1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

শান্তিবালার স্বর্গগমন

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

শান্তিবালার স্বর্গগমন
 রীনা ঘোষ

 এক
 শান্তি - সুদর্শন

     আজ শান্তিবালার বিয়ে। ধুমধাম করেই বটে। বরের নিজস্ব পাঁচ বিঘা জমি আছে, দেখতেও নাকি বেশ ভালো - লম্বা, রোগাটে গড়ন। এসব অন্যের মুখ থেকেই শোনা তার। সে এও শুনেছে তার বরের নাম নাকি অদ্বৈত। প্রথমে নামটা খুব কঠিন লেগেছিল তার। শুভদৃষ্টির সময় বারো বছরের শান্তি প্রথমবার যখন তার বর কে দেখল তখন কঠিন নামটার সহজ মানেটা বেশ মনে ধরল। হ্যাঁ অদ্বৈত-ই বটে, এরকম সুদর্শন পুরুষ সে এর আগে কখনো দেখেনি।

     এদিকে শান্তির গড়ন লম্বাটে হলেও রঙ ময়লা, তাই বারো বছর বয়সে একটি মেয়ের তার বরের প্রতি যে রকম আকর্ষণ জন্মায় তার থেকে যেন একটু বেশিই জন্মেছিল। তবে সে আকর্ষণ ঠিক কিপ্রকার তা জানা নেই। যাইহোক বিয়ের পরে দুই বছর বাপের বাড়ি থেকে সমস্ত কাজ কর্ম শিখে চৌদ্দ বছর বয়সে শান্তি স্বামীর ধুতির খুট ধরে এলো শ্বশুরবাড়ি। 


দুই 
পূর্ব কথা

     অদ্বৈতরা দুই ভাই আর তিন বোন। পূর্ববঙ্গ থেকে যখন এই বাংলায় আসে তখন ভাই বোন সকলেই ছোট। এদেশে আসার আগেই বড়দিদি আর তাদের মা কালাজ্বরে মারা যায়। চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে তাদের বাবা আসেন এখানে।  তাদের সাথে তাদের কিছু জ্ঞাতিও আসে কিন্তু তারাও যে যার মত ছিটকে পড়ে। অদ্বৈতরা পড়ে যায় একা। শুরু হয় বাঁচার লড়াই।

       জায়গা হয় একটি গ্রামে। চারিদিকে কচু বন, বর্ষায় হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা আর গরমে মাটি ফেঁটে চৌচির। সেই কচু বন কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করে গড়ে তোলে মাটির একটা দোচালা ঘর। বাংলাদেশে নিজেদের জমি বাড়ি ফেলে এসে আবার শূন্য থেকে শুরু করে তারা। তবে অদ্বৈত আর অনিল - দুই ভাই মিলে খুব অল্প সময়েই সংসারটিকে নিজেদের হাতে গড়ে তোলে। দুই জনই কর্মঠ, বলিষ্ঠ। সংসারের ভার নিজেদের কাঁধে নিয়ে বাবাকে বিশ্রাম দেয় । এক এক করে দেখে শুনে মেজদিদি আর ছোটো বোনটার বিয়ে দেয়। ঈশ্বরের আশীর্বাদে তারাও ভালো পরিবারে যায়। এবার বাড়িতে একটি বউয়ের দরকার হয়ে পড়ল, যে এসে সংসারের হাল ধরবে। সেই হেতু শান্তির এই পরিবারে আগমন। 


