1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

ব্রেন

ছবি  : ইন্টারনেট

 ব্রেন
সৌরভ মুখার্জি

         হু হু করে গাড়িটা চলেছে এয়ারপোর্ট থেকে এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে। অপারেশনের পর এই আমার প্রথম গাড়িয়াত্রা। এখন আমার আগের জীবনের স্মৃতি খুব আবছা হয়ে গেছে, এই ব্রেন রিপ্লেস করার পর থেকে।
দুহাজার চল্লিশ সালের পর থেকে ব্রেন সংরক্ষনের চল শুরু হয়। আ্যাকসিডেন্ট বা অন্য কোনো কারণে শরীরের অন্য অঙ্গের মৃত্যু হলেও যাদের মস্তিস্ক কাজ করতে সক্ষম, তাদের ব্রেন বৈজ্ঞানিক উপায়ে কয়েক দশক রেখে দেওয়া হয়। আবার যাদের বাকি শরীর ঠিক থেকেও ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে, তাদের শরীরে জুড়ে দিলে তারা আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়। পুরোটাই রোবোটিক প্রসেস, এতটুকু ভুলচুক হবার জো নেই। তবে রিপ্লেসমেন্টের পর থেকে শুধুমাত্র সেই মৃত মানুষের স্মৃতিই কাজ করবে, আমার আগের সব মেমরি মুছে যাবে, এমনটাই বলা হয়েছিল। তাই আমার শরীরটা এখন একজনের, মস্তিষ্কটা অন্য লোকের। যার মস্তিস্ক সেটাই এখনকার আমি। নিজেকে অচেনা লাগছে, পুরো পৃথিবীটাই অচেনা মনে হচ্ছে। প্রায় নব্বই বছর পর আমি আবার পৃথিবীর আলো দেখছি। সবকিছু কত বদলে গেছে!
একসময় ব্রেন রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে দেশে দেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে, কেউ সপক্ষে কেউ বিপক্ষে। তারপর বিপক্ষ দলের প্রধান নেতা মৃত্যুর পর নিজেই ব্রেন রিপ্লেস করানোর ফলে কিছুকাল পরে সব আন্দোলনই থিতিয়ে গেছে। মরতে তো কেউই চায় না। সেসব ঘটনারও প্রায় একশ বছর হয়ে গেল। আমি তাই নিজের পরিচয় হারিয়ে প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো এক বৃদ্ধের ব্রেন নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছি।
যাঁর ব্রেন আমার খুলিতে সেট করে হয়েছে সেই বৃদ্ধ মারা গেছেন দুহাজার পঞ্চাশ সালে। অর্থাৎ, আজ থেকে ঠিক নব্বই বছর আগে। ইনি মনে হয় ড্রাইভারলেস গাড়ি দেখেননি। অর্থাৎ, বর্তমানের আমি দেখিনি। হাসপাতাল থেকে আমার সঙ্গে একটি রোবট দেওয়া হয়েছে, যে আমাকে সবসময় সাহায্য করবে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে। রোবটের নাম নেই, নাম হয় না। আমি তবু নাম ছাড়া ডাকতে পারব না বলে তার নাম দিয়েছি 'র'। র অর্থাৎ রোবট। রোবট হলেও দেখতে সে প্রায় মানুষেরই মত, খালি একটু যান্ত্রিক কথাবার্তা বলে। তার ব্যবহারটা আমার প্রথম থেকেই বিরক্তিকর লাগছিল।

        র বলল, আপনি সম্ভবতঃ ড্রাইভারলেস গাড়ি দেখেননি স্যার। আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, খুব আবছা মনে পড়ছে, প্যারিস ও আমেরিকার কিছু শহরে চালু হয়েছে শুনেছিলাম তবে চড়িনি।
আমার মাথার ওপর দিয়েও বেশ কিছু গাড়ি মাছির মত উড়ছে। এগুলো আসলে ছোট ছোট ওয়ান বা টু সিটের প্লেন। রাস্তাতেও চলে, আকাশেও চলে। দরকারে জলেও চলতে পারে। বরং রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। প্লেনগুলো একে অন্যকে টক্কর দিতে সাঁ সাঁ করে উড়ছে। ওদের সাথে আমাদের গাড়ি পাল্লা দিতে পারছে না। রাস্তার দুপাশে কত বড় বড় বিল্ডিং। আগে বড় রাস্তার ধারে ধারে গাছ থাকত।
হঠাৎ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা র, রাস্তার পাশে একটাও গাছ দেখছি না। র বলল, গাছ আছে উদ্যানে, অভয়ারণ্যে। শহরে গাছ বেমানান, তাই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আপনি গাছ দেখতে চান?

নাঃ। আমি কিছু বললাম না। গাছ আমি দেখিনি তা নয়। র বলল, তবে অক্সিজেনের অভাব নেই। প্ল্যান্ট থেকে সবসময় অক্সিজেন সাপ্লাই হচ্ছে। আমার আঙুলে একটা আঙুল ছুঁইয়ে বলল, আপনার রক্তে অক্সিজেন পর্যাপ্ত আছে, আপনার টেনশন নেই।

তা ঠিক। অক্সিজেন পেলেই হল। তবে আমার ছেলেবেলায় আমি একটা পেয়ারা গাছ লাগিয়েছিলাম। অক্সিজেন পেতে নয়, এমনিই লাগিয়েছিলাম। সেটা নিশ্চয়ই দেড়শ বছর বেঁচে নেই। বা তাকে অভয়ারণ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

   র, এটা কি বর্ষাকাল? আকাশটা কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। যেন কাঁচের মধ্যে রয়েছি আমরা। র বলল, না গত পরশু সরকার শেষবারের মত বর্ষাকালীন কৃত্রিম বৃষ্টিপাত করিয়েছেন। অফিসিয়ালি এখন শরৎকাল, স্যার। আকাশে যে কাঁচের গোলক রয়েছে সেটা দিয়েই আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ হয়। বর্ষার জন্য আবার নয় মাস অপেক্ষা করতে হবে, সরি স্যার। প্রতিটি দেশ নিজেদের আকাশকে কাঁচ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। গরিব দেশরা এখনো পারেনি। এই গোলকের বাইরে ভয়ংকর দূষণ, গ্যাস মাস্ক ছাড়া বেরোনো যায় না। আমি আর অবাক হলাম না, পুরোনো কোনো কিছু দেখলে বা শুনলে তবেই হয়ত অবাক হতাম। ঠিক তখনই দেখলাম আকাশের কাঁচের গায়ে একজায়গায় একটা ছোট্ট শালিক পাখি মরে লেপ্টে আছে। মনে হয় কোনো কারণে বেরিয়ে পড়েছিল, দমবন্ধ হয়ে মরে গেছে। শালিকটাকে আমার চেনা মনে হল। গতজন্মের পরিচয় ছিল হয়ত। আর তো কোনো পাখি দেখলাম না এ পর্যন্ত।

    বাড়ি ফিরলাম। ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল আমার শরীরটা যার সেই লোকটা বেছে বেছে দেড় দুশো বছরের পুরনো একটা ব্রেন কেন নিল? নতুন এই পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত কোনো ব্রেন কি ছিল না? র তখনও আমার আঙুল ধরে ছিল, মনের কথা বুঝতে পেরে বলল আসলে লোকটির যা বাজেট ছিল তাতে ভালো উর্বর মস্তিস্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই পুরোনো ব্রেন সস্তায় পেয়ে কিনেছে। নিজের সম্পর্কে এরকম বক্তব্য মোটেই ভাল লাগল না। আমার মস্তিস্ক অনুর্বর? সেটা আবার যে বলছে সে নিজে একটা যন্ত্র বই তো কিছু না। উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খুপরি ঘরটায় ঢুকলাম। ঢুকে মনে হল এই বাড়িটাও অন্য বাড়িগুলোর তুলনায় নিরেস। সবকিছুই আছে, তবে ঝাঁ চকচকে নয়। দেওয়ালে জানলা নেই, তার জায়গায় বড় বড় এলসিডি স্ক্রিন আছে। ওগুলোই জানলা। যেখানকার দৃশ্য দেখতে চাই সেট করে নিলেই হল। আগে শুনতাম জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়, আকাশ দেখা যায়। তা সেই সমুদ্রের ছবি সেট করে নিলেই হল। আমি সেসব চাই না। আমার ছোটবেলায় জানলা দিয়ে সেই পেয়ারা গাছের ছায়া পড়ত, সে ছবি তো আর পাব না।

জানলায় একটা রুক্ষ পাহাড়ের দৃশ্য সেট করে আমি সোফায় বসলাম। র খাবার দিয়ে গেছে। ধূসর রঙের একটা কেক, সঙ্গে ফ্লুরোসেন্ট নীল রঙের পানীয়। বলল, দুটোই আসলে ওষুধ। এখন নাকি লোকে সাধারণ খাবার আর খায়ই না, সবই ওষুধ মেশানো খাবার। সবাই দীর্ঘ জীবন চায় কিনা!

ভাবলাম র-এর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি। ওকে কি জিজ্ঞেস করা যায়? ওর না আছে মা, না আছে বাবা, না আছে দেশ। যাকগে, আমার ছেলেবেলার সেই ইস্কুলবাড়িটার কথা জিজ্ঞেস করলে ও কিছু বলতে পারবে কি?

র আমার মনের কথা বুঝতে পারে। বলল, ইন্টারনেটে আপনার স্কুল সংক্রান্ত তথ্য খুব কম। তবু যেটুকু জানতে পারছি আজ থেকে একশ কুড়ি বছর আগে সেটা ভেঙে সেখানে একটা রঙের কারখানা তৈরি হয়েছে।

আচ্ছা, আমার ক্লাসমেটদের খবর কিছু জানো? আমার ছেলেমেয়েদের খবর? তারা বা তাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় থাকে, কি করে? আশ্চর্যজনকভাবে তাদের কথা আমার কিচ্ছু মনে নেই।

র বলল, আমি আপনার উদ্বেগ বুঝতে পারছি স্যার, তবে ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন সিকিউরিটি আইন অনুসারে আপনার মস্তিস্ক থেকে তাঁদের সম্বন্ধে সব তথ্য মুছে দেওয়া হয়েছে। তাই আমি এ ব্যাপারে আপনাকে কিছুই বলতে পারব না। ইন্টারনেটেও কোনকিছু পাবেন না।

তাহলে পেয়ারা গাছের কথা আমার মনে আছে কিভাবে? ইস্কুলের কথা? আমার ভাষা, আদব-কায়দা, হাঁটা-চলা সবকিছুই তো মনে আছে। র বলল, শুধু সেটুকুই রাখা হয়েছে যেটুকু আপনার জীবনধারণের জন্য এসেনশিয়াল স্যার। তাছাড়া ছোটবেলার খুব স্পষ্ট কোনো কোনো স্মৃতি সরানো যায় না বলে রেখে দেওয়া হয়।

বেশ। বুঝলাম। আমার নিজের লোকেরা আমার জীবনধারনের জন্য এসেনশিয়াল নয়। কিন্তু আশ্চর্য, ওই পেয়ারা গাছটাকে আমার পরিষ্কার মনে আছে। র বলল, যতদূর জানতে পারছি পেয়ারা গাছটা আর নেই, তবে তার একটি ডাল থেকে একটি গাছ হয়েছিল যেটিকে শহরের এক নামকরা উদ্যানে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

রাতে কিছুতেই ঘুম এল না। শোয়ার ঠিক একঘন্টা চল্লিশ মিনিটের মাথায় র একটা ইঞ্জেকশন ফুটিয়ে দিল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। জানলার পাশে সেই হেলে পড়া পেয়ারা গাছে দুটো চড়াই কিচির মিচির করছে। আমার জানলার ঠিক নীচে রাস্তার ওপর সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো মুচি উবু হয়ে বসে জুতো সেলাই করছে। আমি একদৌড়ে গিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতেই স্ক্রীনে ধাক্কা খেলাম। মেঝেতে পড়ে যাবার মুহূর্তে র আমায় ধরে ফেলে বলল আপনার ছেলেবেলা সম্পর্কে এইটুকু দৃশ্যই দেখানোর অনুমতি পাওয়া গেছে। এলসিডি স্ক্রিনে আর স্পিকারে সেটাই সেট করে রেখেছি। গুড মর্নিং স্যার।

আমি হতভম্বের মত গিয়ে সোফায় বসলাম। আবার কালকের মত কেক আর নীল পানীয়। রয়ের দিকে তাকাতেই সে বলল, আজ টেস্ট চেঞ্জ করে দেওয়া হয়েছে স্যার। আপনার খেতে ভাল লাগবে।

দুপুরের দিকে একটা ড্রোন এসে বেশকিছু খাবার আর ওষুধ দিয়ে গেল বাড়িতে। হোম ডেলিভারী পুরোটাই এখন ড্রোন দিয়ে করা হয়। র সেগুলো নিয়ে ভেতরে সাজিয়ে রাখল। ঘরের তাপমাত্রা বেশ ঠান্ডা। আমি বললাম, আচ্ছা আমি বাইরে বেরোব কবে?

র বলল, যেদিন খুশি স্যার। তবে বাইরের সব কাজ আমিই করতে পারি অতএব আপনার যাওয়ার দরকার নেই। আপনি রেস্ট নিন স্যার। আমি বলতে বলতেও বললাম না যে শুধু সেই পেয়ারাগাছের ডালটাকে দেখার জন্য একবার বাইরে যেতে চাই।

র আর আমি বিকেলের দিকে হাঁটতে বেরোলাম। রাস্তায় চলমান ফুটপাথ। তবু আমরা হাঁটছি। উল্টোদিক থেকে কিছু লোক কিছু রোবট আসা যাওয়া করছে। সকলেরই মুখ ভাবলেশহীন। একটা বাচ্চা কেবল খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলেছে আমার আগে আগে। ওর কাছেও এসবই নতুন, পুরো পৃথিবীটাই নতুন। আমার কাছেও তাই, তবু আমি হাসতে পারছি না।

র বলল, স্যার, আপনি যদি ইমোশনাল হয়ে হাসতে বা কাঁদতে চান তাহলে বাড়ি যেতে হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রকাশ্যে ইমোশন দেখানো আইনতঃ অপরাধ। আপনি বড়জোর সৌজন্যমূলক হাসি হাসতে পারেন। গত ত্রিশ বছর আগে এই নিয়ম হয়েছে, স্যার।

মরা শালিকের পর এই বাচ্চাটাকেও আমার চেনা মনে হল। সেই গতজন্মের পরিচয় ছিল হয়ত।

সে রাতে আমার শরীরটা খুব খারাপ হল। অদ্ভুত এক অস্বস্তি, ছটফট করতে লাগলাম। র কিছুক্ষন চেষ্টা করেও কিছু করতে না পেরে হাসপাতালে নিয়ে গেল আমায়।

হাসপাতালে কিছু রোবট ও ডাক্তার মিলে অনেক রকমের যন্ত্রপাতি দিয়ে আমায় পরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে আমি এখনো নতুন পৃথিবীতে মানিয়ে নিতে পারিনি। রয়ের অনুরোধে অনেক হিসেব করার পর আমায় আরো ছাব্বিশ দিন এগারো ঘন্টা সময় দেওয়া হল। তার মধ্যে যদি এই অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি তাহলে এই ব্রেন ফেলে দিয়ে অন্য ব্রেন লাগানো হবে। এমনকি খুশি মাপার জন্য আমার পিঠে একটা ছোট্ট যন্ত্রও লাগিয়ে দিল।

বাড়ি ফিরলাম। সেদিনটা ঘুমিয়ে কাটল। আর ঠিক ছাব্বিশদিন সময় আমার হাতে। আমাকে খুশি থাকতে হবে। মন থেকে খুশি। আমি খুশি থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে হা হা করে হেসে উঠছি। উদ্দাম গান গাইছি, লাফাচ্ছি পর্যন্ত। কিন্তু পিঠে লাগানো যন্ত্র বলছে আমি নাকি মনে মনে সত্যিকারের খুশি নই।

র কে বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমি ভীষণ খুশি। যেমনই হোক, আমি এই নতুন জীবন হারাতে চাই না। কিন্তু যন্ত্র বলছে আমি খুশি নই। সাতদিন হয়ে গেল এই করতে করতে, আমার খুশির মিটার একটুও বাড়ল না।

র কে চিন্তিত হতে দেখলাম না। তবে সে এবার প্রচ্ছন্ন হুমকির সুরে বলল, আপনার হাতে আর উনিশদিন সময় আছে স্যার। আপনার অবসাদের মাত্রা না কমলে আমি বাধ্য হব আবার ব্রেন রিপ্লেস করতে। কি করলে আপনি খুশি হবেন স্যার?

কিভাবে যে খুশি থাকবো আমি নিজেই তা জানিনা। সারাদিন শুয়ে বসে থাকার পর একদিন সন্ধেয় আমার নিজেকে হঠাৎ খুব বোকা মনে হল। এই কথাটা এতক্ষন মনে আসেনি? র কে বললাম, সেই বাগানে নিয়ে যেতে পারো যেখানে আমার পেয়ারাগাছের ডাল থেকে গাছ হয়েছে?

র বলল, শিওর স্যার। আর বাইশ মিনিটের মধ্যেই দ্রুতগতির একটা টু সিটার ফ্লাইটে করে আমরা পৌঁছে গেলাম একটা ছোট শহরে। এখানেই কি আমি থাকতাম? আমার বাড়ি ছিল? র কে জিজ্ঞেস করলে সে কিছু বলবে না নিশ্চিত। তাই ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই পেয়ারা গাছের অরিজিনাল গাছটা কি এই শহরেই ছিল?

র বলল, এ ব্যাপারে বলা বারণ স্যার। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। অনেক গাছকেই এক শহর থেকে অন্য শহরে স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক গাছই নিজের শহরে রয়ে গেছে।

র যন্ত্র হলেও অত্যন্ত ধুরন্ধর। ওর সৃষ্টিকর্তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে নমস্কার। যাই হোক, উদ্যানে ঢুকলাম। মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত এক অরণ্য। একবার মনে হল বাঘ-সিংহ নেই তো? সঙ্গে র আছে, ভয়ের কোনো কারণ নেই। অন্য একটি রোবট র কে বুঝিয়ে দিল ঠিক কোন দিকে গেলে আমরা সেই পেয়ারা গাছটাকে পাব।

একটা চ্যাপ্টা গাড়িতে বসে আমরা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলাম। এ দিকটায় আমরা দুজন, আর কেউ নেই। প্রায় ঘন্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর আমার সেই পেয়ারাগাছটাকে পাওয়া গেলো। এই গাছটারও অনেক বয়স, তবে এর বয়সকে ধরে রাখা হয়েছে।

একটা বড় কাঁচের টবে মাটি দিয়ে রাখা হয়েছে। চার সাড়ে-চার ফুট মত হাইট, সব মিলিয়ে তিনটে পেয়ারা হয়ে আছে। একটা খুব পাকা। আগের গাছটার মতোই এটাও একদিকে হেলে আছে। এই গাছটা যে ডাল থেকে হয়েছে সেটা আমি নিজের হাতে পুঁতেছিলাম। আমার নিজের হাতে! অন্য সময় হলে কিছু মনেই হত না কিন্তু এখন এই গাছই আমার একমাত্র আত্মীয়। গোটা পৃথিবীতে একমাত্র একেই আমি চিনি, সেও হয়ত একমাত্র আমাকেই চেনে।

আমার চোখে জল এসে গেল। র আবার মনে করিয়ে দিল, প্রকাশ্যে ইমোশন দেখানো বারণ। আমি বললাম, এই গাছের একটি ডাল কি নিয়ে যাওয়া যায়?

উদ্যানের একজন অফিসারের সঙ্গে আলাপ হল। মানুষ, রোবট নন। তিনি খুবই উৎসাহের সঙ্গে বললেন, নিশ্চয়ই। তবে শুধু ডাল নিয়ে গেলেই তো হবে না, গাছটাকে বড় করতে হবে। এমনি এমনি ডাল বা পাতা ছেঁড়ার তো অনুমতি নেই।

আমার মনে নেই শেষ কবে আমি এরকম আনন্দ পেয়েছিলাম। আমি বললাম, গাছটাকে আমি বড় করবই। নিজের সন্তানস্নেহে পালন করব। শুধু বলুন এর জন্য আমায় কি কি করতে হবে?

আমি অসুস্থ বলে আমার হয়ে র ই সব করল। বেশ কিছু টাকাও খসল এর জন্য। কয়েকটি জায়গায় সই আর আঙুলের ছাপ ছাড়া বাকি সব কাজ র নিজেই করে দিল। তারপর আবার সেই গাছের কাছে যাওয়া হল। অফিসার একটা ডাল ভেঙে দিলেন আমার হাতে। ছোট্ট ডাল, তাতে দুটো পাতা কেবল। বললেন,মনে রাখবেন এ গাছ যদি আপনার হাতে মরে যায় তাহলে কিন্তু আর কোনো ডাল পাবেন না। এমনকি সারাজীবন এই উদ্যানে আর ঢুকতেও পারবেন না।

বাঁচবে। আমি ওকে বাঁচাবই। আমি ঠিক ওকে বড় করে তুলব। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার পিঠে লাগানো মেশিন পিঁক করে শব্দ করে উঠল। র মুহূর্তে দেখে নিয়ে বলল, আপনি এখন খুশি স্যার। অভিনন্দন। আপনি ধীরে ধীরে সুখী মানুষ হয়ে উঠছেন।

আমরা বাড়ি এলাম। একঘন্টার মধ্যে ড্রোন এসে টব, মাটি, সার সব দিয়ে গেল। আমি অর্ডার দিয়েছিলাম আমার বাড়ির মাটি আনতে, তবে সে জায়গায় এখন একটুও মাটি নাকি বাকি নেই। তবে সেই শহরের মাটি পাওয়া গেছে। আমি কাঁচের টবে গাছটাকে পুঁতলাম নিজের হাতে। র দরকার মত মেপে মেপে জল আর সার দিয়ে দিল।

সে রাতে আমার খুব ভাল ঘুম হল ইনজেকশন ছাড়াই। খুশির মাত্রাও বেশ ওপরের দিকেই রইল।

হাতে আর আঠেরো দিন তিন ঘন্টা। আমাকে খুশি থাকতে হবে। দেখা গেছে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকলেই আমি খুশি থাকি, হাওয়ায় একটা পাতা দুলে উঠলেও আমি এত খুশি হই যে বলার নয়। তৃতীয় দিন দুটো নতুন পাতার আভাস দেখা গেল এই প্রথম। সেদিন খুশির মিটারের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়েও কয়েক ডিগ্রি বেশি রইল।

সার, মাটি, গাছের উপযোগী প্রাকৃতিক জল, কৃত্রিম সূর্যালোক এসবে প্রতিদিন অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছিল। র মাঝে মাঝেই সেসবের হিসেব দিত। একদিন তো বলেই দিল, আমাদের ফিনান্সিয়াল কন্ডিশন খুব ভালো নয় স্যার। গাছের জন্য রোজ যে পরিমাণ খরচ হচ্ছে সেটা পূরণ করতে গেলে অন্য খরচ কমাতে হবে।

আমি নরম গলায় বললাম, তেমন হলে তোমায় বেচে দেব র। রোবট হলেও চালাক তো কম নয়, ব্যাপারটা বুঝে তারপর থেকে আর কিছু বলেনি।

পঞ্চম দিনে সকালে পাতাগুলোকে একটু নরম নরম লাগল। যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। র কে ডেকে বললাম। র অনেক গবেষণা করে বের করল যে আমার ঘরের তাপমাত্রা পেয়ারা গাছের অনুকূল নয়।

সেদিন থেকে আমার ঘর গরম করা হল। আমি খবরের কাগজ দিয়ে হাওয়া খেতাম কিন্তু পেয়ারা গাছের জন্য ঘর সঠিক গরম রাখতেই হবে। একদিনের মধ্যেই পাতাগুলো আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো।

আর বাকি তিনদিন। এই তিনদিন আমি খুশি থাকলেই আমার ব্রেন আর রিপ্লেস করা হবে না। আমার খুশির মিটার বলছে যেকোনো সাধারণ মানুষের থেকে আমি বেশি খুশি। প্রায় দেড়-দুশো বছর আগে মানুষ এরকম খুশি থাকত। তারপর থেকে মানুষের খুশির মাত্রা কমে গেছে।

আজ আমার জন্মদিন। জানতাম না, র ই জানিয়েছে। খুশির পরীক্ষায় পাশ করতে আর একদিন বাকি। কিন্তু জন্মদিনের দিন এমন একটা দৃশ্যে ঘুম ভাঙবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। সকালে উঠে দেখি আমার পেয়ারাগাছের টব মাটিতে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে।  তার নিচে চাপা পড়ে গেছে আমার একরত্তি গাছটা। আমার সন্তান! আমি দৌড়ে গিয়ে তুললাম তাকে। হাতে গোনা কয়েকটা পাতার মধ্যে বেশিরভাগই ছিঁড়ে গেছে বা থেঁতলে গেছে। গোড়াটাও ভেঙে গেছে। র দেখে বলল এ গাছ আর বাঁচবে না।

আমি র কে ধাক্কা মেরে বাইরে বেরিয়ে পাগলের মত চিৎকার করে বলতে লাগলাম কেউ গাছের ডাক্তারকে খবর দিন। আমার একমাত্র সন্তানটা মরে যাচ্ছে। কেউ আছেন? একবার খবর দিন। কয়েকটা ভাবলেশহীন মুখ চলে গেল কেবল, কেউ ফিরেও তাকালো না। আবার ঘরে ঢুকে দেখলাম র মেঝেতে পড়ে আছে, রোবটটাকে বেকায়দায় ধাক্কা দেওয়াতে আর উঠতে পারেনি। আর আমার পেয়ারা গাছটাও ওভাবেই পড়ে আছে।

আমি বুঝতে পারছি আমার পিঠে লাগানো খুশির মিটার বিপদসীমার নীচে নেমে গিয়ে আওয়াজ করছে। কিন্তু আমার গাছের কি হবে?

নিচে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। নিশ্চয়ই ডাক্তার বা পুলিশ। আমার ব্রেনটাকে আবার পাল্টে দেবে। তা দিক, তবু যদি গাছটাকে বাঁচাতে পারে। আমি দুহাতে গাছটাকে নিয়ে এক দৌড়ে নীচে এলাম।

নিচে এসে দেখি উদ্যানের সেই অফিসার। সঙ্গের ট্রাকে একটা বড় বাক্স। আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাক্সটা দিয়েই চলে গেলেন, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ব্যস্ত মানুষ!

বাক্স খুলে দেখি, আমার সেই পেয়ারা গাছ যেটা উদ্যানে দেখেছিলাম। আস্ত, পুরোটাই। আমাকেই গিফ্ট করা হয়েছে। আমি আবারও আনন্দে আত্মহারা। র এর মৃতদেহটা পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে গাছটাকে ঘরে ঢোকালাম। রোবটটাই যত নষ্টের গোড়া, ও ই হয়ত মেরে ফেলেছে আমার পেয়ারাগাছকে।

এবার আর ডাল নয়,আমার সেই পেয়ারগাছ গোটাটাই আমার ঘরে এনে রাখলাম। আমার খুশির মিটার বলছে এয়াবৎকালের সমস্ত রেকর্ড বোধ হয় আমি ভেঙে ফেলেছি। এত খুশি আমি আগে কখনো হইনি। ব্রেন পাল্টানোর আর প্রশ্নই ওঠে না। আমি আর আমার গাছ থাকব সারাজীবন। এভাবেই বাকি বছরগুলো কেটে যাবে।

একটু বাদে খেয়াল করলাম, গাছের নিচে আঠা দিয়ে লাগানো একটা ছোট্ট কার্ড। এতক্ষন দেখিনি! তাতে লেখা, র এর তরফ থেকে স্যারকে জন্মদিনের ছোট্ট উপহার।

র এর মৃতদেহটা মেঝেতে কুঁকড়ে পড়ে আছে এখনো। চোখ বোজা, তবে মুখটা হাসি হাসি, যেটা আগে কখনো দেখিনি।

souravmukh8@gmail.com
কলকাতা




No comments:

Post a Comment