1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

কচুরির তেল ও অন্যান্য

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

কচুরির তেল ও অন্যান্য
রক্তিম ঘোষ 

                                                                               (১)
             সেইসব মাটিগুলোকে কেমন অচেনা মনে হয়। সেইসব ঘ্রাণগুলোকেও। কিন্তু কখনও কখনও বৃষ্টি নামলে নাক টেনে গন্ধ নিতে ইচ্ছে করে। ভেজা মাটির গন্ধ। খুব প্রাচীন এবং বহুচর্চিত ভালো-লাগা হলেও, এই ভালো-লাগাটা যেন সবার কাছেই নিজের মতো করে আসে। নিজের নিজের মতো করে। ধরা যাক নৃপতি সাহার কথা। পঞ্চান্ন বছর বয়স পার হতে চললো তাঁর, তবু বৃষ্টি নামলে কেমন উদাস হয়ে যান। নাক টেনে টেনে কিসের গন্ধ শোঁকেন। হারিয়ে যাওয়া কোনও স্মৃতি-কোনও মানুষ কিংবা কোনও মৃত্যুকে হয়তো বা এভাবেই নিজের করে নিয়েছেন।  
তবে আজকের নাক টানাটা একটু অন্যরকম। মানে বোঝা যায় মোটামুটি নাক টানার কারণ। আন্দাজ তো করা যায়ই। ঘটনা হলো মাস কতক দোকান বন্ধ — রুটি-রুজি নেই। বাজারে ধারও হয়েছে মন্দ নয়। সেসব বোঝা মাথায় নিয়ে খুলবো খুলবো করেও দোকানটা আর খোলা হয়নি। খুললেই হতো। সমস্যার কিছু ছিল না তেমন। পাওনাদারেরা বরং খুশি হতেন ধার শোধ হওয়ার আশায়। কিন্তু দোকানটা খুলতে আর ভালো লাগছে না তার। 
অভাব না; সে অভাব তো আছেই, অভাব মেটাতে গেলে দোকান খোলা ছাড়া আর পথ নেই তেমন। খুলতেই হবে তাকে। এভাবে ঘরে বসে থাকলে তো আর চলবে না। গৃহিণী ইদানিং ঘরে বসে থাকা নিয়ে দু’চার কথা শুনিয়েও দিচ্ছে। শরীর খারাপের বায়না দিয়ে উদাস চোখে পানা পুকুরের দিকে তাকিয়ে থেকে আর ক’টা দিনই বা চলে। হাত টান একটু কমেছে বটে, তবে সেও ওই দোকানের করুণায়। পূর্ণ লকডাউনের সময় ঘরটা ছেড়ে দিয়েছিলেন পাড়ার ছোঁড়াদের হাতে। কমিউনিটি কিচেন করে রান্নাবান্না হতো। দু’মুঠ ডাল-ভাত তাঁদেরও জুটে যেত ফ্রি-তে। তারপর গাড়ি-ঘোড়া খানিক চলতে শুরু করলে ঘরটা দু’চার দিনের জন্য মাল রাখতে একে ওকে দিয়েছেন। সামান্য হলেও এই বাজারে হাতে যা এসেছে তা তো নেহাত ফেলনা নয়। তবে ওই অব্দিই। কিন্তু ওই করেই বা কতদিন।
বৃষ্টির গন্ধ নাকে আসতে শরীরে কেমন একটা আমেজ এল। হঠাৎ খেয়াল হলো ঘরটা এবার খোলা দরকার। এভাবে আর কতদিন শাটার নামিয়ে পড়ে থাকবে। বাজার দোকান সবাই খুলে ফেলেছে এবার, আর বন্ধ রেখেই বা লাভ কী! বৃষ্টির গন্ধে কেমন ফুটন্ত তেলের মৃদু শব্দ আর আঁচ এসে ধাক্কা মারলো। আঃ। ভীষণ কচুরি ছাড়তে ইচ্ছে হলো কড়াইতে। 
কিন্তু আজ তো কিচ্ছু হবার নয়। দোকানের চাবিটা যে কাছে নেই। হঠাৎ মনে পড়লো ঘরটা শেষ ভাড়া দিয়েছিলেন দিন পনেরো হলো। তারপর থেকে আর পরিষ্কার করা হয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। নাঃ কিচ্ছু করার নেই আজ।