 তিন 
 নতুন সংসার

     এবাড়িতে এসে ওইটুকু মেয়ে কাজের চাপে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। ওদিকে আবার বাড়িতে কথা বলার কেউ নেই। স্বামী , দেওর সারাদিন মাঠে থাকে। সেই কাক ভোরে বেড়িয়ে যায় আর ফেরে সন্ধ্যের সময়। শ্বশুরমশাই কাজ না করলেও বাড়িতে থাকেন না। নিজের জমি জায়গা দেখাশোনা করে সময় কাটান। শান্তি ভোর থাকতে উঠে রান্না করে, সবাইকে খেতে দেয়। তারপর ঘরের সব কাজ করে, বিচুলি কাটে, ঘাস কাটে। একপাল গরু মোষ তাদের কে দিনভর দেখাশোনা করতে হয়।  সব কিছু একা হাতে। তবুও কথা বলার জন্য একজনের দরকার হয়। একটু মনের কথা, যে এই ফাঁকা বাড়িতে তার একাকীত্ব ভেঙে দেবে। জুটেও গেল একজন, পাশের বাড়ির মনার মা। হয়ে উঠল শান্তির প্রাণের সখি। এই মনার মা শান্তির জীবনে নানান চরিত্রে অভিনয় করেছে। কখনো সে ছিল শান্তির মনের সমস্ত কথা বলার প্রাণের সখি , তো কখনো সে করত দিদির মত স্নেহ, আবার হাতে ধরে কাজ শেখানোর সময় সে করত শাশুড়ির মত ব্যবহার। এভাবেই দিন কাটতে লাগল। আর এভাবেই শান্তির অগোছালো সংসার আস্তে আস্তে কচ্ছপের গতিতে এগোতে লাগল। 

      এমন সময় শান্তি সন্তান সম্ভবা হল। প্রথম সন্তান সবসময় বাপের বাড়ি হয় কিন্তু এবাড়িতে তিনটে লোক, তাদের খাওয়া দাওয়া, তার আপন সংসার - তাই শান্তি বাপের বাড়ি গেলো না। ওদিকে শান্তির মা মেয়ের বারণ শুনে চলে এলো জামাই বাড়ি, মেয়ের সংসার সামলাতে, মেয়ের যত্ন নিতে। দশ মাস পর শান্তি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। তখনকার দিনে হাসপাতালের উপর পাড়া গাঁয়ের মানুষের তেমন ভরসা ছিল না ,তাই শান্তির প্রসব বাড়িতেই হল। কিন্তু দুই রাত না যেতেই বাচ্চাটি শান্তিকে ছেড়ে গেল চলে। মুসড়ে পড়ল শান্তি। ষোলো বছর বয়সে প্রথম সন্তান হারানোর ব্যথা অনুভব করল সে। সংসারের কাজে মন গেল উঠে, সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকত। মনার মা ছিল ঠিকই কিন্তু তার নিজেরও তো সংসার আছে। শান্তির এই রকম অবস্থা দেখে শ্বশুরমশাই তার ছোটো ছেলে অনিলের বিয়ে দেবে ঠিক করল। সংসারে আর একজন এলে শান্তি হয়ত ঠিক হয়ে যাবে, আবার আগের মতই ছোটাছুটি করবে, হাসি খুশি প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠবে।


 চার 
 সন্তান - বিয়োগ

      বিয়ে হল অনিলের। ঠিক যে ভাবে বিয়ে হয়েছিল শান্তির। ছেলে মেয়ে কেউ কাউকে না দেখে সোজা বিয়ের পিঁড়িতে। তবে শান্তির মত নতুন বউকে আর বাপের বাড়ি রাখা হয়নি । বিয়ে দিয়েই সাথে করে নিয়ে আসা হয়েছিল শান্তির জন্য। ঘরে এলো প্রতিমা। ছোট খাটো শ্যামলা বরণ একটা মিষ্টি মেয়ে। একদম অনিলের বিপরীত। সুদর্শন অনিল হুবহু তার দাদার মত লম্বা ফর্সা। যাইহোক নতুন বউয়ের সাথে শান্তির বেশ ভাব জমে গেল। ঠিক যেন একমায়ের পেটের দুই বোন। মনার মার সাথে এই দুই বোনের মাঝে মাঝেই বসত গল্পের আসর। শান্তির শ্বশুরমশাই ও সব দেখে খুব খুশি হলেন। এরপর বেশ কিছু দিনের মধ্যে শান্তির কোল আলো করে এলো তার দ্বিতীয় সন্তান আল্পনা। সমস্ত দুঃখের অবসানে শান্তির সংসারে আবার শান্তি ফিরে এলো। 

      দুই ভাই আর দুই বউ - চারজনই মন দিয়ে সংসার করছে । সংসারে উন্নতিও হচ্ছে ,  জমি ভর্তি ফসল, গোলা ভর্তি ধান, গোয়াল ভর্তি গরু আর মন ভর্তি সুখ। প্রতিমার কোলেও এলো ফুটফুটে এক ছেলে। সংসারে আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। কিন্তু এই সুখ শান্তির বেশি দিন সহ্য হল না। পর পর তিন বছরের মধ্যে দুটো কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েও হারিয়ে ফেলল তাদের। একটা গেলো জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে , আর একটা গেল জন্মের এক মাসের মাথায়। সে সময় চিকিৎসা বিদ্যা এতো উন্নত ছিল না। তাই শিশু জন্মের হার যেমন ছিল বেশি , তেমনই মৃত্যু হারও ছিল আকাশ  ছোঁয়া। একুশ বছর বয়সে এসে তিন তিনটে সন্তান হারিয়ে শান্তি প্রায় পাগল হয়ে গেল। প্রতিমা সেই সময় শান্তির মা হয়ে উঠেছিল।  তাকে খাওয়ানো , স্নান করানো, তার ছোট্ট  আল্পনাকে দেখাশোনা করা। আবার নিজের ছেলেটির যত্ন নেওয়া। এছাড়া সংসারের কাজ তো ছিলই।  কিন্তু দিনদিন শান্তির অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল, তার পাগলামি চরমে উঠতে লাগল। শান্তি শাড়ি পড়তে চাইত না, ছুটে ছুটে চলে যেত, কখনও পুকুরধারে বসে একদৃষ্টিতে জলের দিকে চেয়ে থাকত, তো কখনও আমবাগানের মধ্যে কোনো এক গাছের নিচে চুপচাপ বসে থাকত। বাড়ির সকলে একপ্রকার নাজেহাল হয়ে গেল তাকে সামলাতে সামলাতে । এর মধ্যে একদিন সরকারি মানসিক হাসপাতাল থেকে লোক এসে তাকে নিয়ে যায়।  আমাদের গ্রাম বাংলার ভাষায় পাগলা গারদ। আশেপাশের পাঁচটা গ্রামে প্রচার হয়ে গেল। লোকজন ছি ছি করতে লাগল। কেউ বলল - "ও তো বিয়ের আগে থেকেই পাগল ছিল।" তো কেউ বলল - "শ্বশুর বাড়ির লোকজন পাগল করে দিয়েছে।" তারপর চারমাসের মাথায় একদম সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরল শান্তি। 


         পাঁচ 
           ভাঙা হাঁড়ি

       বাড়িতে আবার আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। সংসার আবার গুছিয়ে উঠল।বদনাম যা রটেছিল তাও আস্তে আস্তে পড়ল ধামা চাপা। সুস্থ স্বাভাবিক শান্তি ঘরকন্নার কাজে হয়ে পড়ল ব্যস্ত। বছর ঘুরতে লাগল শান্তি আবার সন্তান সম্ভবা হল। এবার ঘরে এলো এক পুত্র সন্তান অতুল। কিন্তু এই খুশির মধ্যে খবর এলো শান্তির বাবা পরলোক গমন করেছে।বাবার বাড়ির অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বাবা চলে যাওয়ার পর শান্তির মা আর দাদা খুব আরও একা হয়ে পড়ে। সেখানে গিয়ে শান্তি নিজ হাতে সব সামলায়। বাবার শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ, লোকজন খাওয়ানো - সব নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করেছে সে।

       এদিকে শ্বশুর বাড়িতে মাটির ঘর ভেঙে ইটের দেওয়াল দেওয়া ঘর হল। সংসারে তখন উন্নতির জোয়ার । বাবা মারা যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই শান্তির শ্বশুর মশাই ও পরলোক গমন করলেন। তবে তিনি ছেলেদের উন্নতি আর সুখ দেখে গেছেন। ছোটবেলায় মা হারা দুই ভাই বাবা কেও হারালো। কিন্তু দুই লক্ষীমন্ত বউ মিলে সবকিছু সামলে নিল।প্রতিমা ততদিনে দুই পুত্র আর এক কন্যা সন্তানের মা। এদিকে শান্তির কোলে এলো আরো একটি ছেলে মিতুল। সংসারের উন্নতি আর দুই বউয়ের এতো মিল দেখে পাড়াপড়শি দের সহ্য হল না। কান ভাঙ্গানো শুরু করে দিল।  মাঝে মাঝে টুকটাক অশান্তি ও হতে লাগল। অদ্বৈত তখন ভাইকে ডেকে সম্পত্তি দুই ভাগে ভাগ করে দিল। হয়ে গেল হাঁড়ি আলাদা আর পড়শিরা হাতে তালি দিয়ে উঠল। পরে অবশ্য দুই বউই তাদের ভুল বুঝতে পারে কিন্তু ভাঙ্গা সংসার আর আলাদা হাঁড়ি কখনো জোড়া লাগে না। তাই এক বাড়িতে তৈরি হল দুটো রান্না ঘর, দুটো ধানের গোলা আর দুটো উঠোন।


  ছয় 
      একটি ডাকাতি

     এর মধ্যে এক শীতের রাতে তাদের বাড়িতে পড়ল ডাকাত। যখনকার কথা হচ্ছে তখন বাংলার ডাকাত খুব বিখ্যাত ছিল। যাদের বাড়িতে আসবে সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে যাবে । কিন্তু এই ডাকাত কিছু লুঠ করতে আসে নি। নিতে এসেছিল শান্তির স্বামীর প্রাণ। পাশাপাশি দুই ঘরে দুই ভাই আর দুই বউ তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে ছিল ঘুমিয়ে। ইটের দেওয়াল আর টিনের দরজা । প্রথমে ভুল করে ডাকাতরা অনিলের ঘরে ঢুকে পড়ে। অনিলকে ধরে তারা বুঝতে পারে ভুল লোক কিন্তু ছেড়েও দেওয়া যাবে না । তাই চলতে থাকে চড় থাপ্পড়। আর কিছু ডাকাত গেল শান্তির ঘরের দিকে। এদিকে অনিল একটু হালকা পেয়ে কোনো রকমে পালিয়ে
 গেল । মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে। প্রতিমা তার তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে লুকিয়ে রইল গরুর গোয়ালে। কুড়িটি গরুর মাঝখানে, ডাকাতদের চক্ষুর আড়ালে।

      এদিকে অদ্বৈত ব্যাপার বুঝে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে রইল দাঁড়িয়ে যাতে দরজা সহজে খুলতে না পারে। কিন্তু অদৃষ্টকে কে রুখতে পারবে? ডাকাতের কাছে ছিল ভোজালি। সেই ভোজালি দিয়ে টিনের দরজায় মারতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই টিনের দরজা ভেদ করে ভোজালি বারবার গিয়ে লাগতে থাকল অদ্বৈতর বাঁ পাঁজরে। এদিকে শান্তি তার ছেলেমেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়ে অঝোর কেঁদে যাচ্ছে, ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অদ্বৈতর পাঁজর ফুঁটো হয়ে রক্তে ভেসে যেতে লাগল। এর মধ্যে অনিল পাড়ার লোকজন নিয়ে রৈ রৈ করতে করতে ছুটে এলো। সবার হাতে দাঁ, কাঁচি, কুড়ুল দেখে ডাকাতরা কোনো মতে পালিয়ে গেল, নইলে অদ্বৈতর জীবন সেই দিনই শেষ হয়ে যেত। বাঁ দিকের পাঁজর এতটা গর্ত হয়ে গেছিল যে শান্তির পুরো একখানা কাপড় তার মধ্যে ঢুকে গেছিল। তারপর তাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে। সে এক জীবন মরণ লড়াই। এযেন যমের সাথে শান্তির লড়াই। ঠাকুরের কাছে গিয়ে নাওয়া খাওয়া ভুলে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকত। সংসার আর ছেলেমেয়ের ভার আবারও একবার গিয়ে পড়ল প্রতিমার উপর। তবে শেষ রক্ষা হল। সে যাত্রায় শান্তির সিঁদুরের জয় হল। অদ্বৈত বেঁচে ফিরল।

     পরে জানা গেল পাশের গায়ের কারোর জমির ফসল খেয়ে নিয়েছিল অদ্বৈতর গরু। সেই রাগে ডাকাত সেজে তারাই মারতে এসেছিল অদ্বৈতকে। শান্তি ভাবল এতো ছোটো অপরাধের এতো বড় শাস্তি? 


                         সাত 
                     স্বামীহীনা 

     এই ঘটনার পর আরো পাঁচ বছর কেঁটে গেল। শান্তির কোলে এলো অপর্ণা। তার শেষ সন্তান। কিন্তু অপর্ণার জন্মের দেড় বছরের মাথায় শান্তি বিরাট বড়ো একটা ধাক্কা খেল। সেই ডাকাত পড়ার সময় অদ্বৈতর যে জায়গাটা ক্ষত হয়েছিল , সেটা ধীরে ধীরে ঘা- তে রূপান্তরিত হয়েছিল। আর তাতেই প্রাণ হারালো অদ্বৈত। চলে গেল শান্তির প্রথম দেখা সেই অদ্বিতীয় মানুষটি। ফেলে গেল গোটা একটা পৃথিবী আর তার মাঝে চার ছেলেমেয়ে নিয়ে একা শান্তি। তার মনে হতে লাগল গোটা পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নেওয়ার মত একটু বাতাস নেই, দুঃখ ভুলে লুকোনোর কোন জায়গা নেই আর শান্তির চোখের জলের কোনো শেষ নেই। শান্তি একা , বড়ো একা।

      জমি আছে কিন্তু চাষ করার কেউ নেই। ছেলেমেয়ে সব ছোটো। চাষ না করলে খাবেই বা কি? এগিয়ে এলো অনিল। ছোটো ভাইয়ের কর্তব্য করতে একটুও পিছপা হয়নি সে। এগিয়ে এলো প্রতিমা দিদিকে আরও একবার সামলানোর জন্য। সংসারটি আরও একটিবার বাঁচানোর জন্য।

      শান্তিকে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে হল, তার নিজের জন্য নয়, তার চার চারটে ছেলেমেয়ের জন্য। সংসার সামলায় আবার জমির দেখাশোনাও করে। এদিকে দুই ছেলে পড়াশোনা লাটে তুলে দিয়ে কাকার কাছে চাষের কাজ শিখতে শুরু করল। এর মধ্যে বড়ো মেয়ে আল্পনার জন্য সম্মন্ধ এলো। ছেলে সৎ , ভালো পরিবার তাই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। খুব ধুমধাম করে না হলেও মোটামুটি ভালো ভেবেই বিয়ে হল।যাইহোক দুই ভাই খুব পরিশ্রম করতে লাগল সংসারটাকে নতুন করে দাঁড় করানোর জন্য। এই ভাবে বছর ঘুরতে লাগল , ভেঙে যাওয়া সংসার আবার শিরদাঁড়া তুলে দাড়ালো। স্বামী মারা যাওয়ার শোক কিছুটা অল্প হলেও সহজে কি ভোলা যায়? সেই ক্ষতির কি কোনো ক্ষতিপূরণ হয়? তাই মাঝে মাঝে যখন বেদনা হত তখন পুরনো ক্ষত অশ্রুকণা হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত বইতে থাকত। জানান দিত কি নিদারুণ শোক তার অন্তরে চেপে রাখা আছে। এভাবেই শান্তির অবসন্ন দিন গুলি অতিবাহিত হতে লাগল। 


