![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
পাত্র পাত্রী
দীপক মজুমদার
( শ্রুতিনাটক ‘পাত্র পাত্রী’। ঘটক,ম্যাট্রিমনি ইত্যাদি যাই হোক না কেন বিবাহ নামক রহস্যজনক এই বস্তুটি ঘটিয়ে ফেলা বা সেটাকে টিকিয়ে রাখা যুগ যুগ ধরে চলে এলেও খুব একটা সহজ সরল নয়। ইদানিং তাই আগে থেকেই সতর্ক হওয়ারও দরকার। এই বিষয় নিয়েই শ্রুতিনাটক। )
দুটি চরিত্র পাত্র : কানাই: ৩২-৩৩বছর ও পাত্রী : লাবনী: ২৯-৩০ বছর
কানাই এর ফোন বাজে।
কানাই।।হ্যালো কে বলছেন?
লাবনী।। কে বলছি মানে! আপনি আমার নম্বর সেভ করে রাখেননি?
কানাই।।নম্বরটা তো সেভ করা আছে, নামটা সেভ করা নেই।
লাবনী।। বাঃ বাঃ নামটাই নেই!
কানাই।।নেই, তার কারণ আপনি নামটা বলেননি।
লাবনী।। রিয়েলি! আমার নাম লাবনী গুহ।
কানাই।।এ বাবা কেমন যেন নোনতা নোনতা মনে হচ্ছে না….
লাবনী।। নোনতা! নামের আবার নোনতা মিষ্টি কি? আপনি তো কানাই ধর মানে কি কেষ্ট ঠাকুর নাকি কানা, আর কাউকে ধরে ওঠা বসা বা অন্য সব কাজ করেন?
কানাই।।না না তা কেন। কেষ্টও নই কানাও নই। আমার চশমা পর্যন্ত্য নেই।
লাবনী।। শুনে ভালো লাগলো। ম্যাট্রিমনিতে এটাও জানাতে পারতেন। যাক আগের দিন ফোনে তো বলাই ছিল আজ পাত্র দেখতে আসবো…..
কানাই।। হ্যাঁ হ্যাঁ কোনও অসুবিধে হবেনা। অপেক্ষা করছি। ফোন রাখছি।
(কানাই গুনগুন করে গাইছে….এসেছি গো এসেছি, মন দিতে এসেছি
যারে ভালো বেসেছি, মন দিতে এসেছি…..
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেল বাজিয়ে লাবনীর প্রবেশ।)
লাবনী।। আসতে পারি….আমিই লাবনী গুহ।
কানাই।। আসুন। আপনি একা, আর কেউ আসেননি?
লাবনী।। না এই প্রাইমারী রাউন্ডে অন্যের প্রেজেন্স ঠিক না। আমি একাই আসি।
কানাই।। খুব ভালো। আপনি বসুন আমি বড়দের ডেকে আনি।
লাবনী।। আপনাকে বললাম না এটা প্রাইমারী রাউন্ড। এই দেখা দেখিটা শুধু আমাদের মধ্যেই। এই রাউন্ডে যদি আপনি কোয়ালিফাই করেন তবে নেক্সট রাউন্ডে সঙ্গে অন্য কেউ থাকতে পারে।
কানাই।। অবশ্যই। তাহলে ডিসকাশন শুরু করা যেতে পারে।
লাবনী।। যেতেই পারে। আপনার সিভিতো আপনি আপলোড করেইছেন, তবে সেই সব ডকুমেন্টের হার্ড কপি…….
কানাই।। হ্যাঁ হ্যাঁ এই ফাইলেই সব রাখা আছে, দেখে নিন।
লাবনী।। দেখবো তো নিশ্চই। এখন বলুন আপনি কি করেন।
কানাই।। ঐযে, ফাইলেই আছে আমি একটা মার্চেন্ট কোম্পানিতে একজিকিউটিভ।
লাবনী।। ওতো গেল আপনার চাকরির কথা। এছাড়া বাড়িতে আর কি কি করেন।
কানাই।। বাড়িতে আর কি করবো! আফিস থেকে ফিরে ফ্রেস ট্রেস হয়ে টিভি দেখা বা মোবাইল ঘাঁটা…
লাবনী।। আর সকালে?
কানাই।। হেঁ হেঁ সকালে আর সময় কই, ঘুম থেকে ওঠে রেডি হয়ে কোনও রকমে ব্রেক ফাস্ট সেরেই…
লাবনী।। টু হুইলার না ফোর হুইলার?
কানাই।। এখনো নেই তবে খুব শিগ্গির গাড়ী মানে ফোর হুইলারই কিনে ফেলবো।
লাবনী।। সেকি আপনার এখনো কোন ভেহিকাল নেই।
কানাই।। না, বাবার একটা সাইকেল আছে, হারকিউলিস, আমারই বলতে পারেন এখন। ভেরী গুড কন্ডিশন। তবে আজ কাল বড় একটা চাপিনা।
লাবনী।। ও মাই গড,কোথায় ফোর হুইলারের কথা হচ্ছে আর আপনি এখনো সেই সাইকেলের গল্প শোনাচ্ছেন! হারকিউলিস। রান্না করতে পারেন?
কানাই।। পারি মানে জানি, কিন্তু প্রয়োজন হয়নি এখনও পর্য্যন্ত।
লাবনী।। কেন?
কানাই।। ওটাতো মা ঠাকুমা রাই করেন তাই প্রয়োজন হয়নি। তবে চা টা আমি মাঝে মাঝে করি।
লাবনী।। বেশ বললেন যাহোক, বিয়ের পর কি শুধু চা খেয়েই কাটাবেন, নাকি ধরেই নিয়েছেন ওটা একমাত্র মেয়েদেরই কাজ।
কানাই।। দরকার হলে দুজনকেই করতে হবে।
লাবনী।। দরকার হবে। তবে দুজন নয় ওটা বেশির ভাগ আপনাকেই করতে হতে পারে। আমার রান্না মশলায় আবার অ্যালার্জি। হাঁচি শুরু হলে থামতেই চায় না। বেড়াতে যাবেন তো?
কানাই।। হ্যাঁ হানিমুনে তো যেতেই হবে।
লাবনী।। না না হানিমুন তো একবার, আমি তার পরের কথা বলছি। কোথায় ভালো লাগে, পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল নাকি হিস্টোরিক্যাল প্লেস।
কানাই।। তেমন কিছু ভাবিনি।
লাবনী।। অ্যাঁ এটাও ভাবেন নি। আনরোম্যান্টিক।
কানাই।। আপনি কোনটা পছন্দ করেন?
লাবনী।। আমি পাত্র দেখতে এসেছি, তাই প্রশ্ন আমিই করবো। এক্স্ট্রা ইনকাম কিরকম হয়।
কানাই।। মানে, ঘুঁষ! ছিঃ ছিঃ এসব কি বলছেন।
লাবনী।। এ মা, তা কেন হবে। আমি বলতে চাইছি বোনাস বা এক্সগ্রেসিয়া। আপনি না একটা ইয়ে।
কানাই।। ইয়ে….সে আবার কি!
লাবনী।। থাক আর শুনতে হবেনা। তবে ঐ বোনাস বা এক্সগ্রেসিয়া যেটা এক্স্ট্রা ওটা শুধু শপিং এর জন্য বরাদ্দ করতে হবে।
কানাই।। আপনার বুঝি শপিং করতে খুব ভালো লাগে। আমারও, ভালোই হবে দুজনে একসঙ্গে মাঝে মাঝেই……
লাবনী।। না না তার দরকার নেই। ওই গাদা বোটের মতো সব সময় লেগে থাকা মোটেই পৌরুষত্ব নয়।
কানাই।। তাই হবে। তবে গাড়ি কেনার পর আমরা কিন্তু গাড়িতে করে ঘুরতে যাবো, সেটা আগে থেকেই বলে রাখলাম।
লাবনী।। সে দেখা যাবে, আগে গাড়িটাই আসুক মিঃ কানাই।
কানাই।। ওটাতো হবেই, লিখে রাখুন ম্যাডাম।
লাবনী।। লেখা পড়া সবই হবে। স্কচ, হুইস্কি নাকি জয় বাংলা! ক্লাবে না ঘরে।
কানাই।। না না মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাবে।
লাবনী।। ঠিকই আছে, ঘরে এসব মানায় না। বাড়িতে মেম্বার ক’জন।
কানাই।। আমরা মানে আপনি আমি ছাড়া আরও চারজন। মাঝে মধ্যে দু একজন গেস্ট এলে থেকে যায়। অতিথি নারায়ণ।
লাবনী।। তা বিয়ের পর এইসব নারায়ণ আর শালিগ্রাম এনাদের নির্বাসনের কি ব্যবস্থা হবে?
কানাই।। এখানে থাকলে বোধহয় খুব একটা অসুবিধে হবেনা।
লাবনী।। কি বলছেন! প্রিভিসি বলে একটা জিনিস আছে তো।
কানাই।। বেশ তো এ ব্যাপারে পরে ভাবা যাবে’খন। মাপসই একটা ফ্ল্যাট, তাতে মস্ত ড্রয়িং রুম সেখানে একটা ফ্রেমে বাঁধানো থাকবে ‘ছোট পরিবার সুখী পরিবার’, ঠিক আছে।
লাবনী।। যতরকম ওল্ড ফ্যাশন। ওসব আপনাকে ভাবতে হবে না, ইন্টিরিয়ার ডেকরেটর আছে। তারাই ভাববে।
কানাই।। আর কোন আইটেম নেই বোধহয়।
লাবনী।। নেই আবার। আপনি কি যে বলেন। শোনেননি মা মাসীমারা বলতেন লাখ কথা না হলে বিয়ে হয়না। এখনো কতো কথা বাকি।
কানাই।। অনেক বাকি? চাঁদ তারা আকাশ নদী এইসব নাকি ঐ প্রশ্নবাণ? তাহলে আপনার ফিসফ্রাই আর কাটলেট ঠান্ডা হয়ে যাবে ।
লাবনী।। এই তো খাচ্ছি। আপনি তো খাচ্ছেন না।
কানাই।। পরে খাবো, একটু গ্যাসের প্রবলেম আছে।
লাবনী।। এ ম্যা , আপনি কি পেট রোগা?
কানাই।। না না না এটা সাময়িক। আপনি বরং বলুন আর কি জানতে চান।
লাবনী।। গ্যাসের প্রবলেম টা নাহয় সাময়িক, এছাড়া জেনেরাল হেল্থ কণ্ডিশন ! ব্লাড প্রেশার?
কানাই।। নরম্যাল।
লাবনী।। ব্লাড সুগার?
কানাই।। মোর দ্যান নরম্যাল।
লাবনী।। ডাক্তার ঘোষকে দিয়ে একবার চেকআপ করিয়ে নেবেন। চিন্তা নেই,আমার পরিচিত।
কানাই।। যেমন চাইবেন। তাহলে আর কিছু বাকি নেইতো…
লাবনী।। বললামই তো এখনো অনেক বাকি।
কানাই।। সে যতোই বাকি থাকুক, আপনাকে কিন্তু আমার পছন্দ ।
লাবনী।। কি বলছেন ,এতো তাড়াতাড়ি! আগে পরস্পরকে জানা হোক।
কানাই।। আমার সম্বন্ধে আপনার কি মতামত?
লাবনী।। দুম করে মতামত দিতে আমার একটু অসুবিধে আছে। সমস্ত পয়েন্টগুলো নোট করে এগ্রিমেন্ট ড্র্যাফ্ট করে একটা স্ট্যাম্প পেপারে দুজনে সই করতে হবে তো।
কানাই।। একদম ঠিক বলেছেন। এটা আমারও কথা।
লাবনী।। আপনার ল’ইয়ার জানা আছে….. না থাক আমিই করিয়ে নেবো মুখার্জী উকিলকে দিয়ে।
কানাই।।আলবাৎ। বিয়ে বলে কথা, পরে কেউ বলার সুযোগ পাবেনা।
লাবনী।। আমি ক্যাজুয়েলি বলছিলাম।
কানাই।। আমি সিরিয়াস। ফাইনালি বিয়েটাকে টিকিয়ে রাখতে তো হবে। আপনাকে আর একটা ছোট্ট পয়েন্ট অ্যাড করতে হবে, এমজিপি…..
লাবনী।। মানে!
কানাই।। মিনিমাম গ্যারান্টী পিরিয়ড।
লাবনী।। মিনিমাম গ্যারান্টী!
কানাই।। হ্যাঁ আজকাল যা ট্রেন্ড বিয়ের পর ছমাস বছর যেতে না যেতেই মেয়েরা বিয়ে ভেঙ্গে কেটে পরছে। ওটা আপনি মিনিমাম পাঁচ বছর করে দেবেন। ভায়োলেট করলে তিরিশ লাখ টাকার একটা বন্ড- দুজনেরই সই থাকবে।
লাবনী।। এ মা আপনি বরপণ চাইছেন!
কানাই।। তা কেন হবে?
লাবনী।। নয়তো কি, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই বরপণই তো হলো ।
কানাই।। মোটেই নয়। আমরা কুলীন বনেদি বংশের মানুষ, ওসব একদম অপছন্দের। আর পাঁচ বছরের মধ্যে যদি বিয়ে ভেঙ্গে কেটে না পরেন তাহলে টাকার প্রশ্নই আসেনা। এতো সামান্য তিরিশ লাখ টাকার একটা বন্ড। বেশি মনে হলে ওটা কমিয়ে পঁচিশ ছাব্বিশ করাই যেতে পারে। ভেবে দেখুন।
লাবনী।। বন্ড! ওটা করতেই হবে?
কানাই।। হ্যাঁ ওটা করতেই হবে। বিবাহ হলো জন্ম জন্মান্তরের একটা পবিত্র বন্ধন। দুজনের বিবাহিত জীবন, যদিদং হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব, তার মূল্য নেই!
লাবনী।। সে কি আর আমি জানিনা । হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি।
কানাই।। জানেন! তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই। সেক্ষেত্রে পঁচিশ ছাব্বিশ কিছুই না।
লাবনী।। বেশ তাহলে আমার হাজব্যান্ডের সাথে ডিসকাশন করে তবেই ড্র্যাফ্টটা ফাইনাল করবো।
কানাই।। অ্যাঁ! হা-জ-ব্যা-ন্ড। মানে?
লাবনী।। হ্যাঁ। ঐ আর কি। এখনও ওইতো আমার গার্জেন। একটা ভাইটাল ডিসিশন, ওকে তো ইগনোর করতে পারিনা। আমি আসি।
কানাই।। এখনই যাবেন! এই রাউন্ডটা আমি পাশ করলাম তো! নেক্স্ট রাউন্ড তাহলে কবে হচ্ছে। একা, না কেউ থাকবে সঙ্গে।
লাবনী।। ফোন করে জানিয়ে দেবো……
কানাই।।হাঃ হাঃ হাঃ…
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment