1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

মৃত্যুর পূর্বে

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

 মৃত্যুর পূর্বে
কস্তুরী চ্যাটার্জি পত্রনবীশ 
        আমি সৌন্দর্য মুর্মু। আজ আপনাদের আমার গল্প বলতে এসেছি। গল্প ঠিক নয়, আমার এই সাদামাটা জীবনেরকিছু কথা বলতে পারেন। আমার ডিভোর্সী বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে তাই জীবনের
উনিশটা বছর  বৈভব আর বিলাসিতাতেই আমি অভ্যস্ত ছিলাম। 
ছিলাম-বললাম এই কারনে, কিছুদিনের মধ্যেই আমি অতীত হয়ে যাব। 
আসল কথাই বলা হয়নি। আমি ক্যান্সার পেশেন্ট। আমার শরীর কেমোথেরাপি নিতে পারছেনা তাই কয়েকমাসেরমধ্যে মৃত্যু অনিবার্য। আমার বিত্তশালী বাবাকে আমি পূর্নবয়স্কের অধিকার আরোপ করে সবরকম চিকিৎসা প্রনালীআরোপ করা থেকে বিরত করেছি। তার মানে এই নয় যে আমার বাঁচার ইচ্ছা চলে গেছে। আমার বিলাসী জীবনযেকোনও টিন এজারের কাম্য। আমার হাতখরচা একজন নিম্ন মধ্যবিত্তের মাইনের কয়েকগুন।

আমার এই পৃথিবীতে থাকতে ভালো লাগেনা। আমি কয়েকটা বই পড়েছি। আফটার লাইফ অর্থাৎ মৃত্যু পরবর্তীজীবন নিয়ে ইতিবাচক বিশ্লেষন আছে বইগুলোতে। বেশ কয়েকটা বই পড়ার পর এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত যে মৃত্যুজীবনের শেষ অধ্যায় নয়।
তারপরেও মানুষ থাকে। বলা ভালো তার আত্মা থাকে অথবা সূক্ষ্মদেহ থাকে। 
প্রত্যেকবার কেমোথেরাপির পর আমার খুব কষ্ট হয়। বেশ কয়েকদিন শয্যা আশ্রয় করে পড়ে থাকি। তখন ঐ ‘সেইযে হলুদ পাখি’ কিংবা ‘যখন পড়বেনা মোর পায়ের চিহ্ন’ গানগুলো মনে পড়ে আর খুব হাসি পায়। জানালা দিয়েগাছ দেখতে আমার ভালো লাগেনা, দুপুরের নিস্তব্ধতা আমার মৃত্যুচেতনাকে একটুও প্রেরনা দেয়না। ফাঁকা বিশালবাড়িতে কাজের লোকের পায়ের শব্দট ভুতুড়ে লাগে আমার। আমি কেমিস্ট্রির ছাত্রী তাই কোনওদিনই ভেজাজীবনদর্শন কিংবা আলতো স্পর্শ আমার মনকে ছোঁয়না। 
একটি বিরলতম দিনের কয়েকঘন্টা আমার সদাব্যস্ত বাবা আমার কাছে বসেছিল। ঊনিশ বছরের জীবনে আমিকখনও মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করিনি। সেদিন করলাম
“বাবা, মায়ের কথা মনে পড়ে?”
বাবা একটুও সময় না নিয়ে উত্তর দিয়েছিল
“হ্যাঁ, পড়ে।”
“বাবা, তুমি মাকে এখনও ভালোবাস?”
এবারও বাবা সময় নিল না
“না।”
আমি বুঝেছিলাম দুটোই সত্যি। বাবার মধ্যে স্ত্রী নামের একটা যন্ত্রনা বেঁচে আছে, ভালোবাসা নয়।
আমি আমার বাবা মায়ের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাইনি কোনওদিন। এখন তো আরও বেশী একা লাগে।
আমি এই মৃত্যুশয্যা ছেড়ে উঠতে চাই। যদি কয়েকমাস বাঁচি তার মধ্যে কয়েকদিন মৃত্যুকে নিয়ে পড়ে থাকতে চাইনা।আমি পুরনো অ্যালবাম দেখি না। মায়ের কোলে আমার ফটোগুলোকে বাবার অজান্তেই চিরঘুমে পাঠিয়ে দিয়েছিঅনেকদিন।
আমি কোনও ক্যান্সার পেশেন্টের সারভাইভাল স্টোরি শুনি না। কারন আমি কয়েকমাসের জন্য নিজের শরীরেরসাথে সাথে মনকে কষ্ট দিতে চাইনা। 

এই তো কয়েকদিন আগে আমার এক পিসিঠাকুমাকে অপমান করে বিদায় করলাম। আমি কাঠখোট্টা, নীরস, মনেরদিক থেকে মরুভূমি চিরকালই। অবশ্য আমি এতটাই সুন্দরী যে লোকে আমার এই স্বভাবটাকে অহংকার মনে করে।এটা তাদের বোঝার ভুল তাই নিজেকে শোধরাইনি। সুন্দরী মেয়েরা ঠোঁটকাটা হয় সে তো সর্বজনবিদিত।

আসলে পিসিমা সেই সংখ্যাগুরু গুরুজনদের মধ্যে পড়ে যারা নিজেদের জীবনের সম্ভব মুহূর্তগুলোকে ভীষণরকমঅসম্ভবের মোড়কে পেশ করেন অপরজনের কাছে। আমার এই শারীরিক অবস্হায় নেশা করা উচিত নয় প্রায়ঘন্টাদুয়েক তিনি চা আর পান সহযোগে আমায় বোঝালেন। তবে কোনটাতে তিনি স্বচ্ছন্দ-উপদেশ না পান সেটাবোঝা গেল না।

শেষে বাধ্য হয়ে তার নিজের বাড়ির ঠিকানা বলতেই তিনি অপমানিত বোধ করে সেই ঠিকানাই ধরলেন।

                                 (২)

        বড্ড বেশী আমি আমি করছি তাই না? আসলে কি জানেন তো মৃত্যুর থেকে কয়েক মাসের দূরত্বে দাঁড়িয়ে মানুষবোধহয় এরকমই আচরন করে। কিন্তু যেজন্য আজ এই কয়েকটা শব্দ সাজাতে বসেছি তার কারন আমার মৃত্যুউদযাপন নয় কিংবা প্রত্যেক জন্মদিনের মতো এবছর আর বয়স বাড়বেনা জেনে আনন্দ উদযাপন নয়। আরআমার কথা না জানলে ঘটনার মর্মার্থ অনুভব করতে পারবেন না।
এর কারন এক দম্পতি। হ্যাঁ, একজোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। আমার ভাষাকে ইগনোর করুন। আমি রসকষহীন বিজ্ঞানেরছাত্রী তো। ভাষাজ্ঞান আমার সীমিত।
ঊষা সেন এবং সোম সেন প্রবাসী ভারতীয়। আমার বন্ধু অমলের সম্পর্কে দাদু ঠাকুমা। চাকুরীজীবন থেকেই সোমসেন মুম্বই অধিবাসী। পেশায় অধ্যাপক। ঊষা সম্পূর্ন সুস্হ হলেও তিরাশি বছর বয়সী সোম অ্যালঝাইমার্সেরশিকার। দীর্ঘ দশ বছরের এই অসুস্হতা সোমকে নিজের জীবন প্রায় ভুলিয়ে দিতে বসেছে। ভদ্রলোক চেনামানুষজনের সাথে সাথে নিজের প্রাত্যহিক কাজকর্মও বিস্মৃত হন। খাওয়ার পর মনে করতে পারেন না তিনিখেয়েছেন অথবা স্নান করার পর প্রায়ই আবার স্নান করতে যান। অনেকটা প্রেমে পড়ার মতো। মানুষ নিজেকে ভুলেযায় অনিচ্ছাকৃত।
আমার ধারনা ছিল অধ্যাপকের স্ত্রীকে জীবনযুদ্ধে
জর্জরিত এক পরাজিত সৈনিক হিসেবে দেখব।
অথচ প্রথম দর্শনে ঊষাকে দেখে আমার একটুও শোকগ্রস্ত কিংবা অস্বাভাবিক মনে হয়নি। তার সাথে দেখা হওয়ারআগে মনে হয়েছিল অধ্যাপকের অসুস্হতার শিকার ঊষা, যেমন আমার অসুস্হতার শিকার আমার বাবা।
হয়তো স্বভাবের এই মিলটাই আমাকে ঊষার দিকে আকৃষ্ট করেছিল।
“আপনার ভয় করে না?”
“আমাকে তুমি বল। না, ভয় করবে কেন?”
“চোখের সামনে এরকমভাবে একজন সবকিছু ভুলে যাচ্ছে, একদিন তোমাকেও ভুলে যাবে। কষ্ট হচ্ছে না সেটাভেবে?”
“ও যে শিশু হয়ে যাবে একদিন সেটা ভাবো। ওর মনে বিন্দুমাত্র চিন্তা, যন্ত্রনা থাকবেনা। এক একটা মুহূর্তে বাঁচবেসোম। মৃত্যুর আগে কজন এমন শিশু হতে পারে বল? মানুষ এই যন্ত্রনা থেকে বাঁচতে কি কি করে! ওকে ভগবানউপহার দিল।”
ঊষার এই বাহুল্যবর্জিত সত্যি কথাগুলো আমায় অবাক করল। এই প্রথম বুঝলাম মানুষকে আঘাত করার মতোসত্যি ছাড়াও নির্দোষ সত্যিও আছে।আর সেগুলো মানুষের মধ্যেই বাঁচে।
একটা ক্ষতিকর, অস্বাভাবিক অসুস্হতা যেটা অসুস্হ মানুষটার সাথে সাথে তার পাশে থাকা মানুষগুলোরজীবনীশক্তিও নিংড়ে ছিবড়ে করে দেয় সেটাকে ঊষা বেঁচে থাকার অংশই করে নিয়েছিল কারন সে জানত তারস্বামীর পরিস্হিতিটা অনিবার্য। পৃথিবীতে নাকি চন্দ্র-সূর্যই চিরসত্য! 
চিরসত্য কথাটা বোধহয় আপেক্ষিক।

ঊষার কাছে যেমন তার স্বামীর এইভাবে বেঁচে থাকাটা মৃত্যুর পূর্বে এবং পরে সবসময়ই চিরসত্য।
“তুমি নাকি কি অদ্ভূত নেশা কর?”
জ্ঞান রহিত সরাসরি এই প্রশ্নের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলামনা।
“আমি গাঁদাফুল খাই। বেশী খাই বলে সবাই ধরে নিয়েছে ওটা আমার নেশা।”
“অনেকদিনবাদে একদম নতুনধরনের নেশার কথা শুনলাম। গাঁদাফুল কেন খাও? 
খেতে ভালো লাগে নাকি তোমার জীবনের ট্র্যাজেডিটাকে ভুলে থাকার জন্য অদ্ভূত কিছু করার তাগিদ কাজ করে?”
“এত ভাবিনি। খাওয়ার সময় কিম্ভূত স্বাদটা গলা দিয়ে নামাতে বেশ কিছুক্ষন ব্যস্ত থাকি। ব্যস্ত থাকাটা দরকার।”
“তারজন্য সমাজসেবা করতে পার তো।”
“তার জন্য সেলিব্রিটিরা আছে।”
“আচ্ছা, তুমি কোনওদিন নিজের হাতে গাছ লাগিয়েছ?”
“না।”
এরপর ঊষা আর আমায় কিছু বলেনি। আমি তার কলকাতা আসার কারন জিজ্ঞাসা করাতে আমায় একটা অদ্ভূতগল্প শুনিয়েছিল। আজ নার্সিংহোমে বসে এই কথাগুলো লিখে যাচ্ছি। কাউকে জানানোর জন্য লিখছিনা, এইকথাগুলো আমি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারবনা তাই লিখছি। ঊষার এই বেঁচে থাকাটা যদি আমি আর কয়েকটামাসআগে দেখতে পেতাম তাহলে আমিও একটা শেষ চেষ্টা করতাম বেঁচে থাকার। কিন্তু এখন অনেক রাত। অন্ধকারনামতে আর দেরী নেই। 
যাই হোক। যে কথা বলছিলাম...
অধ্যাপক সেন অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত হওয়ার পরে ধীরে ধীরে সবই ভুলে যাচ্ছিলেন। মাঝেমাঝে অতীতের কোনওস্মৃতি মষ্তিষ্কে কড়া নাড়লেও তা সাময়িক। ঊষা এবং সোম দুজনেই প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন। সেখানেই তাদেরআলাপ, প্রেম এবং তৎপরবর্তীকালে পরিনয়।
সম্প্রতি সোম এই কথাগুলো সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়েছিলেন। তার মতে প্রেসিডেন্সি নামে কোনও কলেজ ভূভারতেনেই। ঊষা মিথ্যে কথা বলছেন।
অসুস্হ স্বামীর মন্তব্য কিংবা আচরন তাকে বিচলিত করতনা। 
 তবে এইটা তাকে বড় আঘাত করেছিল। যে স্হানে সদ্যযুবা সোমের সাথে তার দেখা হয়েছিল, সোম বলেন কিনাসেই স্হানটাই নেই। এ তো প্রকারান্তরে তাদের ভালোবাসাকে অস্বীকার করা। এর প্রত্যেকটা ইঁটে তাদের স্পর্শআছে। জীবনের তিনটে বছর বন্দী আছে।
তাই তিনি ঠিক করেছিলেন সোমকে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেবেন। দেখিয়ে দেবেন এইকলেজ ছিল, আছে এবং থাকবে। আর সেখানে এখনও দুই তরুন তরুনীর প্রেম বেঁচে আছে।
কি আশ্চর্য এই ভালোবাসা। শেষ হয়েও শেষ হতে চায়না। তাকে বাঁচিয়ে রাখাতেই আনন্দ। মৃত্যু তো শরীরের একটাঅবস্হা। মৃত্যুর আগে মরতে নেই। বিলাপ আর বসন্তের মধ্যে শেষেরটাই জীবনের কবিতা। 
আমি এখন বিলাসবহুল নার্সিংহোমের চারতলায় ঠান্ডাঘরে অন্তিমপর্বের অপেক্ষায় দিন গুনছি। অপেক্ষা দীর্ঘতরনয়। যাওয়ার আগে জানতে খুব ইচ্ছে করছে ঊষা কি সোমকে মনে করিয়ে দিতে পারল কিছু? প্রেসিডেন্সি কলেজেরসামনে দাঁড়িয়ে ঠিক কি দেখল সোম? 
“মামমাম।”
একটা কড়াহাতের স্পর্শ আমার ভাবনাটা ছিন্ন করল।
“বাবা, একটা কাজ করবে আমার জন্য?”
“বল না।”
“আমাদের বাড়ির ছাদে প্রচুর গাঁদা গাছ লাগাবে? প্রচুর মানে প্রচুর কিন্তু। অন্তত হাজারটা। আর সব হলুদ গাঁদা ।”
বাবার শূন্য দৃষ্টিটা কিছু একটা ভাববার রসদ পেল । 
হাজারটা গাঁদার স্হান সংকুলানের চিন্তা করছে বোধহয়। গাঁদাগুলোর কি হবে জানি না, আমি বাবার স্হানসংকুলান করে দিতে পারলাম ঐ হলুদ গাঁদাগুলোর মধ্যে।
ঊষার মতো বাবাকেও জীবনের একটা মানে পেতে হবে। বাঁচার রসদ খুঁজতে হবে। আমি নাহয় একটা দিয়ে গেলাম।
Kastury.patranabis@gmail.com
হাওড়া



No comments:

Post a Comment