                           আট
                        সং - সার

      এভাবেই কেটে গেল অনেকগুলো বছর। দুই ছেলে বড় হয়েছে।এবার ছেলেদের বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনতে হবে। শান্তিই বা আর কতদিন সংসারের হাঁড়ি টানবে। তার বয়স হয়েছে, চোখে এসেছে মত কাঁচের চশমা । অনিল একদিন শান্তিকে বললো - "একটা ভালো মেয়ের খোঁজ পেয়েছি , একবার দেখবে নাকি? আমাদের অতুলের সাথে বেশ মানাবে।" হ্যাঁ মেয়ে সুন্দরী বটে কিন্তু উপরের সৌন্দর্য্য দিয়ে ভিতরের সৌন্দর্য্যের বিচার না কোনোদিন হয়েছে আর না কোনোদিন হবে। নতুন বউ দিপালী এসে তার প্রমাণ হাতে নাতে দিয়ে দিল। তবুও দোষ গুণ বিচার না করে শান্তি চেয়েছিল একসাথে থাকতে। প্রতিমাও দিপালী কে অনেক বুঝিয়েছিল তা সত্বেও শান্তির ছোটো সংসার আরও একবার ছোটো হয়ে গেল। বড়ো ছেলে বড়ো বৌমা পৃথক হয়ে গেল। আর শুধু তাই নয় , হাঁড়ি ভিন্ন হওয়ার সাথে সাথে বাড়িও ভিন্ন হল। বাবার বড়ো ছেলে অতুল মা - ভাই  আর ছোটো বোনের সমস্ত দায়িত্বভার একপ্রকার অস্বীকার করে চলে গেল অন্যত্র। শান্তির এতো আশা এতো ভরসা সব মিথ্যে হয়ে গেল। ভেবেছিল অনেক তো হল এবার একটু বিশ্রাম নেবে কিন্তু ঈশ্বর তাকে বিশ্রাম দিলে তো।

       এভাবেই দিন যায়, এদিকে ছোটো মেয়ের ও বিয়ের বয়স হয়েছে। সেই চিন্তায় শান্তির নাওয়া খাওয়া প্রায় উঠে গেল। ভালো ছেলে পাওয়া তো মুখের কথা নয়। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে তবু একটা খোঁজ পাওয়া গেল। ছেলে মেয়ে সব পছন্দ হল। হয়ে গেল বিয়ে। দু বছরের মধ্যে সন্তানের মুখ ও দেখল কিন্তু এমন এক রোগ হল, যা না কোনো ডাক্তারের পরীক্ষায় ধরা পড়ে আর না কোনো অসুধে কাজ হয়। দিন দিন শরীর ভাঙতে লাগল, সাথে বমি, পেট ব্যাথা। ডাক্তার, বদ্যি, হাকিম, ঠাকুর বাড়ি, ঝার ফুক - সব করা হল কিন্তু কোনো কাজ দিল না। মেয়ে দিন দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। ওদিকে বড়ো জামাই মাটির মানুষ হলেও সংসারে নিত্য অভাব লেগেই আছে। মেয়েদের চিন্তায় শান্তি দিশেহারা। মাসের বেশির ভাগ দিনই ছোটো মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকে, থাকতে হয়। নইলে মেয়েটার সংসার যে ভেসে যাবে। তাই নিজের সংসারের জন্য ছোটো ছেলের বউ নিয়ে আসা আবশ্যক হয়ে পড়ল। বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে, তাই দেখে শুনে বিয়ে দিল ছেলের। বৌমা এসে হাল ধরল সংসারের। এবার তো এমন হাল ধরল যে এই সাধের সংসার থেকে শান্তির প্রায় সমস্ত অধিকারই উঠে গেল। যাক তবু চিন্তা তো একটু কমল।


                           নয় 
                      বৃদ্ধ বটবৃক্ষ

       ঘটল আর এক বিপদ। বিয়ের চার বছরের মাথায় ছোটো ছেলের নতুন রোগ ধরা দিল। অনেক টা মৃগী রোগের মত। ছেলের জন্য ও অনেক ছোটাছুটি করা হল। রোগ ও ধরা পড়ল, কিন্তু এমনই অসুখ যে আসুধ খেলে কম পড়ে, আবার বেড়ে যায়। ছেলের অনিশ্চিত জীবন শান্তিকে আরও ভেঙে দিল। মিতুলের কিছু হলে নতুন বউটার কি হবে শান্তি দিশেহারা হয়ে পড়ল। তবুও শান্তি যেন যমের দুয়ার আগলে দাঁড়িয়ে থাকার পণ করল। একদিকে ছোটো ছেলে আর একদিকে ছোটো মেয়ে। এমনিতেই ছোটো সন্তানের উপর মায়ের টান একটু বেশিই হয়, তার উপর সেই সন্তান যদি রুগ্ন হয়।

