1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

বিসর্জন

 

ছবি  : ইন্টারনেট  

বিসর্জন
ড: করণ দেবদ্যুতি

        শরীরটা কয়েক মুহূর্ত আগেও হাঁফাচ্ছিল। এখন নিস্তেজ নিষ্প্রাণ। এই বাড়ির এই ঘরটায় কেটেছে নাদিয়ার জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময়; সেই কবে প্রথম যৌবন থেকে। এক কালে চাচাজিকে আব্বুকে নামাজ পড়তে দেখেছে। এখন মনে হয় সে বুঝি কত জন্ম আগে! তার জীবনে আব্বু আম্মু কিংবা সোহেল নামে যে কোনও ভাই ছিল সেকথা ভুলে গেছে বহুকাল। নিয়তির গতি তার আত্মীয় স্বজন পরিচিতদের কেড়ে নিয়ে দিয়েছে নতুন ঠিকানা। আর দিয়েছে নতুন কিছু গিরগিটি -মানুষ আর অনেক মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়ার ক্রমিক কলঙ্কায়িত স্মৃতি। সে এখন মুসলমান কিনা জানে না, হিন্দু বৌদ্ধ জৈন কিনা; তাও না। নামাজ পড়তে ভুলে গেছে কোনকালে! অন্য মেয়েদের মত কার্তিক পুজো করেছে। একটি জ্যান্ত কার্তিকও জুটে গিয়েছিল তার জীবনে। অকস্মাৎ ভুলে নয়; ইচ্ছেতেই। কিছুদিন তার সেই কার্তিক মূর্তিটি হারিয়ে গেছে।

          বিদায়ী মুহূর্তে সেই নিয়ে লড়াই চলল কিছুক্ষণ। ইচ্ছে -আকাঙ্খা আর বাস্তবের তীব্র লড়াই। সংসার হয় নি; আবার হয়েছেও! স্বামীর সুখ কী জিনিস বোঝেনি কোনওদিন। অথচ দেহজ অভিজ্ঞতা এসেছে সারাজীবন! সে অভিজ্ঞতা সুখের নয়। তবে কখনও যে সুখ পায় নি তাও কী ঠিক? সেই যে হিন্দু মাস্টারবাবুটি আসত! সে ওর কাছে কেন আসত তা ভেবে অনেকদিনই ও মাঝে মাঝে অবাক হত। এমন একটা মানুষ যে কখনও ওর সাথে জবরদস্তি করেনি। কখনও পোশাক খুলে ফেলার জন্য নাছোড় হয়নি। সেই ওর সুখ, ওর মনের পুরুষ। কত রাত্রি ওকে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। পরে ও জেনেছিল মাস্টারবাবুটির জীবন স্বাভাবিক গতিতে এগোয় নি; বউ ব্যভিচারী। হয়তো সেই ক্ষত ঢাকতেই নাদিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে নিঃসঙ্গ রাতগুলোকে সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইত। নাদিয়ার স্তনের আকুলতার চেয়ে চোখের অসহায়তা বাবুটিকে বড় টানত। শুধু নিশারতি আর যৌনতায় থেমে থাকেনি সম্পর্কটা। তাই কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে নাদিয়া ঠিক করেছিল এই বাবুটির মত একটি ক্যাবলা কার্তিক সেও ধারণ করবে।

           মাষ্টারমশাই অবশ্য এই প্রস্তাবে সায় দেয় নি, ভয় পেয়েছিল। জীবনে ঝামেলার তো অভাব ছিল না; নতুনকরে আর ঝামেলা দিকে পা বাড়াতে চায় নি। নাদিয়া জেদ করেই নিয়েছিল সন্তান। সে এই সন্তানের দায়ে আবদ্ধ করেনি তাকে। অথচ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লোকটি সন্তানের দায়িত্ব পালন করত। সেসব ছিল নাদিয়ার সুখের দিন। কিন্তু নিয়তি বড় হিংসুটে! অন্যের সুখ সহ্য করে না। লোকটি মরল হার্টের রোগে। তখন নাদিয়ার গর্ভের সন্তানের বয়স বারো। তারপর থেকে নাদিয়ার জীবনের আরেক পর্যায়।

          আগে যদিও স্বামী না হোক মাথার উপর কেউ একটা ছিল। সে আশ্রয়ও হারাল ওরা। ছেলেটি বছর দুয়েকের মধ্যেই স্কুল ছাড়লো। ভিড়লো বস্তির ছিনতাই বাজদের দলে। একদিন ছেলের হাতে দামি ঘড়ি দেখে প্রথম আঁচ করে ও। সেদিন মেরেছিল খুব। কিন্তু সে মার সেদিন ওর সন্তানের গায়ে লাগেনি। তার আগেই তার বাস্তবের সাথে আলাপ হয়েছিল। দ্বিতীয়দিন মারতে গেলে সে ওর হাত ধরে। সেই হাতের স্পর্শ আর চোখের অভিব্যক্তিতে ও সেদিন বুঝেছিল যে মাস্টারবাবুকে সে তার গর্ভ দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল; তার মৃত্যুর সাথে সাথে ওর গর্ভজাতটিও মরেছে। 

         তবুও সন্তানকে তো বর্জন করা যায় না। সে যত খারাপই হোক সে আত্মজ! তাকে অস্বীকার করা মানে নিজের শরীরকে অপমান করা। গিরগিটি -মানুষের ভিড়ে এক রঙ নিয়ে থাকা অভিযোজনের প্রতিকূলে। নতুন প্রজন্ম সে পাঠ তাড়াতাড়ি নেয়। পুরনোরা পিছিয়ে থাকে। সেই পাঠের ওভাবেই বাঁধে জেনারেশন গ্যাপ। সন্তান যেন রাত কাটানোর আশ্রয়ের জন্য লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে মায়ের কাছে আসে। সকালে হোটেলের ভাড়া বাবদ কিছু টাকা রেখে আবার মিলিয়ে যায় দিবালোকে কোনও আঁধার জগতের ভিড়ে। নাদিয়া ও টাকা ছুঁতে চায় নি প্রথম প্রথম। সে প্রথমের আড়মোড়া ভাঙতে যেটুকু সময়। তারপর সব হিসেব গুলিয়ে দেয় জীবন। 

          অভিমানের চেয়ে আহার বড়। অধিকারের চেয়ে আত্মিক টান। দিন দিন পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। একদিনের তাপে অঝোর বর্ষা ভরা মাঠ শুকিয়ে যায়। চোখের জল শুকোতে কতক্ষণ! নাদিয়ার দেরি হয় নি। শরীরের সাথে চোখের জলও শুকিয়ে এল। শুকনো ডালের খটমট জড়িয়ে ধরল গাছটিকে। তখন ফল ভেসে গেছে স্রোতে। গাছ থেকে অনেক অনেক দূরে!

                                 ----

- সুসি তাড়াতাড়ি গোটা। ঘাটে কী লাফড়া জানিস তো!
সুস্মিতার সময়-জ্ঞান ছিল না এতক্ষণ। আজ মেয়েদের উৎসব; ওরা আজ উমার মত সিঁদুরে রাঙাতে চায় নিজের মুখ ও মন। বোন আর পাড়ার মহিলাদের সাথে সিঁদুর খেলছিল ও। বেলা বারোটা বাজতে চলেছে! ওর হাতে ঘড়ি থাকলেও বিশেষ মুহূর্তে মেয়েদের ঘড়ি অকেজো হয়ে যায়। 
রাকেশের তাড়ায় ধাতস্থ হল; - ও মা! ক’টা বাজল গো?
- হাতের ঘড়িটা দ্যাখ!
- বারোটা বেজে গেল তো। অ্যাই রুমি তাড়াতাড়ি কর। কত বেজে গেল রে!
রুমিও আনন্দে আত্মহারা। তরুণ গালে রাঙা সিঁদুর যেন বসন্তের কৃষ্ণচূড়া। রাকেশ তাড়াহুড়োতেও আটকে যায় ওই রাঙা নারীসৌন্দর্যে। সুস্মিতা প্রমাদ গোনে। 
- ওই যাও মিষ্টিগুলো কোথায় রাখলে? সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে মাকে তুলতে হবে যে!
রাকেশকে মোহ ভেঙে উঠে যেতেই হয়। রুমিতা মুখ ব্যাঁকায়। রাকেশকে সে যে একদম প্রশ্রয় দেয় না তা নয়। তবে কেড়ে নেবার কথা ভেবে না কখনও। দিদির সন্দেহে খানিক লজ্জাও আঁকড়ে ধরে তাকে। অপ্রস্তুত ভাবটা কাটিয়ে উঠতে রাকেশের কাছ থেকে মিষ্টি নিয়ে অন্যান্য মহিলাদের দিকে এগিয়ে যায়। সুস্মিতাকে ক্ষণিক অন্তরঙ্গতার সুযোগ করে দেয়।

       কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিমা বাঁশে বেঁধে মেটারোডে উঠে গেল। ওরা সুইফট গাড়িতে প্রতিমার পেছনে যাবে। এসিতে উঠে স্বস্তি পেল। বাইরে যা গরম! চেনা রিংটোনে রাকেশের আইফোন বেজে উঠল; মন্টু, - বশ! খারাপ খবর আছে।
- কী?
- মা... ইয়ে নাদিয়াজি মারা গেছে।
- হুঁ!
- আমি..
- নিমতলায় যা। বিসজ্জন দিয়ে আসছি।

      সুস্মিতা আর রুমিতা দুই বোন থ্রি-সিটারে ওর পাশেই বসেছে। ওরা ফোনের ওপাশের চাপা আওয়াজ কিছুটা শুনতে পেল।
    রাহুল গুম হয়ে গেল। যতই হোক ওই যে আত্মিক যোগ। এড়িয়ে চলা যায়; অস্বীকার করা সহজ নয়। রুমিতা ওর দিদিকে দোষ দেয়; একটা মুমূর্ষু মানুষকে একটু দেখাশুনো করলে কী হত! খুলেছে তো সমাজসেবী সংস্থা। সেবা না হয় একটু শাশুড়িকে দিত! নিজে না পারলে আয়া রেখে লোকে করে না কী? নিষিদ্ধ পল্লীতে খাবার পোশাক বিতরণ কী শুধু নাম কেনার জন্য? মিডিয়ার সামনে যত ভাষণ! অথচ ওই মহিলা যদি কিছুটা শুশ্রূষা পেত হয়তো আরও কিছুদিন বাঁচতো। এই ব্যাপারে রাকেশকেও দোষ দিতে হয়। কোনও মেয়েমানুষের কথা শুনে মাকে ছেড়ে আসা কী যায়? আচ্ছা সে নিজে হলে কি করত? সেও কী দিদির মত সব স্বামীকে সব সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে বলত! যে নারী সমাজের কাছে পতিতা বলে পরিচিত তার সাথে কী একঘরে থাকা যায়? হয়তো যায় না; কিংবা চাইলেও সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে একসাথে থাকা না গেলেও শেষ অবস্থায় দূর থেকে হলেও এই মহিলার চিকিৎসা করাত সে।

        দিদির সম্পূর্ণ ঘটনা ওর অবগত। প্রথমবার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর সুস্মিতা সম্পর্কের ব্যাপারে খুব ফেরোসাস হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ডিভোর্সী মেয়েকে মেনে নেওয়ার মত মনের জোর কম পুরুষের আছে। রাকেশের ফ্যামিলি ব্যকগ্রাউন্ড ভালো হলে ওকে মেনে নিত কি? কিছুদিন বাপের বাড়িতে বসে থেকেই ও হাঁফিয়ে ওঠে। আত্মীয় স্বজনদের নানা প্রশ্ন উপযোগ অভিযোগ উপদেশে কান টেকা দায়! ওই সময় তার মনে হত বাড়ি থেকে বেরোতে পারলেই বাঁচে। 

       প্রথমে কিছুদিন প্রাইভেট টিউশনি করেছিল। তারপর জুয়েলারি শপের সেলসম্যানের কাজ; ও পরে পরিচিত কয়েকজনের বদান্যতায় সমাজসেবী সংগঠন করে। কিন্তু করলেই তো হল না। এখন তো লতাপাতার মত এদিক ওদিক গজিয়ে উঠছে সমাজসেবী সংগঠন। সবার মুখে এক বুলি দুঃস্থদের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। অনুদান দিন, চ্যালেঞ্জ নিন, আরও পাঁচ রকম বক্তেমি।

      একটা শক্ত গাছ দরকার ছিল এ লতার বেয়ে চলার। পেল কয়েক বছর পর। একটি সাংস্কৃতিক মঞ্চে আলাপ হল রাকেশের সাথে। ও বালির মাফিয়া। বেশ দুপয়সা কমিয়েছে; পলিটিক্যাল ব্যাকআপও গড়ছে তখন। এরপর উপরে উঠতে হলে মিডিয়ার ব্যাকআপ চাই। জনগণের সামনে সমাজসেবার টোপ দরকার।তাই ওদের সংস্থায় সভাপতিত্বের আহ্বান লুফে নিল সে। তারপর সুস্মিতার সাথে প্রেম, অন্তরঙ্গতা। শুধু সভার নয়; ওরও পতিত্ব নিতে হল। কিন্তু এসবের মধ্যে থেকে নাদিয়ার সাথে সম্পর্কটা বিদায় নিল ধীরে ধীরে। এরকম নারীর ছেলে হিসেবে ওকে মেনে নেওয়া সহজ না। একে তো মুসলিম; তারপর পতিতা। মায়ের সাথে ক্ষীণ হয়ে আসা সম্পর্ক থেকে রাকেশকে বেরিয়ে আসতে হল। 

                       ----

       দেবীমূর্তির বিসর্জন দিতে দেরি হল না। রাকেশের লোক ধরা ছিল। বিকেলের মধ্যেই ওখান থেকে নিমতলায় এল। মন্টু ওদের শবদেহর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল; - ম্যাডিকেল সাটফিকেট কী লাফড়া গুরু! করোনার ছাপ্পা পড়লেই বডি ভ্যানিশ।
- হুঁ!
রাকেশ গুম হয়ে আছে এখনও। নাদিয়া স্নাত শব-শরীর সব কালিমা মুছেছে। ফুল-চন্দন চর্চিত প্রৌঢ়র সর্বাঙ্গ। এতদিন এই শরীরে ফুল রাকেশের জঘন্য লাগত; আজ তেমন লাগছে না। সে শেষবারের মত প্রণাম করল; ওর পাশে রুমিতাও।
ওদের দেখাদেখি সুস্মিতাও দূর থেকে প্রণাম জানাল প্রৌঢ়কে। রাকেশ অবাক হল না। সময় মানুষের সব দম্ভ বিদ্বেষ কলঙ্ক কেড়ে নেয়। 

    এরপর বিদায়ের পালা। শবদেহ ধাতব শব্দে চুল্লীতে প্রবেশ করল। কিছুক্ষন বাদে বেরিয়ে এল ছাই হয়ে। রাকেশ হিন্দু আচার মেনে অস্থি বিসর্জন দিল গঙ্গায়। 
দেবীর মৃত্তিকা ও মানবী মূর্তির অবশিষ্টাংশ ভেসে চলল। ও অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে অস্থি যাত্রার দিকে। জলে হবু ডুবু খেয়ে ডুবে ভেসে কিছুদূর এগিয়ে মিলিয়ে গেল। সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হতে হতে মিশে যাচ্ছে রাত্রিতে। এ রাত্রি কাটলে আবার নতুন ভোর! কোলাহলে মিশে ম্লান হবে সব কালিমা। তাদের কথা আবার শোনা যাবে যারা বেঁচে আছে। আর যারা মৃত তারা হারিয়ে যাবে ধীরে ধীরে।

   রুমি রাকেশের কাঁধ স্পর্শ করে বলল; - চলো ফিরতে হবে এবার! 
সুসি বলল; - ওকে আর একটু থাকতে দে রুমি। খানিক থেমে বলল;- দ্যাখ, একই নদী; মানুষ আর মাটির বিদায়ের মিল কেমন! শুধু সমুদ্রে হারিয়ে যাবার অপেক্ষা।
    রুমি দিদির মুখে এরকম কথা কথা শোনেনি। অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে। ওর মনে হয় তার এতদিনের অভিযুক্ত মানুষটার সব অহংকার আজ নাদিয়ার অস্থির সাথে ভেসে গেল গঙ্গায়। 

drdebadyuti.karan@gmail.com
পূর্ব মেদিনীপুর




No comments:

Post a Comment