প্রফেসার শঙ্কু এবং অন্যরকম বিকেলে
পিনাকী চক্রবর্তী
দুহাজার সালের বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি, নির্জন শনিবারে যাদবপুর হাইস্কুলের, একমাত্র গ্রন্থাগারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি৷ ঘড়ির কাঁটায় — একটা কুড়ি৷ বুক কাঁপছে৷ মাত্র দশ মিনিট৷ এর মধ্যেই দেখা করতে হবে, কথা বলতে হবে৷ আমি দরজা দিয়ে ঢুকলাম৷ অষ্টম শ্রেনীর ছাত্র, বি সেকসনে পড়ি, হাতের "লাইব্রেরি" কার্ড দেখেই ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-"বই শুধু দেখবার জন্য নয়, বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যও ইস্যু করা হয়৷ প্রতি শনিবার দেখি শুধু বই এসে দেখো, ইস্যু করোনা কেন?" সেই সব দিনে,পৃথিবীটা ইন্টারনেটের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলনা৷ সেই সব দিনে গল্পের বই আমাদের অন্য এক পৃথিবীর বাসিন্দা করে দিত৷ ততদিনে আমি চাঁদের পাহাড়, আবার যখের ধন, হীরা মানিক জ্বলে- পড়ে ফেলেছি৷ ঘনাদা সমগ্রও শেষ৷ টেনিদার চারমূর্তির অভিযানতো চোখ বন্ধ করলে দেখতে পারি৷ এইসব বই উপহার পাওয়া৷ প্রতি শনিবার গ্রন্থাগারে আসি এবং এমন কিছু খুঁজি যা আমাকে আলাদা অনুভূতি দেবে৷ আমি মাথা নেড়ে বললাম-"ঠিকাছে, আজ দেখি"৷ এটা একটা ডাঁহা মিথ্যা কথা৷ অথচ আমাকে বলতে হয়েছে, কেননা ম্যাডামের প্রতি আমার শ্রদ্ধা মেশানো ভয় কাজ করতো৷ আমি বললাম-"ভিতরে যাই?"
যেখানে ম্যাডাম বসে থাকেন, চেয়ারের পিছনে আরেকটা বড় ঘর রয়েছে৷ ভরা এবং থরে থরে সাজানো বই৷ আমার পৃথিবীটা আমার পৃথিবীই, সেখানে অন্য কেউ ঢুকে পড়ুক, আমার পছন্দ নয়৷ এই বই গুলোকে দেখে ভীষন আনন্দ বোধ হচ্ছে৷ সত্যি বলতে অঙ্কতে ভীষন কাঁচা, ইংরাজীতে অনেকটাই পিছিয়ে, বাকী বিষয় থেকে বাংলা ভাষায় লেখা গল্পই আমাকে বেশী আকর্ষন করতো৷ এখানে নিজের হেরে যাওয়ার যন্ত্রনা ছিলনা৷ আমি খেলা বা শারীরিক কসরতে পিছিয়ে আছি৷ এই অবস্থায় গল্প এবং গল্পের বইএর সাথে সময় কাটানো অন্যরকমের আত্মবিশ্বাস দিতো৷ সত্যি বলতে আমি যখনই নিজেকে পরাজিত ভাবতাম, তখনই গল্পের বই পড়তাম৷ কল্পনার জগতে চলে যেতাম৷ এই বই গুলো আমাকে কখনই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য নম্বর দিতে পারেনি, ভরপুর বেঁচে থাকবার আত্মবিশ্বাস দিয়েছে৷
বই গুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছি৷ সামনের বাঁদিকের কোনার দিকে সাদা মলাটের সরু বইয়ের দিকে চোখ চলে গেল৷ হাত দিয়ে নামিয়ে দেখলাম অন্যদের থেকে আলাদা, একজন লোকের দিনলিপি লেখা আছে৷ মানে স্থান, সময়, উল্লেখ করেছে, তারপর তলায় অভিজ্ঞতা লিখেছে! অদ্ভুত লাগছে৷ এরআগে এমন লেখা পড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি৷ প্রথম পাতা পড়তেই ভিতরে শিহরিত হলাম! বুঝলাম কিছুতো রয়েছে, যেটা রয়েছে সেটাকে উপভোগ করতে হবে৷ বইটি ইস্যু করবো৷
ম্যাডাম বইটি মধ্যে থাকা কার্ডে পরবর্তি জমা দেওয়ার তারিখ লিখলেন৷ বইটির মধ্যে থাকা কার্ডটি নিজের টেবিলের ড্রয়ারে রেখে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- এনার বই আগে পড়েছো?
আমার এই কথা শুনে বিরক্ত লাগছিল৷ কেননা প্রথম পাতা পড়েই, সেই অজানা অদ্ভুত আর রহস্যময় জগতের সম্বন্ধে জানবার ইচ্ছা এখন প্রবল৷ আমি তাও বললাম- না৷
ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- এই বইটা শেষ হলে ঠিক জেনে যাবে৷
এর আগে চারটি শনিবার, একান্ত গোপনে আমি গল্পের বইয়ের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম৷ ঘি রঙের প্রায় শীর্ণকায় বইয়ের পাতা, আবার সাদা পাতার মাঝে কালো মৃত পোকা ছাপ, ধূলো জমা ছাপ—আমাকে কখনই বিব্রত করেনি৷ আমি দুপাতার বুকে কালো কালিতে ছেপে থাকা যে বাক্য, তা অদ্ভুত এক কল্পনার মধ্যে নিয়ে যায়! চরিত্ররা চারপাশে ঘোরে, আমি কথা বলি৷ এই প্রক্রিয়া যেনও চলতেই থাকে৷
যে বইটি হাতে নিয়ে রয়েছি, তাঁর মলাট দেখেই আমি প্রায় দশমিনিট ভুলে ছিলাম! "প্রফেসার শঙ্কুর ডায়েরি" লেখকের নাম সত্যজিৎ রায়৷ মনে হচ্ছে যতক্ষণ না বইটির শেষ পাতা অব্দি গিলে ফেলতে পাচ্ছি, মানসিক শান্তি পাবোনা৷ দুপুরে যদি তিনটের মধ্যে বইটি পড়া শুরু করি, সন্ধ্যা ছটার মধ্যে লক্ষ্যভেদ হবেই৷ আজ মাঠে নাইবা গেলাম, দুহাজার সালের বেশ কিছুটা পরেও কিন্তু বিকালবেলা পাড়ার মাঠ গুলো ফুটবলের "গোল গোল" শব্দ শুনতে পাওয়া যেতো৷ শনিবারের বিকেলে নিজেকে ঘরে আটকে রাখা যথেষ্ট নির্দয়, নির্মম আয়োজন ছিল৷
বইটির প্রথম অভিজ্ঞতা হচ্ছে " ব্যোমযাত্রীর ডায়েরি"৷ আর প্রথম গল্পেই আমি ধরাশায়ী! পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে, এটা গল্পই নয়, লেখক নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন৷ মনে হচ্ছিলো প্রফেসার শঙ্কু কোথাও আছেন হয়তো৷ প্রফেসার ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর ডায়রি আমি পেয়েছিলাম আমাদের লাইব্রেরি থেকেই৷ আনন্দ পাবলিশার্সের অসংখ্য শঙ্কুর গল্প সংকলিত একটি বইয়ের প্রথম গল্প৷ আজ আমি গল্প বলতে পারি, মানে সেই ডায়রিটা আসলে গল্পই, সেইদিন আমার কাছে শঙ্কু বলে একজন অত্যাশ্চর্য বাঙালি বিজ্ঞানীর অভিজ্ঞতার সংকলন ছিল৷ আমি পড়তে পড়তে ভীষন গর্ববোধ করতাম৷ অজানাকে জানা আর অচেনাকে চেনার যে অভিযান, বাঙালি সেই অভিযান রোমাঞ্চ থেকে কিছুতেই নিজেকে নিরুপেক্ষ রাখতে পারেনি৷ রোমাঞ্চের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন নিয়েই আমি সব গল্প গুলো গিলছি৷
খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে, গভীর রাত অব্দি আমি রহস্যময় দ্বীপ, পিরামিড, পোর্টসেইডের ইম্পেরিয়াল হোটেল, নীলগিরির পাদদেশ ঘুরছি৷ সে অনেক অভিজ্ঞতা৷ সারারাত যেনও শঙ্কুকেই খুঁজে গেলাম!
রাত শেষ হয়ে ভোর হয়েছে৷ পাশের জানলা থেকে শান্ত আলো আমার বিছানায় ছড়িয়েছে৷ গ্রীষ্মকালীন ভোরে আলোর সাথে মিষ্টি হাওয়া থাকে৷ রাতে গরমের জন্য জানলা খুলেছিলাম, সেখান থেকেই আলো আসতে, মুখের উপর আলোকিত হল৷ আমার মাথাটা ডানদিকে, সেখানেই শঙ্কুর বইটি রাখা৷ মন খুব ভারী৷ কষ্টে ভারী৷ আমি বিশ্বাস করতে চাইছিনা, প্রফেসার শঙ্কু আসলে কাল্পনিক, মেনে নিতে মন চাইছেনা৷
মনে হচ্ছে কলেজস্টীট, গড়িয়াহাটার মোড় বা অন্য কোথাও সে আছে! আজ রবিবার৷ মন খারাপের বিকেল আসবে৷ আমি দুপুরে খেয়ে, প্রায় সাড়ে তিনটের সময় রা ঢাকুরিয়া লেকের দিকে যাচ্ছি৷
মনে হলও আজ রবিবার গড়িয়াহাটার ব্রীজের সামনেই, গোলপার্কের থেকে গড়িয়াহাটার দিকে যেতে হলে মাঝে,ফুটপাতে অসংখ্য পুরানো বইয়ের ভীড়! দোকান গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, চারপাশে অসংখ্য বইয়ের মধ্যে বেশ আনন্দ আছে৷ আমি এখানে এসেছি, এর পিছনে আদৌ কোন পরিকল্পনা ছিলনা৷ তাও চলে এলাম৷ বই কিনবার টাকা পকেটে নেই৷ প্রফেসার শঙ্কু এখানেও আসতে পারেন! আমার ভোঁ ভোঁ করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে৷ এমন সময় টের পেলাম, মাথার উপর মেঘ জমছে! ঘড়িতে বিকেল চারটে৷ রোদে ভরে থাকা বিকেলে আচমকাই মেঘ জড়ো হচ্ছে! আমি ঠিক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়েছি, সামনে সরু রাস্তা দিয়ে সামনের দিকে যতটা সম্ভব এগিয়ে যেতেই, ঝড় উঠল৷ বৈশাখমাসে কালবৈশাখী৷ আমি সামনের দিকে দৌঁড় লাগালাম৷
কতক্ষণ ছুঁটেছি জানা নেই, সামনে বড় বড় বাড়ি ছিল৷ এখন মনে হচ্ছে এটা সম্পূর্ণ আলাদাজগৎ! এটা মাঠ৷ আমার বাড়ির সামনে যে মাঠ থাকে তেমন৷ কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনা! আমি মনে হচ্ছে অন্য কোন জায়গায় চলে এসেছি৷ নিজের ভিতরে অস্থিরতার জন্ম নিচ্ছে৷ আমি মাঠেই বসে গেলাম৷
কতক্ষণ এমনভাবে কাটবে জানিনা! ঝিমুনি আসছে৷ আচমকাই মাঠের মাঝখানে ছোট্ট একটা জ্যোতি দেখতে পেলাম! ধীরে ধীরে জ্যোতি বলয়ের সৃষ্টি হচ্ছে৷ ওটা উজ্বল রঙের গোলক,ক্রমশই বড় হচ্ছে৷ এরপর দেখলাম গোলকটির ভিতর থেকে কিছু আলোর স্রোত গড়িয়ে নামছে৷ গোলকের মাঝখানটা ফেটে যেতেই, দেখলাম একজন বৃদ্ধ নেমে এলেন৷ আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন৷ আমি অবাকই হয়েছিলাম৷
- তুমি আমার খোঁজ করছিলে?
লোকটার কন্ঠস্বর ভারী৷ আমি বললাম
-মানে!
আমার কন্ঠে যতটা অবিশ্বাস মিশেছে, তার চেয়েও অনেক বেশী ছিল উদ্বেগ৷ অচেনা মানুষ৷ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
- এতো চিন্তার কোন কারন নেই৷ পৃথিবীতে যত চিন্তা, সব দিয়ে ভালো আবিষ্কার করো৷ পৃথিবী দেখবে অবাক কারখানা হয়ে উঠবে৷ তুমিতো এতো ভাবছো যে, তোমার সাথে দেখা হওয়ার মজা নষ্ট হয়ে যাবে৷
আমি বললাম- আপনি কে?
লোকটির মাথায় মস্ত বড় টাক, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, লম্বা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, দুটো চোখ দেখে মনে হচ্ছে উনি খুঁজছেন৷
-এই ঘাবড়িও না৷ আমার কাহিনীই তুমি পড়ছিলে৷
লোকটির কথা শুনে আমি সত্যি সত্যিই বিরক্ত বোধ করলাম৷ আমি বললাম
-আপনি কে?
-বাহ, যার ডায়রি পড়লে৷ ছুটে এলে, ওই বিদঘুটে জায়গায় ঘুরছিলে৷ সে যখন তোমার সামনে, তাকেই চিনতে পারলে না!
আমি অবাকই হলাম৷ লোকটা পাগল মনে হচ্ছে৷ এটাও ঠিক দৌঁড়টা মনে আছে, এখানে আসবারাআগের সবটা মনে নেই৷ অদ্ভুত লোকটা কোথা থেকে এলো৷
- পৃথিবীর খুব কাছেই মানে ২০৩ আলোকবর্ষ দূরে একটি গ্রহ আছে৷ আমি এখন সেখানেই থাকি৷ আমার নতুন গবেষনায় মত্ত৷
আমি ঢোক গিলে বললাম- কী নিয়ে গবেষনা৷ ওখান থেকে এখানে কেমন ভাবে এলেন!!
উনি হাতের একটা ঝোলা দেখিয়ে বললেন- আমার এই যন্ত্র হচ্ছে, মানুষের মনের কথা শুনে তাকে বাস্তবিক রূপ দেওয়া৷
আমি অবাক হয়ে বললাম- মানে?
লোকটি ঝোলা থেকে একটি আইপ্যাড বের করলেন৷ বললেন
-এটার ভিতরে কোনও ফাইল নেই৷ এসো আমরা দুজনেই একসাথে একটি সিনেমা দেখি৷ দুজনের চিন্তার স্রোত মিশলেই আমার এই ট্যাবে সিনেমা দেখা হবে৷
আমি এখনো বিশ্বাস করতে পাচ্ছিনা৷ এই মানুষটা!
লোকটি বললেন- হাতে বেশী সময় নেই৷ তোমার আমাকে যদি কিছু প্রশ্ন করবার থাকে করতে পারো৷ আমার পিছনে একটা কাঁচের মোটরসাইকেল দেখছো? যার চারপাশে নীল কাঁচ৷ মনে হবে তোমাদের ছোটখাটো অটো৷ ওটা আলোর থেকেও বেশী দ্রুত ছুটতে পারে৷ আলোর গতিবেগকে হারাতে পারলেই আমার গ্রহে যাওয়া যায়৷ পৃথিবীর বিজ্ঞান নয় এটা৷ আমার গ্রহের বিজ্ঞান৷
আমি অবাক হয়ে অদ্ভুত গাড়িটাকে দেখলাম!
বললাম- স্যার...
মাঝপথে, কথা থামিয়ে বললেন
-আমাকে স্যার বলবেনা৷ আমি সাধক মাত্র৷ বিজ্ঞানকে মানুষের উপকারে ব্যবহারের চেষ্টা করি৷ আমার আবিষ্কারের কথা তুমি ইতিমধ্যে পড়েই ফেলেছো৷
আমি বললাম- নতুন কিছু গবেষনা করছেন?
লোকটি থুতনি চুলকে বললেন- মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে কেন?
আমি বললাম- সে বলতে পারবোনা৷
লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে জোরে হাসলেন৷
-পৃথিবীর মানুষরা পরস্পরের ভাবনাকে সম্মান করতে চাইছে না৷
-মানে?
আমার কাছে ভাবনার সম্মান বিষয়টা বেশ প্যাঁচালো লাগল৷
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
-ধরো তুমি আর তোমার বন্ধু টিভিতে একটা অনুষ্ঠান দেখবে, এমন যদি হয় টিভিতে যে অনুষ্ঠানটি হবে তা তোমাদের দুজনার চিন্তা ভাবনার যৌথ ফলেই হবে৷৷
আমি বললাম- ঠিক বুঝতে পারলাম না৷
লোকটি হাসতে হাসতে বললেন— তোমার মস্তিস্কে নিশ্চই পুরানো কোন মেমরি আছে৷ আমার মস্তিস্কেও আছে৷ আমরা যদি মনে মনে তা ভাবি, সেখান থেকে চিন্তারস্রোতকে আমার ট্যাবের ডিভাইসটি গ্রহণ করে নেবে৷ সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য ট্যাবের মনিটরে ততক্ষণই সিনের পর সিন আসবে, যতক্ষণ আমরা মনে মনে সিনেমাটি একসাথেই ভাববো৷ ভাবনা মিললেই সিনেমা দেখতে পাবো৷ এমন ভাবেই চলতে থাকবে৷ এটা শুধুই মনঃসংযোগের খেলা নয়, এটা একসাথে ভাবনার খেলাও৷
আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম—আপনার নতুন নতুন অভিযান, গবেষনা নিয়েও এখন আর কোন লেখা পাইনা৷
লোকটি চুপ থেকে বললেন৷
— আমার অভিযান গুলোর কথা লিখবার মতন কেউ নেই৷ উনি যতদিন লিখেছেন, ততদিন তোমরা জেনেছো৷
আমি বললাম— আমি আপনার নতুন কথা জানতে চাইছি৷ সে সুযোগ হবেনা?
লোকটি হাসলেন— দেখো আমি আমার কথা গুলো বলি মাত্র,তোমাদের সত্যজিৎ বাবু সেই কাহিনী গুলোকে লিপিবদ্ধ করেছেন৷ সেই ভাষা সব লেখকদের আয়ত্তে নেই৷ থাকলে নিশ্চই আমিই গিয়ে বলতাম৷
—আচ্ছা, উনি এতোসব লেখা লিখেছেন, কখনো ক্লান্ত হতেন না?
—না৷ আমি প্রতিরাতে তাঁর পড়ার টেবিলের সামনে এসে বসে থাকতাম, তখন বাইরে রাত৷ সেই পাড়ার মোড়ের গ্যাস লাইট দেওয়া ল্যাম্প পোস্টটা জ্বলছে৷ তেমন রাতেই অদ্ভুত ভাবে লিখে যেতেন! পাশে শুধু আমি থাকতাম তা নয়, আরো অনেকেই থাকতেন৷ ফেলুদা, তাড়িনী বাবু, আর আরও অনেকে৷ রাতেই আসতেন৷
—যাদের নাম বললেন তাঁরা কে?
—এনারাই সত্যজিৎ বাবুর সৃষ্টি৷
—এনাদের সাথে কেমন ভাবে দেখা হবে?
—তুমি সবে শুরু করলে হাঁটা৷ অনেক পথ হাঁটবে৷ পথের বাঁকে বাঁকে দেখবে এনারাই দাঁড়িয়ে আছে৷ হাত নাড়বে৷
আমি থেমে গেলাম৷ আবার বলতে শুরু করলেন
—বাঙালির জীবনের সত্যজিৎ বাবুর চরিত্ররা মিশে থাকে৷ সব চরিত্ররাই তোমার আমার জীবনের চেনা মুখ৷ একটু ভারী হয়ে গেল না?
আমি সেইদিন কিছুই বুঝতে পারিনি৷ আজ বুঝি৷ উনি বললেন— সিনেমাও বানিয়েছেন৷
—সিনেমা!
—সিনেমা!
—হ্যাঁ৷৷
আমি বললাম— ওনার ছবি গুপি গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে দেখেছি৷
উনি হেসে বললেন— স্যারকে পৃথিবীর মানুষ সমীহ করে৷ পৃথিবীর বাইরেও যখন সভ্যতার নতুন ইতিহাস লেখা হবে, মানুষের জীবন সভ্যতার কথা লেখা হবে— সত্যজিৎ এর সৃষ্টি থাকব৷
খেয়াল হয়েছে, দেখলাম আমাদের পিছনের সূর্যটা ডুবে গেছে৷ আমরা দুজনেই মাঠের উপর বসেছি৷ বাঙালি হিসেবে আমার গর্ববোধ হচ্ছে৷ উনি বললেন— বাঙালি জীবনে সত্যজিৎ এর প্রেম, এডভেঞ্চার, স্বপ্ন, বিক্ষোভ সবসময় থাকবে৷ ওই দেখো, ওটা পশ্চিম দিক, কিছুক্ষণ আগে ওখানেই সূর্যটা ডুবে গিয়েছে৷
আমি বললাম— আপনার নানান দেশে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা আমরা পড়েছি৷ এখনো ঘুরতে যান?
উনি আমার কথা শুনে বললেন—আমি এখনো ঘুরি৷ এখন পৃথিবীর বাইরে, কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরে আমি ভেসে বেড়াই৷ নতুন নতুন গ্রহের নতুন নতুন সভ্যতা দেখি৷ সে বিচিত্র সব ঘটনা৷ সেখানেও প্রাণীদের মধ্যে তোমাদের মতনই উদ্দামতা, আনন্দ, যন্ত্রনা ঘিরে আছে৷
আমি ঢোক গিলে বললাম— এলিয়ান? ভিনগ্রহী? প্রফেসার তারা মানুষ না জীব৷
প্রফেসার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— ওরা মানুষ নয়, মানুষের থেকে আরো উন্নতশীল জীব৷
—মানুষের থেকেও উন্নত!!
আমার সেই বয়সে বিস্ময়ের বিস্ফোরন ঘটল৷ মানুষের থেকেও উন্নত প্রাণী আছে? যে মানুষ মোটা মোটা ইতিহাস বই লেখে, ভয়ংকর ভয়ংকর পাটিগনিতের অঙ্ক কষে, এতো সুন্দর সুন্দর বই লেখে, সেই মানুষের থেকেও আরো বুদ্ধিমান কেউ হতে পারে!!
মনের মধ্যেই এইসব প্রশ্ন গুলো জলে থাকা কই মাছের মতনই কিলবিল করছিল৷ আমি কিছু বলবার আগেই, প্রফেসার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন৷ বললেন
—হ্যাঁ গো, মানুষের থেকেও বুদ্ধিমান জীব এই বিশ্বে রয়েছে৷ এইযে তোমার মনের কথা আমি টের পেলাম, কেমন ভাবে পেলাম?
আমি ঘাবড়ে গেলাম!
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— তোমার মনের ভিতর যখনকথার তরঙ্গ ছুটছিল, আমার পকেটে থাকা একটি ছোট্ট যন্ত্র তা ধরে ফেলে, আমার মাথায় পাঠিয়ে দেয়৷ আমি বুঝতে পারি৷ এই বিজ্ঞান আমার ভিনগ্রহীদের থেকেই নেওয়া৷ মানুষতো এখানে শুধু রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে৷ সবসময় অন্য মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়ার ফন্দি আঁটে৷ সত্যিকারের বিজ্ঞান সাধনা এখন হয়না৷ হলেও অর্থের বিনিময়ে সব কিনে নেয়! যাই হোক আমার খুব ভালো লাগছে তোমরা এখনো ভাবছো৷ তোমরাই ভবিষ্যৎ৷ যতদিন স্বপ্ন দেখবে, ততদিন আমরা বেঁচে থাকবো৷ তুমি আমার সব অভিযান পড়েছো৷
আমি ঢোক গিলে বললাম— আজ্ঞে না পড়িনি৷ তবে এতটুকু জানি আপনাকে নিয়ে আর নতুন লেখা হয়না৷ আপনি কালজয়ী৷ আপনি সময় অতিক্রান্ত চরিত্র৷ আপনার কীর্তি আমাকে সাহস দেয়, বড় হয়ে কিছু করবার৷ বাংলা ভাষায় কথা বলতে পাচ্ছি, এটা আমার কাছে অহংকারের স্যার৷ আপনিও বাঙালি৷ ভারতীয় বাঙালি৷
প্রফেসারের মুখ ভারী৷ চোখ দুটো ছলছল করছে৷ বললেন— আমার অনেক অনেক নতুন অভিযান, আবিস্কারের গল্প আছে৷ বলতে চাইছি, কিন্তু জানি সেতো আর হবার নয়৷ উনি নেই, আমার কথা বলবার লোকও নেই৷ শুধু বলতে পারি এই পর্বের অভিযান গুলো আরো রোমহর্ষক, মজাদার আর সারারাত জাগিয়ে রাখবার মতনই৷ কিন্তু এই লেখা লিখবার জন্য সত্যজিৎ বাবুর কলমের মতন মুন্সিয়ানা দরকার৷
আমি দেখলাম৷ সূর্যের গায়ের আলো, পশ্চিমদিকেই মেখে রয়েছে৷ সূর্য ডুবছে, আলোর রেস থেকে গিয়েছে! বিকেলের কালবৈশাখী, মেঘ পেড়িয়ে আকাশ ভরা আলোর ধারা প্রবাহিত৷ আকাশের নীচে মাঠ৷
সূর্য ডুবে গেলও৷ আমরা দুজনে এখনো দুজনের মুখ দেখতে পাচ্ছি৷
No comments:
Post a Comment