1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

আরশি

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

আরশি
 বুমা ব্যানার্জি দাস

         শেষ বিকেলের আলোয় নীরজা আগরওয়াল পলেস্তারা খসে যাওয়া দেওয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কটা দিনই বা। তাদের প্রায় দেড়শ বছরের পুরানো এই দোতলা বাড়ি প্রোমোটারের হাত থেকে বাঁচানোর উপায় আর নেই। অবিশ্যি রেখেই বা কী হবে। যে কোন সময় নিজেই ভেঙে পড়ে যাবে হয়তো। আজ কত বছর হতে চললো না হয়েছে রং না হয়েছে কোন সংস্কার। সে অন্তত তার জীবনে দেখেনি। এখন তার ছাব্বিশ চলছে। বাবা থাকলে তাও নাহয় চেষ্টা করা যেত। দশ বছর হতে চললো বাবা নেই। মাকে তো তার মনেই পড়ে না। সেই কোন ছোটবেলায় মা কে হারিয়েছে নীরজা। নাকি অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। শুনেছে, মনে পড়ে না তেমন কিছুই। তারা আসলে লোকে যাকে বলে মারওয়ারি।এদিকে মাছ না হলে ভাত মুখে ওঠে না। নীরজা তো হিন্দীর থেকে বাংলা বেশি ভালো বলে। পূর্বপুরুষের মারওয়ারি ভাষা শুনলেও বুঝতে পারবে না নির্ঘাত। বহু বছর আগে তাদের কেউ বাংলায় এসে ঘর বাধে। ধীরে ধীরে ব্যবসা জমায়, ধন সম্পত্তি বাড়ায়। এই বাড়ি তৈরি হয় তারও কতদিন পর। এক সময় খুবই রমরমা ছিল তাদের। তারপর আবার ছড়িয়ে পরে নানাদিকে সবাই। এই বাড়িতে থেকে গিয়েছিল তারাই শুধু। অবস্থা খারাপ হতে হতে আজ আর বিশেষ কিছু বাকি নেই। মায়ের গহনা ছিল কিছু, বিয়ের পর সেসব নিয়ে ভাই আলাদা হয়ে যায়। যোগাযোগ নেই সেই থেকে। নীরজা পড়াশোনাটাও খুব বেশিদূর করেনি। মোটামুটি চাকরি পায় মাঝে মধ্যে, করে কিছুদিন। আবার খোঁজে। আর কিছু না পাক, মায়ের রূপের বেশ কিছুটাই পেয়েছে সে। তার উপর স্বভাবটা বড্ড নরম। দুর্বল বললেই চলে। জোরে কথা পর্যন্ত বলতে সে পারেনা। দুর্বল ও মুখচোরা অথচ চোখে পড়ার মতো সুন্দরী হওয়ার যা স্বাভাবিক পরিণতি তার সাথে সেটাই হয়ে থাকে প্রায় সব কাজের জায়গায়। শেষ চাকরিটা ছেড়েছে সপ্তাহ দুয়েক হলো। কাজের অছিলায় গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, কাজ না থাকলেও ডেকে পাঠানো, অর্থবহ ইঙ্গিত করা এসব গা-সয়া হয়ে গেছে এখন। আগে বাড়ি ফিরে কাঁদতে বসত, এখন রেসিগনেশন লেটার লেখে। আবার কবে কোথায় কাজ পাবে জানেনা সে। বড্ড একা লাগে মাঝে মাঝে।

           পাড়ার গুন্ডা কাম প্রোমোটার কাম রাজনৈতিক দাদা সম্রাট। বাপ মা আদর করে নাম রেখেছিল সম্রাট। তা এহেন সম্রাট করতে পারেনা এমন কুকাজ কমই আছে। আগরওয়ালদের ভাঙ্গা বাড়ি আর ফুলের মত নীরজা তার চোখে পড়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই। মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেলতে পারলে ল্যাঠা চুকে যেত, বাড়ি মেয়ে দুটোই তার কব্জায় এসে যেত। কিন্তু মুশকিল হলো বছরখানেক আগে তার মা খুব ঘটা করে ঘরে বউ এনেছে। তাকে এত তাড়াতাড়ি লোপাট করা মুশকিল। ভোট সামনে। এখন এসব করতে গেলে আখেরে ক্ষতিই হবে। মেয়েটাকে তুলে আনতেও সেই কারণেই আটকাচ্ছে। তাছাড়া সে মেয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে যায় বিকেল না হতেই ঘরে ঢুকে পড়ে। ওই ভাঙ্গা বাড়ি কতদিন আর আগলে রাখবে ওইটুকু মেয়ে। একদিন খুব ভদ্রভাবে বিকেলবেলা সে বাড়ি গেল সম্রাট। কাজের কথাই বলল। বাড়ি তাকে দিয়ে দিক, সে সাততলা ফ্ল্যাট বানাবে, একটা ফ্ল্যাটে থাকুক নীরজা। ভয়ে ফ্যাকাশে মেরে গিয়েছিল মেয়েটা। তাও কি সুন্দর দেখাচ্ছিল। চোখ দিয়ে গিলতে গিলতে সম্রাট বুঝিয়েছিল বাড়ি কি এভাবে সে রাখতে পারবে। কত রকম বিপদ আছে। একটা হতে কতক্ষন। বার চারেক এইভাবে হানা দেবার পর রাজি হয়েছে নীরজা। সাততলা উঠলে একটা ফ্ল্যাটে তো সে থাকছেই। যাবে আর কোথায়। সম্রাট সুযোগ কি আর পাবেনা। তবে আর একবার যেতে ইচ্ছা করছে আজ সম্রাটের। দরকার না থাকলেও কিছু কাগজপত্র সই করবার অজুহাতে যাবে নাকি? এই সন্ধ্যের মুখটাতে রাস্তায় তেমন কেউ নেইও।

         অন্ধকার হয়ে আসে। নীরজা আলো জ্বালানোর কথা ভুলেই গেছে। কি কি নিয়ে যাবে সাথে? বাড়ি তৈরি যতদিন না হয় তাকে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হবে। এক কামরার ছোট একটা ফ্ল্যাট। পুরানো জিনিসের বিশেষ কিছুই আর নেই। তার খাটটা বিশাল। অনেক পুরানো। মাথার কাছে ভারি সুন্দর কাঠের কাজ করা। সেটা বিক্রি করে দেবে নীরজা। কয়েকটা পুরানো কাঠের খেলনা, গালার কাজ করা- চমৎকার দেখতে। সেগুলো নিয়ে যাবে সঙ্গে। আর আর্শিটা কী করবে? এটা যে কবেকার ঠিক জানেনা নীরজা। আদৌ কোন দামী জিনিস কিনা তাও জানেনা। দেখতে তো অতি সাধারণ। চৌকো, তবে লম্বায় বেশ বড়। সামনে দাঁড়ালে পা পর্যন্ত দিব্য দেখা যায়। চারপাশের ফ্রেমটা সোনালী, খানিক রংচটা। উপরের দিকের ফ্রেমটা আবার খানিক ফাটাও। শুনেছে এটা নিয়েই নাকি এদেশে এসেছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কেউ হাতছাড়া করেনি এটা। একসময় নাকি পুজো হতো। কেন কোনো ধারণা নেই নীরজার। এই ফাটা আরশি কেউ কিনবে না অবশ্যই। ফেলতেও মন চায়না। না হয় নেবে এটা সাথে। আশর্য কান্ড তার পূর্বপুরুষদের। টাকা পয়সা ধন সম্পত্তি সব গেল, এই আরশি বয়ে বেড়িয়েছে বংশ পরম্পরায়। ভালো করে দেখাও যায়না ইদানিং। ঝাপসা মতো ছায়া পড়ে। আরশির সামনে দাঁড়িয়ে অন্ধকার হয়ে আসা ঘরে এলোমেলো এইসব ভাবছিল নীরজা। প্রোমোটারটিকে একদম ভালো লাগেনি তার। দেখলেই কেমন সাপের মতো লাগে। সে ঠিক করেছে এখানে যে ফ্ল্যাট তাকে দেওয়া হবে সেটা বিক্রি করে অন্য কোথাও চলে যাবে সে। হঠাৎ খুট করে একটা আওয়াজ পেয়ে চমকে ওঠে নীরজা। ঘরে একটা ছায়া ঢুকে আসে।

        একতলার দরজা খোলা পেতে অবাক হলো সম্রাট। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে পড়ে সে। আলো জ্বলছে না। সিঁড়ি বেয়ে সাবধানে উঠে আসে সে। এত সহজে ঢুকে পড়তে পারবে ভাবতে পারেনি। আবছা আলোয় নীরজাকে দেখতে পায়। শিকারী বেড়ালের মতো এগোতে যাবে, নীরজা টের পেয়ে চিৎকার করে ওঠে।
-কে? কে ওখানে। - লাফিয়ে এগোতে যায় সম্রাট। দেওয়াল হাতড়ে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে নীরজা। ভয়ে বোধকরি সুইচ খুঁজে পায়না। সম্রাট আরো এগিয়ে আসে।


         একটা হালকা নীলচে আলোয় হঠাৎ ভরে ওঠে ঘর। আলোটা আসছে আরশিটা থেকে। ভারী মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। হতবাক হয়ে নীরজা দেখে একটা আলতো পরা পদ্মের মতো পা আরশি থেকে বেরিয়ে আসে। মেঝেতে পা টা পড়ে। আস্তে আস্তে কেউ বেরিয়ে আসছে আরশি থেকে। কিন্তু একটুও ভয় করেনা নীরজার। স্পষ্ট হয় পায়ের পাতা, শরীরের বাকি অংশ। সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে কি আশ্চর্য এক সুগন্ধ। কি অপরূপ। পা দুটিতে সোনার নুপুর ঝলমল করে ওঠে। পরনে ঘন নীল ঘাগরা, খুব দামী কোনো রেশমী কাপড় দিয়ে তৈরি। কোমরে সোনার গহনা, হাত দুটি যেন চাঁপার কলি। মুখের দিকে তাকানো যায়না এত উজ্জ্বল। গায়ে জড়ানো সোনালী আঁচল। নীরজার কেন যেন কাঁদতে ইচ্ছা করে। এত আপন কেন লাগছে, কোথায় দেখেছে সে একে। চোখ দুটো তুলে তাকায় সেই অপরূপা। যেন পূর্ণিমার চাঁদ। দু চোখ দিয়ে আলো ঝরছে। চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে নীরজার। ঠিক কপালের উপর খুব উজ্জ্বল একটি পাথর। হীরে মনে হয়। কাঁধের উপর দিয়ে লম্বা বেনী কোমর ছাড়িয়ে নেমে এসেছে। মেঘহীন আকাশের মতো ঝলমল করছে কপাল। মাঝখানে একটি টীপ, সামান্য আলপনা দিয়ে ঘেরা।হঠাৎ দরজার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকায় সেই দেবীমূর্তি। চমকে ফিরে তাকায় নীরজা। আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রোমোটার সম্রাট। কিন্তু তার পেছনে কে? শীর্ণ শুষ্ক শরীর, হিংস্র দুটো চোখ, সূঁচালো দাড়ি? এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে সেই দেবী প্রতিমার দিকে। তীব্র গম্ভীর ঘন্টার মত কন্ঠ শোনা যায় - আজও নয় খিলজী… আজও নয়। সেদিনও পারোনি, আজও পারবে না। চারিদিকে তীব্র এলো ঝলসে ওঠে। চোখ বন্ধ করে নেবার আগে শেষবারের মতো দেখতে পায় সেই দেবীমূর্তি আবার প্রবেশ করছে আরশিতে। জ্ঞান হারাবার আগে নীরজার কানে আসে হাহাকার মেশানো পুরুষকণ্ঠ - পদ্মাবতী, যেও না।

      পুলিশ এসেছিল, কারণ পাড়ার গুন্ডা কাম প্রোমোটার কাম রাজনৈতিক দাদা সম্রাটকে নীরজা দের ভাঙ্গা দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নীচে পড়তে দেখা গেছিল। সম্রাট কেন লাফিয়ে পড়েছিল কিছু বলতে পারেনি। পা ভেঙেছিল, তবে আপাতত মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি যেন বলে।খুব কান খাড়া করলে মনে হয় অনেক পুরানো একটা ছড়া বলছে - রানী তো রানী চিতোর কি রানী, বাকি সব গাধাইয়া। কেউ কিছু বুঝতে পারেনা। নীরজাকে পুলিশ পেয়েছিল অজ্ঞান অবস্থায় একরাশ ভাঙ্গা কাঁচের মধ্যে, ঘরের ভিতর।

         বাড়ি বিক্রি করতে হয়নি নীরজাকে। আরশিটা আর সরায়নি যদিও। যে অনেকগুলো আরশির প্রতিচ্ছবিতে  তৈরি রানী পদ্মাবতীর প্রতিবিম্ব ঝিলের জলে দেখে উন্মাদ হয়ে গেছিল খিলজী তার একটা কি সারানোর জন্যও কারো হাতে তুলে দেয়া যায়। যত্ন করে তুলে রেখেছে সেটা। সারিয়ে নেওয়ার লোভ যে হয়নি তা নয়। আর একবার যদি সে আসে, যদি আর একবার অন্তত ভালো করে তাকে দেখে নেওয়া যায়। তারপর মনে হয়েছিল নাহ থাক। হঠাৎ চাকরি একটা জুটে যায় কপালে। সেটাই করছে মন দিয়ে। আর সপ্তাহে তিন দিন সেলফ ডিফেন্স শিখতে যায় কাছেই ক্যারাটে স্কুলে। বেশ লাগে। পৃথিবীতে আলাউদ্দিন খিলজীর অভাব তো নেই। আর তার নিজের নামের মানেও যে পদ্মফুল।
banerjee.buma@gmail.com
কানাডা 



1 comment:

  1. মন ভরে গেল। যেমন লেখনী , তেমনি ভাবনা। সব সম্রাট খিলজী না হোক, সব নারীরা মাঝে একজন পদ্মাবতী যেন থাকে । অন্তত নিজের আরশিতে যেদিন সব মেয়ে আত্মরক্ষার সাহস দেখাতে পারবে, সেদিন হবে আসল ক্ষমতায়ন।

    ReplyDelete