...দিপক মজুমদার
ভুমিকা
ও প্রথম পর্ব
আবার বেড়াতে যাওয়ার একটা সূযোগ এলো।
এবার ভূটান।
খরচের কথা চিন্তা করে প্রথমে রাজি হচ্ছিলাম না।
অনেক টালবাহানা করে এড়াতে পারলাম না,
শেষ পর্যন্ত রাজী হতেই হলো।
আবার সেই ডাস্টারে মেয়ে,
জামাই,
তার মা,
প্রায় পাঁচ বছরের নাতির সঙ্গে আমরা দুই বুড়ো বুড়ি সওয়ার হলাম।
না গেলে অবশ্যই এমন সুন্দর দেশের অনেক কিছু অদেখাই থেকে যেতো।
আদর্শ সময় সেপ্টেম্বর অক্টোবর হলেও মে মাসের
19 তারিখ
সন্ধ্যা ছটায় আসানসোল থেকে রওনা দিলাম।
উত্তর পূর্ব ভারতের সংলগ্ন দেশ ভুটান।
ভুটান শব্দটি
এসেছে সংস্কৃত শব্দ
"ভূ-উত্থান"
মানে
"উঁচু
ভূমি"।
সুন্দর পাহাড় ও নদী,
একাধিক প্রাচীন মঠ ও সুন্দর মানুষ দিয়ে সাজানো ছোট্ট একটি দেশ ভূটান ।
ভুটানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর থিম্পু। ফুন্টসলিং ভুটানের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র।
যাত্রা শুরুর আগে এই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া অবশ্যই দরকার।
১২শ শতকে এখানে দ্রুকপা কাগিউপা নামের বৌদ্ধধর্মের একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটিই বর্তমানে ভূটানের বৌদ্ধধর্মের প্রধান রূপ।
১৬১৬ সালে নগাওয়ানা নামগিয়াল নামের এক তিব্বতি লামা তিনবার ভূটানের উপর তিব্বতের আক্রমণ প্রতিহত করলে ভূটান এলাকাটি একটি সংঘবদ্ধ দেশে পরিণত হতে শুরু করে।
পরবর্তীকালে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের পর ১৮৮৫ সালে উগিয়েন ওয়াংচুক শক্ত হাতে ক্ষমতা প্রয়োগে সক্ষম হন এবং ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন।
ধীরে ধীরে আরও অনেক পরিবর্তনের মাধ্যমে ২০০৮ সালের ১৮ই জুলাই ভূটানের সংসদ একটি নতুন সংবিধান গ্রহণ করে।
এই ঐতিহাসিক দিন থেকে ভূটানে পুরপুরি রাজতন্ত্রের
সমাপ্তি ঘটে এবং ভূটান একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও সংসদীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়।
ইতিহাস ছেড়ে এবার সরাসরি ভুটানে ভ্রমণের দিকেই মন দিই।
পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার জয়গাঁও হলো সীমান্ত শহর।
পাঁচিলের ওপারেই ভুটানের শহর ফুন্টশোলিং।
ঘিঞ্জি কোলাহল পূর্ণ জয়গাঁও পেরিয়ে শান্ত শৃঙ্খলা পরায়ণ একদম বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যে প্রবেশ করলেই অনেক মানসিক পরিবর্তন আসে।
ভারতীয়দের ভুটান প্রবেশ করতে ভোটার কার্ড অথবা পাসপোর্টের ও দুটি ছবির প্রয়োজন।
আগে থেকে হোটেল বুকিং ডকুমেন্ট সঙ্গে নিয়ে ইমিগ্ৰেশন অফিসে এন্ট্রি পারমিটের জন্য লাইন দিতে হবে।
ভীড় থাকলেও মোটামুটি ঘন্টাখানেকের মধ্যে ভিসা পেয়ে নির্দিষ্ট হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
পথে আর এক প্রস্থ চেকপোস্টে চেক করিয়ে ছাড় পেলাম।
আমাদের সঙ্গে গাইড থাকায় অনেক সহজেই কাজগুলো সম্পন্ন হয়।
দ্বিতীয় দিন আর বিশেষ কিছু না ঘুরে প্রথমেই
RTO থেকে
নিজেদের গাড়ির পারমিশন নিয়ে থিম্পুর উদ্দেশ্যে
রওনা দিলাম।
দুরত্ব প্রায়
180 কিমি।
রাস্তায় এক অজানা ঝর্ণার কাছে নেমে ছবি তোলা ও কিছুক্ষণ পর রওনা।
পথেই শুরু হলো বৃষ্টি,
মেঘ ও কুয়াশার মধ্যে আলো আঁধারির মধ্যে এগিয়ে চলেছি।
প্রকৃতির এই অবর্ণনীয় রুপ মনে রাখার মতো। খাওয়ার জন্যে রাস্তার ধারে একটা হোটেলে নামলাম।
এখানে অর্ডার দিয়ে রান্নার জন্য বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হয়। নন ভেজ অর্ডার দেওয়া খুব রিস্ক।
বিফ ও পর্কের ছড়াছড়ি।
ওখানেই একটা ঘরে সাপের মতো কিছু রোদে শুকোবার জন্যে ঝুলছে।
কৌতূহল নিয়ে জানতে পারলাম গরুর ইন্টেস্টাইন।
শুকোবার পর খাওয়া হবে।
যাইহোক ডালভাত আলুভাজা খেয়ে রওনা দিলাম।
এখানকার লোকেদের ভাত বেশী পছন্দের।
প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে ঘুরপাক রাস্তায় কিছুক্ষণ যাওয়ায় পর একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হলাম।
রাস্তার ধারে সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে কলকল করে এগিয়ে চলেছে থিম্পু চু
(চু
অর্থ নদী)
।
অবিস্মরণীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য।
একের পর এক সবাই মিলে ছবি তুলছি।
প্রায় আধঘন্টা কাটিয়ে আবার এগোনো।
থিম্পু শহরে ঢুকতে বেলা প্রায় গড়িয়ে গেলো।
ছবির মতো একটা শহর
,প্রতিটি
বাড়ি প্রায় একই রকম দেখতে,
একই রকম করুকার্য,
এটাই এখানকার বৈশিষ্ট্য।
নির্দিষ্ট হোটেল গালিংখা পৌঁছতে প্রায় সন্ধে হলো।
ঠান্ডা ভালোই,
সঙ্গে সঙ্গে গ্ৰীণ টিএর উষ্ণ অভ্যর্থনায় মনটা আরও উৎফুল্ল করে দিল।
বাজারের মধ্যস্থলেই হোটেল তবে আজ আর না বেরিয়ে একদম বিশ্রাম।
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় দিন আমাদের যাত্রা শুরু হলো বুদ্ধ পয়েন্টের উদ্দেশ্যে।
বুদ্ধ পয়েন্ট লোকাল নাম হলেও আসল নাম বুদ্ধ ডর্ডেনমা।
থিম্পু শহরের প্রায় সব প্রান্ত থেকেই
169 ফুট
উঁচু এই মূর্তিটি চোখে পরে।
চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের ৬০তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপনে উপলক্ষ্যে ভুটানের রাজধানী থিম্পুর কুয়েসেলফোদরং পাহাড়ে ব্রোঞ্চের এই বিশালাকায় মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মূর্তির নিচে মূল ভবনে
1লক্ষ25
হাজার বুদ্ধ
মূর্তি রাখা প্রতিষ্ঠিত আছে।
এরপর আমাদের গন্তব্য ভুটানের জাতীয় পশু টাকিন
(Motithang Takin Preserve) দর্শন। তবে সময়ের অভাবে ভেতরে না ঢুকে কিছুটা ওপরে পাইনের জঙ্গলে গিয়ে অপেক্ষা করি।
কিছুক্ষণ পর দেখা পেলাম শক্তিশালী পাহাড়ি টাকিনের একটা ছোট দলকে।
দুপুরের খাওয়া একটু দেরিতে সেরে যাই National Institute of Zoric Chusum (প্রবেশ মূল্য 100টাকা) যেখানে নানা বয়সের ছাত্রছাত্রীদের ভুটানের আর্ট ও ক্রাফ্টস নিয়ে হাতে কলমে শেখানো হয়। এরপর গেলাম Royal Textile Academy of Bhutan ( প্রবেশ মুল্য 100 টাকা), ভুটান সংস্কৃতির নানাবিধ সংগ্রহ খুবই প্রশংসনীয় তবে উল্লেখযোগ্য হলো ভিডিওর মাধ্যমে এখানকার জাতীয় পোষাক পরানো দেখানো। পুরুষের পোশাককে বলে গো (gho) আর মহিলাদের পোশাক কিরা(Kira)। প্রসঙ্গত বলে রাখি ভুটানের Ngutrum (NU)ও ভারতীয় কারেন্সির একই মুল্য তাই সমান ভাবেই দেওয়া নেওয়া চলে। তবে বেশির ভাগ কার্ডই ওখান চলেনা তাই পর্যাপ্ত নগদ সঙ্গে রাখা বাঞ্ছনীয়। সন্ধের পর বাজারে একটু আধটু শপিং করতে যাওয়া। প্রতিটি জিনিসের দামই অপেক্ষাকৃত বেশি।
পরের দর্শণীয় স্থান থিম্পু জং
(Tashichho Dzong), এই
ফোর্ট্রেসটি এখন অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ
অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাই টুরিস্টদের প্রবেশের অনুমতি নেই।
তবে
5 টার
সময় রাজা ও রাজ সৈন্যদের দ্বারা রাজকীয় অনুষ্টানের মাধ্যমে পতাকা নামানো দেখা যায়।
বিরাট বাগানের বাইরে থেকে আমরা সেই রাজকীয় অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম।
আর বিশেষ কিছু দেখার নেই,
বাকি সময়টা কিছুক্ষণ বাজারে কাটিয়ে হোটেল ফেরা।
চতুর্থ দিনের যাত্রা ফবজিকা ভ্যালী,
দুরত্ব
134 km সময়
4 যন্টা।
মাঝ রাস্তায় পড়বে গাংতেই মনেস্ট্রী
(Gangtey Monastery) যেটা
নিয়েংগমাপা মনেস্ট্রীর একমাত্র নিদর্শন।
গাংতেই ভ্যালীর পশ্চিম দিকে এই বিশাল মনেষ্ট্রী একটি সুন্দর গ্ৰাম দিয়ে ঘেরা,
তারাই এটি দেখাশোনা করে থাকে।
পেমা লিঙ্গ্পার তৃতীয় প্রজন্ম পেমা তিনলে
1613 সালে
প্রথম গাংতেই অবতার রুপে এই মনেস্ট্রী তৈরী করে।
পরবর্তী কালে এটিকে জং হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই ভ্যালীর একমাত্র বিশেষত্ত্ব প্রতি বছর ব্ল্যাক নেকেড ক্রেনের সমাগম।
একটা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র আছে যেখান থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন টেলিস্কোপ দিয়ে এই পাখিদের গতিবিধি লক্ষ করা যায়।
প্রবেশ মুল্য
100 টাকা।
মেঘলা কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশ ক্রমাগত বৃষ্টির মধ্যেই প্রকৃতির এক মোহময় রূপ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। দুরে পাইনের ঘন জঙ্গল তার নিচে বিস্তীর্ণ উপত্যকা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণ নদী। এধার ওধার কিছু ঘোড়া ও ইয়াক চড়ে বেড়াচ্ছে। এই সব দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আমাদের নির্দিষ্ট ডেওয়াচেন হোটেল পৌঁছে গেছি। তখনও বৃষ্টি পরছে , হাড় হিম করা ঠাণ্ডা ঠক ঠক করে কাঁপছি। গরম জলে ভেজা রুমাল দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল। ঘরের মধ্যে কাঠ জ্বালিয়ে গরমের ব্যবস্থা থাকলেও আমরা ব্যালকানি থেকে বৃষ্টি ভেজা ফবজিকা ভ্যালীর রুপ দেখছি আর মোহিত হয়ে যাচ্ছি। গাইডের কাছে খোঁজ পেয়ে কিছু পরেই গাড়ি নিয়ে ভ্যালীর আরও ভেতর দিকে এগিয়ে গেলাম। যতটা এগিয়ে যাচ্ছি প্রকৃতির রুপ দেখে আত্মহারা হচ্ছি। অনেকটা জায়গা জুরে বেগুনী রঙ্গের অজানা ফুল গালিচার মতো বিছিয়ে রয়েছে, কোথাও সাদা ও হলুদে রঙের ড্যানডেলিয়ন ফুটে সৌন্দর্যের আর এক মাত্রা এনে দিয়েছে। আবার কোথাও ঘন সবুজ ঘাসের গালিচা যেগুলোর ওপর এক পাল ঘোড়া চড়ে বেড়াচ্ছে। দুরে আরও কয়েকটি ইয়াক মনের আনন্দে ঘাস খেয়ে চলেছে। এ এক অভিনব সুন্দর পরিবেশ। সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্যের নানা ছবি দেখেছি তবে এই ফবজিকা ভ্যালীর থেকে সুন্দর কিনা জানিনা। ক্রমেই অন্ধকার নেমে আসায় আমাদের হোটেলে ফিরে আসতে হলো। সাতটার মধ্যেই ডিনার চালু হয়ে যায়, আমাদেরও তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ঘরের মধ্যে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে শুয়ে পরলাম।
তৃতীয় পর্ব
পঞ্চম দিন আজ আমাদের যেতে হবে
163 কিলোমিটার
দুরে বুমথাং,
সময় লাগবে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টা।
কিছুটা এগোনোর পর ঘন জঙ্গলের মধ্যেও নানা রঙের নানা রকম ফুলের সমারোহে চোখ জুড়িয়ে যায়।
এই সময় ভুটানের সর্বত্র ফুলের সৌন্দর্য চোখে পড়বে।
রাস্তার দুধারে বিভিন্ন রঙের রডোডেনড্রন আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে।
কোথাও বিভিন্ন রঙের বোগেনভেলিয়া,
নাম না জানা আরও কতো ফুল।
আর গোলাপ ফুলের ছড়াছড়ি
, যত্নে
অযত্মে বড় বড় ফুলে আলো হয়ে আছে।
মাঝপথে পড়বে ভুটানের সবথেকে বড় ট্রংসা জং।
ক্ষরস্রোতা মাংডগে চু এর তীরে ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ের মধ্যে এই জংটি অবস্থিত।
এই এলাকায় প্রচুর সাপের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় তাই ল্যান্ড অফ স্নেক নামেও পরিচিত।
জংটির বেশিরভাগ অংশই এখন ট্রংসা জেলা হেডকোয়ার্টারের
অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ
অফিস।
ট্রংসা ডিজং নিয়ে নানারকম লৌকিক গল্পকথা প্রচলিত আছে। Zhabdrung Ngawang Namgyal এটি প্রথম
1541 সালে
তৈরী হয়।
পরবর্তীকালে
1644 সালে
Chhogyel Mingyur Tenpa দ্বারা
বর্তমান রুপে পূনঃনির্মিত হয়।
ভয়াবহ ভূমিকম্পে
1897 জংটির
অনেক ক্ষতি হল
Jigme Namgyal এর
মেরামতি করে বর্তমান রুপে সজ্জিত করেন।
এরপর গন্তব্য ট্রংসা টাওয়ার বা রয়াল হেরিটেজ মিউজিয়াম।
পাঁচ তলা এই গম্বুজকৃতি মিউজিয়ামে ভুটানের রাজপরিবারের ব্যবহৃত দ্রব্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগ্ৰহ দেখতে পাওয়া যায়।
নিচেই কাফেটারিয়া,
লাঞ্চ সেরে বুমথাং শহরের দিকে এগোলাম। বিকেল বিকেল নির্দিষ্ট হোটেল সুইস গেষ্ট হাউস পৌঁছে গেলাম।
বুমথাং চু এর পাশেই অ্যপ্রিকট বাগানের মাঝে কারুকার্য মন্ডিত শোভা ও পরিবেশ দুইই সুন্দর,
অনেকদিন মনে রাখার মতো।
এরপর বিশ্রাম,
আগামীকাল আবার নতুন যাত্রা।
আজ ষষ্টদিন প্রথমেই যাব
27 কিলোমিটার
দুরে বার্ণিং লেক বা মেমবার্টসো।
চড়াই উৎরাই ভেঙ্গে ঘন্টা দেড়েক বাদে পৌঁছলাম।
এটি একটি পবিত্র স্থান যেখানে
15 শতাব্দীতে
পেমা লিম্পা গুরু রিনপোচের লিপি উদ্ঘাটিত করেছিলেন।
ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দিয়ে প্রায়150
ফুট নিচে নেমে তাং চুর ভয়াবহ খাদে নেমে পেমা লিম্পার উদ্দেশ্যে প্রদীপ জালিয়ে এই গা ছমছমে পরিবেশের অনুভূতি পেলাম।
বার্ণিং লেক নামের পেছনে অনেক লোককথা আছে,
আমাদের গাইড তার বর্ণনা দিল।
ভুটানের অধিবাসীরা তাদের মনস্কামনা পূরণের আশায় ছোট ছোট মুর্তি নিবেদন করে থাকে।
এই পবিত্র স্থান দর্শন করে আমরা বুমথাং ভ্যালী ও পাইনের জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাটালাম।
এ আর এক অনুভূতি যা বর্ণনা করা কঠিন।
বুমথাং বাজারে লাঞ্চ সেরে কিছুটা দুরে বুমথাং চিz
ফ্যাক্টরী ও হানী কালেকশন সেন্টার পরিদর্শন করলাম।
হানী ও জ্যাম কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শপিংএর জন্য সন্ধ্যার পর আবার বেরোনো হলো।
সপ্তম দিনের ঠিকানা পুনাখা।
দুরত্ব
218 কিলোমিটার প্রায় 7 ঘন্টা সময় লাগবে।
বুমথাং পুনখা হাইওয়ে দিয়ে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলেছি পাশে বয়ে চলেছে বুমথাং চু আর তার পাশে পাহাড়ে আকাশ ছোঁয়া বিস্তীর্ণ ঘন জঙ্গল।
প্রায় অন্ধকার জঙ্গল দিয়ে বেশ রোমাঞ্চকর পরিবেশের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছি।
এই ঘন জঙ্গলে ডাইনী নিয়ে অনেক ভৌতিক গল্প প্রচলিত আছে।
রাত্রে কোন গাড়ি দাঁড়ায় না কেউ লিফ্ট চাইলেও এড়িয়ে যায়।
এই বিষয়ে বিস্তারিত গল্প বললে ভ্রমণের আনন্দই নষ্ট হয়ে যাবে।
আজ অষ্টম দিন আমাদের পুনাখা থেকে পারো ভ্রমন,
দুরত্ব
126 কিলোমিটার।
থিম্পু হয়ে যেতে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা।
মাঝে দ্রষ্টব্য দুই বিখ্যাত নদী পো চু ও মো চু এর সঙ্গমস্থলকে কেন্দ্র করে পুনাখা জং।
1637 সালে
Ngawang Namgyal পুনাখা
জংটির স্থাপনা করেন যা ভুটানের দ্বিতীয় বৃহৎ ও প্রাচীন ফোর্ট্রেস,
বর্তমানে পুনাখা জেলা হেডকোয়ার্টারের
অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ
অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
প্রবেশ মুল্য
300 টাকা।
পরের উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য এখান থেকে দেড় কিলোমিটার দুরে পো চুর ওপর নির্মিত ভুটানের আকর্শনীয় ঝুলন্ত ব্রীজ।
হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
160 মিটার
লম্বা ব্রীজ পুনাখা জং ও ভ্যালীর অপর প্রান্তে সেনগানা গ্ৰামের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে।
বিশেষ স্থাপত্যের নিদর্শন এই ব্রীজের ওপর দিয়ে পারাপার করতে রীতিমতো রোমাঞ্চিত হতে হয়।
এরপর আমরা এগোলাম দোচুলা পাশের দিকে।
2003 সালে
ভারতের আক্রমনে নিহত ভুটান সেনার স্মৃতির উদ্দেশ্যে
108 টি
স্তুপা
(চোর্টেন)
তৈরী করা হয়।
কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের গায়ে
3100 মিটার
উচ্চতায় নির্মিত দোচুলা পাশ ট্যুরিষ্টদের এক আকর্শনীয় স্থান।
এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশে চারিদিকে বিস্তীর্ণ হিমালয়ের শোভা সবাই মোহিত হয়ে যায়।
ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়ায় আমরা সবাই কাঁপছি।
পাশেই ক্যান্টিনে গরম চিকেন পকোড়া ও চা খেয়ে একটু স্বাভাবিক হয়ে আবার এগিয়ে চলা।
পারোতে রেমি রিসর্ট যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল পাঁচটা।
পারো ভ্যালীর ওপরে পারো চু এর একদম ধারে এক সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে মন উৎফুল্ল হয়ে সারাদিনের ক্লান্তি দুর করে দিল।
চতুর্থ ও শেষ পর্ব
ভুটানে আজ নবম দিন আমরা যাবো চেলে লা পাশ। তার আগে পারো এয়ারপোর্ট সম্বন্ধে কিছু
না বললে ভ্রমণ কাহিনী অপূর্ণই থেকে যাবে। চারিদিকে সুউচ্চ পাহাড় আর তারই পাদদেশে এই এয়ারপোর্ট পৃথিবীর কয়েকটি
গুরুত্বপূর্ণ এয়ারপোর্ট গুলির মধ্যে অন্যতম। চওরা রাস্তা একদিকে বয়ে চলেছে পারো চু
আর একদিকে ছোট্ট সাজানো গোছানো সুন্দর এয়ারপোর্ট। কয়েকটি এক্সপার্ট পাইলট ছাড়া এখানে প্লেন
ল্যান্ড করার সুযোগই পায়না। রাস্তার ধারে ভিউ পয়েন্টে থেকে এই
এয়ারপোর্টের
দৃশ্য খুবই আকর্শনীয়।
পারো থেকে
37 কিলোমিটার
দুরে
13000 ফুট
উপর এই পাশটি দেশের সর্বোচ্চ পাশ।
চারিদিকে পাইনের ঘন জঙ্গল ও চড়াই উৎরাই দিয়ে অনেক ঘুরপাকের মধ্যে দিয়ে চেলেলা পাশ পৌঁছলে হিমেল হাওয়ায় কাঁপিয়ে দেবে।
আকাশ পরিস্কার থাকলে দুরে
22000 ফুট
উচু পবিত্র তুষারাছন্ন জুমলহরি পিক নজরে আসে।
এখান থেকে
26 কিমি
দুরে হা ভ্যালী পরিস্কার ভাবেই নজরে আসে সেখানে আলাদা পারমিট না থাকায় আমাদের যাওয়া হয়নি।
চারিদিকে ঘাসের মধ্যে ফুটে রয়েছে চোখ জোড়ানো সাদা ও হলুদে রঙের ড্যানডেলিয়ন। বেশ খানিকটা সময় কাটানোর পর নেমে এলাম পারোর বাজার এলাকায়।
খাওয়া দাওয়া সেরে বাজারে এ দোকান ঘুরে বেড়ানো।
বাজার এলাকাটি খুবই সুন্দর রাস্তার দুধারে নানাবিধ কারুকার্য করা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাড়ি গুলো ভুটানের কলা ও স্থাপত্যের নিদর্শন।
গোটা ভুটান দেশটাই ঝাঁ চকচকে পরিস্কার।
কোথাও কোনো প্লাস্টিক বা অন্য বর্জ ফেলা বারন এবং প্রত্যেকে তা মেনে চলে।
যাইহোক দোকানে নানাবিধ ভুটানের হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট
ও বেবি ইয়াকের লোমের শাল/স্টোল খুবই আকর্ষনীয়।
পরদিন ভুটান ভ্রমনের দশম ও শেষ দিন।
গন্তব্যে টাইগার নেস্ট।
ভুটানের মনেষ্ট্রীগুলির
মধ্যে উল্লেখযোগ্য ও সেরা হিসেবে গণ্য করা হয়।
পারো টাকতশাং নামেও পরিচিত এই মনেস্ট্রী ভুটান ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ যেটা ভুটানের সিম্বল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কাহিনী অনুসারে
8ম
শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক হিসেবে বাঘের পিঠে চেপে ভুটান এসে
3000 মিটার
উচ্চতায় এই পাহাড়ের উপরে সাধনা করেন।
তাই এটি টাইগার্স নেস্ট নামে পরিচিত।
পাথুরে রাস্তা দিয়ে এখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছতে প্রায় দুই আড়াই ঘন্টা লাগে।
নিচে অবশ্য টাট্টু ঘোড়ার ব্যবস্থা আছে
(ঘোড়া
প্রতি
500 টাকা
নিয়ে থাকে)
তাও মাঝ রাস্তা পর্য্যন্ত নিয়ে যায় সেখান থেকে বাকিটা হাঁটতে হয়।
হাঁটার সুবিধার জন্য নিচেই লাঠি ভাড়া পাওয়া যায়।
টাইগার নেস্ট দেখার পর মোটামুটি ভুটান সফর শেষ।
অনেক দেখা স্থান কাহিনীর মধ্যে সংযোজন করা হয়ে ওঠেনি বা আরও অনেক কিছু বাকি থেকে গেল পরে আবার সুযোগ হলে সম্পূর্ণ হবে।
পরদিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে নটার মধ্যে বেড়িয়ে পড়া।
পারো থেকে টানা
22 ঘন্টা
গাড়িতে চেপে পরদিন সকাল
7 টায়
যখন আসানসোল পৌঁছলাম তখন গাড়ি থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিনা।
মাথা থেকে পা অব্দি টলমল করছে।
বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সেই স্মৃতি রোমন্থন করছি।
ধন্যবাদ জানাই আমাদের জামাই অরিত্র,
তার প্রিয় ডাস্টার গাড়ী,
ভুটানের গাইভ নিমা ও আমাদের টিম মেম্বারদের।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ উইকিপিডিয়া, মৌসুমী মজুমদার, ঋতুপর্ণা মজুমদার ও অরিত্র রায়।
dkmajumder2952@gmail.com
No comments:
Post a Comment