1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

উলট চরিত মানস

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

উলট চরিত মানস
 আফতাব হোসেন

                                (১)

"একটা কাঁধ দেবে সাঁই…
একটু কাঁদবো…
সব্বাই সব দেয় গো…অনেক অনেক দেয় । শুধু ,
কেউই কাঁদতে দেয় না ।"

 কিচ্ছু গোছাতে পারি নি। সে স্কুলের বাক্স হোক আর জীবনের হিসেব । সব এলোমেলো হয়ে যাওয়াটাই মনে হয় স্বাভাবিক আমার কাছে । বউ বলে তোমার গ্রহে দোষ আছে , হতে পারে । ভূগোলে আমি বরাবরই দুর্বল, গ্রহ নক্ষত্র বরাবর আমার দুর্বোধ্য । তবে একটা জিনিস খেয়াল করেছি যাই হোক না কেন আমি উল্টো জিনিসকে বেশি ভালোবাসি । আমার সব উল্টো । আসলে আমার বিশ্বাস যদি উল্টো থেকে শুরু করি তাহলে আর উল্টোনোর কোন সুযোগই থাকে না । এই ধরুন যেমন যেটা সবার শেষে লেখার কথা ছিল সেটা প্রথমেই লিখে দিলাম -

“ একটা কাঁধ দেবে সাঁই…
একটু কাঁদবো…


                                     (২)

       নতুনপুরের মুখার্জী পাড়ার পাশ দিয়ে যে লাল রাস্তাটা সাপের মত চলে গেছে তার ঠিক সামনের বট গাছটার মোড়টাতেই রোজ খাতা কলম নিয়ে ঘন্টা দুয়েক বসতে হয় । লাল্টু মুখার্জির ছোট বৌমা হাজিরা দেন । রোজ আধা ঘন্টার জন্য । বিয়ের তিন মাসের পর ছোট বউমা বেপাত্তা ছিল প্রায় আট বছর । গায়েব হবার আগের দিন মুখার্জি বাড়ির ছোট ছেলে সাপের কামড়ে মরেছিল । লোকে বলে কালাচ । দাগ কেউ খুঁজে পায়নি । শুধু মুখে সাদা গ্যাজলা দেখে কলাপাতা আর ডালের নৌকায় সব্বাই ভাসিয়ে দিয়েছিল । তার ঠিক দু বছর আট দিনের মাথায় বড় ছেলে গলায় দড়ি দিল আর বড় বউ ঘর ছেড়ে বাপের ঘরে । গ্রামের পঞ্চ রা মত দিল ছোট বউমাকে ফিরিয়ে আনা হোক । না হলে অভিশাপ কাটবে না । এত বড় মুখার্জি বাড়ি তখন খাঁ খাঁ । লাল্টু মুখার্জী তিনমাসের বেনারসের সফরে বেরিয়ে সবাই কে অবাক করে ছোট বউমা কে নিয়ে ফিরলো । সবাই অবাক হলেও নতুন মুন্ডিত মস্তক রূপের বিধবা বউমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস করেনি কেউই । সব ঠিকঠাকই চলছিল । কিন্তু ওই যে বললাম না আমার কপাল উল্টো । উল্টোই হল । মুখার্জী বাড়িতে চাকরী জুটে গেল । হিসেব দেখার । কি হিসেব , কি বা দেখার জন্য উপরবালা ঠিক করেছিলেন কে জানে । প্রথম কদিন কাজের পরই ছোট বউ এর মুখোমুখি হতে ভদ্রতায় প্রশ্ন করেছিলাম কেমন আছো ছোট বউ । চোখ ছোট করে উত্তর ছিল -
 ‘ একটু কাঁদতে দেবে সাঁই’।

               
                                  (৩)

      পাঁচের ক্লাসে নাম লেখার সময় ধুতি পরা মাস্টার 'হোসেন' টাইটেল দেখে প্রথমবার মুখ কুঁচকিয়ে জাত চিনিয়েছিল । জাত চেনার প্রথম থেকেই আমি নাকি কাফের । মাতব্বর রা মত দিয়েছিল ছোড়া বড্ড পাকা । ইবলিসের বাচ্চা । মাথাব্যথা কোনদিনও ছিল না জাতের । ভয়ডরও ছিলনা বেজাত হবার । ভয়টা ধরলো প্রথম যৌবনে । বর্ষাকালে মুখার্জিদের পুকুরটার পাশে বৃষ্টিতে ভেজা ভীরু চোখ দেখার পর থেকে জাতের ভয়টা ঢুকলো মনে খুব । শরৎ চন্দ্র থেকে রবিঠাকুর সব বড্ড বিষ বিষ ঠেকলো । সর্বক্ষনের সখারা বলল মন হালকা করতে । বুঝতেই পারিনি মন ভারী পাপে না জ্বালায় । ঈমান সামলাব না মাথার টুপি বোঝার আগেই ভাসলাম । ভেসেই গেলাম । কুল তীর স্রোত কিচ্ছু না জেনে ভাসলাম । কখনো জানার চেষ্টাও করিনি নদী জানে কিনা আমার ভাসার কথা । তাও ভাসলাম । কোথাও পৌঁছানোর ইচ্ছেই ছিল না । তাই নদীর জোয়ার ভাটার খোঁজ রাখিনি । ঠোকর খেলাম মোহনায় । শুনলাম স্রোতের জোর এ পর্যন্ত ই । বাকিটা সাগর জানে । আমার পুকুর পাড়ের ভীরু চোখ অন্য নৌকায় , অন্য নদীতে , অন্য স্রোতে ভেসে গেল । বাকিটা ইতিহাস । আমার কি । আমি তো কাফের , ইবলিস ছিলাম ই । ইবলিস রা কিছু পাওয়া না পাওয়ায় আশায় থাকে না । সব ধ্বংস করে বোধহয় ।

                                  (৪)

- ' শরীর ছুঁয়েছো কখনো সাঁই । মেয়ে শরীর ।' প্রশ্নটা করেই তাকিয়ে রইলো ছোট বউ ।
 নিজেকে শক্ত করে বললাম ওসব থাক ছোট বউ । লোকে শুনলে নিন্দে করবে । চাপা হেসে বললো লোকের লজ্জায় এত লাজ হলে হবে সাঁই । তুমি নাকি লেখক হবে । তা নারী না ছুঁলে সংসার লিখবে কেমনে ? শোন কবি -
মেয়েদের শরীর দেখতে একটা কিন্তু শরীরে মধ্যে তিনটে গোটা মেয়ে আছে বুঝলে । যুবতী মেয়ে । বাম দিকে ইরা । ডান দিকে পিংগলা আর মাঝখানে সুশুমনা । তিনে মিলে এক নারী । আমরা বলি ত্রিবেনীর ঘাট । এখানে মাসে মাসে জোয়ার ভাটা আসে গো । ইরা উযান । পিংগলা ভাঁটা । এর মাঝে সুশুমনা কে নিয়ে তিনটা এক করতে পারলেই সুখ আর সুখ বুঝলে সাঁই । 
তোমরা বুঝবে না গো । ছোট মুখার্জিও বোঝেনি । বিয়ে করে ভোগ করতে চেয়েছিল । মনটাকে না ছুঁয়েই শরীরটা কে লুটতে চেয়েছিল । অমাবশ্যার দিন মানত করেছিলাম । মা মনসা ফল দিয়েছিল । শশুর বললো মাথার সিঁদুর মুছে নে বউমা । তোর কপাল ফাটা । কিন্তু সাঁই বিশ্বাস কর একটা লম্পটের জন্য সিঁদুর মুছতে মন সায় দেয়নি । পালালাম । কপাল নিয়ে গেল নতুম ঠিকানায় । নতুন রূপে । ঘর বাঁধতে শিখলাম সাঁই । ঘর ছাড়ার পর খেয়াল করিনি । ঘুরতে ঘুরতে পৌছালাম সুদূর দুর্গাপুর এ । মহাকালের আশ্রম । কত মানুষ সাঁই । কত প্রাণ , কত কথা,কত ব্যাথা আর কত সুখ । এক হয়ে গেলাম । সব ছেড়ে এক হয়ে গেলাম ওদের সাথে । দোতারা তুলে আখড়ায় আখড়ায় গান শোনাতাম । চিন্তাগুলো দোতারার গান হয়ে মুখ দিয়ে বের করতে পারলেই কত্ত সুখ । কিন্তু সুখ সইলো কই । মহাকাল বললো তুই এখানে কেন । তুই তো সৃষ্টি মা । তুই সৃষ্টি সত্য কে ছাড়লে ঈশ্বরী ক্ষমা করবেন না রে । তুই সব ছাড়বি কেমনে যদি তোর কিছু নাই বা থাকে । বিশ্বাস কর সাঁই সারাদিন ধরে , সপ্তাহ ভর , মাসখানেক শুধু ভেবেছি আমার কি আছে । কি ছাড়লে আমি গ্লানিমুক্ত হব । কিচ্ছু খুঁজে পাইনি ।
জান সাঁই আমাদের আখড়ায় এক পুলিশ অফিসার ছিল । যখন মেদিনীপুর ভাঙেনি , তখন ওখানের একটা শালবনি বলে গ্রামের বড়বাবু ছিল । সরকার একদিন হুকুম করেছিল বড়বাবু কে মিছিল ভাঙতে । বড়বাবু গুলি করে দুটো মানুষ মেরেছিল । বড়বাবু নিজে শুনিয়েছিল আমায় । বলত সই চোখ বন্ধ করলে আজও লোকগুলোকে দেখতে পাই রে । মন কিছুতেই শান্তিতে থাকতে দেয় না । তাই সব ছেড়েছুড়ে এখন দোতারাই শান্তি খুঁজি । লালন আমায় অভিশাপ থেকে বাঁচিয়েছে । না হলে মনে হয় বাঁচতাম না । বড্ড ময়লা ছিল মনে । এখন অনেক সাফ । বড়বাবু বলতো
তা তুই কেন এখানে ? চোখ বন্ধ করলে কি দেখিস সই ?
উত্তর দিতে পারিনি বুঝলে সাঁই । নিজের মনকে বুঝিয়েছিলাম আমি কি সব হারিয়েছি ? কিন্তু সাঁই আমি কি চেয়েছিলাম ? কোন লম্পট বর তো আমি চাইনি । তাই আমি কি সত্যি কিছু হারিয়েছি । জবাব পাইনি । দোতারা ,আখড়া কেউ জবাব দেয়নি । পালিয়ে এসেছিলাম । বেনারসের ঘাটে চুল বিসর্জন দিয়ে সাধু সন্তদের পথে ঘুরতে ঘুরতে শ্বশুরের সঙ্গে দেখা । কে জানে হয়ত ঈশ্বরী তাই চাইছিল । নিয়ে এলো এখানে । আমিও অমোঘ টানে চলে এলাম । কার টান ঈশ্বরী জানেন ।
          
                                (৫)

      অনেকটা লিখে ফেলেছি ছোট বউ এর জীবনকথা । পুরো আট বছরের ভ্রমনের কতই না বিচিত্র অভিজ্ঞতা । এবার শেষ করার পালা । বলেছিলাম ছোট বউকে এবার লেখা শেষ করে পড়ে শোনাবখন । কিন্তু একটু সময় লেগে গেল । দোষ অবশ্যই আমার । কালের নিয়মে বিয়ে করে নতুন কনের গন্ধ শরীর থেকে ওঠার পর আবার ছোট বউকে নিয়ে বসেছিলাম আজ । দেখলাম ছোট বউ মনে হয় উদাস । নিজে থেকেই বললো জান সাঁই মানুষ না অনেক সময় না বুঝেই কেমন জানি পাল্টে যায় । শ্রীরাধাকেই দেখ । প্রেমিক শ্রীকৃষ্ণের প্রথম প্রেমিকা । কত শত বাধা পেরিয়ে এক হবার কত সুতীব্র ইচ্ছে । তবুও সেই রাধাই যখন রণসাজে সজ্জিত এক  রাজনীতিবিদ কে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখতে পেয়েছিলেন তখন হয়ত হতাশ হয়েছিলেন । যে ছেলেটা যমুনার তীরে বসে বাঁশি বাজাতো, আর রনসাজের এই লোক কে মেলাতে পারেননি মনে হয় । তাই দেখা না করেই চলে আসেন। মানুষ ঠিক এভাবেই পালটে যায় সাঁই । তুমিও পাল্টে গেছ । বৃষ্টির সেই মুখার্জিদের পুকুর ধারের ভীরু ছেলেটা আর আজকের এই লেখক কি এক সাঁই ?

চমকালাম…বাকরুদ্ধ হলাম । ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি নিজের জীবন কাহিনী লিখছি । বললাম না আমার সবই উল্টো । বৃষ্টির দিনে পুকুরপাড়ে ভেসে যাওয়া নদীর শুধু চোখ দেখেছিলাম । ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে নদীর স্রোতে ভেসেও সাঁতার শিখতে পারিনি সেই নদী জীবনের মোহনায় এসে এভাবে দিক পাল্টাবে । কিছুই বলার মত অবস্থায় ছিলাম না । শুধু পায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম আর কিছু বলবে ছোট বউ । আমি এখন কি করবো বলো ? এখন আমি কি দিতে পারি বলো । 
ছোট বউ মুচকি হেসে বললো

"একটা কাঁধ দেবে সাঁই…
একটু কাঁদবো…
সব্বাই সব দেয় গো…অনেক অনেক দেয় । শুধু ,
কেউই কাঁদতে দেয় না ।"

aftab.hossainslb@gmail.com
পশ্চিম মেদিনীপুর

No comments:

Post a Comment