বাথরুম, সব উঁকি মেরে দেখল অনন্যা। “বাহ্ ,খুব সুন্দর সাজিয়েছ তো”,”এই পেন্টিংটা কার আঁকা?”,”এই শোপিসটা কোথা থেকে কিনলে?”, “এটা কি তোমার ছোটবেলার ছবি? কি দুষ্টু দেখতে ছিলে”, “কি খাওয়াবে  আমাকে?” এইসব নানা কথা চলতে থাকল। পিছন পিছন “হুঁ, হাঁ” করতে করতে, বোকার মত ঘুরতে থাকে প্রীতম। উফ্,কখন যে......তর সয়না ওর। মাথায় শুধু একটাই চিন্তা।“আর  তোমার কবিতার বইগুলো দেখাবে বলেছিলে যে, কই দেখাও!”, অনন্যা উৎসাহী হয়।প্রীতম তখন আর  কবিতার জগতে নেই, ধুত্তোর কবিতা। কবিতার থেকে বাস্তব অনেক অনেক সুন্দর। জড়িয়ে ধরতে চায় অনন্যাকে একা পেয়ে ।নাঃ, থাক, কি ভাববে! যদি ভাবে, সুযোগ নিচ্ছে।তার চেয়ে একটু অপেক্ষা করা ভাল, ভাবল প্রীতম।

      একটু একটু ক’রে জড়তা কাটছিল প্রীতমের। বলল “কি খাবে বল,কেক খাবে?” কিছু তো কিনে রাখতে পারেনি অনন্যার জন্য! হাতে সে সময়- সুযোগও ছিল না। ফ্রিজে মার করা কেক ছিল কি ভাগ্যিস, তাই মুখরক্ষা। সেটাই বার করে অনন্যাকে একটা বড় টুকরো কেটে খাইয়ে দিতে গেল প্রীতম। “আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও। তুমি না? এত বড় টুকরো কেন কাটলে? আমি খেতে পারি এতটা?”, বলে ভেঙে ছোট একটা টুকরো মুখে দিল অনন্যা। খাইয়ে দিতে না পেরে একটু দমে গেল প্রীতম।অনন্যা খুব তৃপ্তি করে কেকটুকু খেল। তারপরে বলল “ওয়াও, দারুন। তোমার মা করেছে বুঝি? এবার একটু জল দাও তো।“ কাঁপাকাঁপা হাতে জল ঢেলে দিল প্রীতম, অনেক চেষ্টা করলেও একটু জল চলকে টেবিলে পড়ে গেল। “ছাড়,ছাড়, হয়েছে। ওতেই হবে।“ অনন্যা অল্প একটু জল খেল, আলগোছে। প্রীতম ভাবল, ধুর, ঠোঁটের ছাপটাও পড়ল না গেলাসে। অন্তত সেটাতেই ঠোঁট ঘষত পরে, তাও হল না। ওকে ভাবতে দেখে অনন্যা হেসে বলল, ”কি এত ভাবছ, হাঁদাগঙ্গারাম? এবার কবিতার বইগুলো দেখাও।“ “ও হ্যাঁ,এই যে”, তাড়াতাড়ি বইয়ের আলমারির শাটার সরিয়ে হাতে অনেকগুলো কবিতার বই বের করে ফেলল  প্রীতম, তারপর বলল “চলো,ঐ ঘরে বসি।“ সামনের ঘরে দুজনে আসে। খাটের উপর কবিতার বইগুলো নামিয়ে দিল প্রীতম। অনন্যা এবার খাটে বসল। বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে থাকল। প্রীতম খাটের  আর এক ধারে বসল, একটু দূরত্ব রেখে। আর একটু সময়, কি করে যে শুরু করবে ওর মাথায় আসে না, লজ্জা করে। অনন্যা ওকে হ্যাংলা না ভাবে, ওর চোখে যেন প্রীতম লোভী, সুযোগসন্ধানী আর পাঁচজনের মত না হয়ে যায়।

কবিতার বইগুলো খাটে ছড়িয়ে দিল প্রীতম। গোটা খাট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সুনীল শক্তি নীরেন জীবনানন্দ সুভাষ আর জয়। কবিতা ভরা বিছানার দু’দিকে দুই প্রেমিক-প্রেমিকার কবিতাযাপন চলে। টুকটাক কথা, প্রীতম আর অপেক্ষা করতে পারছিল না, সময় চলে যাচ্ছে। হঠাৎ অনন্যার একটা হাত ধরে নিজের দিকে অল্প টান দিল। অনন্যা যেন প্রস্তুতই ছিল, বোধহয় এই টানটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ছিটকে প্রীতমের দিকে সরে আসে। প্রীতম জড়িয়ে ধরল অনন্যাকে, সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল ওর ঠোঁটে। একটু বেকায়দায় অনন্যাও, কিন্তু বাধা দেবার চেষ্টা করে না, পৌরুষের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেই সুযোগে অনন্যাকে কবিতার বইয়ে সাজানো বিছানাতেই শুইয়ে দিল প্রীতম। অনন্যা জড়িয়ে ধরল ওকে, কবিতার বইগুলোর উপরেই দুজনের জড়াজড়ি চলতে থাকে। প্রীতমের হার্টবিট দ্রুততর হল, এবার ফেটেই যাবে বোধহয়, অনন্যার সম্মতি আছে। কোথায় গিয়ে পৌছবে এই শারীরিক প্রেম, কে জানে! হাঁটুতে একটা কবিতার বই খোঁচা দিচ্ছিল, জীবনানন্দ কি? সেটাকে পা দিয়েই সরিয়ে দিল ও। জীবনানন্দের চেয়েও ওর জীবনের আনন্দ এখন অনেক বেশি জরুরী, চুলোয় যাক কবিতা। কি নরম শরীর অনন্যার, প্রীতম ডুবে যায়।

অনন্যার কপালে, গালে, ঠোঁটে, গলায়, ঘাড়ে চুমু খেতে খেতে নামতে থাকল প্রীতমের ঠোঁট। শরীরের গোপন জায়গাগুলো খুঁজে বের ক’রে, পৌঁছতে চাইছিল। উত্তেজনায় গরম নিঃশ্বাস পড়ছিল দুজনেরই। অনন্যার ঠোঁটে মার করা কেকের স্বাদ তখনও লেগে, চেটেপুটে নেয় প্রীতম, ঘামতে থাকে। অনন্যার গলায়, ঘাড়ে কি সুন্দর মাদকতাময় মেয়েলী গন্ধ। এই অনন্যা ওর, শুধু ওর নিজের, ওর সবচেয়ে ভালবাসার জন। তার সঙ্গে শরীরী প্রেমে অন্যায় কি আছে? কোন বাঁধন নেই, পাগলের মত শুধু চুমোয় চুমোয় দুজনে দুজনকে অস্থির করে দেয়। প্রীতম ওর  মুখটা প্রানপনে নামিয়ে আনতে চাইল নীচে, আরও নীচে। সেখানে মুক্তোঝিনুক আছে, তার রহস্য ওকে আজ  ভেদ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে নয়, প্রীতম শুধু  দামাল ভালবাসায় অনন্যার আগলগুলো সরিয়ে দিতে চাইছিল। অনন্যা চেপে ধরল প্রীতমের মুখটা, ওর সম্বিৎ ফিরল। অনন্যা ওকে বাধা দিচ্ছে আরও নীচে নামতে। না, অনন্যাকে কোন জোর ও করতে পারবে না। পৌরুষের আত্মাভিমান ওকে বাধা দিল। অনন্যা ওর প্রেমিকা, ওর কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছে নিজেকে, তার ওপর কি জোর খাটানো যায়? প্রেমিকা তো আর কোন ভোগ-লালসার  পসরা নয়। যা হবে দুজনের পারস্পরিক সহমতেই হবে। আর একটু এদিক ওদিক হলেই একটা বড় ভুল করে ফেলছিল, যার কোন ক্ষমা হত না জীবনে। কত ছোট হয়ে যেত ও। প্রীতম পরিস্কার বুঝতে পারল, অনন্যা এখন প্রস্তুত নয়, অনন্যা থামতে চাইছে। প্রীতম সেই ইচ্ছাকে সম্মান দেয়, আর তাই তখনই এক পারস্পরিক ভরসা, বিশ্বাস আর মরমী ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে যায় দুজনে, একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকার করে।