                                                           (২)
           প্রেমটা নেমেছে সাত মাস হলো, তার মধ্যে পাঁচ মাসই লকডাউন। দেখা নেই – সাক্ষাৎ নেই, কাঁহাতক আর ফোনে কথা বলে আর ভিডিও কলে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলা যায়! উপায় নেই সক্কলে বাড়িতে। মা-বাবা কারুরই বেরোবার নাম বা চান্স কোনটাই নেই। সুতরাং মেসেজ টিপতে টিপতে আঙুলের সাড় চলে গেছে। কেমন ফুলে উঠেছে, দেখলে মনে হয় ভিতরে পুঁজ জমেছে। ভারী মুশকিল, নখের ডগায় ব্যথা করে ভীষণ। তার উপর সত্যি বলতে কোনও কাজ নেই। নাঃ। কোনও কাজই নেই। এমনকি ভ্যাগাবন্ড হয়ে চরে বেড়াবার উপরও কেন্দ্র-রাজ্য-পরিবার সব সরকারের নিষেধাজ্ঞা। কিস্যুই আর ভালো লাগ না। ধ্যার। এর চেয়ে প্রেম না হলে বেশি ভালো হতো।  
নীহারিকা যখন হেলতে দুলতে রাস্তা দিয়ে যেত, তখন দূর থেকে সাইকেলে ফলো করার মজাটাই ছিল আলাদা। গোটা পাড়াটা নীহারিকা একাই কভার করতো। পাড়ার বাইরে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে অবশ্য ওর অন্য বন্ধুবান্ধবীরা থাকতো। বাস বন্ধ হবার আগে আর প্রেমের পর ক’দিন সে অবশ্য সাইকেলে করে ছেড়ে এসেছে ওখানে। কিন্তু না, সেই হেলতে দুলতে হাঁটাটা পিছন থেকে অচেনা লোকের মতন চেয়ে দেখার আমেজই আলাদা ছিল। খোকন তখনই বলেছিল, অন্য কেউ হলে নীহারিকাকে বলেই দিত মনের কথা। এত ঘাবড়ানোর কী আছে! বলার কথা মনে যে হয়নি একদম তা নয়, কিন্তু এত হিম্মত ছিল না। বরং দূর থেকে সাইকেল চালানোটাই — মানে এই নজরদারীর ভঙ্গিমায় পিছন পিছন যাওয়াটার মধ্যে একটা ইঙ্গিত ছিল তো! স্পষ্ট ইঙ্গিত না কি? নীহারিকা কি গাধা নাকি যে খেয়াল করবে না। একদিন দু’দিন হলে অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে, কিন্তু মাসের পর মাস, দিনের পর দিন! 
দীপ্তর মনে হলো সেই রোমাঞ্চগুলো এই জীবনে আর ফিরবে না। উফ্ কী উত্তেজনা! রোজ একটাই চাওয়া থাকতো। এই তাকালো বুঝি — এই বুঝি একটু হাসলো। মাইরি বলতে এতোগুলো মাস ওভাবে এঁটুলির মতো এঁটে থাকার চেষ্টা করেও কোনও লাভ হয়নি। নীহারিকা তাকালোই না কোনদিন। কথা বলা তো দূরে থাক। 
তারপর বাধ্য হয়ে সেদিন দীপ্ত ঠিক করেছিল চিঠি লিখবে নীহারিকাকে। কিন্তু কীভাবে? আরে একটা লাইনও মাথায় এলে তবে তো লেখার প্রশ্ন! খোকন অনেক বড় বড় লাইন বলে দিয়েছিল; এমনকি বললো প্রয়োজন হলে ওই লিখে দেবে। কিন্তু না ভাই, এটা দীপ্তর পার্সোনাল ম্যাটার। এখানে যা করার ওকেই করতে হবে। ওই খোকনকে শুধু নীহারিকাকে গিয়ে দিয়ে আসতে হবে।  
—ওসব হবে না। আমি কি মাকাল নাকি?
—তাহলে চিঠি দেব কী করে?
—সাইকেলে করে হাতে হাতে। 
—আমি দেবো আর ও নিয়ে নেবে? আর সামনা সামনি হতেই যদি পারতাম তাহলে আর চিঠি কেন?
—সেটাই তো! সোজাসুজি বলে দে।
—তাহলে তোকে কী প্রয়োজন? কোথায় একটু হেল্প করবি তা নয়…
—আচ্ছা দেখছি। অন্য রাস্তা ভাবতে হবে। আচ্ছা চিঠি রেডি? 
—সে রেডি করে ফেলবো। কাল দিই তোকে? 
—হ্যাঁ বেশ।… আচ্ছা শোন কাল তোর সাইকেলটা একটু দিস্ তো আমায়।
—কখন নিবি?
—সকালে। দশটা নাগাদ।
—ধোর্! তখনই তো ও স্কুলে যাবে… 
—হ্যাঁ তখনই। 
—চিঠিটা সকালে আগে — মানে ভোরবেলা লিখে দেবো? 
—না আজ রাতে। 
—কিন্তু ভাই কী লিখবো? 
—মানে!! কী লিখবি মানে??? 
সারারাত ঘুমোতে পারেনি দীপ্ত। নিজে হাতে লিখেছে তার প্রথম প্রেমপত্র। ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ করতে হয় জানলে তো খুব সহজ হয়ে যেত… তবে খুব ছোট্ট চিঠি…
নীহারিকা, 
আমি তোকে খুব ভালোবাসি।
দীপ্ত ৭/২/২০২০
ব্যস। আর কিচ্ছু না। বরং সারারাত ধরে ভেবেছে খালি নীহারিকার নামটা না, সবটাই রক্তে লিখবে। বাঁ হাতের পাতার মাঝখানটা, ঠিক রেখার উপর ব্লেড বুলিয়ে বুলিয়ে। ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলেছে দীপ্ত। সারারাতে খোকনকে দেওয়া হয়নি চিঠিটা। 
ভোরবেলা খোকনের বাড়ির দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিল। এখন ভীষণ শীত করছে তার। সূর্য উঠতে দেরী এখনও। গোটা পাড়া ঘুমোচ্ছে। সে আলতো করে বসে পড়লো খোকনের বাড়ির পাশের কদম গাছতলায়। রক থেকে নেমে এল তারপর। কেমন ঘোর লাগা চোখে বসে পড়লো পিচ রাস্তার ধারে ধুলোর মাঝে গজিয়ে ওঠা একমুঠো ঘাসে। মাথা থেকে চাদরটাও সরিয়ে নিল। আস্তে আস্তে শিশিরের বিন্দু জমতে লাগলো কপালে-গালে। ভোরের কুয়াশায় আবছায়া সবকিছুর দিকে তাকিয়ে তার নিজেরই মনে হচ্ছিল, এক অলৌকিক কৃচ্ছসাধন করে চলেছে সে।

                                                      (৩) 
               একটানা সারা রাত বৃষ্টি। মাথার ভিতরটাও কেমন ঝিমঝিম করছে আজকাল। আচ্ছা কাল তিনি ঘুমিয়েছিলেন তো? দূর ছাই। স্বপ্ন আর বাস্তব সব জবাব দিয়ে দিয়েছে। এখন বৃষ্টিটা আর ভালো লাগছে না। ভিজতেও ইচ্ছে করছে না। কেমন একটা গায়ে শিরশির করে উঠছে। করোনা হবে না তো? 
মাথায় ছাতা দিয়ে পায়ে পায়ে হাঁটা লাগালেন ষষ্ঠীর চা-দোকানের দিকে। মাস্ক লাগাতেও ভুল হয়নি আজ। গতকাল ওই কেলোটাই হয়েছিল। মুখে মাস্ক থাকলে তাঁর যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, কাকে বোঝান! আর এরাও কি বোঝবার পাত্র? সুযোগ পেলেই হলো, ফোকটে জ্ঞানদানের কোনও বিরাম নেই। পারেও মানুষ!
চায়ের চুমুকটাও কেমন তিতকুটে লাগে তাঁর। আজ কিছুই ভালো লাগছে না। কী একটা হারিয়ে গেছে। কী যেন? খুব চেনা কিছু। শান্তি পাচ্ছেন না কিছুতেই। ষষ্ঠী বলে, ও নিপু, দোকানটা আর খুলবিনি? হ্যাঁ, দোকান! দোকান! এই তো মনে পড়েছে চাবি… হ্যাঁ চাবিটাই তো! সেই তেল চিটচিটে হাতা, কড়াই আর… কতকাল সেসব তাঁর হাতের ছোঁয়া পায়নি।  
খুব ইচ্ছে করছে এখুনি ছুট্টে যান দোকানঘরে। কিন্তু, চাবিটা! চাবিটা যে খোকন চেয়ে নিয়েছে তাঁর থেকে। সে আজ তিনদিন হলো। বলেছিল এক-দু’দিনে ফেরত দেবে। কী যে হলো ছোঁড়াটার! তারপর থেকে কোনও সাড়া নেই। কেমন বেপাত্তা হয়ে গেছে। কেন লাগবে জানতে চাইলে একশ টাকা গুঁজে দিল হাতে। যা করবে করুক মরুক গে যাক। কিন্তু চাবিটা দিয়ে গেল না যে! দেখা হলে আরও কটা টাকা চাইতে পারবেন ভেবে পরক্ষণেই মনটা একটু শান্ত করার চেষ্টা করলেন। 
যদিও মনটা তারপরও কেমন খচখচ করতে লাগলো তাঁর। ঘরটা কেন নিল ছোঁড়াটা? কোনও বদ মতলব নেই তো!  

                                            (৪)
               কতক্ষণ তাকিয়েছিল জানে না। তারপর ধুম জ্বর। কীসব বকবক করেছিল জ্বরের মধ্যে, দীপ্তর কিচ্ছু মনে নেই। কিচ্ছু না। যখন হুঁশ ফেরে তখন বাড়ির বিছানায়। মাথায় গায়ে ঝিমঝিম ভাব আর বড্ড দুর্বলতা। মাথা তুলতে গেলেই চক্কর লেগে যাচ্ছে। সাল তারিখ মুহূর্ত কিছুরই হিসাব নেই তার। কী, কেন, কোথায় কিচ্ছুর না। বাড়ির সবাই ভীষণ স্বাভাবিক। ভীষণ ভাবেই স্বাভাবিক। সবকিছু যেন ঠিক আছে, কোথাও কিছু হয়নি। কিন্তু নীহারিকা?
ঘুম ভাঙতে সামনে দেখে খোকন বসা। ভীষণ স্বাভাবিক খুশি খুশি মুখ। তাকে সেরে উঠতে দেখে খোকনের চোখে আলোর ঝলকানি যেন। আলতো গলায় কথা বলতে গিয়ে সব গুলিয়ে যায় দীপ্তর। শুধু মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, 
—নীহারিকা!
—সব ঠিক আছে বস্। ম্যানেজ করে নিয়েছি।
—চিঠিটা!
—এনেছি সাথে করে। চাপ নিও না। 
—আমি ওখানেই পড়েছিলাম না?
—ওই কদমতলায় তো। কিন্তু চিঠির কথাটা জানলি কীকরে? 
—বাঃ জানবো না? পকেটে রেখেছিলাম, পাসনি?
—কোন চিঠি! দেখিনি তো! আমি তো অন্য চিঠির কথা বলছিলাম। একটা জেনুইন স্যাম্পেল বানিয়েছি। আজ ঘন্টাখানেক বাদে ওর সাথে অ্যাপো আছে। তুমি শুধু একটা অটোগ্রাফ দিয়ে দাও। ব্যস! 
—পাসনি চিঠিটা?
—না। আমি তোর বুক-প্যান্ট সব হাতড়ে দেখে নিয়েছিলাম। চিঠি পাইনি তাই দু’দিন দেরী হলো। একবার পড়ে দেখ্ এটা। জম্পেশ বানিয়েছি…
—কোথায় আসবে ও? 
—মাঠের ধারে ওই আইসক্রিম কারখানার গলিটায়। 
—চল যাবো। 
—মানে! এই অবস্থায় তোকে নিয়ে আমি কেস খাই নাকি? তাছাড়া কাকিমা তোকে বেরোতে দেবে এখন?
দীপ্ত উত্তর দেয় না। চিঠিটা নেই। চিঠিটা হারিয়ে গেছে। শুধু এটুকুই যেন মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকে। চিঠিটা থাকলে কী হত? কিচ্ছু না। কিন্তু ওর রাতজাগা যন্ত্রণা! কান্না দলা পাকিয়ে গলার কাছে জমতে থাকে। খোকন আর মা সামনে দিয়ে ঘুরছে, হাত-পা ছুঁড়ছে… কত কথা বলছে। কানে ঢুকছে না কিছু আর।  
ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছে সে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারছে না দীপ্ত। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে মাঠের দিকে। মাঠটা পার হলে আইসক্রিম কারখানা। একরাশ কুয়াশা এসে জড়ো হয় মাঠের ঠিক মাঝখানে। সবকিছু আবছায়া লাগতে শুরু করে। দূরে কোথাও একটা ঘন্টা বেজে ওঠে। সাইকেলেরও হতে পারে শব্দটা। আচ্ছা তার সাইকেলটার কী হলো? 

                     (৫)
      হাঁটতে হাঁটতে খোকনের বাড়ি অব্দি পৌঁছনোর আগেই সাইকেলের ঘন্টি। 
—নিপুকাকু! চাবিটা… 
হাত বাড়িয়ে চাবিটা নিয়ে নেন নৃপতিবাবু। কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই দেখলেন ছোকরা অপেক্ষা করবার মেজাজে নেই। সাইকেলটা কোনমতে দাঁড় করিয়ে বাড়ি ঢুকে গেল হুট করে। ভারী অদ্ভুত ছেলে। বেআক্কেলে-উজবুক। মনে মনে গালাগালি দিলেও চাবিটা পাওয়ার আনন্দে বাড়তি টাকার কথা ভুলে মেরে দিয়েছেন। 
চা তেষ্টা পেল হঠাৎ। মন পুলকিত হলে চা তেষ্টা পাওয়াটা ভীষণ স্বাভাবিক ওনার কাছে। কোনদিকে যাবেন বুঝতে পারেন না। দোকান যেতেও ইচ্ছে করছে ভীষণ। আর চা-এর তেষ্টা টানছে উল্টোদিকে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থা যাকে বলে। কিন্তু সম্পত্তির টানের চেয়ে আর কোনও বড় টান আছে কি?  
কিন্তু এই টানটা বোধহয় ঠিক সম্পত্তির নয়। নিজের ঘর-নিজের কড়াই-নিজের খুন্তি, শুধু এই টানেই মানুষ এমন করে উন্মত্তের মতন অভ্যস্ত পায়ে জগত সংসার ভুলে দোকানের দিকে হেঁটে যেতে পারে কি? নাকি কৌতূহল। অদম্য কৌতূহল। এতো তাড়াহুড়া করলো কেন ছেলেটা? কিছু কাণ্ড বাধায়নি তো? ঘরের মধ্যে কোনও চিহ্ন রয়ে গেছে নির্ঘাত কৃতকর্মের। কোন্ টান বড় এখন একমাত্র নৃপেন সাহাই জানেন। কিন্তু উনি আমাদের জানিয়ে যাননি আর আমরাও অন্য কোনও এক অজানা টানে ওনার পিছনে ছুটে চলেছি। 
ঘরটার দিকে প্রায় দৌড়তে দৌড়তে যেতে থাকা নৃপতি সাহা একমাত্র খেয়াল করেছিলেন আকাশে আর এক দফা কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। কয়েকটা সাদা বক কি!… রাস্তায় আলো একটু কম হচ্ছে বলে চোখ গেল বোধহয় আকাশে। কারণ চারপাশে কোথায় কী আছে এবং কী নেই, উনি কিছুই খেয়াল করেননি। কোনও শব্দ-কোনও গন্ধ-কোনও অভিমান কিস্যু না।
