1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

মিসেস রায় ভৌমিক

 

ছবি  : ইন্টারনেট  

মিসেস রায় ভৌমিক
সমাজ বসু

            অক্টোবর মাস পড়তে না পড়তেই মিসেস রায় ভৌমিকের হাতে উলের কাঁটা উঠে আসে। অফিসের ফাইল থেকে একটু ফাঁক পেলেই সোয়েটারের উলটো সোজা ঘর বুনতে ব্যাস্ত হয়ে পড়েন। হাতও চলে বেশ তাড়াতাড়ি। ভদ্রমহিলার স্বামী খুব ভাগ্যবান পুরুষ,যাকে প্রত্যেক শীতেই তাঁর স্ত্রী এইভাবে নিজের হাতে বর্ম তৈরি ক'রে উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া থেকে রক্ষা করেন।
      --- আজকাল দোকানে তো কত রকমের ডিজাইন করা সোয়েটার পাওয়া যায়। তাছাড়া এত সময়ই বা কোথায়,যে কাজ ফেলে সোয়েটার বুনব। অদিতি সেনের কথায় মিসেস রায় ভৌমিক হাসতে হাসতে বলেন--
       --- দোকানের কোন জিনিসই তাঁর পছন্দ হয় না। রঙ পছন্দ হয় তো ডিজাইন মনে ধরে না। ডিজাইন ভাল লাগে তো রঙে মানায় না। আমার বোনা সোয়েটারে ও বরাবরই কমফর্ট ফিল করে।
      --- তোমার দাদাকে একবার একটা সোয়েটার বানিয়ে দিয়েছিলাম। সেই সোয়েটার গায়ে দিয়ে তাঁর কি হাসি। ঝুলে লম্বা,বহরে ঢলঢলে আর গলাটা এত ছোট,যে রীতিমত যুদ্ধ ক'রে পরতে হয়েছিল। সেই থেকে নাক কান ভুলেছি,আর না! আর এক সিনিয়র কলিগ দীপালি কুন্ডু তার অভিজ্ঞতার কথা শোনাতেই, মিসেস রায় ভৌমিকের হাসি আর থামতেই চায় না।

          অফিসের সব সহকর্মীই জানে, মিসেস রায় ভৌমিক স্বামী ছাড়া পৃথিবীর কিছুই বোঝেন না। আটঘন্টার ডিউটিতে ,ছ'ঘন্টাই শুধু তার পতিদেবের কথা। ঘুম থেকে উঠে অফিসে বেরনো অবধি স্বামীর সঙ্গে যাবতীয় কার্যকলাপের ধারাবিবরণী শুনতে হয়।  কিছু কমবয়সী কলিগ তাকে একটু অন্যমনস্ক দেখলেই টিপ্পণী কাটে-- কী,কাল রাতে বুঝি দাদার সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে? তাই মন খারাপ?
      --- না,না সেরকম কিছু না। শুতে শুতে একটু রাত হয়েছিল,তাই  চোখ টানছে। সকলেই তার জবাবে বুঝতে পারে, তিনি কিছু একটা লুকোতে চাইছেন।
        মিসেস রায় ভৌমিকের মুখে,তার হাজব্যান্ডের গল্প শুনতে শুনতে সবাই কমবেশি ক্লান্ত। বছরে তিনবার যখন সাতদিনের ছুটি নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ট্যুরে যান, অফিস তখন বাক্যহারা। কাজের অবসরে যেটুকু কথাবার্তা হয়। মিসেস রায় ভৌমিকের মত, ঘরের সব গল্প করার মানসিকতা বা ইচ্ছে কারও নেই। কখনো সখনো বলার মত কিছু ঘটলে তার সহকর্মীদের ভেতর আলোচনা হয়। কিন্তু ওই সকালে গায়ে জল ছিটিয়ে স্বামীর ঘুম ভাঙ্গানো থেকে শুরু করে তাঁর খাওয়ার বায়না, পোশাক বেছে দেওয়ার গল্প আর কত ভাল লাগে?