সময় চলে গেছে অনেকটা, অবশেষে ওদের সম্বিৎ ফিরল। এবার ফিরতে হবে, প্রীতম অনন্যাকে দরজা অবধি এগিয়ে দিল। অনন্যার যেন তখনই যাবার ইচ্ছে ছিল না, কিছুটা বাধ্য হয়েই দুজনে দুজনকে বিদায় দিল। দরজা খুলে নিমেষেই সিঁড়ি দিয়ে হারিয়ে গেল অনন্যা। কেউ দেখেনি, নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা বন্ধ করল প্রীতম।

     এই ঘটনার পনের বছর পরের কথা। প্রীতম আজ বড় একটা  সফ্টওয়ার কোম্পানিতে, খুবই উঁচু পোস্টে চাকরি করে। বিবাহিত, কিন্তু ঠিক সুখী নয়। একটা মেয়েও আছে, কিন্তু প্রেম নেই ওর জীবনে। অনন্যার সঙ্গে প্রেমটা ভেঙ্গে গেছিল অনেকদিন আগেই, অনন্যা বাধ্য হয়েই খুঁজে নিয়েছিল অন্য সঙ্গী, নিশ্চিন্ত বিবাহিত জীবন। কিছু করার ছিলনা প্রীতমেরও, তখনও ও বেকার। বাবা হঠাৎ ক্যান্সারে মারা গেলেন, সংসারে অনটন। তারপর জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে করতে, জীবন গড়িয়েছে নিজের নিয়মে। দুজনে দুজনকে হয়ত ভুলেও গিয়েছিল সেই ফাঁকে। কিন্তু ক’দিন আগে, হঠাৎই ফেসবুকে দুজনের আবার যোগাযোগ হয়ে গেল। খুঁজে খুঁজে প্রীতমই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট  পাঠিয়েছিল অনন্যাকে। অনন্যার চেহারা এখন ভারী হয়েছে কিছুটা, কিন্তু এখনও আকর্ষণীয়। প্রীতমেরও চুল একটু হালকা হয়েছে, মধ্যপ্রদেশ বেড়েছে, কিন্তু মনটা রয়ে গেছে আগের মতোই সতেজ, প্রেমিক,যৌবনময়। ফেসবুকে চ্যাটিংএ  বা ভিডিওকলে বেশ ক’বার দুজনের কথা হয়েছে ।অনন্যার একটি ছেলে ,স্বামী চাকরি করে কি  একটা কারখানায়। অনন্যাকে দেখেই পুরোনো স্মৃতি আবার জেগে উঠল প্রীতমের। রোমান্স নয় ,এখন ওর অন্য একটা শারীরিক খিদে জেগে উঠল অনন্যার প্রতি,যৌনলালসা। সেদিনের মত নিষ্কাম প্রেম আজ আর নেই, শুধু জৈবীক চাহিদাই এখন বড় হয়ে উঠেছে। সময় পাল্টে গেছে, বদলে গেছে দুজনেই। আজ পনের বছর পরে, যখন আবার অনন্যাকে প্রস্তাবটা দিল প্রীতম, অনন্যা কিন্তু প্রথমেই না বলে দিয়েছিল, প্রীতমের সঙ্গে আর সে দেখা করতে চায় না, ফ্ল্যাটে আসা তো দূরের কথা। কিন্তু কি করবে প্রীতম? ও আজ নিঃসঙ্গ। মানসীর সঙ্গে ওর বনেনি,তাই  মেয়েকে নিয়ে মানসী প্রায়ই বাপের বাড়িতে আলাদা থাকে, মিউচুয়াল সেপারেশনেরও কথাবার্তা চলছে। মাও মারা গিয়েছেন বছর দুই হল। ফ্ল্যাটটাতে প্রীতম এখন একাই থাকে । শুধু অনন্যা যদি আর একবার আসত!  কিন্তু আজ প্রীতমের মনে বিন্দুমাত্র প্রেম নেই, আছে শুধু ভোগবাসনা । বিবাহিত জীবনে ও সুখ পায়নি, অনন্যাকে পেলে এবারে বিছানায় নিয়ে গিয়ে তুলবে, শয্যাসঙ্গিনী বানাবে। পনেরো বছর আগের সেই দিন, বোকার মতো ও যা পারেনি, আজ সুদে-আসলে তা উশুল ক’রে শোধ তুলবে।