ঘরের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালেন নৃপতি সাহা। দাঁড়াতেই হলো। না দাঁড়িয়ে উপায় ছিল না যে। ঘরের শাটারের তলা দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। গলগল করে না বেরোলেও বেরোচ্ছে। পোড়া গন্ধটা সন্দেহ বাড়িয়ে দিল ওনার। খচখচ করছিল মনটা আগে থেকেই। ছোঁড়াটার আচরণ যেন কেমন কেমন একটা… 
গন্ধটা কীসের? আবার চলতে শুরু করলেন নৃপতি সাহা। এবার মন্দ গতিতে। বয়সটাও বাড়ছে বটে। বেশ হাঁপিয়ে পড়েছেন। বুক ভরে প্রশ্বাস টানলেন। এ গন্ধটাও যে বড় চেনা। কেমন ছেলেবেলার লম্ফের আলো-শ্যামাপোকা-গরম তেলে পাঁচ ফোঁড়নের শব্দ। 
শাটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে গন্ধটা নিচ্ছিলেন তিনি। কাগজ পুড়ছে। পরিবেশের জন্য গন্ধটাও একটু ভেজা ভেজা লাগছে কি? হতেও পারে। 
শাটার টেনে তুলতেই দৃশ্যটা দেখতে পেলেন। দরজার ওপাশের দেওয়ালের দিকে কাগজ পুড়ছে। দু-তিনটে পাতা। খবরের কাগজ নয়। লাইন টানা পাতা। তবে লেখা আছে পাতাগুলোয়। ছাইগুলো বাইরের হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে এলোমেলো উড়তে শুরু করলো। 
বেশ লাগছে নৃপেন সাহার। একদম অন্যরকম একটা আমেজ। ঘরময় পোড়া গন্ধটা গোল গোল পাক খাচ্ছে, আর হ্যাঁ ইতিমধ্যে দেখে নিয়েছেন তাঁর আসবাব, উনুন, রান্নার যন্ত্রপাতি যথাস্থানে পরম যত্নেই রাখা রয়েছে।  
আলোটা জ্বাললেন নইলে চারদিকে অন্ধকারে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। পাতাগুলো উদ্ধার করা যায় কি? অদম্য কৌতূহলে কপালে ঘামের ফোঁটা দেখা দিল। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি বলেও হতে পারে, তবে একটা পাতা তিনি তুলে নিতে পারলেন সেটার গা থেকে আগুন নিবিয়ে। তাও সবটা আসেনি। খানিকটা খসে গেল। পরে রইল সামান্যই। মরুকগে যাক। 
“…দিতে পারিনি তখনও। যা বলতে চেয়েছিলাম, সেটা কি আর মুখে বলা যেত? দেখ্ আজ তোকে লিখছি কিন্তু একটুও সাহস লাগছে না। ওই ভয়টাই বোধহয় ভালোবাসা ছিল না রে? প্রেমিক-প্রেমিকা হতেই হবে সবাইকে? ভয় নিয়ে বাঁচতে পারবে না কেউ? ভালো লাগাটা নিয়ে? শুধু ভালো…” 
দুচ্ছাই। এতে ঘন্টা বোঝা যায়! কে লিখছে তো বোঝা গেল। ছোঁড়ার দৌড় দেখেই… কিন্তু মেয়েটা? রাস্তায় আসবার সময় চোখ মুছতে মুছতে কাকে যেন ছুটে যেতে দেখলেন! হ্যাঁ ঠিক। মনে হলো যেন… মৌ! মানে মৃণালবাবুর মেয়ে! নাকি পরাশরের মেয়েটা! আচ্ছা দত্ত বাড়ির নতুন বউটা…  
বৃষ্টি নামলো। ভীষণ নৈশব্দে ডুবে গেল ভাবনাগুলো। নৃপেন সাহা বুক ভরে আবার প্রশ্বাস টানলেন। সোঁদা মাটি-পোড়া কাগজ। রান্নার তেল ফুটছে যেন কোথায়। একবার রান্নার আসবাবগুলো দেখে নিলেন। উনুনের জ্বালানির ব্যবস্থাও করতে হয় এবার। কাল থেকে আবার কচুরি ভাজার পালা।

raktim.burning@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment