1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

পালাবার পথ নেই

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

   পালাবার পথ নেই
পিনাকী চক্রবর্তী
‘জিতলে বাড়ি ফিরব না হলে মরেই  ফিরব’ 
- মেভা খোটে 
           ১ 
      গাড়ি বলবন্তপুরের মাটি ছুঁতেই, ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। শীতের আকাশে তাড়াতাড়িই  আলো  ফুরিয়ে   আসছে। চারপাশের পার্থিব যাবতীয়  আয়োজন অপার্থিব হয়ে উঠেছে!  গাড়ির ভিতর থেকে খুশবন্ত সিং   বাইরের   পরিবেশ  দেখছিল। গাড়ি চালাচ্ছে  হরকিশন পাসোয়ান, খুশবন্তের  ব্যাক্তিগত ড্রাইভার, ওঁরা  সরকারি বাংলোর  সামনে  এসে থামল। দুজনেই  গাড়ি  থেকে  নামল। 
 কালো রঙের  লোহার  লম্বা গেট দিয়ে ঢুকলে, সবুজ ঘাসে  মোড়া লন দেখা  যায়; চারপাশ   বড়  বড়    গাছে ঢেকে গিয়েছে। অনেকদিন বাদে  বড় সাহেবদের  পায়ের  ধুলো পড়বে, ঝাঁড়পোছ হচ্ছে। লন পেড়িয়ে তিনতলা বাংলোর  সামনেই খুশবন্তের গাড়ি  দাঁড়িয়ে। দুজন কনস্টেবল তাঁকে স্যালুট করল। খুশবন্ত  সিং পঁয়ত্রিশ বছরের  ঝকঝকে  তরুণ। টিকালো নাক,  পেশীবহুল শরীর, লম্বা, ফর্সা চেহারা। খুশবন্ত দিল্লি  পুলিশের এসিপি। তাঁর  চেহারা  দেখে  বলাই যায় - চাইলে বলিউডের  নায়ক  হতেই পারত। 
খুশবন্ত হাতে থাকা মোবাইল ফোনে  নম্বর  ডায়েল করল। ফোনের উল্টো দিক থেকে ভেসে আসছে নারী কণ্ঠ। মেয়েটি বলল 
- যাওয়ার আগে  অন্তত একবার ফোন  করতে  পারতে।
-একদম মাথায় ছিল না। স্যরি।
-এটাই  কমন কথা, তুমিও বললে  আমিও শুনলাম। এও জানি আবার স্যরি  বলতে  হবে।
-তুমি এখনি শুরু  করলে! 
খুশবন্ত  গাড়ির সামনে  আড়ালে এসে  বলল 
-আসবার  সময় তোমার  কথা  খুব  মনে  পড়ছিল।
উল্টো দিকের  নারী  কণ্ঠ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। বলল 
-গুছিয়ে  মন রাখবার কথা  বলতে  হবেনা, ডিউটির  সময় পৃথিবীর  কাউর  কথাই  মনে  থাকেনা তোমার।
খুশবন্ত কিছুক্ষণ  থেমে, পিছনের  দিকে  তাকিয়ে  দেখল, পাতলা  কালো রঙের বছর  আঠারোর  একটা ছেলে দাঁড়িয়ে  আছে। তাঁর দিকে  তাকিয়ে  খুশবন্ত বলল-‘ঘর  ঠিক  করও,  স্নানের  জল লাগাও’।  ছেলেটিকে  নির্দেশ  দিয়েই  আবার  ফোনে কথা  বলতে শুরু  করল। 
- উপর মহলের চাপ আছে নিধি। এই ব্যাপারটা নিয়ে সরকারের উপরমহলেও চাপে আছে। 

এখন চারপাশে আলো  নেই। সব আলো আচমকাই  উধাও! খুশবন্ত ফোন  রেখে দিয়ে, চারপাশের  বড়  বড়  গাছ , গাছের শাখা প্রশাখায় মিশে থাকা আত্মনিবেদিত শব্দদের  খুঁজছিল।  কিছুক্ষণ আগেও  পাখিদের  কিচিরমিচির কানে আসছিল। ঘড়িতে পাঁচটা তিরিশ, শীতের বিকেল, ভারী  ঠাণ্ডা  চেপে ধরছে। ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা  নামছে। রাস্তার ধকল এখনো খুশবন্তের চোখে  মেখে রয়েছে। ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। 

ঘড়িতে রাত দশটা, বাংলোর বাইরে ঝি ঝি পোকারা  ডাকছে। খুশবন্ত জানলার সামনে  দাঁড়িয়ে  আছে। বাইরে ঠাণ্ডা রাত  ক্রমশই নীরব  হয়ে  উঠছে। আকাশে তারারা জ্বলছে। রাতের ছায়ায় মিশে  গিয়েছে  বড় বড় গাছেরা। এখানে  খুব একটা আলোর  ব্যাবস্থা নেই। কিছুটা দূরে গেটের সামনে হাল্কা পাওয়ারের হলুদ বাল্ব জ্বলছে। কেয়ারটেকার বাথরুমের সামনে  নতুন বাল্ব ঝুলিয়েছে; খুশবন্ত  আলোর  তীব্রতা দেখে  বুঝতে পেরেছে।  

ঘরের বাইরে কেউ দাঁড়াল। খুশবন্ত  বলল- বাইরে  কে? 
-স্যার আমি পাপ্পু। আপনার রাতের খাবার এনেছি। 
 খুশবন্ত  বলল- আয়, ওই  টেবিলে  রাখ।
মাথায় টুপি, গায়ে চাঁদর জড়ানো।
- তোর নাম কী ?
খুশবন্ত চেয়ারে বসেই, হাতের  সিগারেটে টান  দিল।    
ছেলেটি  বলল- স্যার আমি  হরিমোহন। 
-এখানে  কতদিন আছিস?
-স্যার, আপনি আসবেন বলে আমাকে ডাকা হয়েছে। আমি রাঁধুনি নই। মহাজন কৃষকদের জমিতে ক্ষেত মজুরি করি।
-তাহলে এখানে রান্নার কাজ করছিস!
-গ্রামে এখন চাষের  কাজ বন্ধ আছে, কিছুতো  খেতে হবে। ঘরে  বাপটা অসুস্থ। 
ছেলেটা  এদিক ওদিক  তাকিয়ে, পা ভাঁজ করে  খুশবন্তের  পায়ের কাছে বসল। ফিসফিস করে  বলল-  বাবু, শুনেছি গুরুবন্তের  শরীর  ভালো নেই,অবস্থা খুব খারাপ। বয়স হয়েছে, এমনিতেই ভুখা পেটে  তাকত নেই। এবার  জল পর্যন্ত  খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।   
-তুই  গুরুবন্তকে  চিনিস?
হরিমোহন  বলল- তাঁকে  এই  তল্লাটে সবাই  জানে।
-তাই নাকি ?  
-হুযুর, সে  যে  বাঁজা  জমিতেও ফসল  ফলাতে পারে। আমরা তাঁকে বাবা গুরুবন্ত  বলি।
খুশবন্ত তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল- সেই বাবা এখন কেরামতি দেখাচ্ছে। সরকারের  নাকে  দড়ি  দিয়ে  ঘোরাচ্ছে। প্রশাসনের  ঘুম  কেড়ে  নিয়েছে। 
হরিমোহন  বলল- বাবা গুরুবন্ত সবসময় আমাদের  হয়েই  কথা  বলে। 
ছোট্ট  নিঃশ্বাস  ছেড়ে, খুশবন্ত বলল- হরি, আমি এখন  ঘুমাব, তুই ঘরের আলো নিভিয়ে, দরজা  বন্ধ   করে  চলে  যা। 
হরিমোহন খাবারের  দিকে  তাকিয়ে  বুঝতে পারল না, খুশবন্তের মেজাজের  গতিবিধি। স্থির চোখে  অপেক্ষা করে ঘরের  বাইরে বেরিয়ে গেল। 
বাইরে  তখন  দেহাতি ঠাণ্ডা, ঘন কুয়াশায়  বাল্বের আলো ঘোলাটে  হয়ে গিয়েছে। ঘরের  ভিতর অল্প পাওয়ারের টিউব নিভে গেল। খুশবন্ত রাতে হুইস্কি অনেকটাই নিয়েছে, বিছানায়   শুয়ে ঘুম আসতে বেগ পেতে হবেনা। 
  
          ২ 
     গাড়িতে  খুশবন্তের  সাথে  তিনজন   কনস্টেবল আছে। গাড়িটি যিনি চালাচ্ছেন তাঁর নাম জায়গিরদার। সেই  প্রথম  বলল- স্যার আমাদের  প্রায় কুড়ি  মিনিট  পায়ে  হাঁটতে  হবে। গাড়ি  যেখানে  থামবে সেখান থেকে  হাঁটা  পথ। 
খুশবন্ত  বলল- মানে? আমরা হেঁটে  যেতে  যাব কেন?
জায়গিরদার গাড়িটাকে  কিছুটা ধীর  করে  বলল- সেখানে যে  আল্লার বান্দা আছে। 
খুশবন্ত  বলল- তুমি কার কথা  বলছো ? 
ফোন  বেজে  উঠতেই, খুশবন্ত  ইশারায় গাড়ির  ভিতর  সবাইকে  চুপ থাকতে বলল। গাড়িটি থামতে, খুশবন্ত গাড়ি  থেকে  নেমে, ফোন  ধরল। উল্টো দিকে  ভারী কণ্ঠস্বরে যিনি বলছেন কথা, তিনি খুশবন্তের  সিনিয়ার। 
-গুড মর্নিং  স্যার। 
ভারী কণ্ঠে  বছর  পঞ্চাশের উপর  বয়সী একজন বললেন
-কোনও  অসুবিধা  হয়নিতো? 
কথাটা শুনেই  খুশবন্ত কিছুক্ষণ  থেমে  বলল- স্যার আজই  প্রথম  যাচ্ছি। আমি সব  খবর  নিয়ে  রেখেছি।
-ডিপার্টমেন্ট খবরে নয়, কাজে  বিশ্বাস  করে। 
কিছুক্ষণ  থেমে  খুশবন্ত  বলল- স্যার এর আগে  আরও  অনেক  বড়  বড়  কেসে  আমাকে পাঠিয়েছেন। আশা  করছি  হতাশ  করব না।
-এটা   রাজনৈতিক  আন্দোলন  নয়। ব্যাক্তিগত  আন্দোলনও  নয়।এটা  কৃষক আন্দোলন। ওরা দেশের অন্নদাতা। সেন্টিমেন্ট  বুঝতে না পারছো? একটু এদিক ওদিক হলে,  পাবলিক সরকারের বিপক্ষে  চলে  যাবে।  
-জানি স্যার।
খুশবন্ত  কিছুক্ষণ   চুপ  করে  বলল- যারা ফসল ফলাচ্ছে, যারা দেশের  মানুষের  মুখে  খাবার দিচ্ছে, আজ তাঁদের  পথে  নামতে  হয়েছে, দেশের  রাজনৈতিক  দলেরা নিজেদের  অন্যায় আবদারকে রাখতে  গুণ্ডামি করে। আর স্যার কৃষকদের  আন্দোলন  দমাতে আমাদেরও  অন্যায় করতে হবে।  
-হু হু, একটু  চেঞ্জ করে  বলও। , আমাদের  পদন্নতির জন্যই, সরকারের অন্যায় কাজে সাথ দিতে হয়। এটা নতুন ঘটনা নয়। 
উল্টো দিকের  ভারী  কণ্ঠস্বর  থেকে  প্রবল  হাসির শব্দ  ভেসে এলো। 
-স্যার আপনি হাসছেন!
-হ্যাঁ  হাসছি, আমার খুব  কাছের  হয়েও, এখনো এইসব  আবেগ নিয়ে  বসে আছো! এইসব চিন্তা কলেজ  স্টুডেন্টদের  জন্য  রেখে  দাও। একটু  ম্যাচিওর  হয়ে  ওঠো। সুনিধিকে তো  তোমাকেই সামলাতে  হবে। মনে  রেখো, তুমি  বলেন্দ্রর সিং এর একমাত্র  মেয়েকে  বিয়ে  করবে। ইউ আর মাই  সন  ইন  ল।
খুশবন্ত কথাগুলি  শুনে চুপ  করে  থাকল। উল্টো  দিক  থেকে ভেসে  এলো- এতো  বেশি  চিন্তা  করলে  জীবনে  একজায়গায়  থেমে  থাকতে  হবে। আমরা   সবাই এগিয়ে  যেতে  চাই। গো এহেড... 
ফোন  রেখে দিতেই , পিছনে  পাতলা  চেহারার   সদ্য  কাজে  যোগ  দেওয়া  ছেলেটি দাঁড়িয়ে  আছে । তাঁর  দিকে  তাকিয়ে  বলল-  তুমি  নতুন এসেছো?
ছেলেটি  লাজুক  মুখে  বলল-  হ্যাঁ স্যার, বাবা  এক্সিডেন্টে  মারা  যায়। একবছর  ওয়েটিং এ ছিলাম।
‘কি  নাম?’  কথাটা  বলেই, খুশবন্ত পকেট  থেকে সিগারেট  নিয়ে মুখে দিল। আগুন দিয়ে  সিগারেট জ্বালালো। 
ছেলেটি  বলল- আমার নাম রাকেশ  গুপ্তা। 
খুশবন্ত  বলল- তুমি তো  একজন সিভিল  ইঞ্জিনিয়ার। ভালো লাগবে  তোমার সাথে  কাজ  করে।
রাকেশ  কিছু  বলতে  যাবে। মুখ দেখে খুশবন্ত বলল- কিছু  বললে  বলতে  পারো।
খুশবন্তের পায়ে হাত দিয়ে রাকেশ বলল- আপনার সাথে  কাজ  করবার   সুযোগ  অনেক  বড় ব্যাপার। ট্রেনিং  করবার সময় ব্যাটেলিয়নে আপনার  কথা  অনেক শুনেছি। আপনি গুরু আমাদের। 
- এই বয়সে আমাকে  বাবা বানিও না। তুমি অবশ্য চ্যালা হতে চাইলে  অসুবিধা নেই। 
কথা শুনে হেসে ফেলল। রাকেশ উঠে দাঁড়াতেই, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল- আমার সাথে  থেকো, তোমার দরকার  হবে।
- স্যার জীবন দিয়ে  দেবো।  
খুশবন্ত চোখে   চোখ  রেখে  বলল-  এখন অন্তত কৃষক আন্দোলনের গতিবিধির খবরটা আমাকে  দিও।   

ওরা গাড়িতে  উঠতেই, গাড়ি   চলতে  শুরু করল। 

ওদের  গাড়ি  ক্ষেতের  মাঝখান দিয়ে আসছে। চারপাশে  গম ক্ষেত। সেইদিকে  তাকিয়ে  রাকেশ বলল- ‘জমি আবেগ। আমার বাবার দশবিঘা জমি ছিল। দিদি, বোন, দাদা, বাবার চিকিৎসায় এখন  দুবিঘায় এসেছে।’আকাশে রোদ বাড়ছে। গাড়িটির গন্তব্য  খুবই ধীরে, এর একটা কারন এটি  গ্রামের  এবড়ো খেবড়ো পথ। এখানে  ধরে না চালালেই, গাড়ি ক্ষেতে  ঢুকে  যেতে  পারে। ঘড়ির দিকে  তাকিয়ে খুশবন্ত  বলল-‘জায়গাটা কোথায়?’ জায়গিরদার বলল-‘দিল্লির  টিকরি বর্ডারে কৃষকরা আন্দোলন করছে। ওখানেই  দশদিন   ধরে বুড়ো গুরুবন্ত বাবা অনশন চালাচ্ছেন। দম আছে  বলতে হবে। এই বয়সেও...  
খুশবন্ত বলল- রাতে  যদি  ঝামেলা  করতে  হয়, তোমাদের  সবাইকে  পাবো তো? 
খুশবন্ত রাকেশের দিকে  তাকিয়ে  বলল- তুমি রাতে  থাকবে তো?
বাকীরা সম্মতি দিলেও, রাকেশ মৌন রয়েছে! খুশবন্ত এই  মৌনতা দেখে বিরক্তই হল। গাড়ি গ্রামের রাস্তা ছেড়ে পাকা সড়কে উঠল। গাড়ির গতি বাড়তে শুরু  করেছে। খুশবন্ত বলল –রাকেশ চুপ কেন? কিছু বলও? তুমি  নিজে  একজন কৃষক, তাই  হয়ত কৃষকদের প্রতি মন  নরম  হচ্ছে?
রাকেশ চুপ করে  আছে। খুশবন্ত তাঁর নীরবতাকে মেনে নিতে পাচ্ছেনা। পনেরো দিন ধরে টিকরির মতন ব্যস্ত সীমান্তে, কৃষকরা অহিংস আন্দোলন করছে! এই আন্দোলন যতটা  শান্ত, স্থির ততটাই  বিপদজনক,  বড়  বড়  রাজনৈতিক নেতাদের রাতের  ঘুম  উড়ে  গিয়েছে। নেতারা  রাতে  ঘুমাতে, ঘুমের ওষুধ আনতে   প্রশাসনকে পাঠিয়েছে। এইসময়ই সবচেয়ে  দামী  সময়। এই ক্ষণই  মাহেন্দ্রক্ষণ। আটকে থাকা  পদন্নতি  গুলি খুব দ্রুত  হতে থাকে। উঁচুতলার  কর্মীদের  ভাগ্যে  শিকে  ছিঁড়তে থাকে। 
খুশবন্ত যদি  নিজের  দায়িত্ব পালন  করতে  পারে, তাহলে বিয়ের আগেই পদন্নতির সরকারি সম্মতিপত্র  হাতে  নিয়ে  বিয়েতে  বসবে। এই সময়ই নিজের  জীবনকে  সাজিয়ে  নেওয়ার চূড়ান্ত  সময়। সে  নিজেও  খুব মানসিক চাপে আছে। তাঁর  উপর অনেক  বর্ষীয়ান পদাধিকারীরা ভরসা করছে। নিজেকে এই মুহূর্তে হিন্দি সিনেমার  নায়ক বলে  মনে হয়, তাঁর  গতিবিধির  উপর  পুরো চিত্রনাট্য, দর্শক, প্রযোজক  নির্ভর  করে  আছে। পকেট  থেকে সিগারেট নিয়ে  মুখে  দিয়ে, জ্বালিয়ে দিল, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে  বলল- ‘রাকেশ আবেগের জায়গা প্রশাসন নয়। আমরা উপরতলার  হুযুরের কর্মচারী। রাষ্ট্র, সরকার আর  রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যেই আমাদের জীবন আটকে আছে।  আমি বা  তুমি, আমরা  কেউই  সার্থক  বিদ্রোহী হতে পারব না। আমাদের কাজ কৃষকদের আন্দোলন নষ্ট করা। সেটা  করবার জন্যই এসেছি। আমার  নেতৃত্বে  যে  টিম  তৈরি হয়েছে, তাঁদের দায়িত্ব এই  আন্দোলনকে  যে কোন ভাবে  নষ্ট করা। আমাদের যে  কোন মূল্যে সফল হতে হবে।’  
গাড়িটা যেখানে  থামল, কিছুদূর  থেকেই  মানুষের মেলা  বসেছে! সবাই কৃষক নয়। অধিকাংশই  কৃষক, সাথে  অল্প বয়সী ছেলে  মেয়েদের দেখা  যাচ্ছে। সবাই  মাটিতে  বসে আছে। মুখে কৃষিবিল  বিরোধী  শ্লোগান  চলছে। খুশবন্ত দেখল, আন্দোলনকারীদের ব্যারিকেড  দিয়ে  আটকে  রাখা  হয়েছে। সামনে  মিডিয়ার লোকজন খবর  করছে। যারা  প্রতিবাদ  করছেন, বিক্ষোভ  দেখাচ্ছেন, তাঁদের  ভাষায় যে  উষ্ণতা  আছে, তা  চারপাশের আবহাওয়াকে উষ্ণ করে  তুলেছে। খুশবন্ত চারদিকে আন্দোলনের ছবি দেখে  স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জায়গিরদারকে  হাত নাড়িয়ে ইশারা করল। জায়গিরদার  স্যালুট জানিয়ে  বলল-স্যার, টিকটিকি পিছনের পথ  দিয়ে নিয়ে  যাবে। আমার লোক সে, আন্দোলনের সব খবর ওই দেয়। স্যার শুধু একটা  অনুরোধ আছে । 
খুশবন্ত বলল- কীসের? 
খুশবন্ত কথা গুলো বলতে  বলতে  মোবাইল দেখছে। 
জায়গিরদার মাথা নিচু করে  বলল- স্যার ওর ভাইকে একটা চাকরী দিতে হবে। হোমগার্ডের চাকরী। একটু  দেখবেন স্যার।
খুশবন্ত বলল- কাজ ঠিকঠাক  হলে, উপরতলার সুপারিশে  চাকরী হবে।  
কিছুক্ষণ বাদে, একজন শুকনো চেহারার বছর পঁয়তাল্লিশের  লোক, খুশবন্তের দিকে  তাকিয়ে বলল- সালাম সাব।  
জায়গিরদার লোকটিকে  বলল- রফিক, বড়া  সাব এসেছে।
খুশবন্ত চোখে  সানগ্লাস  পড়ে নিল। রফিকের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে জায়গিরকে  বলল- তাড়াতাড়ি চলো।

ওরা পিছনের রাস্তা দিয়ে অনশন  মঞ্চের কিছুটা  কাছে গিয়ে  দাঁড়িয়ে  আছে। রফিক  বলল- ওদের ডেকে আনছি। 
মাথার  উপরে  যে  বিস্তৃত  আকাশ, শীতের রোদ খেলা  করছে। তিনটে  মঞ্চ খাটিয়ে, চারদিক  ঢেকে  দেওয়া  হয়েছে। রফিকের  সাথে তিনজন  লোক  চলে  এল।মোটা মতন  একজন  লোক মধ্যবয়সের,  খুশবন্তের  দিকে  তাকিয়ে  বললেন- আপনারা সামনের দিক  থেকে  এলেন না  কেন? 
খুশবন্ত  বলল- আমরা  আপনাদের  সাথে  আগে  আলোচনায়  বসতে  চাইছি।
- অসুবিধা নেই, আমাদের  দাবী  মেনে  নিন। আমরাও  আন্দোলন থামিয়ে  দেবো।
-দাবীটা মানা যায়?
-দেখুন আমরা  যে  দাবী  করেছি, আমাদের  হকের কথা  ভেবেই। কৃষকদের এতো  অবুঝ ভাববেন না।
-প্রশাসনের  ভাবার  অধিকার  নেই। তাঁরা হুকুম  পালন  করে।
-কৃষকরা প্রশাসনের  মতন  হুকুম মানতে  বাধ্য  নয়।
-দেখুন, আমি  শুধু  বলব, আজ মিডিয়া, কাল বিরোধী  রাজনৈতিক দল, পরশু  আপনাদের  যারা পিছন  থেকে সাহায্য  করছে, তারা  থাকল। কিন্তু  তারপর? সরকার পক্ষের সাথে  আলোচনায় আসুন। 
-আমরা  শান্তিপূর্ণ  ভাবে আমাদের  কথা  সবাইকে  বলছি। সরকার  আমাদের  যন্ত্রণা  নিয়ে  আদৌ চিন্তিত  নয়। প্রতি বছর  কত কৃষক  আত্মহত্যা  করে, হিসেব আছে?
-এইসব  ব্যাপার  নিয়ে আলোচনা  করুন, আগে  অনশন  তুলে নিন। 
লোকটি কিছুক্ষণ থেমে  বললেন-  সরকার প্রথমে নিজেদের সিদ্ধান্ত  থেকে  নড়বে না বলে। যখন  জনমত তাঁদের  বিপক্ষে   যেতে  থাকে,  মিথ্যা  প্রতিশ্রুতি  দেয়। কৃষকদের  জীবনে  পরিবর্তন  আসেনা।
লোকটির  চোখে অসম্ভব উগ্রতা লক্ষ্য  করছে। খুশবন্তের  এই  দৃষ্টি  অসহ্য লাগছে। এদের  চোখে  ভয়  নেই  কেন!
লোকটি বললেন-  বাবা গুরুবন্ত বলেছেন, আপনাদের সাথে  মেহেমান নামাজি  করতে। এখন  দুপুর। আমরা আপনাদের  জন্য খুব সামান্য  খাবারের  ব্যবস্থা  করেছি। অসুস্থ  শরীরে  বাবা  আপনাদের  জন্য  নিজে দাঁড়িয়ে থালি  তৈরি  করেছেন।
রাকেশ হাত জোর করে বলল- বাবা  গুরুবন্ত! আমার প্রণাম  জানাবেন।
লোকটি  প্রতিনমস্কার জানালেন। কথার উত্তেজনায় খেয়াল  ছিল না, এখন  দেখল  পিছনের  চারজন  লোক  খাবার থালা, আর  ভাত, তরকারি, ডাল ভরা  বালতি  নিয়ে  এসেছেন। লোকটি  রাকেশের দিকে  তাকিয়ে  বললেন- সন্ধ্যার দিকে  এখানে  ভজন  হয়। বাবাকে দেখতে  আসতে  পারো। নাও এখন  খেয়ে  নাও। 
খুশবন্ত  বলল- আমাকে  যেতে  হবে, তোমরা  চাইলে  খেতে  পারো। 
রাকেশ  বলল- স্যার চলুন। 
গাড়িতে  যখন  ফিরছিল, খুশবন্তের  দুটো  চোখ  ভরা  অপমানের  লেলিহান  আগুনের  শিখা, দাউ দাউ  করে  জ্বলছে।  খুশবন্ত শান্ত  হয়ে  গিয়েছে। তাঁর চোখে  অতীতের  ছায়া ভাসছে, মানুষের  অতীত  রহস্যে  ঘেরা দ্বীপ। সেখান থেকে  মাঝে মধ্যেই অনেক  কিছুই  মানুষটির বর্তমান  জীবনকে  প্রভাবিত  করে। খুশবন্তের  অতীতের  কিছু  অমীমাংসিত অধ্যায়  রয়েছে। এই  অধ্যায়  সে রাতের  অন্ধকারে, লোহার বাক্সে থাকা  সেই ছেঁড়া  পরিচয়হীন  চিঠির  শরীরে  খুঁজতে  থাকে। খুশবন্ত চোখ  বন্ধ  করতেই , চিঠির ছায়া দেখছে! রাকেশর  উদ্দেশ্যে বলল- একজনের  পরিচয় জানতে  রাকেশ  তুমি কতদিন সময়  নেবে?
রাকেশ আচমকা  এই  কথায়  ঘাবড়ে গেল। ঢোক  গিলে  বলল- দুদিন  সময় দিন  স্যার। 
খুশবন্ত  বলল- বাবা গুরুবন্তের অতীত জানতে হবে। যদি কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড  থাকে। 
রাকেশ  বলল- স্যার সত্তর বছরের  বৃদ্ধ! 
খুশবন্ত- রাকেশ যা  বলছি  সেটা  করবে। 
৩ 
‘আপনি তাহলে আমাকে ফিরিয়ে দেবেন!’- খুশবন্ত কথা  গুলো বলতে  বলতে  নিজের অসহায়তা টের  পাচ্ছিলো! সামনে সত্তর  বছরের  বুড়ো মানুষ, খড়ের গাদার উপর বিছানা  তৈরি করে শুয়ে আছে।  কিছুক্ষণ আগেই খড়ের  বিছানার উপর চাঁদর  জড়িয়ে শুয়ে ছিল। এখন মাঝরাত। ঘড়িতে  বারোটা  দশ। এই  তাঁবুর  ভিতরে দুজন মানুষ  ছাড়াও  শুধু একটি  খড়ের  বিছানা আর   হ্যাজাকের লণ্ঠন  রয়েছে।  সামনে  আধশোয়া  মানুষটা টানা বারো দিন একফোঁটা জল মুখে তোলেনি। শরীরে  ক্লান্তি, চোখ দুটোর  দিকে  তাকিয়ে আছে। খুশবন্তের  মনে  হচ্ছে  চোখ দুটো এতোটা  গভীর, যার  তল মাপতে  সে ব্যার্থ। তাঁবুর বাইরে  শীতের  রাতের  জবুথবু  নীরবতা। দূরে  কুকুর  ডাকল। তাঁবুর  ভিতর  কিছুক্ষণ আগেই  কথা  হয়েছে। এখন দুজনেরই  মুখে  কথা  নেই। খুশবন্ত  বলল- আপনার কাছে   এসেছিলাম, ভেবেছি আপনি   মেনে  নেবেন।
বৃদ্ধ  লোকটি শুকনো  হেসে  বললেন- আমি  অনেক দূর  এগিয়ে  গিয়েছি। আমি আর ফিরতে  পারব না। তুমিও পারবে  না। আমরা  কেউই  হয়ত  পারিনি। 
খুশবন্ত চোয়াল  শক্ত  করে  বলল- আমি  পারব। আমি হারবো না। কিছুতেই  নয়।  
বৃদ্ধ লোকটি  বলল- আমাদের আদৌ  পালাবার  পথ আছে? 
খুশবন্ত  কণ্ঠস্বর   শক্ত  করে  বলল- আজ থেকে  চল্লিশ বছর আগে, তখনও  আপনি বাবা গুরুবন্ত  হননি।  এখন  আপনার সামনে-পিছনে  যে  বিশাল  অনুরাগীর  দল, যারা  আপনাকে  কৃষক  দরদী  ভাবছে, তাঁদের আবেগ থেমে যাবে, সেই কালো অতীত জানলে। 
গুরুবন্তের চোখ দুটো স্থির, শান্ত আর  প্রতীক্ষিত। এইরকম  কথা শুনবার  পর শুধু  মুচকি হাসলেন। খুশবন্ত বলল-  মনে  পড়ছে? গুরুদাসপুরের গ্রাম, সেখনাকার বিঘে বিঘে জমি, আর বিশ্বাস ঘাতকতা? আপনি  ভুলে গেলেও, আমরা  ভুলিনি। ইতিহাস আদৌ মুছেফেলা যায় না! আপনার  জীবনের  কালো  অধ্যায় হয়ত কেউ জানেনা, তবে  কেউ কেউ জানতেই  পারে।
গুরুবন্ত হাসল। হাসি দেখে  খুশবন্তের রাগ হয়ে যাচ্ছে, যেই মানুষটা  টানা  পনেরো দিন অনশনে রয়েছেন, যার জীবনের  শেষ   সম্বল  বলতে  মানুষের  ভরসা; সেই  ভরসাটুকু  ছিনিয়ে  নিতে এসেছে। সেই মানুষ এখনো এতো আত্মবিশ্বাসী! গুরুবন্ত বললেন-  ভুল মানুষই  করে। ভুলের মাশুল  বলে  আমরা  যেটা  বলে  থাকি, সেটা  আসলে  নিজের  কাছে নিজের স্বীকারোক্তি। আমি শেষ চল্লিশ বছর প্রতি নিয়ত স্বীকার করে   চলেছি আমার  ভুলের। এই যে  যন্ত্রণা, আমার নেওয়া সিদ্ধান্তের জন্য আমাকে কষ্ট  পেতে  হচ্ছে, ধরে নাও এতে  নিজের  অপারাধের  শাস্তি  ভোগ  করছি। 
খুশবন্ত  বলল- পালিয়ে  বেরাচ্ছেন নাতো? আপনার অপরাধের দলিল আমার কাছে আছে। 
গুরুবন্ত, বুকের কাছে  ময়লা কম্বল  টেনে  নিল। বলল- জীবনে  পালাবার পথ  নেই। যেই  পথ দিয়েই পালাবার চেষ্টা  করও, দেখবে   ঘুরে ফিরে  শুরু  থেকেই শুরু  হচ্ছে! 
খুশবন্ত  কালো জ্যাকেট, জিনস পড়েছে। তাঁবুর ভিতরের ঠাণ্ডা গা ছুঁয়ে আছে। দুটো  মুখ, দুই  প্রজন্মের   প্রতিভূ হয়ে মুখোমুখি। খুশবন্ত  বলল- আপনার  পরিচয় আমি শুরুতেই  পেয়েছি। ভেবেওছিলাম এই  গল্প এমন  ভাবে শেষ  করব না। আপনিই বাধ্য  করছেন।
গুরুবন্তের চোখের দুটো  পাতা ধীরে  ধীরে  নেমে  আসছে, সে বলল- জীবনের শেষ  পর্বে  আমার নিজের  কাছেই  কিছু  বলবার নেই। এখন লোকের চোখে নিজেকে  সাজাতে ভালো লাগেনা। খুশবন্ত এটা  জীবন,  এখানে আমরা কেউ পালাতে পারিনা। আমিতো পারিনি। আমার অপরাধটা সেইদিন অপরাধ ছিল, আজও আছে, আর যেইদিন এই পৃথিবীতে থাকব না, তখনও অপরাধই থাকবে। নিজের অপরাধকে আমি ভয়  সারাজীবন মেনে এসেছি। তুমি যাদের  পক্ষ থেকে এসেছো, তাঁদের জানিয়ে দিও, আমার মৃত্যুর পরেও আন্দোলন  চলবে।  
খুশবন্ত এই প্রচণ্ড শীতেও ঘামছে! দিল্লির ঠাণ্ডায়, তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে একটা চেয়ারের উপর  বসে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বলল- আপনি  অনশন  ত্যাগ করবেন না?
গুরুবন্ত চিত হয়ে শুয়ে  পড়লেন। শুয়ে   শুয়ে  বললেন-‘ তোমার বাবা, জশবন্ত  মারা  যাওয়ার দুমাস আগে আমাকে চিঠি পাঠায়। আমরা দুজন বাল্যকালের  বন্ধু। আমিও  তোমার  পিতাতুল্য। কাল সকালে  সেই চিঠি  তোমাকে  পাঠিয়ে  দেবো। আমার  মনে  হয়, চিঠিটা তোমার পড়া দরকার।’  
 চোয়াল চেপে রেখে, খুশবন্ত তাকিয়ে রইল। তাঁবুর বাইরে একজন লোক মাথা ঢুকিয়ে বললেন- উনি ঘুমিয়ে  পড়েছেন। গুরুবন্ত খুব নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। এতো নিরাপদ  ঘুম বহুদিন উপভোগ করেনি খুশবন্ত সিং।   
৪ 
  ঘড়িতে  বেলা দশটা। ফোন  বেজেই খুশবন্তের ঘুম  ভাঙল। আগের রাতে   দুটো চোখের পাতা এক করতে পারেনি, নিজেকে  খুব   দুর্বল  মনে  হচ্ছে। একজন   বিশ্বাসঘাতকের  ভাঁওতায়  কৃষকরা  আন্দোলন চালাচ্ছে! দেশের লোকজন, মিডিয়া ভালোই নাটককে  উৎসাহিত করে চলেছে। 
দরজার বাইরে শুনতে পেল, রাঁধুনি ছেলেটা  ডাকছে। খুশবন্ত বলল- ভিতরে এসো
ছেলেটা এসে  বলল- আপনার নামে  এই   চিঠিটা  একজন  দিয়ে  গিয়েছেন। বাবা গুরুবন্তের  শিষ্য।
খুশবন্ত চিঠিটা  নিয়ে  হাত  দেখিয়ে  ঈশারা  করল। ছেলেটি  ঘরের  বাইরে  চলে  গেল, খামটি  খুলে দেখল লম্বা   কাগজ বাবার বাঁকা হাতের লেখায়   ভরে গিয়েছে। 
 গুরুবন্তকে  লেখা, মৃত্যুর   দুমাস আগে বাবার চিঠি।  

প্রিয়,
গুরু।
তোর সামনে  কোন  মুখ  নিয়ে  দাঁড়াব? নিজেকে  খুব  অসহায়  মনে  হয়, ইদানীং  আরও  বেশি  করে  মনে  হচ্ছে। জীবনের আলোর তেজ  ক্রমশই  কমে আসছে। একদিন নিভে  যেতে  হবে। তুই  অনেক  বড় জায়গায় গিয়েছিস। অর্থ, প্রতিপত্তিতে তোর থেকে আমি এখনো এগিয়ে। তুই  কিন্তু আমাকে  হারিয়ে  দিয়েছিস অন্য জায়গায়। জানি, গুরু  থেকে   বাবা  গুরুবন্ত  হওয়ার পথ ছিল আত্মত্যাগের। আমি যেটা  চেয়েছি, তারই  প্রতিচ্ছায়া  হয়ে  রয়েছি। আমার চোখে  এখনো সেই সব দিন  জ্বলে  ওঠে। আমাদের   যৌবনের  দিন। তোর, আমার , আর  মনপ্রিতের  বন্ধুত্ব। আজ আমি আর মনপ্রিত স্বামী স্ত্রী, খুশবন্ত আমাদের একমাত্র ছেলে। বিশ্বাস  কর আমি মনপ্রিতের মনে  আমার  জন্য  একফোঁটাও  শ্রদ্ধা  দেখতে  পাইনি। ওঁর  মৃত্যুর এতবছর বাদেও, ওঁর  সবটুকুতো পেলাম না! যন্ত্রণা  হয় খুব। তোকে ভালবাসত, জীবনের শেষ  সময়  অব্দি ভালবেসেছে। আমাদের  গ্রামে  জোতদারদের  নিজের জমি দেওয়া হবেনা  বলে আমরা ঠিক  করলাম। সবাই  সিদ্ধান্তে  অনড়।  আমাদের  চোখে  তখন  রঙিন স্বপ্ন, মনপ্রিতের বাবা আমাদের অর্থের   লোভ দেখাল। আমি আমার  জমি বিক্রি করে দিলাম। তুইও দিলি।  গ্রামের  কৃষকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা  করেছি।  গ্রাম ছাড়তেই হবে। আমরা গ্রাম থেকে  শহরে পালিয়ে এলাম। সেইদিন থেকেই  তোর  মধ্যে এক   অদ্ভুত পরিবর্তন দেখলাম! মনপ্রিতের বাবার দেওয়া  মোটা  অঙ্কের টাকা নিয়ে সুখে সুন্দরি বউ, সন্তান নিয়ে জীবন কাটাতে পারতিস। সেই পথে গেলিনা। কঠিন পথ বেছে নিলি। আমাদের ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে  গেলি! আমরা তখনও নিঃসন্তান ছিলাম, দশ বছর বাদে  যখন ফিরলি, তোর কোলে  নবজাতক শিশু, মনপ্রিত কোলে  নিয়ে সন্তান যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে। খুশবন্ত যতটা আমাদের ছেলে  ঠিক ততটাই তোর ছেলে। ঝোঁপে ফেলে দেওয়া  বাচ্চা আজ সমাজে  প্রতিষ্ঠিত। তাঁর পিতা –মাতা  যে  জীবন তাঁকে দিতে চায়নি, তুই দিলি।    

আমি  সারাজীবন সুখ বেছে নিয়েছি। এই অপরাহ্ণ বেলায়  নিজের থেকে  নিজে  পালাতে পারলাম কই! দুজনেই পাপ  করেছিলাম। তুই  সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিস। আমি  পালিয়ে বেরাচ্ছি।  
আচ্ছা গুরুবন্ত যদি  কখনো আমাদের   খুশবন্ত  কোনও পাপের  মুখোমুখি  হয়, আমরা পারব তাঁকে   বাঁচাতে? এই চিঠি ওকে দিস। আমার  মৃত্যুর পর দিস...’  

খুশবন্ত কিছুক্ষণ চুপ  করে  থাকল। খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। বাবা গুরুবন্তের পা ধরতে  ইচ্ছা করছে। গুরুবন্ত তাঁকে  নিশ্চই আরেকবার ক্ষমা  করে  দেবে। এখনি  যেতে হবে, দেরী  করা  ঠিক  নয়। 
আচমকাই   বলেন্দ্রর সিং এর ফোন বেজে  উঠল।
-হ্যালো স্যার।
উত্তেজিত  গলায় বলেন্দ্রর বলছে- তোমার ভাগ্য সত্যিই   হিংসা করবার মতন। শুনেছি কাল রাতে গুরুবন্তের সাথে  কথা  বলতে গিয়েছিলে, আজ  সকালে  অবস্থা ভীষণ  সিরিয়াস হয়। কিছুক্ষণ আগেই  হৃদযন্ত্র  বিকল  হয়ে  মারা  গিয়েছে। তোমার প্রোমোশন  নিশ্চিত। যদিও   বিরোধীরা হই  হট্টগোল  করছে। মিডিয়া প্রেসার দিচ্ছে। তবে আমরাও  বলব সব দাবী দাওয়া মানতেই  আমরা আলোচনা চালাচ্ছিলাম। প্রাথমিক ঝামেলা মিটল...  

খুশবন্ত সিং বাকী কথা শুনতে পেল না। সে পালাবার পথ  খুঁজছিল। তাঁকে এখন পালাতে  হবে।  

সাতদিন বাদে  ভারতবর্ষের সবকটা সংবাদ মাধ্যমে  ‘ব্রেকিং নিউজ’ ভেসে উঠল-
‘এইমাত্র দিল্লি পুলিশের এসিপি  শ্রী খুশবন্ত  সিং চাকরী থেকে  পদত্যাগ করেলেন…’    

chakrabortypinaki50@gmail.com
কলকাতা



No comments:

Post a Comment