         মিসেস রায় ভৌমিক যতই তার স্বামীর গল্প করুন, কাজের বিষয়ে তিনি খুব সিরিয়াস। তার কাজের ধরন দেখে বোঝা যায়, তিনি ভীষণ ছিমছাম আর পরিপাটি। কোথাও এতটুকু ভুল কিংবা ত্রুটি থাকে না। সেইজন্য ম্যানেজার শ্রীমতি অনিতা বটব্যাল তাকে বিশেষভাবে সমীহ করেন। বছরে তিনবার তার ছুটি মঞ্জুর করেন নির্দ্বিধায়। কারণ তিনি জানেন, ফিরে এসেই মিসেস রায় ভৌমিক সাতদিনের ফেলে রাখা কাজ সাত ঘন্টায় শেষ করে দেবেন। ঘটেও তাই।
      --- মিসেস রায় ভৌমিক,আর কতদিন ঝাড়া হাত পায়ে থাকবেন? এবার একটু ভাবনা চিন্তা করুন। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু! 
     ---- হ্যা কাকলি দি, ওকে আমি বলেছি,সাড়ে চার বছর হলো আর না। এবার কিন্তু আমি মা হতে চাই।
      --- যত বয়স বাড়ে, আমাদের অনেক কমপ্লিকেশন গ্রো করে, জানেন নিশ্চয়ই। তাই যত তাড়াতাড়ি এসব হয়,ততই ভাল। তবে আপনার যা ছিপছিপে গড়ন,মনে হয় না কোন অসুবিধা হবে। কাকলি দির কথায় ঠোঁটের ওপর তিনি একটু হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন। 
      --- তা এবার কোথায় যাচ্ছেন? নর্থ না সাউথ?আর এক জুনিয়র সহকর্মী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। 
      --- আমাদের দুজনেরই সাউথ ভীষণ ফেভারিট। তাই এবারেও সাউথ। এতবার সেখানে গিয়েছি যে কলকাতার অলিগলি না চিনলেও, সেখানকার পথঘাট সব নখদর্পনে।
       --- বৌদি, আপনার স্বামীর গল্প শুনে মনে হয়,উনি খুব রোমান্টিক,তাই না?
     --- হ্যা,তা বলতে পারো। আমি মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি, কিন্তু তাঁর রোমান্সে এতটুকু খামতি নেই।
     --- রীতা দি,এই এত বছরে দাদার একটা ছবি কিন্তু দেখলাম না।
      ---- তুমি হয়ত জানো না, এখানে সবাই জানে। ছবি তোলায় তোমার দাদার আপত্তি আর অনীহার কথা। বহু বছর আগে তাদের কোন এক পূর্বপুরুষ নাকি ছবি তোলার সময় হার্টফেল হয়ে মারা যান। সেই থেকে তাঁদের উত্তরসূরীদের ভেতর একটা ভয়  আর কুসংস্কার কাজ করতে থাকে। ছবি তুলতে গিয়ে আবার যদি কারো অকালে প্রাণ যায়! ওর কলেজ লাইফের একটা ছবি অবশ্য আমার কাছে আছে। সে ছবি আমি নিজেও দেখি না। এত হাসি পায়। তবে এইবার ঘুরে এসে পঞ্চম বিবাহবার্ষিকীতে সব্বাইকে বাড়িতে ডাকব কেমন। তখন আমার মনের মানুষটিকে সরাসরি দেখে আসবে।

