1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

আত্মজা

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

আত্মজা
পৌলোমী মুখার্জী

"মা...., আই হ্যাভ ক্র্যাক্ড ইট", চেঁচিয়ে ডাকে রাই। পৃথা বসেছিল ঠাকুর ঘরে। সকাল থেকে। দুদিন আগেই জেনেছে, জয়েন্টের রেজাল্ট বেরোবে আজ। সেই থেকে পৃথা ঠাকুর ঘরে হত্যে দিয়েছে। আজ তো শুধু রাই এর রেজাল্ট নয়, পৃথা আর অভিষেকের ও রেজাল্ট বেরোলো। আঠারো বছর আগে নেওয়া চ্যালেঞ্জ এর রেজাল্ট। 

হুড়মুড় করে নীচে নামে পৃথা। " "কিরে, কি হল! "
"মেডিকেল এ হয়ে গেছে মা! " রাই জড়িয়ে ধরে পৃথা কে। 
"তোর বাবা কোথায়? বাবা কে বল। "চোখে জল আসে পৃথার। 
" বাবা তো শুনেই সবাই কে ফোন করতে শুরু করে দিয়েছে। ঐ দেখো, বারান্দায়। "
পৃথা দেখে, অভিষেকের চোখে যেন আলো জ্বলছে। সাফল্যের আনন্দ রাই এর কতটা কে জানে, কিন্তু পৃথা আর অভিষেক চেয়েছিল এভাবেই যোগ্য জবাব দিতে প্রতিটি লোককে। 

পৃথা ফিরে গেল ঠাকুর ঘরে। সেখানে একটি বড় ছবি মাদার তেরেসার। পৃথা ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে হাপুস নয়নে। 
"তোমার জন্যই সব মা, তোমার জন্যই। আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। "-মনে মনে বলতে থাকে পৃথা। 
পৃথার ঠাকুর ঘরে মনীষী দের ছবি সব। এনারাই ঈশ্বর তার কাছে। সবার মাঝে জ্বলজ্বল করে মাদারের ছবি টি। পৃথা আর অভিষেক এর জীবন পাল্টে গেছে এই মানুষ টির জন্য। পৃথা তাই এখনও ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে মাদারের ছবির সামনে। 

দুপুরের খাওয়া মিটিয়ে রাই বেরিয়ে পড়ল বন্ধু দের সাথে। অভিষেক টিভি তে খবর চালিয়ে বসল বসার ঘরে। পৃথা এল একটু গড়িয়ে নিতে। কাল সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল চিন্তায়। এমন নয় যে, রাই ডাক্তার হতে না পারলে পৃথিবী রসাতলে যেত। তবু, জীবনের পথে একটা বড় চৌকাঠ ছিল এটা। সেটা সফলভাবে উতরে গেছে। এটাই শান্তি। 

বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে পৃথা। ঘুম আসছে না। অতীতের যত এলোমেলো ঘটনা ভিড় করছে মাথায়। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রয়েছে। 

মন চলে গেছে অনেক বছর আগে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে পৃথা। মিসক্যারেজ হয়েছে তার। এই নিয়ে তৃতীয় বার। চোখের জল ও শুকিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। একটার পর একটা সন্তান নষ্ট হবার যন্ত্রনা। প্রথম বার নষ্ট হবার পরেই ভেঙে পড়েছিল পৃথা। তারপর আবার। দ্বিতীয় টি নষ্ট হবার পর আর সন্তান নিতে চায়নি ওরা। প্রতি বার নতুন একটি প্রাণের আশায় বুক বাঁধা। স্বপ্ন দেখা। আর প্রতি বার ই নিদারুণ স্বপ্ন ভঙ্গ। অথচ ডাক্তারি পরীক্ষায় কোন সমস্যা ধরা পড়ছে না। তাই দ্বিতীয় বারের পর অভিষেক ও বলেছিল, " আর নয়। শরীর, মনে এভাবে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয়না। পৃথা, ইচ্ছে করলে তুমি ছোটখাটো কোন চাকরির চেষ্টা কর, সময় কাটবে, মন ও ভালো থাকবে। "পৃথাও রাজি ছিল। 

কিন্তু হলে কি হবে! ঐ যে, সমাজ! তার চোখ রাঙানো যাবে কোথায়!! 
বিয়ের এক মাস পর থেকে আত্মীয়, বন্ধুরা শুরু করেছিল, " কোন নতুন খবর আছে? "
যেন সন্তানের জন্ম দেওয়াই বিয়ে করার একমাত্র উদ্দেশ্য। দুবার মিসক্যারেজ এর পরেও তাই অভিষেক অফিস যাওয়ার পর শ্বশুর শাশুড়ি ঘ্যান ঘ্যান করতেন পৃথার কাছে। একটা নাতি নাতনীর মুখ না দেখলে ইহ জীবন বৃথা হয়ে যাচ্ছিল ওনাদের। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেষ্টা চলে তৃতীয় বারের জন্য। হয়েও যায় পৃথা অন্তঃসত্ত্বা। আবার আনন্দে বুক বাঁধে। সমস্ত রকম সাবধানতা নিয়েও শেষ রক্ষা হয় না। আবার মিসক্যারেজ। এবার ৭মাসে। অগত্যা, সেই হাসপাতালের বিছানা। ডাক্তার যতই আশা দিন, আত্মীয়রা যতই কথা শোনাক, আর নয়। পৃথা আর অভিষেক সিদ্ধান্ত নেয় হাসপাতালে বসেই। দরকার হলে ওরা আলাদা ফ্ল্যাটে চলে যাবে। সেখানে কেউ পৃথা কে কথা শোনাতে পারবে না। কিন্তু বাচ্চার চেষ্টা ওরা আর কিছুতেই করবে না। সবার সব থাকে না। সব পেলে নষ্ট জীবন।
বাড়ি ফেরার পর কিছু দিন চুপচাপ সবাই। তারপর আবার শুরু হল আভাসে ইঙ্গিতে। এক ই প্রস্তাব। পৃথা দেখল এদের সাথে সারাদিন থাকা অসম্ভব। চাকরি নিল ছোটদের একটা স্কুলে। সকালে অভিষেকের সাথেই বেরিয়ে যায়। ফেরে দুপুরে। বাকি সময়টা নিজের কাজ নিয়ে থাকে। শ্বশুর শাশুড়ির সাথে গল্পে যায় না। কিন্তু, তাতেও শান্তি নেই। বাড়িতে আত্মীয় স্বজন আসা লেগেই আছে। আর এলেই ঘুরে ফিরে এক ই প্রসঙ্গ। নানা রকম কথা শোনানো।
 একদিন তো চরম অপমান! মাসি শাশুড়ির মেয়ের সাধ ভক্ষণ অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে সাধারণত মেয়েদের ই নেমন্তন্ন থাকে। পৃথা শুনতে পেল, শাশুড়ি বলছেন শ্বশুর কে, "মুন্নির সাধে পৃথা কে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না, বুঝলে? তিন-তিনবার এক ই ঘটনা ঘটল। মুন্নির বাচ্চার কল্যাণ অকল্যাণের একটা ব্যাপার আছে তো। দিদি ও চাইছে না পৃথা যাক। কি করে যে আটকাই পৃথা কে..... "
ওনারা বুঝতেই পারলেন না, পৃথা শুনতে পেল সবটাই। পৃথা বাকরুদ্ধ। এই শতাব্দীর মানুষ ও এগুলো মানে! পয়া, অপয়া!! এরা নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করে!!! 
অভিষেক সব শুনল রাতে। পরের মাসে ওরা চলে গেল নতুন ফ্ল্যাটে। অভিষেক আর পৃথা। অভিষেকের বাবা আপত্তি করেছিলেন। অভিষেক বলল, "কোম্পানি ফ্ল্যাট দিচ্ছে, হাতছাড়া করা উচিত হবে না। " যদিও আলাদা হবার দায় নিতে হল পৃথা কেই। তবু ভালো ছিল ওরা। দুজনে। সারা সপ্তাহ স্কুল, অফিস, বাড়ির কাজ। সপ্তাহান্তে প্রায়ই ছোট খাটো বেড়ানো, সিনেমা দেখা, বাইরে ডিনার। আশেপাশের ফ্ল্যাটে ছোট বাচ্চা দেখলে পৃথার কষ্ট হত না এমন নয়, তবে মানিয়ে নিয়েছিল। 

সেদিন টা ছিল পৃথার জন্ম দিন। অভিষেক বলল, "আজ তোমাকে দিব্যেন্দু দার বাড়ি নিয়ে যাব। নেমন্তন্ন আছে। "
পৃথা জানে দিব্যেন্দু বাবু অভিষেকের অফিস কলিগ। দুজনের দারুন বন্ধুত্ব। রাজি হয়ে গেল যেতে, দুপুরে নেমন্তন্ন। বারোটা নাগাদ পৌঁছোল ওরা। দরজা খুলল দিব্যেন্দু দাই। কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। কিন্তু বাচ্চা টা কে? দিব্যেন্দু দাদের কাহিনী তো খুব ই করুণ। ওনাদের একমাত্র ছেলে মারা গেছে পুলকার অ্যাক্সিডেন্টে। সেও তো হয়ে গেল বছর দুয়েক। অভিষেকের কাছেই এসব শুনেছিল পৃথা। ওদের আবার বাচ্চা হয়েছে?  কিন্তু, অভিষেক তো কিছু বলেনি! 
পৃথা কে অবাক হতে দেখে অভিষেক বলল, "তোমায় সারপ্রাইজ দেব বলেই বলিনি পৃথা, দিব্যেন্দু দা আর বৌদি, দিয়া কে অ্যাডপ্ট করেছেন। দিয়া এসেছে সাতদিন হল। আমরা অবশ্য জানতে পেরেছি গত পরশুদিন। দাদা সবাই কে মিষ্টি খাইয়ে খবর টা দিল। তার আগে কদিন দাদা ছুটি তে ছিল। আমি শুনেই বললাম তোমায় নিয়ে আসব দিয়াকে দেখতে। "
পৃথা তো দারুন খুশি। সারাদিন ৬ মাসের দিয়াকে নিয়েই কাটল। সামনেই দিয়ার অন্নপ্রাশন। সেই নিয়ে বিস্তর প্ল্যান হল। সেইসঙ্গে নতুন করে অনেক দিনের চাপা পড়ে যাওয়া ইচ্ছে টা উস্কে দিল দিয়া...। 

অভিষেক সব নিয়ম জেনেই নিয়েছিল দিব্যেন্দু দার কাছে। ও জানত পৃথা আব্দার করবেই একটি বাচ্চা দত্তক নেওয়ার জন্য। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। পরের দিন ই ফোন করল ওরা, মিশনারিজ অফ চ্যারিটি, শিশু ভবনে। সিস্টার রা দেখা করতে বললেন। দেখা হতে ওনারাই বুঝিয়ে দিলেন কি করতে হবে। কাগজ পত্র জমা দেবার পর ওনাদের লোক বাড়িতে আসবেন। পরিবারের লোকেদের সঙ্গে এক এক করে কথা বলবেন। জানবেন, দত্তকের ব্যাপারে সবাই রাজি কিনা। 
এবার পৃথা আর অভিষেক, দুজনের বাড়িতে জানানোর পালা।
অভিষেকের বাবা মা এক কথায় বলে দিলেন, "কার না কার অবৈধ সন্তান। জাতপাতের কথা বাদ দিলাম, কিন্তু অন্য জিন। কি না কি অসুখ থাকবে, স্বভাব কেমন হবে... "। অভিষেক বলল, " সমস্ত টেস্ট করিয়ে ওনারা বাচ্চা দেবেন। তাছাড়া অসুখ তো পেটের সন্তানের ও হয়। আর স্বভাব টা নির্ভর করে পরিবেশের উপর। "

পৃথার বাবা মা অতটা খারাপ ভাবে না বললেও বোঝা গেল ওনাদের ইচ্ছে ছিল পৃথার শরীর টা নিয়ে আরও কয়েকবার কাটা-ছেঁড়া হোক। 

অন্যান্য আত্মীয় রাও বলল, "চোর, ডাকাত, খুনি, কার না কার বাচ্চা কে জানে! তার চেয়ে টেস্ট টিউব বেবীর চেষ্টা কর। "

অভিষেক আর পৃথা সবাই কে বলল, "সন্তান দত্তক নেওয়া টা আমাদের ফাইনাল ডিসিশন। কোনভাবেই সেটা পরিবর্তন হবে না। " মন থেকে মানতে না পারলেও মুখে কেউ কিছু বলতে পারে নি আর। 

রাই এল একটা বর্ষার সকালে। পৃথা আর অভিষেকের ফ্ল্যাটে। আত্মীয় রা একে একে উপহার নিয়ে দেখতে এসে এমন ভাব করল, যেন ভিন্ন গ্ৰহের কোন প্রাণী কে দেখছে। এরপর থেকেই দায়িত্ব, কর্তব্য ছাড়া কোন মানসিক বন্ধন আর ছিল না কারোর সাথে। পৃথা অভিষেকের ধ্যান জ্ঞান ছিল রাই। সেদিন থেকেই চ্যালেঞ্জ টা নিয়েছিল ওরা। রাইকে মানুষের মতো মানুষ করবে। তবে রাই এর সহযোগিতা ছাড়া সেটা সম্ভব ছিল না। 
আজ সেই আশা পূরণের দিন। আজ রাই এর সাথে পৃথা আর অভিষেক ও সফল। 
কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে এসব ভাবতে ভাবতে। ঘোর কাটল রাই এর ডাকে, "ওমা, ওঠো, চা করবে না? বাবা ডাকছে তো....। "

poulomim2013@gmail.com
হুগলী





No comments:

Post a Comment