1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

মায়ামৃগ

ছবি  : ইন্টারনেট 

মায়ামৃগ
আশিস চক্রবর্তী

        আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে প্রথম চাকরির পোস্টিং টা আমার হয়ে ছিল একটা বন পাহাড় আর বিরাট জলাশয় ঘেরা অঞ্চলে। স্টেশন টার নাম বড়ো অদ্ভুত, মারাং বুরু হল্ট।এ শব্দের অর্থ জেনে ছিলাম অনেক পড়ে। মারাং বুরু হলেন সাঁওতাল দের আদি দেবতা।পুরোটাই আদিবাসী অঞ্চল, তার মধ্য খানে একটা ছোট্ট স্টেশন। দিনে দু একটার বেশি ট্রেন আসে না। স্টেশন লাগোয়া একটা ছোট্ট কোয়ার্টার দিন রাত পড়ে পড়ে ঘুমোও ,এই হলো আমার কাজ। দিব্যি আরামের চাকরি। আমার সহযোগী ছিল বছর পঁচিশ এর এক ছোকরা ,নাম পান্নালাল। বড়ো পরিশ্রমী ছেলে । পাশের গ্রাম থেকে বাজার-হাট, রান্না ওই সব করতো। সেখানে বুনো মুরগির ডিম পাওয়া যেত বেশ ভালো।আমরাও তখন জোয়ান বয়েস, কাঠের মতো মজবুত শরীর , কয়েক দিনেই শরীরে যেন মেদ জমে আসলো।

এই অব্দি বলে জেঠু একটা খৈনির ডিব্বা বার করে হাতেই তালুতে ঢেলে অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে লাগলো। খানিক বাদেই হাতে বার কতক চাপড় মেরে মুখের ভেতর চালান করে দিলো। খৈনি মুখে নিয়ে ওনার কথা বলাই সেরম কোনো অসুবিধা হয়না। দুপুরের খাওয়া সেরে আমি দিব্যেন্দু আর পুলক বাগানের মাচায় বসে ঝিমুছিলাম। হঠাৎ দেখি লক্ষী জেঠু হাজির। তারপর মাচায় চড়ে বসে জীবনের অভিজ্ঞতা শোনাতে লাগলেন। অনেক ক্ষন চুপ হয়ে রইলে ,দিব্যেন্দু বললো -- তারপর কি হলো জেঠু?

-- হম। বলছি। স্টেশন শেষ হলেই শুরু বিরাট জঙ্গল। চারিদিকে মহুয়া , পলাশ ,পিয়াশাল,বহেরা ,সেগুন ,হরীতকী আরো কত অজানা গাছ গাছালির বন।একটু ভেতরে পা রাখলেই হামেশাই হরিণ, বুনো শুয়োর, হাতি ,ময়ূর এসব জন্তু জানোয়ার বিচরণ রত অবস্থায় দেখা যায়। স্টেশনের উল্টো মুখে জলাশয় এর ধারে পরিযায়ী পাখি দের আনাগোনা তো লেগেই রয়েছে। সব টা মিলিয়ে এক রকম ম,নোরম পরিবেশ। জঙ্গল পেরিয়ে সাঁওতাল দের বস্তি থেকে একটা অল্প বয়স্ক ছোকরা মাঝে মধ্যেই কোয়ার্টারে এটা ওটা বেচতে আসতো। ছেলেটির নাম যুগল সরেন। বেঁটে খাটো স্বাস্থ্য বান ,গায়ের রং ভীষণ পুরু। মাথায় ছোট করে ছাটা কোঁকড়ানো চুল ,চ্যাপ্টা নাক আর মোটা ঠোঁট। একদিন একটা মুরগী তুলে নিয়ে এসে বললো -- বাবু এটা লিবি ?

ওদের নিজেস্ব ভাষা ওরা গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবহার করলেও বাংলা টা বেশ চলনসই।

আমি বললাম -- দাম কত ?

ছেলেটা মেঝেতে বসে পড়ে বললো -- পয়সা লিবোক লাই। এমনি লিয়ে লে।

পান্নালাল খপ করে সেটা খামচে নিয়ে বললো -- কি রে হঠাৎ এতো দয়া ! ঘুষ দিচ্ছিস না তো ? শেষে বলবি ফ্রি তে ট্রেনে চড়ে এখান ওখান যাবো !

-- না বাবু, সে কতা লই। বোঙ্গা তোরা বাঁচা।

এ কথার মানে আমি না বুঝলে ,পান্নালাল এর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালে ও বললো -- ওরা এই বনটাকে দেবতা ভাবে। বোঙ্গা মানে ভগবান। ওর টাইটেল সরেন ,ওদের বিশ্বাস অনুযায়ী হরিণ থেকে ওদের উৎপত্তি। কিন্তু দীর্ঘ কিছু বছর থেকে চোরা শিকারীরা যেভাবে হরিণ মেরে গায়েব করছে, তাতে  বন একদিন হরিণ শূন্য ,মানে ওদের ভাষায় দেবতা হীন হয়ে পড়বে।

পান্নালাল এখানে দীর্ঘ কয়েক বছর আছে সে কারণে ওদের ভাষা একটু আধটু বোঝে। আমি বললাম -- প্রশাসন কে জানাক ব্যাপারটা। কিংবা রেঞ্জার কি করছে ?

পান্নালাল একটা লম্বা হাসি ছেড়ে বললো -- বিভীষণ না থাকলে রাবন কে মারা সহজ হতো না দাদা ।

সমস্ত ঘটনাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বিশাল চক্র কাজ করছে এখানে , ওপর মহল জড়িত। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ । ওই আদিবাসী মানুষ গুলোর মতোই এই বিষয়ে নিরুপায় বোঝাতেই যুগল মাথা নিচু করে চলে যেতে লাগলো। আমি ওকে দাঁড় করিয়ে সঙ্গে আনা মুরগি টা ফেরত দিয়ে দিলাম। এতে পান্নালাল যে খুব একটা খুশি হয়নি সেটা বলাই বাহুল্য ।


মাঝ রাত্তিরে বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকারের বন্দুকের শব্দ শুনে এক একরাত ঘুম ভেঙে জেগে উঠলে পান্নালাল ইশারা করে শুয়ে থাকতে বলতো। কয়েক সপ্তাহ পর পান্নালাল তখন রাত্রের দিকে হুর কাটরায় গিয়েছে, আমি কোয়ার্টার এ একাই আছি।

পুলক মাঝখানে জানতে চাইলো -- হুর কাটরা কি ?

--হুর কাটরা হচ্ছে সাঁওতাল দের একটা বিবাহ পদ্ধতি। সবটাই ধর্মীয় বিশ্বাসে একটা বলপূর্বক বিবাহ পদ্ধতি। কোন সাঁওতাল যুবক যদি কোন সাঁওতাল যুবতীকে ভালোবেসে ফেলে আর সেই যুবতী যদি অসম্মতি জানায় ,তবে সেই যুবক হাটে গিয়ে সেই যুবতীকে খুঁজতে থাকে। যদি সে তাকে দেখতে পেয়ে যায় আর তার কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিতে পারে, তবে ওই মেয়ের আর ওই যুবক কে ছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে করা সম্ভন নয় ধর্মীয় মতে। তখন গ্রামের মাতব্বর রা ওই যুবকের কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করে ধুম ধাম করে বিবাহ সম্পূর্ণ করে। পান্নালাল এর পরিচিত কেউ এরম করে বসলে সে সেখানেই যায়। সে রাত্রে তার যে ফেরার সম্ভাবনা অত্যন্ত ই কম আমি সে আগে ভাগে বুঝেই খাওয়া দাওয়া সেরে দোর এঁটে শুয়ে পড়লাম। রাতের দিকে সেদিকে ট্রেন তেমন চলে না। বুনো হাতির দল লাইন আটকে পারাপার হতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনায় পূর্বে ঘটেছিল বলে রেল কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন। শীত তখন হালকা হালকা নেমেছে। তবে বনাঞ্চল আর জলাশয়ের কারণে রাত বাড়লে ঠান্ডা জাঁকিয়ে নামতো। আমি সবে মাত্র গায়ে মোটা চাদর চড়িয়ে শুয়েছি , ওমনি হঠাৎ শুনি এক কান্নার শব্দ। ধরফরিয়ে উঠে জানলার দিকে কান পাতলে শুনতে পেলাম শব্দ টা আসছে জঙ্গলের ভেতর থেকে । একটা মেয়ের কান্না। ইনিয়ে বিনিয়ে সমানে কেঁদে চলেছে। নিরবিচ্ছিন্ন সে কান্নার শব্দ আমাকে যেন কিছু তেই স্বস্তি দিচ্ছে না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এক মহিলা বিপদে পড়ে কান্নার শব্দের মাধ্যমে সাহায্য চাইছে। আমি পুরো ব্যাপারটা বোঝাবার জন্য খানিক ক্ষন চুপ করে বসে রইলাম। তারপর সেই কান্না করুন থেকে করুনতর হয়ে উঠলে গায়ে গরম পোশাক চড়িয়ে টর্চ নিয়ে অন্ধকারে সেই শব্দ লক্ষ্য করে হাঁটা দিলাম। সঙ্গে নিলাম একটা শক্ত লাঠি। বয়েস অল্প ঝুঁকি নিতে কোনো আপত্তি ছিলনা।শরীরে ভয়ও ছিল কম। জমাট অন্ধকার আর কুয়াশার পাতলা ওড়না ভেদ করে টর্চের আলো আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। কতটা গভীরে পৌঁছে গিয়েছিলাম আর কতক্ষন হেঁটেছিলাম জানি না। তবে সেই কান্নার শব্দে কান পেতে এগিয়ে যেতে যেতে দেখি জঙ্গলে চোরা শিকারী দের ফাঁদ পাতা রয়েছে। আর সেই ফাঁদে আটকা পড়েছে এক গর্ভবতী হরিণ। দীর্ঘক্ষণ ফাঁদ থেকে বেড়ানোর চেষ্টা করে সে প্রায় ক্লান্ত। নড়বার শক্তিও যেন নেই। হা করে পড়ে রয়েছে, আর থেকে থেকে নড়ছে অল্প। আমার ওই দৃশ্য দেখে যুগলের কথা মনে পড়লো।হরিণ তো ওদের কাছে দেবতা ! তৎক্ষনাৎ সেটিকে উদ্ধার করে ছেড়ে দিলাম। হরিণী খানিক ক্ষন দম নিয়ে বনের গভীরে হারিয়ে গেল।

দিব্যেন্দু এতটা শুনে বললো -- আর সেই মেয়েটির কান্না ?

-- নেই। কিছু নেই। কানে সেসব আর এলোনা। কেবল নিশাচর দের শব্দ শান্ত বন ভেদ করে শরীর শিহরিত করে চললো। আমিও ভাবলাম সে মেয়ে বুঝি কষ্ট লাঘব করে ফেলেছে, কিংবা অন্য কেউ আমার পূর্বেই সেই শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে সাহায্য এর হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মিনিট দশেক সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে উল্টো পথ ধরে একই ভাবে কোয়ার্টারে ফিরে এলাম। হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়েছি ঘুমটা সবে মাত্র এসেছে এমন সময় দেখি দরজা টা দুলে দুলে উঠছে।আর তার সাথে মিষ্টি তীব্র একটা সুগন্ধি নাকে ভেসে আসছে। কোনো বন্য জন্তু যেন দরজাতে মাথা দিয়ে গুঁতো মারছে। মেজাজ বিগড়ে গেল।খানিক ক্ষন থেমে থেকেও রেহায় নেই। সমানে গুঁতো দিয়ে চলেছে। উঠে গিয়ে বাইরের লাইট টা জ্বেলে জানলা দিয়ে উকি মেরে দেখি একজন লোক দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে। অনেক সময় রেলের ঊর্ধ্বতন অফিসারেরা কোনো রকম অগ্রিম খোঁজ খবর না দিয়ে এভাবেই আচমকা ইনস্পেকশনে আসেন । সেরম অভিজ্ঞতা পান্নালাল এর মুখে শুনেছিলাম। আমি ওরম কিছু একটা ভেবে দরজা খুলতেই দেখি লোকটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো তারপর চেয়ারে বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলো -- আপনার নাম ?

-- লক্ষী চরণ রাম , -বললাম আমি।

আগন্তুকের পড়নে মাথা থেকে পা অব্দি ঢাকা পশমের পোশাক। ঘরে প্রবেশ করা মাত্র সেই মিষ্টি সুবাস যেন আমার নাক মুখ শিরায় শিরায় প্রবেশ করলো। ভীষণ ঝাঁঝালো মিষ্টি সুগন্ধি এবারে অনুভব করছি।আমার দিকে একদৃষ্টে খানিক চেয়ে থেকে বলল -- বসুন , আমার নাম সম্বর সরেন। ওদিকটায় থাকি ।,

বলে ,জানলা দিয়ে পিছনের বনের দিকে ইশারা দিলো। আমি সরেন শুনে বুজতেই পারলাম স্থানীয় আদিবাসী বস্তি থেকে এসেছে।আরো একটা জিনিস লোকটার চোখে পড়ার মতো। তা হলো চঞ্চলতা। ঘরের এদিক ওদিক সমানে যেন দৃষ্টি ঘুরিয়ে চলেছে।আমার এ ঘরে আসার কারণ হিসেবে বললো -- এখানে নতুন ,তাই আলাপ করতে এসেছি।

আমি তাকে সেই মিষ্টি গন্ধের উৎস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ,মৃদু হেসে বললো --  এ এক লম্বা আশ্চর্য কাহিনী।

আমি বললাম -- আমার ঘরে এসেই যখন পড়েছেন তখন মিষ্টি গন্ধের রহস্য উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ছি না।

সম্বর সরেন কিছু চেবানোর মতো করে মুখটা দু বার নেড়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো --আমার স্পষ্ট মনে আছে সময়টা ছিল কার্তিক মাস। রাতের দিকে ঠান্ডা বেশ ভালো মতোই নামছে। সাঁওতাল দের বস্তিতে এমন এক রাতেই পালিত হচ্ছিল সোহরায় উৎসব। এই উৎসব মূলত বনের পশু আর গৃহ পালিত পশুদের মঙ্গল কামনার জন্য ওরা পালন করে। উৎসবের মূল আকর্ষণ সাঁওতাল রমণীদের  মাদলের তালে তালে জোট বদ্ধ নাচ।  আমি সেদিন গভীর অরণ্যেই ছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল চোরা শিকারী দের উচিৎ শিক্ষা দেয়া। গভীর অন্ধকারে ঘন বনের ভেতর ভেসে আসছিল মৃদু মৃদু সোহরায় উৎসবের বাজনা। গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল পূর্ন চাঁদের আলো। কি অপরূপ সে দৃশ্য। হঠাৎ সেই মিষ্টি সুগন্ধ আমার নাকে এলো। আমি তাকে অনুসরণ করে যেতেই সামনে দেখলাম দুধ সাদা বর্ণের কিছু হরিনী চাঁদের আলো গায়ে মেখে সেই সহরায় উৎসবের গান বাজনা তালে তালে নাচছে। আর ওদিকে থেকেই আসছে সুবাস। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য আমি দেখে চলেছি। কি অপরূপ আর মায়াবী সে ছবি। আজও আমার চোখে ভাসছে। হরিণী দের পায়ে যেন বাঁধা রয়েছে অদৃশ্য নুপুর ওর থেকেই আসছে মাতাল করা রিনিঝিনি শব্দ। বাঁকানো সিং এর বাহার দেখবার মতো। নিদারুণ চোখের চাহনিতে ওরা প্রত্যেকেই গর্বিনি। শঙ্খ শুভ্র ওদের মেদ বহুল শরীর যেন নরম কচি ঘাসের থেকেও ঠুনকো আর সতেজ। গাছের আড়াল করে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে দেখি, আমার এতো ক্ষনের দর্শন সব ভুল। বিস্ফারিত চোখ নিয়ে সেদিকে নজর ফেলে দেখি ওরা হরিণী নয়। এক একটা জীবন্ত নারী। যাদের কানের দুপাশ দিয়ে হরিণীর মতো সুন্দর সিং। নিরাবরন শরীরে সূক্ষ সূক্ষ শ্বেত বরণ রোম। সঙ্গিনী দের সাথে নৃত্য আর খেলায় মেতে আছে। চোখের দৃষ্টি ফেরানো যায় না এক মুহূর্ত । এমন সময় শুনি বিকট যান্ত্রিক শব্দ। মুহূর্তের মধ্যেই সব এলোমেলো হয়ে গেল ।ওরা লাফিয়ে হাওয়ার গতিতে চোরা শিকারীদের গুলির শব্দে মিলিয়ে গেল আঁধারে। এতো ক্ষন ভাবছিলাম আমি একাই এই অপূর্ব মায়ার সাক্ষী। কিন্তু না ! চোরা শিকারীরা বন্দুক তাক করে রেখেছিল সুযোগ সন্ধানী হিসেবে। কিন্তু নিষ্ফল হয়ে ওরা চারপাশ ঘুরে ফিরে উধাও হলো। সব শান্ত হলে ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে অনুভব করলাম সেই মিষ্টি গন্ধ এখনো যায়নি। ইন্দ্রিয় সজাগ করে অনুসন্ধানে নামলে দেখলাম শুকনো পাতার ওপর পড়ে রয়েছে সেই সূক্ষ লোমশ একটা প্রায় গোলাকার পিন্ড আর ওর থেকেই গন্ধটা আসছে। হাতে তুলে নিয়ে দেখি কস্তুরী । এর লোভেই শিকারী রা গুলি ছুঁড়ে ছিল।

ভদ্রলোক গল্প শুরু করলে আমার তাকে ফরেস্ট রেঞ্জার বলেই মনে হয়েছিল । একটা সম্মান এসেগিয়ে ছিল ভেতরে ।কিন্তু গল্পের শেষে সম্মান টা আর রইলো না ।কারণ তিনি ডাহা মিথ্যা বাদী। তার মিথ্যার প্রসঙ্গ ধরিয়ে দিতে বললাম -- আপনার অলৌকিক দৃশ্য দর্শনের সৌভাগ্য ঈর্ষান্বিত হবার জন্য যথেষ্ট। তবে বেশ বড়ো মাপের ভুল করছেন আপনি। সেটা হলো কস্তুরী গ্রন্থি  হরিণীর নাভিতে থাকে না । থাকে পুরুষ হরিণের নাভি তে। আর এই একই কথা ওদের সিং প্রসঙ্গেও সমান ভাবে খাটে।

একথা শোনার পর লোকটা ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর বললো -- পশু সম্বন্ধীয় জ্ঞান ,প্রেম বেশ ভালোই আপনার  ।মিথ্যার আশ্রয়ে আপনার কাছ থেকে পাড় পাওয়া যাবে না দেখছি। চোরা শিকারী দের ফাঁদ থেকে হরণীর প্রাণ ফেরানোর জন্য অপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছিলাম। সুগন্ধি টা কোথা থেকে আসছে এরপর আপনি নিজেই টের পাবেন।

কথা বলা শেষ হলে চোখের সামনে তার গায়ে চড়ানো পশমের পোশাক টা শরীরে ধীরে ধীরে সেঁটে যেতে দেখলাম। এরপর কানের পাশ দিয়ে প্রকট হলো শাঁখা প্রশাখা সমেত দুটো সিং। অদ্ভুত সেসব ঘটতে দেখে আমার বাকশক্তি নিমিষে ফুরিয়ে গেল। হঠাৎ চারপায়ে ভর করে সে ছুটে হারিয়ে গেল অন্ধকারে। আমার বাস্তব অবস্থায় ফিরে আসতে অনেক সময় লেগেছিল। মিষ্টি গন্ধটা এখনো আমার ঘর ছেড়ে যায়নি। মেঝেতে নজর ফেলে দেখি একটা লোমশ গোলাকার বস্তু পড়ে রয়েছে আর ওর থেকে তীব্র মিষ্টি ঘ্রাণ বেড়োচ্ছে। হাতে তুলে নিতেই সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। কস্তুরী ! হরিণ এর নাভি পিন্ড।

এতক্ষন গল্প শুনে আমদের কিছু প্রশ্ন করার আগেই লক্ষী জেঠু আবার বললো-- জানি তোদের মনের অবস্থা অনেক কৌতূহল ই জমা হয়েছে। আসলে ও ছিল বোঙ্গা। মানে যুগল সরেন দের দেবতা। গর্ভবতী হরিণীর প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমাকে দেখা দিয়েছিলেন। আর সেই কস্তুরী ছিল ওনার নাভীচ্যুত। ও আমি এখনো রেখে দিয়েছি দেশের বাড়িতে। গোটা গ্রাম ওর গন্ধে ম ম করে এখনো। সামনের ছুটিতে নিয়ে এসে তোদের দেখাবো ,কেমন।

গল্পের বিষয় বস্তু যে আকর্ষণীয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু হরিণ হরিণীর মানুষ রূপ ধারণের ব্যাপারটা আমার হজম না হওয়ায় বললাম -- সবই ঠিক আছে ,তবে হরিণেরা মানুষ হয়ে উঠলো এটা মেনে নেয়া যায়না।

এর উত্তরে জেঠু যেটা বললো তার কাছে সব অবিশ্বাস ই নিষ্ফলা।

-- রাক্ষস মারীচ যদি স্বর্ণ হরিণের রূপ নিতে পারে ! তবে আদিবাসী সরেন দের বোঙ্গা মানে দেবতা কেন মানুষের রূপ নিতে পারবে না ?

misterashis@gmail.com
মুর্শিদাবাদ




No comments:

Post a Comment