1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Friday, May 1, 2020

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মভিটা ও লাহেড়ী বাবার আশ্রম

লেখকের নিজের তোলা ছবি
                                                                                ...তাপস বিশ্বাস


" মহত্ত্ব জিনিসটা কোথাও ঝাঁকে ঝাঁকে থাকে না। তাকে সন্ধান করে খুঁজে নিতে হয়।"                                                                                                          --শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

          যে পরিবেশের মধ্যে আমরা দিনরাতের প্রতিটা মুহূর্ত অতিবাহিত করি, বার বার দেখে তার আকর্ষণ কমে যায়। তখন নেমে আসে এক ঘেঁয়েমি জনিত ক্লান্তি। মন খুঁজে বেড়ায় বৈচিত্র। কারণ বৈচিত্রের মধ্যেই জীবনের আনন্দ। এই বৈচিত্র্যময় বিশ্বের মধ্যে যে কত বিচিত্র জায়গা, বিভিন্ন মানুষ ও নানারকম দৃশ্যাবলী আছে তার অন্ত নেই। বিরাট অজানা রাজ্যের কিছুটা না জানলে স্বার্থকতা থাকে না।

                  ভ্রমন মানুষকে কুপমন্ডুকতার ছত্রছায়া থেকে মুক্ত করে বিশাল পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যের মধ্যে ঠাই দেয়। মানুষের মনকে করে তোলে উদার। ক্ষুদ্র এ মানব জীবনকে দান করে গতিশীলতা। আর সেই ভ্রমণ যদি শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্য হয় তাহলেতো কোনো কথাই নেই। এই শিক্ষা মূলক ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষের অসম্পূর্ণ ও আবদ্ধ জ্ঞান বিকাশ লাভের সুযোগ পায়। শিক্ষা মূলক ভ্রমণ জীবনকে আনন্দময় ও পরিপূর্ণ করে তোলে। এই ভ্রমণের মাধ্যমে ইতিহাস, ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হওয়া যায় যা জ্ঞানের সীমাকে প্রসারিত করে। এই ভ্রমণের মাধ্যমে একদিকে যেমন বিনোদন হয় অন্যদিকে তেমনি  সুপ্ত প্রতিভা ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে।

               স্কুল জীবনে বাংলা পাঠ্য বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প ছিল 'মেজদিদি'। মূলত এই গল্পের মাধ্যমে আমার পরিচয় ঘটে বাংলা সাহিত্যের রাজা ধিরাজ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাথে। তারপর 'বড়দিদি', 'বিলাসী', 'বিশুর ছেলে', রামের সুমতি', 'পরিনীতা', 'বৈকুন্ঠের উকিল', 'মহেশ' গল্প গুলো যেমন পড়েছি। তেমনি 'শ্রীকান্ত', 'দত্তা', 'গৃহদাহ', 'পন্ডিত মশাই', 'দেবদাস', 'বিরাজ বৌ', 'চরিত্র হীন', 'পথের দাবী' ইত্যাদি উপন্যাস পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তার গল্প ও উপন্যাসে বিট্রিশ ভারতের বাঙালি সমাজ জীবনের চিত্রই বিশেষ ভাবে ফুটে উঠেছে। তার রচিত 'পল্লী সমাজ' তৎকালীন সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র। এই উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন তৎকালীন সমাজজীবনে নানা কুসংস্কার, তর্ক-বিতর্ক, দ্বন্দ-বিবাদ, আক্রমণ-প্রতিআক্রমনে পল্লী সমাজ কী ভাবে ক্ষুব্ধ ও জর্জরিত।


শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'চরিত্র হীন' উপন্যাসে বলেছেন,--" যাহা সত্য, তাকেই সকল সময় সকল অবস্থায় গ্রহণ করবার চেষ্টা করবে। তাতে বেদই মিথ্যা হোক, আর শাস্ত্রই মিথ্যা হয়ে যাক। সত্যের চেয়ে এরা বড় নয়, সত্যের তুলনায় এদের মূল্য নেই। জিদের বশে হোক ক্ষমতায় হোক, সুদীর্ঘ দিনের সংস্কার হোক, চোখ বুজে অসত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করায় কিছু মাত্র পৌরুষ নেই।" এই মহামূল্যবান উক্তির টানেই বেশ কিছু দিন ধরেই ভাবছিলাম, তার জন্ম স্থানে গিয়ে একবার কথা সাহিত্যিকের চরনে প্রনাম ঠেকিয়ে আসব। যাব যাব করে যাওয়া হচ্ছিল না । হঠাৎ করেই রবিবার ছুটির দিন সুতপাকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।

বাড়ি থেকে বেড়িয়ে টোটোয় করে করে কাঁচরাপাড়া স্টেশন। সেখান থেকে কল্যাণী লোকালে উঠে নৈহাটি স্টেশন পৌঁছালাম। নৈহাটি স্টেশন থেকে নৈহাটি ব্যান্ডেল লোকাল ট্রেনে পৌঁছালাম ব্যান্ডেল স্টেশন। স্টেশন থেকে শরৎচন্দ্রের জন্মস্থান অটোতে পনের মিনিটের পথ। শীতকালে দুপুরের আগেই অটোওয়ালা নামিয়ে দিল দেবানন্দপুর মোড়ে। সবুজ বনানীতে ঘিরে থাকা শান্ত পরিবেশ। সেখান থেকে একজন কে জিজ্ঞেস করলাম  কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের জন্মভিটেটা কোন দিকে? ভদ্রলোক দেখিয়ে দিলেন। ঘুঘুর ডাক শুনতে শুনতে এগোলাম জন্ম ভিটের দিকে।


           দেবানন্দ পুর জায়গাটা অতি প্রাচীন। বাংলার রাজধানী সপ্ত গ্রামের অন্তর্গত যে সাতটি মৌজা ছিল দেবানন্দ পুর তার মধ্যে অন্যতম। যদিও গ্রামটির আয়তন ছোট। কিন্তু নবাবী আমলে এটি ছিল একটি সমৃদ্ধ শালী এলাকা। দেবানন্দ পুরে কথা শিল্পী নামাঙ্কিত একটি পাঠাগার রয়েছে। প্রবেশ পথে কথা সাহিত্যিকের মর্মর মূর্তি। গ্রন্থাগারটি একটি দোতালা বাড়ি। সামনে প্রশস্ত লন। লন পেরিয়েই বারান্দা। বারান্দার ধারে তিনটি ঘর। একটি ঘরে কথা সাহিত্যিকের জীবনের ঘটনাবলী মাটির মডেলে প্রদর্শিত হচ্ছে। পাশের ঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে কথা সাহিত্যিকের চিঠিপত্র, লাঠি, পান্ডুলিপি, কলম, বসার চেয়ার, পুস্তক প্রভৃতি ব্যবহৃত দ্রব্য। এই সংগ্রহ শালায় শরৎচন্দ্রের জীবনী ও সাহিত্য বিষয়ক পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, অনুবাদ গ্রন্থ, আলোকচিত্র, অনুবাদিত ও চলচ্চিত্রায়িত শরৎ কাহিনী সহ অন্যান্য বিবরন রক্ষিত আছে।

     দেবানন্দপুরে কেটেছে কথা সাহিত্যিকের কৈশর। এখানে তার জীবন স্মৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু স্থান এখন পর্যটকদের দ্রষ্টব্য। যেমন-
শরৎচন্দ্রের জন্ম ভিটা:
১২৮৩ সনের ৩১শে ভাদ্র, ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দখিনদ্বারীতে একটি মাটির ঘরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। শরৎচন্দ্রের ৬ বছর বয়সে পিতা মতিলাল ডিহিরিতে চাকরী করার অর্থে ও মাতুল বংশের দান করা জমিতে এই দুই কামরার পাকা বাড়ী ও বৈঠকখানা গৃহ নির্মাণ করেন। ১৮৯৩ সালে দেবানন্দপুর ত্যাগ করে পিতা মাতার সঙ্গে স্থায়ীভাবে ভাগলপুরে চলে যাওয়ায় ৩ বছরের মধ্যে ভবনটি নিলামে মাত্র ২২৫ টাকায় বিক্রি হয়ে যায়। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি পৈতিক ভিটা উদ্ধার করতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে রাজ্য সরকার ভবনটি অধিগ্রহণ করেন।
প্যারী পন্ডিতের পাঠশালা:
শরৎচন্দ্রের ঠাকুমা ৫ বছর বয়সে প্রতিবেশী প্যারী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাঠশালায় ভর্তি করে দেয়। এই পাঠশালায় তাঁর বাল্যকালের দৌরাত্ম্যের বিবরণ 'শ্রীকান্ত' 'দেবদাস' উপন্যাসে বর্নিত আছে। পন্ডিত মশাইয়ের পুত্র কাশীনাথ শরৎচন্দ্রের বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন।
গড়ের জঙ্গল:
বাড়ীর কাছে আম, জাম, কাঁঠাল প্রভৃতি ফলের গাছ ও বেত বৈচী শেয়া ফুলের আগাছায় ভর্তি একদা দু:ভেদ্য এই জঙ্গলে চুরি করা, ফল সংরক্ষণ, নেশা করা এবং পিতামাতার অসমাপ্ত রচনা পাঠ করা প্রভৃতি নিষিদ্ধ কাজের এলাকা ছিল।

সরস্বতী নদী:
শরৎচন্দ্র তাঁর নায়ক-নায়িকাদের প্রিয় সঙ্গী সরস্বতী নদী। 'দত্তা' উপন্যাসের নায়ক নরেন ও নায়িকার বিজয়ার সম্পর্ক নিকটতর হয়েছিল সরস্বতী নদীর তীরে।
মোহন মুন্সীর দালান:
একদা এই স্থানে অবস্থিত মোহন মুন্সীর দালানে সিদ্ধেশ্বর ভট্টাচার্য্যর বাংলা স্কুলে শরৎচন্দ্র তিনবছর কাল চোখের জলে বোধদয় ও আর আদ্যপাঠ সমাপ্ত করেন। শরৎচন্দ্র তাঁর মৃত্যুর ২বছর আগে ১৯৩৬ সালে শেষ বারের মতো দেবানন্দপুরে এসে বাল্যবন্ধু প্রিয়লাল দাসের সঙ্গে গ্রামে ঘোরার সময় এই মোহন মুন্সীর দালানে তাঁর ছাত্রাবস্থায় বাসাবাঁধা পায়রা গুলির ব্যবস্থা করেন।
শরৎচন্দ্র শিক্ষা নিকেতন:
১৯৬৪ সালে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দেবান্দপুর জুনিয়র হাইস্কুল ১৯৭০ সালে গিরীন্দ্রকুমার হাইস্কুলে রুপান্তরিত হয়ে ১৯৭২ সালে গিরীন্দ্র ভবনে দেবানন্দপুর শরৎচন্দ্র নিকেতন নামে শরৎচন্দ্র স্মৃতিতে উৎসর্গিত হয়।

ব্রোঞ্জ মূর্তি ও সেমিনার হল:
শিল্পী কর্তিক পাল নির্মিত শরৎচন্দ্রের পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জ মূর্তি নিরাবরন করেন পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী ও শরৎচন্দ্র সেমিনার হলের দ্বারোঘাটন করেন উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রী শম্ভু ঘোষ ১৯৪২ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর।
রায়গুনাকর ভরতচন্দ্র স্মৃতি স্তম্ভ:
ভারতচন্দ্র ফরাসী ভাষায় শিক্ষার প্রয়োজনে ১৫ থেকে ২০ বছর বয়সকালে দেবানন্দপুর গ্রামের জমিদার দত্তমুন্সী পরিবারে বসবাসের সময় ১১৩৪সনে প্রথম বাংলা কবিতা রচনা করেন। বর্তমান ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের নিকট হূগলি জেলা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত এই স্মৃতি আবরন উন্মোচন করেন ১৯৩৯ সালে ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
শরৎচন্দ্র স্মৃতি মন্দির:
১৯৩৯ সালে শরৎচন্দ্রের প্রথম বর্ষ স্মৃতি সভায় দেবানন্দপুরের সুসন্তান দ্বিজেন্দ্রনাথ দত্তমুন্সীর চেষ্টায় শরৎচন্দ্র স্মৃতি সমিতি গঠিত হয়। সেই সমিতি 'শরৎচন্দ্র স্মৃতি মন্দির' নির্মাণ কল্পে অর্থ সাহায্যের জন্য দেশবাসীর উদ্দেশ্য আবেদন পত্র প্রচার করেন। সেই আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করেন সুভাষচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বিধানচন্দ্র রায়, কাজী নজরুল ইসলাম সহ সেকালের বহু বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানবৃন্দ। দেবানন্দপুরের জমিদার দত্তমুন্সী পরিবারের দান করা জমিতে ১৯৫৯ সালের ২৬ জুলাই শরৎচন্দ্র স্মৃতি মন্দিরে দ্বারোঘাটন করেন কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী ডা: বি.ডি কেশকর। অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

শরৎচন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার:
গ্রামবাসীদের দ্বারা ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত"বয়েজ ইউনিয়ন লাইব্রেরী" নামে ১৯২৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শরৎচন্দ্রের ৫৩তম জন্মদিনে শরৎচন্দ্র পল্লী পাঠাগার ও ১৯৩৮ সালে তার তিরোধানের পর "শরৎ স্মৃতি পাঠাগার" রূপে চিহ্নিত হয়। ১৯৬০ সালের ১জানুয়ারী থেকে রাজ্য সরকার পাঠাগারটি "গ্রামীণ গ্রন্থাগার" রূপে স্বীকৃতি দেয়।
শরৎ জীবনী প্রদর্শনী:
শরৎ জন্ম শতবর্ষে ১৯৭৫ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর ৫৭ টি দৃশ্যে ১৫২টি মাটির পুতুলে গোপালচন্দ্র রায় রচিত শরৎ জীবনী অবলম্বনে শিল্পী রমেন পাল নির্মিত এই প্রদর্শনীতে সমগ্র শরৎ জীবনী চিহ্নিত আছে।


         সেখানে বেশ কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে ফিরে আসব বলে টোটোতে উঠেছিল, টোটো চালক তখন বলল দাদা একটা আশ্রমে যাবেন। আমি বললাম এখান থেকে কতদূরে টোটো চালক বলল মাত্র দশ মিনিটের পথ।এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম।
 নির্জন প্রকৃতির মধ্য দিয়ে সরু ঢালাই রাস্তা দিয়ে টোটো এগিয়ে চলল। কিছু ক্ষনের মধ্য নামিয়ে দিল একটি আম বাগানে। সেখানে থেকে কিছুটা যেতেই পৌঁছালাম আশ্রমের মূলগেটে।  এই আশ্রমের নাম 'বিষ্ণু মোক্ষ ধাম' হলেও এটি লাহেড়ী বাবার আশ্রম নামেই বেশী পরিচিত। হূগলি জেলার পোলবা থানার অন্তর্গত বাজহাট গ্রামে প্রকৃতি, নির্জনতা ও সৌন্দর্যের আশ্চর্য্য মেল বন্ধনে তৈরী এই আশ্রমটি।

সুতপাকে সাথে নিয়ে জুতো খুলে মূল গেটের কাছে পৌঁছালাম। আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী সুতপা মাথায় চাদর চড়িয়ে নিলো। রঙিন আলপনা মাখা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললাম। মিষ্টি ফুলের বাগানে ভরা এই আশ্রমের দৃষ্টি নন্দন পরিবেশ যেন মনের কোনে জমে থাকা সমস্ত মলিনতা ধুইয়ে দেয়.....মন যেন ভেসে চলে এক আশ্চর্য্য হাওয়াই জাহাজে।

মহাবতার বাবাজী মহারাজের যোগদীক্ষা পরম্পরা ষষ্ট প্রাণ পুরুষ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় বহু প্রতিকুল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে গড়ে তুলেছেন এই আশ্রম। প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করেই জগদ্ধাত্রী মন্দির। আশ্রম পিতা একবার সাধনকালে দেবী জগদ্ধাত্রীর দেখা পেয়েছিলেন তাই এই জগদ্ধাত্রী বা কৌশিকী অবতারনা।


এই মন্দিরের বাঁদিকে রয়েছে হর মন্দির বা শিব মন্দির। লিঙ্গ বিহীন ধ্যানমগ্ন শিব মন্দির রয়েছে এখানে। নারায়ণ এখানে স্বর্ণ মন্ডিত। যেহেতু অন্তর আত্মা জাগ্রত তাই নারায়ন এখানে জেগে রয়েছে। পাশে ডানদিকে পড়বে পঞ্চবেদ মন্দির। এই মন্দিরে রয়েছে ব্যাসদেব ও চার বেদ। ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুবেদ ও অথর্ব বেদ। পঞ্চবেদ মন্দিরের পর দেখতে পাবেন লোকনাথ বাবার মন্দির। জগদ্ধাত্রী মন্দির থেকে সোজা এগোলেই আপনি দেখতে পাবেন রাজহাঁসের দল। এখানে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, স্বামীজী ও নেতাজীর প্রতিমূর্তি।

আশ্রমের মূল মন্দিরটির নাম 'আধারালয়'। মানুষের দেহ একটি আসন বা আধার। সেখানে বসেই সাধনা হয়। এই হচ্ছে এই মন্দিরের মূল মন্ত্র। সারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিখ্যাত মন্দিরের স্থাপত্য কৌশল এখানে অনুসরণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের ৬নভেম্বর এই মন্দিরে সমস্ত দেবদেবীর প্রতিষ্ঠা হয়। মন্দিরের প্রথমেই ডান হাতে রামসীতার মন্দির। মন্দিরটিতে দাক্ষিনাত্য স্থাপত্য রীতি অনুসরন করা হয়েছে। এখানে রয়েছে রাম, লক্ষন, সীতা ও হনুমান। বাদিকে রয়েছে চন্ডি কালীর কৃষ্ণ মন্দির। এখানে রয়েছে চন্ডী, কালী ও কৃষ্ণ। মন্দিরে নটি চুড়া। দেহের নবদ্বারের প্রতীক। এই দুই মন্দিরের মাঝে রয়েছে গরুরদ্বাজ। এটি পেরিয়েই জলধার। এই মন্দিরে ঢোকার আগে সেই জলধারে পা ধূয়ে নিতে হয়। মেয়েদের মাথায় থাকতে হবে অবশ্যই ঘোমটা জাতীয় কিছু। মন্দিরে ঢোকার জন্য রয়েছে পুকুরের ওপর দিয়ে সুসাদৃশ্য সেতুপথ যা আমাদের স্বর্ণ মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। মন্দিরের সেতুপথটি দেহ মন্দিরের মেরুদণ্ডের পরিচয়।মন্দিরে ঢুকলেই আপনি দেখতে পেয়ে যাবেন বাবাজী মহারাজের মূর্তি। গর্ভ গৃহে রয়েছে শ্যামাচরন লাহেড়ী মহাশয়ের বিরাট মূর্তি।


কে এই শ্যামাচরন লাহেড়ী? আসুন এই যোগী মহাপুরুষ সম্পর্কে দুচার কথা জেনে নিই। এই মহাপুরুষের আবির্ভাব হয় ১৬ই আশ্বিন ১২৩৫ বঙ্গাব্দে বা ৩০ সেপ্টেম্বর,১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি মহাবতার বাবাজীর শিষ্য ছিলেন। তিনি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের ঘুর্নী গ্রামে একটি ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। গৌড়মোহন লাহেড়ী ও মাতা মুক্ত কেশীর কনিষ্ঠ পুত্র ছিলেন তিনি। শিশু অবস্থায় তার মা মারা যান। শ্যামাচরন লাহেড়ী মাত্র তিন চার বছর বয়সে গলা অবধি বালিতে সমাহিত হয়ে প্রায়ই ধ্যানে বসে থাকতেন। পূর্ব পুরুষদের বাড়ি বন্যায় নষ্ঠ হয়ে যাওয়ায় পরিবারটি বারানসীতে চলে আসেন। সেখানেই তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করেন।

গৌরমোহন প্রাচীন ধর্ম সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হলেও শ্যামাচরনকে শিশু কাল থেকেই উর্দু ও হিন্দি অধ্যায়ন করান। পরে সরকারি সংস্কৃত কলেজে বাংলা, সংস্কৃত, ফার্সি এবং ইংরেজি অধ্যায়ন করেন। ১৮৪৬ সালে তার শ্রীমতি কাশীমনির সাথে বিয়ে হয়। তার দুই পুত্র ও তিন কণ্যা। ইংরেজ সরকারের সামরিক প্রকৌশল বিভাগের একজন হিসাব রক্ষক হিসেবে কর্মসূত্রে তিনি সমগ্র ভারত ঘুরেছেন। ১৮৬১ সালে শ্যামাচরনকে হিমালয়ের পাদদেশে রানীক্ষেতে বদলি করা হয়। একদিন পাহাড়ে চলার সময় , তাকে ডাকছে এমন কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন। আরো ওপরে ওঠার পর তিনি তাঁর গুরু মহাবতার বাবাজীর দেখা পেয়েছিলেন। যিনি ক্রিয়া যোগের কৌশল গুলিতে তাকে পরিচয় করিয়েছিলেন।

বাবাজী শ্যামাচরনকে বলেছিলেন, যেন তার বাকি জীবনটি ক্রিয়া যোগের কথা প্রচারের জন্য উৎসর্গ করতে হবে। শীঘ্রই লাহেড়ী মহাশয় বারানসীতে ফিরে আসেন সেখানে তিনি সক্রিয়ভাবে ক্রিয়া যোগের মার্গ অন্বেষণ শুরু করেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি মালী, গেটম্যান, রাজা-মহারাজা, সন্ন্যাসী, গৃহস্থ, নিম্নবর্ন বলে পরিচিত খ্রিষ্টান এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের দীক্ষা দেন। লাহেড়ী মহাশয় ভবিষ্যদ্বানী বলছিলেন যে, শিশু যোগানন্দ একজন যোগী হয়ে উঠবেন এবং আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে তিনি অনেক লোককে ইশ্বরের জগতে নিয়ে যাবেন। এমনই যোগীর মূর্তি মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে। তার নামেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আশ্রমটি।


ছটি সিঁড়ির মাধ্যমে অনাহূত চক্র অতিক্রম করা হয়। শিশু, বালক, কিশোর, যুবা, পৌড় ও বৃদ্ধ। গর্ভ মন্দিরের এক পাশে ব্রাহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মন্দির। গর্ভ মন্দিরের দিকে যেতে চোখে পড়বে বুদ্ধ মন্দির। বুদ্ধ মন্দিরের পাশ দিয়ে ভূগর্ভের দিকে নেমে গেলে শেষ দর্শনীয় হরিদ্বারের গঙ্গা থেকে উদ্ধার হওয়া নর্মদাশ্বরের লিঙ্গ মূর্তি। এখানেই শিবক্ষেত্রের ছবি দিয়ে বোঝান হয়েছে মন্দিরের আধ্যাত্মিক ব্যাখা।

আশ্রমের ভিতরে বাদ যাইনি যীশু কিংবা মক্কা মদিনা। এক কথায় এই আশ্রমে হয়েছে সর্ব ধর্ম সম্মেলন। আশ্রমটি শ্রী শ্রী আদ্যনাথ ট্রাস্ট কতৃক পরিচালিত হচ্ছে। আশ্রমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল , প্রকৃতিকে ব্যবহার করে প্রতিটি জিনিস সুন্দর ভাবে সাজানো ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস আশ্রম উৎসব মুখর হয়ে ওঠে। আশ্রম প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর দুপুর ৩টে থেকে সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকে। আশ্রমে প্রবেশ করেই ভোগের কূপন কেটে নিন। আশ্রম সংলল্গ আমবাগানে রয়েছে পিকনিক করার ব্যবস্থা।

কয়েকটা ঘন্টা জীবনের সেরা সময় কাটিয়ে এবার ফেরার পালা। আজকের এই অভিজ্ঞতার মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় বলব,---
"শরৎচন্দ্রের সৃষ্টি ডুব দিয়েছে বাঙালির হৃদয় রহস্যে। সুখে দু:খে মিলনে বিচ্ছেদে সংঘটিত বিচিত্র সৃষ্টির তিনি এমন করে পরিচয় দিয়েছেন, বাঙালি যাতে আপনকে প্রত্যক্ষ জানতে পেরেছে।"
                                                                            tapas.chandra.biswas@gmail.com



No comments:

Post a Comment