-কবে দেখা হবে আমাদের ?

-কেন, দেখা করে কি হবে? এই তো ফোনে বেশ কথা হচ্ছে ।

-না গো, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

-সে কি গো ! ভিডিও কলে তো রোজই দেখতে পাচ্ছ ।

-না না সেরকম নয়, সামনাসামনি।

-কি দরকার? তার চেয়ে এই ভাল।

-কি বলছ ! এত বছর পর দু’জনের যোগাযোগ হল, আর দেখা করব না!  বিশেষ করে দু’জনেই যখন এত কাছে থাকি।

-ঠিক আছে, চলে এসো না বাসস্টপে। ওখানেই দেখা হয়ে যাবে।

-না, না, কি বলছ। সবাই দেখে ফেলবে যে, শেষে কে কি ভাববে! 

-কি আবার ভাবব? কেউ কারো সঙ্গে কথা বলতে পারে না নাকি?

-কেউ যদি সন্দেহ করে ! তোমার হাজব্যান্ড বা আমার বউ জেনে গেলে সমস্যা হবে, বুঝলে ?

-তাহলে?

-তাহলে আবার কি? আমার ফ্ল্যাটে চলে এসো। তুমি তো চেনো।

-না, না বাবা, ফ্ল্যাটে যেতে ভয় করছে।

-ভয়! আমি কি বাঘ না ভাল্লুক, যে তোমাকে খেয়ে ফেলব?

-না তা নয়.....

-তবে আবার কি? চলে এসো। প্রাণ খুলে গল্প করব কতদিন পর।

-কিন্তু.....

-কোন কিন্তু নয়। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস কর না?

-তা কেন হবে? আসলে আমার না ঠিক যেতে ইচ্ছে করছে না। তার চেয়ে চলো না, কফি হাউসে বসে আড্ডা মারি।

-কফি হাউজ? অতদূর? কেউ দেখে ফেললে?

-তাহলে ছাড়ো। দেখা করার দরকার নেই।

-কেন? প্লিজ, একবার এসোই না। ফ্ল্যাটটা দারুন সাজিয়েছি, তুমি দেখবে না?

-তাই নাকি? দেখি, তাহলে যাব একদিন।

-ঠিক তো? কবে আসব বল।

-বলে দেব, কিন্তু আমার দিকটাও দেখো ।

আসলে প্রীতমকে দেখতে ইচ্ছে করছিল অনন্যারও। কিন্তু ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, প্রীতম পাল্টে গেছে। মেয়েরা অনেক কিছু দূর থেকেও বুঝতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হল অনন্যাকে, প্রীতমের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের কাছে। প্রীতমকে যে ও ভাল ক’রেই চেনে, আপনার জন মনে  করে, এখনও সেদিনের মতোই ভালবাসে । প্রীতম যে বড় ভরসার জন ছিল, ভালবাসার জন ছিল। এখন অবশ্য অনন্যা আর্থিক ভাবে একটু দুর্বল , ওর স্বামী তপন সেরকম বড় চাকরি করেনা, কষ্টেসৃষ্টেই চলে ওদের, বেশিরভাগ সময় ও ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকে। প্রীতম কিন্তু অনন্যার শেষ কথাটার মানেটা এখনও বুঝতে পারেনি। কি বলতে চাইছে অনন্যা ওকে? টাকা পয়সার কথা, আর্থিক সাহায্য চায় ? ও কি প্রীতমের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে? তাই শরীরের বিনিময়ে কিছু আদায় করে নিতে চায়? প্রীতমের একটু খটকা লাগে।

অবশেষে একদিন  অনন্যা প্রীতমের ফ্ল্যাটে আসতে রাজি হয়ে গেল। মোবাইলে কথা হয়ে গেল দুজনের এইমাত্র, অনন্যা এখনই আসছে। ফ্ল্যাটের ভিতর একা প্রীতম। ওর বুকে আজও  সেই প্রথম দিনটার মতোই হাতুড়ির ঘা পড়তে লাগল। একটা জিন্স আর টি শার্টে এখন ওকে দারুন স্মার্ট দেখাচ্ছে, সেদিনকার মত নার্ভাস আর ও নয়। ফ্ল্যাটটাও ঝাঁ চকচকে ক’রে সাজিয়েছে, দামি গ্যাজেট, ফার্নিচার, ইমপোর্টেড শোপিস, দেওয়াল জোড়া অয়েলপেন্টিং, লেটেস্ট ইন্টিরিয়র ওর আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ দেয়। প্রীতম ফ্রিজ থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের ক’রে ডাইনিং টেবিলে সাজায়, সঙ্গে দুটো গ্লাস। উত্তেজনায়  ও দু’পেগ মেরেও দেয়। তারপর অপেক্ষা করতে থাকে অনন্যার জন্য। সেই পাঁচ মিনিটের রাস্তা, সেই ফ্ল্যাট, সেই দুজন। মাঝে শুধু কেটে গেছে পনেরোটা বছর। সেদিনের  ভুল আর  ও করবে না, দরকার হলে জোর করবে, আজ ওর নেশা চেপে গেছেক্লাবড্রাগ ড্রিঙ্কসে মেশাতে কতক্ষণ?

ওর সাজানো ফ্ল্যাটে আজ  সবকিছুই আছে, শুধু আর সেখানে কোন কবিতার বই নেই, সেসব কোথায় চলে গেছে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার প্রতিযোগীতা, দাম্পত্য কলহ আর স্বার্থান্ধতায় সেসব কোথায় মুখ লুকিয়েছে বা হয়তো খবরের কাগজের সঙ্গে বিক্রি হয়ে গেছে। সেসব যাক, আজ তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। অনন্যা কি আসছে? প্রীতম উত্তেজনায় ফুটতে থাকে।

          সিঁড়িতে পায়ের শব্দগুলো ওকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। কলিংবেল বাজে। ছক সাজাতে সাজাতেই, সপ্রতিভ প্রীতম তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই চমক। দেখতে পায় একটি শিশুর হাস্যময়, আলোকিত মুখ। তার আভা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঘরে। তার পেছনে ঝাপসা মুখ, কপালে টিপ, মুখে হাসি- না কোন মেয়ে নয়, কোন পরস্ত্রী বা প্রেমিকা নয়, দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মা। প্রীতমের মনে পড়ল ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে টাঙানো যামিনী রায়ের আঁকা ছবিটার কথা- ক্যাপশন মা ও শিশু।

     bluebasu22@gmail.com
দুর্গাপুর





 

No comments:

Post a Comment