       যেদিন থেকে এই বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকে মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেছে  নানান ঝড় ঝাপটা। বট বৃক্ষের মত শান্তি তাও অটল হয়ে ছিল এতো গুলো বছর। কিন্তু সেই জোয়ান বটগাছ  আজ বুড়ো হয়েছে, সহ্য শক্তি কমেছে। এক বৃষ্টির রাতে চরম বিদ্যুতের ঝলকানি এখন খুব সহজেই তাকে জ্বালিয়ে ছারখার করে দিতে পারে, বা কোনো মেঘের জোরালো গর্জন বাজ হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে সেই বৃদ্ধ বটবৃক্ষকে নিস্তেজ দিতে পারে খুব সহজেই। শান্তির দশাও খানিকটা সেই রকমই। 

                         দশ
                     স্বর্গ গমন?

      শান্তি বারবার ভেঙেছে, বরাবর উঠে দাঁড়িয়েছে।  একদিন যে মানুষ গুলো তার পাশে খুঁটির মত তাকে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল তারাও এক এক করে সবাই ভগবানের প্রিয় হয়েছে। তিন বছরের মধ্যে মনার মা, অনিল আর প্রতিমা চলে গেল। এতটা একা নিজেকে আর কক্ষনো লাগে নি শান্তির। অদ্বৈত চলে যাওয়ার পড়ে তবুও এরা পাশে ছিল কিন্তু এখন , চারিদিকে শুধু মৃত্যুই যেন চোখে পড়ে শান্তির। শরীর সাথ দিলে চাইলেও মন সাথ দেয় না আর। আপনজনদের মৃত্যু, সন্তানদের শরীর তাকে বড্ড মুচরে ফেলেছিল। এর মধ্যে একদিন মনার ছোটদাও দীর্ঘদিন রোগে ভুগে চলে গেল। সেও তো ছিল শান্তির ছেলের মতই। তাই মনার দাদা মারা যাওয়ার শোক শান্তি আর সামলে উঠতে পারল না।বারবারই নিজের ছেলেমেয়েদের মৃত্যু ভয় তাকে তাড়িয়ে বেড়াত। প্রতিনিয়ত শুধু একটা চিন্তাই তাকে কুরেকুরে খেত, যদি তার মৃত্যুর আগে তার ছেলেমেয়ের কিছু হয়ে যায়। এই বয়সে এসে সন্তান শোক সহ্য করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য। এই সব চিন্তায় ধীরে ধীরে শান্তি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। বিছানা থেকে ওঠার শক্তি থাকলেও মনের ইচ্ছা ফুরিয়ে এসেছিল। তারসাথে ফুরিয়ে এসেছিল বাঁচার ইচ্ছাও।

         যে মানুষ ভিতর থেকে মারা যায়, তাকে বাইরে জীবিত রাখা বড় দুষ্কর হয়ে পড়ে। তারপর এক ঝড় জলের গভীর রাতে শান্তি তার সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা একপ্রকার ত্যাগ করে বিদায় দিল এই পৃথিবী থেকে, তার সাধের এই সংসার থেকে। চৌদ্দ বছর বয়সে বউ হয়ে এসেছিল সে এই বাড়িতে। যার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে এসেছিল সে তো অর্ধদায়িত্ব পালন করেই পালিয়ে গেছিল কিন্তু শান্তি পালাতে পারে নি। তাকে পালন করতে হয়েছে সমস্ত দায়িত্ব, তাকে বুক দিয়ে ঠেকাতে হয়েছে সমস্ত বিপদ। আজ সে বড় ক্লান্ত , আজ সে অপারগ তাই এখানে তার আর কোনো প্রয়োজন নেই। চার ছেলেমেয়েকে তাদের নিজের নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে শান্তি চলে গেল শান্তির খোঁজে।

   শান্তির স্বর্গারোহন হল নাকি সে নরকে পতিতা হল তা আমার জানা নেই, জানা সম্ভব ও নয়। তেমনি এটাও জানা সম্ভবপর হয় নি যে আমাদের অভাগী শান্তি মৃত্যুর পড়ে আদৌ শান্তি পেল কী? 
                                                                        (সমাপ্ত)

rina21.ghosh@gmail.com
নদিয়া 


No comments:

Post a Comment