        আগামীকাল মিসেস রায় ভৌমিকের ট্যুরে বেরনোর কথা। তাই কাজ নিয়ে খুব ব্যাস্ত। আজ একটু তাড়াতাড়ি তার অফিস থেকে ফিরতে হবে। টুকটাক কিছু কেনাকাটা বাকি আছে। কিন্তু সকাল থেকে সবাই লক্ষ্য করছে যে অন্যদিনের তুলনায় তাকে কেমন যেন নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে। চোখের কোণে কালির ছাপ স্পষ্ট। দুটো বেজে গেল অথচ এখনও অবধি টিফিন করেননি। লাঞ্চবক্স খুলেও আবার সেটা ঢেকে রেখে দিলেন।
     --- কী ব্যাপার ম্যাডাম, এখনও টিফিন করেননি।
     --- দেখুন না, কাজগুলো আজই সেরে যেতে হবে। তাই টিফিনের সময় পাচ্ছি না। করে নেব, চিন্তা করবেন না।
     --- কিন্তু আজ অন্যদিনের তুলনায় আপনাকে অনেক বেশি ক্লান্ত লাগছে। শরীর কী খুব খারাপ?
      --- আপনিও ঠিক আমার স্বামীর মতই বলছেন।একটু ক্লান্তি লাগলেই তাঁরও হাজার প্রশ্ন। আমার কিচ্ছু হয়নি। একদম ঠিক আছি। কথাগুলো বলে মিসেস রায় ভৌমিক আবার কাজে ডুবে গেলেন।

         সাতদিনের জায়গায় দশদিন হয়ে গেল,অথচ মিসেস রায় ভৌমিক এখনও কাজে জয়েন করলেন না। কোন খবরও বাড়ি থেকে এসে পৌঁছায়নি। ছুটি কাটিয়ে এইরকম নীরব অনুপস্থিতি আগে কখনো হয়নি'। স্বাভাবিকভাবেই অফিসে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। ম্যানেজার শ্রীমতি বটব্যাল আজ শনিবারের হাফ ছুটির পর কাকলি চৌধুরীকে নিয়ে তার বাড়িতে যাবেন ঠিক করে ফেললেন।
        অনেক খোঁজাখুঁজির পর বড় রাস্তা পেরিয়ে পার্কের গা ঘেঁষে একটা গলির মুখে এসে দাঁড়াল অফিসের গাড়িটা। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ড্রাইভার মাখনলাল বাড়ির ঠিকানাটা বলতেই,দুজন কমবয়সী ছেলে যে অনুসন্ধান দিল, সেখানে এই গাড়ি পৌঁছাবে না। একটা সরু গলির শেষ মাথায়, এই নম্বরেই সম্ভবত থাকেন মিসেস রায় ভৌমিক। তাও সঠিক বলতে পারল না। উপায় নেই দেখে মিসেস বটব্যাল ও কাকলি চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে গলি ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে কাগজে লেখা নম্বরের বাড়িটার সামনে এসে দুজনেই চমকে উঠলেন। এইরকম নোংরা পরিবেশ আর এত ছোট ঘর;হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। ছেলে দুটোই মিসগাইড করেছে, এই ভেবে মনে মনে দুজনেই যখন ফেরার কথা ভাবছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
      --- আপনারা কি মিসেস রায় ভৌমিকের অফিস থেকে তার খোঁজে এসেছেন?
     --- হ্যা,ইনি আমাদের অফিস ম্যানেজার শ্রীমতি অনিতা বটব্যাল আর আমি মিসেস রায় ভৌমিকের কলিগ কাকলি চৌধুরী।
       পরিচয় পাওয়া মাত্র ভদ্রলোক দুজনকেই ঘরের ভেতর ডেকে নিলেন। ঘরে প্রবেশ করা মাত্র দুজননের অবাক হওয়ার পালা। সব কথা যেন হারিয়ে যেতে লাগল। কোনরকমে নিজেকে সামলে মিসেস বটব্যাল প্রথম মুখ খুললেন-- আপনি বুঝি মিঃ ভৌমিক?
     --- না না, আপনারা ভুল করছেন। আমি তপন রায়। পৃথার হতভাগ্য দাদা আর ও আমার একমাত্র বোন। গত চারদিন যাবৎ ওর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। একটা কথাও বলতে পারছে না। আজ সকাল থেকে এক ফোঁটা জলও পেটে পড়েনি।
      --- কিন্তু এই অবস্থা কেমন করে হলো?
      --- চারমাস অন্তর একটা করে কেমো নিতে হচ্ছে ওকে। দিন সাতেক হলো লাস্ট কেমোটা পৃথা নিতে পারেনি। বেঙ্গালুরু হসপিটালের জবাব পেয়ে গেছি। তাই ওকে নিয়ে এসেছি।
      --- আমরা তো চার মাস অন্তর আপনার বোনের ট্যুরে যাওয়ার কথা জানতাম--একরাশ বিষ্ময় ঝরে পড়ে শ্রীমতি বটব্যালের গলায়।
    --- জীবনের এই মর্মান্তিক লড়াইটাকে ও খুব হালকা ভাবে নিয়েছিল। জানি না কেন? হয়তো যন্ত্রণা আড়ালের চেষ্টা। তাই এই সফরটা পৃথার কাছে ট্যুরই। তপন বাবু উত্তর দিলেন।
    --- তা এই অবস্থায় মিঃ ভৌমিককে তো দেখছি না। তিনি কোথায়? 
          শ্রীমতি বটব্যালের প্রশ্নে তপন রায় দ্বন্দ্বে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর ব্যথার বোবা মেঘ সরিয়ে নিজেকে মেলে ধরলেন।
     --- পৃথার জীবনে মিঃ ভৌমিক বলে কারো অস্তিত্বই নেই। সেও কোনদিন কারও মিসেস হতে পারবে না জেনেও এইসব অভিনয় করে গেছে। স্বামীর ঘর করার  বড় সাধ ছিল মেয়েটার। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে,দু দুবার ওর বিয়ে ভেঙে যায়। শুধু তাই নয়,এক প্রতারকের প্রবঞ্চনাও জোটে। সেই কারণে ও ভেতরে ভেতরে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ঠিক তারপরেই ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ে। তখন চিরতরে বিয়ের স্বপ্ন মন থেকে মুছে ফেলতে বাধ্য হয়। ভাগ্যের কাছে হেরে গেলেও নিজের ইচ্ছে আর স্বপ্নের কাছে কোনদিন হারতে চায়নি। সেই থেকে নিজের পদবীর সঙ্গে, বিবাহিতা রমণীর মত স্বামীর ভুয়ো পদবী জুড়ে নেয়। এইভাবে মিসেস রায় ভৌমিক সেজে  জীবনের আঁচলে আনন্দের ফুল কুড়োতে থাকে। বিবাহিত জীবনের অপূর্ণ চাওয়া পাওয়ায় মেতে থাকে। বানানো সাজানো ওর এই স্বামীসঙ্গের কথা,সব জেনেও কিছু বলিনি। আমিও আমার সব সখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছি শুধু এই বোনের জন্য।
        বড় ভাইয়ের মুখে মিসেস রায় ভৌমিকের কথা শুনতে শুনতে শ্রীমতি বটব্যাল আর কাকলি চৌধুরীর চোখের পাতায় দুঃখ টলমল করতে থাকে। তাঁরা দুজনেই বুঝতে পারেন,হয়তো আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মিসেস রায় ভৌমিকের গলা থেকে খুলে নেওয়া হবে নকল মঙ্গলসূত্র। আগামী জন্মে আসল মঙ্গলসূত্রের স্বপ্ন দেখতে  দেখতেই ঘুমিয়ে পড়বে পৃথা রায়,ওরফে মিসেস রায় ভৌমিক। আর কখনও সে ঘুম ভাঙ্গবে না। বিছানায় মিশে যাওয়া নিস্তেজ ও মৃতপ্রায় শরীরটার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে কান্না সামলে শ্রীমতি বটব্যাল অনিচ্ছাসত্ত্বে মিথ্যের সুর শোনালেন--মিসেস রায় ভৌমিক,আপনার কিচ্ছু হবে না। আপনার স্বামী মিঃ ভৌমিক আরো ভাল চিকিৎসার জন্য আপনাকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। তাই নিয়ে উনি খুব ব্যাস্ত,এখনই এসে পড়বেন।
        মিসেস বটব্যালের কথায়,ক্ষমার ভঙ্গিতে দুটো হাত তাঁর সামনে মেলে ধরল পৃথা রায় ওরফে মিসেস রায় ভৌমিক।
       এতক্ষণ পর বাঁধভাঙা নদীর মত দুচোখ ছাপিয়ে জল এলো আর ছোট্ট ছেলের মত হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো পৃথার দাদা।

arghyabasu61@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment