1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

এপার-ওপার

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

এপার-ওপার

রাজকুমার মাহাতো


(১)


“বলাই নাসিম বাবুকে চিকেন স্ট্রুটা দিয়েছিলে?” রীতা ফোনে বলল বলাইকে।

বলাইও ফোনের এপার থেকে উত্তর দিল “হ্যাঁ দিদি, অনেক আগেই দিয়েছি। তবে এখনও অর্ধেকটা পড়ে আছে। মা না এলে খাবেন না উনি। জেদ ধরে বসে আছেন।“

ফোনটা কেটে দিল রীতা। সদ্য অষ্টআশি পেরোনো তুলসী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল “ যাবে মা একবার? না খেলে ওনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। একবার চলোনা মা।“

তুলসী দেবী গোবিন্দ তুলসীর চারাটাকে টবে পুঁতে সবে একটু জল দিচ্ছিলেন।এই বয়সেও ডাঁটো মহিলা হিসেবে পরিচিত তিনি এলাকায়। আর পুরো দেশে তার নাম একডাকে সবাই চেনে। তার “শান্তিনীড়” বৃদ্ধাশ্রমের জন্য সদ্য অনেকগুলো দেশীয় পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।রীতার বয়সও পঞ্চান্ন এর কোটায়। স্বামী মরেছে দু-বছর হলো। ছেলেদুটো বিদেশে থাকে। তাই রীতা মায়ের কাছে থেকে তার দেখাশোনা করেন। 

শুকিয়ে যাওয়া চামড়ার হাতটা তখনও ভিজে কাদায় ভর্তি। হাতটা বেসিনে ধুয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললেন “দেখ রীতা গোবিন্দ তুলসী। একবার গাছটাকে ছুঁয়ে হাতটাকে নাকের কাছে ধরে দেখ। গন্ধে মন ভরে যাবে। আর একটু বড় হলে সারা বাড়িটাকে নিজের সুগন্ধে ভরিয়ে দেবে এই তুলসী।“

রীতা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল “ কথা ঘুরিয়ো না মা ।কতদিন এভাবে পালিয়ে বেড়াবে? নিয়তি ওনাকে তোমার সামনে আবার এনে দাঁড় করিয়েছে।নিয়তির থেকে কেউ পালাতে পারেনা মা। তুমিই তো বলো। একবার চলোনা। “ 

তুলসী দেবী রীতার দিকে তাকিয়ে বলল “ নিয়তির হাতে আমাকে ফেলে সেদিন ও পালিয়ে গেছিল। আর আজ সেই নিয়তি আবার ওকে আমার সামনে নিয়ে এসেছে বুঝেছি। কিন্তু আমি কি করব? ও সেদিন যেটা আমার সাথে করেছিল নাকি তোর বাবা সেদিন যেটা আমার সাথে করেছিল? কোনটা সেটাই তো ভেবে পাচ্ছিনা মা।“

রীতা মায়ের আরও একটু কাছে এসে বলল “ হয়ত ওনার কাছে কোন উপায় ছিলনা মা।“

তুলসী দেবী মুচকি হেসে বলল “ উপায় থাকেনা মা, তৈরি করে নিতে হয়। যেমন তোর বাবা সেদিন করেছিল।“

রীতা মায়ের হাতটা ধরে বলল “ তুমি কি চাইবে কেবলমাত্র তোমাকে না দেখতে পাওয়ার জন্য একটা লোক এভাবে না খেয়ে মারা যাক?”

তুলসী দেবী আর কোন কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রীতা বুঝল ঠিক জায়গায় টোকাটা মেরেছে সে। এবার একটা পজিটিভ রিপ্লাই আসবেই।

দরজা খুলে শাড়ীর আচলটা কাঁধে নিয়ে তুলসী দেবী বলল “ চল, কোথায় যেতে হবে।“

রীতা প্রস্তুত ছিল আগে থেকেই তাই মাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল সে। একটা গভীর অভিমানে দগ্ধ মন নিয়ে তুলসি দেবী এগিয়ে চলল সেই অভিমানের স্তুপ টার দিকে।

(২)


মুখ ঘুড়িয়ে বসে নাসিম বাবু। বছর নব্বইয়ের কোটায় বয়স।পাশে একটা প্লাস্টিকের ঝুড়ি দিয়ে ঢাকা আধ-খাওয়া চিকেন স্ট্রু এর বাটি। অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে বসে আছেন তিনি আর মনে মনে ভাবছেন সেই সময় তার কি করার ছিল। সে যেটা করেছিল অন্য কেউ হলে তাই হয়ত করত। নাকি সে ভুল করেছিল? কিন্তু যদিও ভুল করেই থাকে তাও একসময়ের সম্পর্কের টানে কি একবার আসতে পারেনা সাহিদা? কেন? তার কি এমন ভুল? সে তো চেষ্টা করেছিল সাহিদাকে নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার কিন্তু……………

“ খাননি কেন খাবারটা?” রীতার কথায় ঘোর কেটে গেল নাসিম বাবুর।মুখটা সামনের দিকে করতেই দেখল তার সামনে রীতা দাঁড়িয়ে আর তার পিছনে কালো রঙের বোরখা পড়ে বছর পনেরোর সাহিদা। বোরখার ভেদ করে হালকা তার চোখগুলো দেখা যাচ্ছিল। বিনা কাজলেও সাহিদার চোখগুলো একেবারে কাজল কালো। একবার সেই চোখ যে দেখবে তার আর ভোলার অবকাশ নেই। 

“কি হল, উত্তর দিচ্ছেন না যে?” রীতার দ্বিতীয় প্রশ্নে আবার একটা ঘোর কাটল নাসিম বাবুর। এবার সে দেখল সেই পনেরো বছরের মেয়েটার চামড়া গুলো সব ঝুলে গেছে। মাথার চুলগুলো সব এক্কেবারে সাদা। পড়নে একটা সাদা থানের শাড়ী। গলায় একটা মোটা মতন রুপোর চেন। চোখগুলো তার আজও একি রকম কাজল-কালো। ওই যে, যে একবার দেখবে ভুলতে পারবে না। তাই হয়ত নাসিম বাবুও ভুলতে পারেনি।

ক্ষয়ে যাওয়া গলার স্বরে নাসিম বাবু বললেন “ও আসছিল না কেন? তাই আমি খাইনি।আর কাল থেকে না এলে খাবও না। এই বলে দিলুম।“

বেশ গম্ভীর একটা স্বরে রীতা বলল “ কেন? উনি কি আপনার পার্সোনাল প্রপার্টি নাকি? যে আপনি ডাকলেই ওনাকে আসতে হবে।“

নাসিম বাবুও বেশ গর্ব দেখিয়েই বললেন “ হ্যাঁ, তা বটে। আমার বিবি ও। আমার কথা মানবে না আবার? তাই দেখো কিরকম ছুটে এসেছে।“ বলেই একটাও দাঁত না থাকা মুখটা দিয়েই একটা হাসি হাসলেন এবং পাশে থাকা বাটিটা তুলে খেতে শুরু করলেন।

দুপুরের মাথার উপর থাকা সুর্যের মত চোখে আটকাচ্ছিল নাসিম বাবু তুলসী দেবীর।তাই ওনার দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে ছিলেন তুলসী দেবী। তবে তার তাপে নিজেকে বদ্ধ পাচ্ছিলেন তিনি। রীতার দিকে তাকিয়ে তুলসী দেবী বললেন “ দেখলি তো কেন আসছিলাম না? ও সারাটা জীবন একই থেকে গেল।ওর কথাবার্তা আজও সেই জানোয়ারদের মতই আছে।“

খাওয়াটা শেষ করে নাসিম বাবু আড় চোখে একবার তুলসী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল “ হ্যাঁ। আমাকে তো জানোয়ার মনে হবেই। অন্য মানুষ খুঁজে পেয়েছিলে কিনা।“

কিছু না বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল তুলসী দেবী। রীতা বলাইকে ডেকে বলল “ বলাই কাল থেকে যদি ঊনি না খেতে চায়, ওনাকে খেতে হবেনা। আমাদেরকে ফোন করার কোন দরকার নেই। এইসব লোকের থেকে আমার মা’কে আমি দূরেই রাখতে চাই।“

কর্কট একটা দৃষ্টি রীতার উপরেও এসে পড়ল নাসিম বাবুর চোখ থেকে। উপরের সাদা হয়ে যাওয়া ভ্রু গুলো কুঁকড়ে একপাশ ওপরে আর একপাশ নিচের দিকে নেমে গেল। তার চোখে-মুখে একটা অচেনা গর্ব দেখল রীতা। যে গর্বটা সে কোনদিনই তার বাবার মধ্যে দেখেনি।

লাঠিটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল নাসিম বাবু। এক-পা দু-পা করে রীতাকে পিছনে ফেলে বাইরের দিকে এগিয়ে গেল। রীতা তাকিয়ে দেখল এক পায়ে খোড়ানো মানুষটা কত সহজেই শুধুমাত্র একটা পেয়ারা কাঠের লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে চলে গেল তাকে পিছনে ফেলে। মনে মনে ভাবল একসময় প্রচুর শক্তিশালী ছিলেন ও কর্মঠও হবেন। সদ্য কিনে দেওয়া নতুন লুঙ্গি আর পাঞ্জাবিটা না পড়ে যে বগল ছেঁড়া জামা আর লুঙ্গিটা পড়ে এসেছিলেন এখানে সেটা পরেই রয়েছেন। বৃদ্ধাশ্রমের নিজস্ব লাঠীটাও না নিয়ে সেই পুরানো পেয়ারা ডালটা নিয়ে ঘুরছেন। এত আত্মসম্মান যদি তা মা’কে ছেড়ে পালিয়ে গেছিলেন কেন? প্রশ্নটা চেঁচিয়ে করতে গিয়েও থেমে গেল রীতা।

(৩)


অফিস ঘরে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন তুলসী দেবী।ধীর পায়ে এসে সেখানে ঢুকলেন নাসিম বাবু। তুলসী দেবীর সামনের চেয়ারে বসে পড়লেন থপ করে। পেয়ারা ডালটা হাত থেকে নীচে পড়ে গেল। সেটাকে তোলার কোনরকম চেষ্টাও তার মধ্যে না দেখে বিরক্তির সাথে তুলসী দেবী বললেন “ আবার এখানে কেন? খাওয়া তো হয়ে গেল। এবার কি আমার মাথাটা খাবে……?”

মুচকি হেসে নাসিম বাবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন “ নতুন সংসার, নতুন মানুষ পুরানো সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছে নাকি?”

নাসিম বাবুর দিকে তাকিয়ে তুলসি দেবী বলল “ মনে রাখার কোন কারণ খুঁজে পাইনি আমি। পুরানো সব কিছুই আমাকে কেবল কষ্ট দিয়েছে। তাই কষ্টগুলোকে আর মনে রাখিনি আমি। আর এই বয়সে এসে আর ওসব মনেও করতে চাইনা।“

তুলসী দেবীর তাকানোয় বুকের ভেতরটা একবার ছ্যাত করে উঠেছিল নাসিম বাবুর। যে চোখটাকে দেখে একদিন তার শরীর গরম হত আজ সেই চোখদুটোই তাকে কোন একটা প্রাচীন অপরাধ বোধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।বয়সের সাথে সাথে যে অভিমান রাগ ক্ষোগ গুলো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা সেগুলো আজ আবার তার যৌবন ফিরে পাচ্ছে তুলসী দেবীর চোখে। ঝোলা চামড়ার বুজে আসা চোখগুলো ধীরে ধীরে লাল হয়ে উঠল তার। আর সেই চোখ থেকে বেড়িয়ে আসা লেলিহান অভিমানের ক্ষোভের শিখা নাসিম বাবুকে মাথা নীচু করতে বাধ্য করল।

মুখটা ওপর দিকে তুলে স্মৃতির অমলিন সাগরে ডুব দিল দুজন। না চাইতেও সেই দিনটা তাদের সামনে ছায়াছবির আকারে ভেসে উঠতে লাগলো।

(৪)


দিনটা ভারত আর পাকিস্তানের বিভক্ত হওয়ার দিন। এক দেশের মানুষ তখন দুটি ভাগে বিভক্ত। হাতে হাত রেখে স্বাধীনতার লড়াই করা মানুষ গুলো তখন একে অপরকে নিজেদের ভাগ থেকে তাড়াতে মরিয়া। তখন নাসিমের বয়স হবে সতেরো। মাত্র মাস কয়েক আগেই পনের বছরের সাহিদাকে নিকাহ করে ঘরে এনেছে সে। সাহিদার কাজল-কালো চোখ নাসিমকে সব ভুলিয়ে একটা গোটা সংসারের দিকে টেনে আনছে। তবে নাসিম চিরকাল শক্ত। ভিতর থেকে মুচড়ে গেলেও কেউ ভনক টুকুও পাবেনা। 

সে দিন সবে একগাল ভাত থালায় নিয়ে বসেছে নাসিম। পাশে বুড়ি মা একটা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করছে আর দরজার এক কোনে দাঁড়িয়ে সাহিদা। এদিকে দেশ ভাগের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সাহিদার মন খারাপ। যে দেশে জন্মাল বড় হল নতুন সংসার পেল সেই দেশ ছেড়ে আবার নতুন দেশে গিয়ে নতুন করে সংসার বাঁধতে হবে। এ কেমন স্বাধীনতা। কেন একটা গোটা দেশ এপার-ওপারে ভাগ হয়ে গেল। এসব প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল তার। চকচকে দু-গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল মেয়েটার। 

খেতে খেতে নাসিম সাহিদার দিকে তাকিয়ে বেশ রাগের সাথেই বলে “ মরা কান্না কাঁদিস নি তো আর। এ দেশ আমারও।ভিটে মাটি ছেড়ে এত সহজে চলে যাব আমি? আরে আমরা ভাই-ভাই কারোর উস্কানিতে কিচ্ছু হবেনা। মরা কান্না টাকে বন্ধ কর এবার। এপার-ওপার যারা করেছে তারা বুঝবে। এ দেশের দু-ভাগ সম্ভব নয়। তা না হলে…………”

“নাসিম ভাই পালাও।পালাও। ওরা আসছে।“ পাশের বন্ধু আসলামের চেঁচানোয় চমকে উঠল নাসিম। মুখ ঘুরিয়ে দেখল আসলাম ছুটে ছুটে তাদের দিকে আসছে। ভাত মাখা হাতটা একটু ঝেড়েই উঠে দাঁড়িয়ে নাসিম আসলামকে বলল “ কি বলছিস ভাই?কোথায় পালাব? কেন পালাব?”

আসলাম হাঁপাতে হাঁপাতে বলল “ জানিনা, তবে এ দেশ আমাদের ছাড়তি হবে। এ দেশে আর আমাদের জায়গা নি গো ভাই। চলো তাড়াতাড়ি ওই দেখ সাঁকো পেইড়ে আসছে তারা। আমাদের সমেত ঘর জ্বালাবে বলে।আমাদের ওপারে যেতি হবে, এপার তাদের। আর ওপার থেকেও আমাদের মতই ওদেরও তাড়া খেতে হচ্ছে। এ কি হল ভাইজান।“

এক মূহুর্তে নাসিমের সব বিশ্বাস ভেঙ্গে চুর-চুর হয়ে গেল। বুড়ি মা জোড়ে জোরে কান্না জুড়ে দিল আর সাহিদা চৌকাঠে থপ করে বসে পড়ল।

এক কাপড়ে মা আর বউকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল নাসিম। সাথে শয়ে শয়ে সেপারের মানুষ। হ্যাঁ, এ দেশ তখন নাকি আর তাদের ছিলনা। যদিও সে দেশেরও একই হাল ছিল সে-সময়। সে দেশও ওপার থেকে এপারের মানুষ উচ্ছেদে ব্যস্ত। কেবল ভাগিয়ে বিদায় করার পালা চলছিল তখন এপার আর ওপার মিলিয়ে।কিছু মানুষের উস্কানি তখন একটা গোটা দেশের সাথে মানুষকেও ভাগ করেছিল।

রাত তখন কতটা গভীর হবে জানেনা নাসিম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে সে তার মা আর বঊকে নিয়ে। যে যেদিকে পেরেছে ছিটকে গেছে। সবার তখন একটাই লক্ষ্য নদীটা পেরিয়ে ওপারের মাটিতে পা রাখতেই হবে নয়ত সকাল হলেই মৃত্যু।

পাশের জনকে দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। তার উপর মশার অবিরাম কামড়। এদিকে গুলি খাওয়ার অথবা গলা কাটার ভয়। মাঝে মাঝেই নাসিম ধীরে ধীরে বলছে “ সাহিদা হাত ছাড়বি না, তাহলেই হারিয়ে যাবি। আর পাবনা। “ সাহিদার পায়ের তলায় কেটেকুটে তখন রক্তের দাগ এপারের ওই রাস্তার প্রতিটা ঘাসে নিজের চিহ্ন রেখে যাচ্ছে।

হঠাত একটা বিকট শব্দ। দূরে গুলি চালিয়েছে কেউ। নাসিম সাহিদাদের নিয়ে নীচে বসে পড়ল। একটা প্রকান্ড বটগাছ। তার নীচে হোগলা বনের মধ্যে বসেছে তারা। সাহিদার মুখ থেকে কোন কথা বেরোচ্ছে না। বুড়ি কেবল ওপর-ওয়ালা কে ডাকছে। নাসিমের চোখ সামনের দিকে। 

কিছুক্ষন চারিদিকে নিস্তব্ধতা। আবার একটা জোড়ে আওয়াজ। চেঁচিয়ে উঠল নাসিম “ আবার গুলি চলল। সাহিদা আম্মি পালাতে হবে। এক নিঃশ্বাসে দৌড় লাগাও। সাহিদা দৌড়া তুই। আমি আম্মিকে কাঁধে নিয়ে দৌড়াচ্ছি।“শুরু হল দৌড়। 

এক নিঃশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে কতদূর এল সাহিদা জানেনা। সে পথের আর শেষ আছে কিনা তাও জানেনা সে। হাপিয়ে মাটিতে পড়ে গেল সাহিদা। চোখটা মেলে দেখল চারিদিকে কেবল অন্ধকার। নাসিমের আর কোন সাড়া-শব্দ পেলনা সাহিদা। অস্ফুট স্বরে একবার ডেকে উঠল “নাসিম। আমাকে একা ফেলে যেওনা। যেওনা আমাকে ফেলে।“ আর কিছু মনে নেই সাহিদার। 

সকালে যখন জ্ঞান এল সাহিদা তখন রায় বাবুর বাড়ির ছোটছেলের ঘরের বিছানায়। তাকে ঘিরে জনা দশেক লোক ও মহিলা। জ্ঞান আসতেই পাশ থেকে একজন মহিলা বলল “ তা হ্যাঁ গা মেয়ে, কাদের বাড়ি এয়েছ? জাত কী?” আর একজন বলল “ নাম কি গা তোমার? বে হয়েচে? হাতে শাখা-পলা নেই কেন?”

সাহিদা কি বলবে কিছু ভেবে পেলনা। কি করে যে সেই জঙ্গল থেকে এখানে এল। সে নিজেই জানেনা। তারপর সব লোকেদের পাশ কাটিয়ে একজন এসে দাঁড়াল সাহিদার সামনে। লম্বা চওড়া একজন পুরুষ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। ডান কাধে একটা ঝোলা ব্যাগ। হাতে একটা সুটকেস। সাহিদার দিকে তাকিয়ে বলল “ এখন কেমন লাগছে তুলসী?”

সাহিদা কিছু না বুঝেই মাথা নেড়ে বলল “ভালো।“ সেই থেকে ওই বাড়িতে থাকা তার। আর সাহিদার তুলসী রুপে পরিবর্তন। তাকে ফেলে পালিয়েছিল নাসিম আর সেখান থেকে তাকে কুড়িয়ে এনেছিল বায় বাবুর ছোটছেলে অবিনাশ। তার পর পরিবারের অমতে বিয়ে অবিনাশের তুলসীর সাথে। কলকাতা চলে আসা। বৃদ্ধ বয়সে তাদের মত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য একটা বৃদ্ধাশ্রম খোলা। সেটাকে নিজের সবটুকু দিয়ে সাজানো। অবিনাশের চলে যাওয়া। সব ওই পোড়া দু-চোখ দেখেছে। প্রতিটা বসন্ত তুলসীকে অনেক কিছু দিয়েছে আবার অনেক নিয়েছে। দেওয়া-নেওয়া নিয়েই তো জীবন।

(৫)


সবকিছু মনে করে তুলসী দেবী যেন আরও জ্বলে উঠলেন। ভাঙ্গা কান্না ভেজা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন “ বলাই, এনাকে নিয়ে যা এখান থেকে। আমার ঘরে যেন আর কোনদিন না আসে এই লোকটা।“

নাসিম বাবু অনেকটা শান্ত স্বরে বললেন “ আমাকে তাড়ালে কি স্মৃতি গুলোও চলে যাবে?”

বাইরে দাঁড়িয়ে বলাইকে রুখে দিয়ে রীতা বলল “ যা,তোদের অন্য কাজ কর।আমি দেখছি।“ দরজার বাইরে থেকে সে সব শুনছিল।

আবার নাসিম বাবু বললেন “ আমি সেদিন কি অবস্থায় ছিলাম আম্মিকে নিয়ে একবার জানবে না?”

তুলসী দেবী বললেন “না, তুমি সেদিন ওই জঙ্গলে আমাকে একা ফেলে পালিয়েছিলে এর থেকে বড় সত্যি আমার কাছে আর কিছু নেই।“

নাসিম ঘাড়টাকে নাড়িয়ে বলল “ না। আমি পালাই নি। ধরা পড়েছিলাম সৈন্যদের হাতে। আর আম্মি রাস্তাতেই মরে গেছিল। তিনমাস পর আমার সব চেকাপ করে ওরা আমায় বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে তখন আর এপারে ফিরে আসার পরিস্থিতি ছিলনা। চেষ্টা করে এসেছিলাম একবার কিন্তু তোমাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে গিয়ে সংসার করেছিলাম। বউটা এই দু-বছর আগে মারা গেল। ছেলেদের তাড়া খেয়ে আবার নিজের দেশে ফিরে এলাম। ভাবলাম এক দেশে জন্মেছি আর এক দেশে মরব। তা হয়না। তাই মরতে এপারে এলাম। তবে মরতে আর পারলুম কই? গঙ্গায় ঝাঁপ দিলুম। বেঁচে গেলুম,পুলিশ তোমার এখানে দিয়ে গেল। হয়ত তোমার ভুল ভাঙ্গানোর জন্যই ওপরয়ালা আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিল।“

সবটা শুনে এক মুহুর্তে কেমন যেন বিশ্বাস করতে মন চাইল তুলসী দেবীর। নাসিমের দিকে তাকিয়ে বলল “ আমার সব থেকে বড় দোষ কি জানো? আমার মন বলছে যেন তুমি সত্যি কথা বলছ। কেন যে সবসময় তোমাকে এতটা বিশ্বাস করে ফেলে ও, বুঝতে পারিনা।“

নাসিম বাবু একটু মুচকি হেসে বলল “ বিশ্বাস করা না করাটা তোমার ব্যাপার। আমি বলে এবার খালাস হব। সব দেনা-পাওনা চুকিয়ে দিলুম। আর মনে কোন আক্ষেপ নেই সাহিদা। এবার আল্লাহ আমাকে নিয়ে নিক। এটাই চাই।“ 

নাসিম বাবু ঘর থেকে লাঠিটাতে ভর দিয়ে বেড়িয়ে গেল। তুলসী দেবী বলাইকে ডেকে বললেন “ ওনার খেয়াল রাখিস বলাই। একটা নতুন লাঠি দিস। আর কয়েকটা নতুন কাপড়।“ 

বলাই মাথা নেড়ে চলে গেল।এত বছরের জমানো অভিমানগুলো এক নিমেষে গলে জল হয়ে গেল। অভিমানের সূর্য ডুবে হয়ত আবার নতুন সূর্য উঠবে এই বয়সে।

(৬)


ভোরের পাখি ডাকার আগেই তুলসী দেবীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সারাটা রাত বুড়ির ঘুম হয়নি। নাসিম বাবু সারারাত পাশে বসে গল্প করেছে। একপাশে নাসিম আর একপাশে অবিনাশ। ঠিক এপার আর ওপারের মতই। মাঝখানে তুলসী দেবী। ভোরে আজানের শব্দে কেঁপে ওঠে তার বুকটা। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে হরি নাম জপ করতে থাকেন তিনি। 

কিছুক্ষন পর একটু মুচকি হেসে নিজের মনেই বলে ওঠেন “ আর যে নামেই ডাকি। তুমি এক এবং অদ্বিতীয়। এক রুপে জন্ম দিয়েছিলে আর এক রুপে মরন দেবে আমায়। এপার আর ওপারকে তুমি কোনদিন ভাগ করোনি। জানিনা মানুষ হঠাৎ কেন দুপারে ভাগ হয়ে গেল। আমি মাঝখানে আছি। একেবারে মাঝখানে। এপার আর ওপারের তফাৎ থেকে দূরে রেখো আমায়।“

দরজায় টোকা দিয়ে রীতা বলল “ মা,জেগে আছো?”

তুলসী দেবী মুখটা দরজার দিকে করে বলল “ এসো সুপ্রভাত।“

রীতা ঘরে ঢুকল, হাতে তার মোবাইল ফোন। চোখের কোনে চিকচিক করতে থাকা জল দেখে তুলসী দেবী বলল “ কাঁদছিস মা? আমি জানি সে আর নেই। এইত খানিকক্ষণ আগে এসেই ওপারে গেল। আমি এপারেই রয়ে গেলাম। আমি মাঝখানেই থাকব চিরকাল। এপার আর ওপার আমার বুঝে লাভ নেই। ওরা দুজনেই আমার অপেক্ষা করবে বলেছে। আমি বলেছি আমি আসব খুব শিগগির। তারপর বন্ধু হয়ে এপার আর ওপারকে জুড়ে রাখব।“

দূরে শহরের আকাশে হালকা নতুন সূর্যের রশ্মি উঁকি দিচ্ছে। এপার থেকেও যে সূর্যকে দেখা যাচ্ছে ওপার থেকেও সেই সূর্যই দৃশ্যমান।

rajukrmahato2014@gmail.com
কলকাতা




 


No comments:

Post a Comment