1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Friday, May 1, 2020

লখনউ দিল্লি আগ্রা মথুরা ও বৃন্দাবন ভ্রমণ

                                                                                                    ...সোমা চ্যাটার্জি             
                        সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে আমার ছেলের। তাই যথারীতি আমরা পাঁচজন আবার বেরিয়ে পড়লাম ভ্রমণে। এখানে 5 জন বলতে আমি; আমার স্বামী ও আমার একমাত্র ছেলে আর আমার মা ও বাবা। আমরা যেখানেই যাই একসাথে যাই।তাই এবারও সবাই মিলে আবার বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের ট্রেন ছিল বর্ধমান জংশন থেকে। জম্মু তাওয়াই 1টা চল্লিশে এলে আমরা মহা আনন্দে ট্রেনে উঠে  নিজের নিজের সিটে বসে পরলাম। নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে তা খেয়ালই করিনি। চায়ের সরঞ্জাম আমাদের সঙ্গেই থাকে। তাই আমর মা চা বসিয়ে দিল ট্রেনের চার্জ দেওয়ার প্লাগে। গরম গরম চা খেয়ে যে যার নিজের ফোন নিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। রাত সাড়ে আটটা বেজে গেলে আমার বাবা ও ছেলে খেতে চাই। তাই সবাই মিলে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতে বেশ ভালোই ঘুম হলো। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নামার জন্য রেডি হলাম। লখনউ আস্তে আমরা সবাই ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম । 

তারপর সোজা  হাঁটতে লাগলাম হোটেলের সন্ধানে। পেয়েও গেলাম একটা মনের মত হোটেল। হোটেলের নিয়ম কানুন সব মিটিয়ে ঘরে গিয়ে সবাই একে একে স্নান সেরে রেডি হয়ে নিলাম। আমরা যখন আবার হোটেলে নীচে এলাম তখন প্রায় দশটা বেজে গেছে। বাইরে থেকে একটা অটো ঠিক করে লখনউ শহরটা দেখতে বেরিয়ে গেলাম। অটোওয়ালা পাঞ্জাবি ছিল; আর তার ব্যবহারটা খুব ভালো ছিল। আমরা প্রথমে গেলাম লখনউ বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া দেখতে। একটা গাইড নিয়ে দেখা শুরু করলাম। মাস চারেক আগে আমার হাঁটুতে টিউমার অপারেশন হয়েছে। তাই সিড়ি ওঠানামা করতে আমার একটু অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু দেখার আগ্রহ প্রবল। তাই এই ব্যথা-যন্ত্রণা কে তোয়াক্কা না করে সবার সাথে এগিয়ে চললাম। দেখে অবাক হয়ে গেলাম যে তখনকার দিনে মানুষের বুদ্ধি কত ছিল। না হলে এমন জিনিস তৈরি করা সম্ভব নয়। দেখে যা বুঝলাম তা হলো আমাদের মত সাধারন মানুষ যদি একা ভুলভুলাইয়া তে ঢোকে তাহলে তার বেরোনোর রাস্তা পাওয়া একটু অসম্ভব আছে। যাইহোক গাইডের সাথে সাথে আমরা বেরিয়ে এলাম। ভুলভুলাইয়া দেখা যখন শেষ হলো তখন দুপুর হয়ে গেছে। 

তারপর আমরা গেলাম লখনৌর ইউনিভার্সিটি দেখতে। সব জায়গায় প্রবেশ নিষেধ তাই যেটুকু দেখতে পেলাম তাতেই মনের  তৃষ্ণা মেটাতে হলো।তবে একটা জিনিস বেশি করে দেখলাম যে সর্বত্র জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে। মনে মনে হাসলাম আর ভাবলাম একেই বুঝি পড়াশোনা করা বলে। যাইহোক সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা দুপুরের আহার সারলাম লখনউ বিরিয়ানি দিয়ে। তখন প্রায় তিনটে বেজে গেছে। সুস্বাদু সেই বিরিয়ানি এখনো যেন তার স্বাদ মুখে লেগে আছে। তারপর আরো দু একটা জায়গা ঘুরে অটোওলা নিয়ে গেল লখনউ চিকন এর দোকানে। এখানে কেনাকাটি সেরে হোটেলে ফিরলাম। একটু রেস্ট নিয়ে আমরা আবার তৈরি হয়ে গেলাম দিল্লির উদ্দেশ্যে ট্রেন ধরার জন্য।

                 দিল্লী ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়লো। সারাদিন ঘোরাঘুরির জন্য রাতে বেশ ভালো করেই ঘুম হলো সবার। দিল্লি পৌঁছে গেলাম খুব সকালে। সব জায়গার হোটেলের নাম আমি লিখে নিয়ে যায়। তাই হোটেল পেতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। হোটেল অশোকাতে উঠে  সবাই তাড়াতাড়ি স্নান সেরে রেডি হয়ে নিলাম। তারপর হোটেলের নিচে নেমে একটা দোকানে টিফিন সেরে বাস ধরলাম লালকেল্লা দেখার উদ্দেশ্যে। মার্চ মাসে যে দিল্লিতে এত গরম পড়ে যায় তা আমরা ভাবতেও পারিনি। লালকেল্লায় ভিড় হয়েছিল খুব। ঘুরতে ঘুরতে মোগল সাম্রাজ্যের কথা মনে পড়তে লাগল।

 যেন সব চরিত্র ইতিহাসের পাতা থেকে বেরিয়ে আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দেখা যখন শেষ হলো তখন গরমে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। বাইরে বেরিয়ে সবাই কোলড্রিংস আর আইসক্রিম খেতে লাগলাম। তাতেই আমাদের পেট ভরে গেল। আমরা বাঙালি তাই দুপুরে ভাতের দিকে মনটা টানে। কিন্তু গরমের চোটে সেদিন আর ভাত খেলাম না।  তারপর চাঁদনী মার্কেটে কিছু কেনাকাটা করে রাত্রি আটটায় হোটেলে ফিরে এলাম। পরের দিন গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে দেখলাম দিল্লির বিড়লা মন্দির । আজ পর্যন্ত বিড়লা মন্দির যেখানে যেখানে দেখেছি সত্যিই এদের পাথরের কাজ দেখলে অবাক হতে হয়। দিল্লির বিড়লা মন্দির টা আকারে বেশ বড়। যতটা পারলাম তাড়াতাড়ি ঠাকুরের দর্শন সেরে নিলাম। তারপর সেখান থেকে গেলাম সেই বিখ্যাত গেট দেখতে; যাকে বলে ইন্ডিয়া গেট। তার চারপাশের রাস্তা এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন যে এটা ভারতবর্ষের কোন জায়গায় সেটা ভাবতেই অবাক লাগে।

 গাড়ি একটু দূরে পার্কিং করলো। আমরা সেখান থেকে রাস্তা পেরিয়ে হেটে গেলাম। মানুষের ভিড় যেন উপচে পড়ছে । আমরা ইন্ডিয়া গেট কে নিজেদের মুঠোফোনে বন্দী করে নিলাম । সময়ের তোয়াক্কা না করে একটু বেশি সময়ই সেখানে কাটিয়ে ফেললাম। তাই আমাদের ড্রাইভার বলল যে এরপরের স্পট গুলো একটু তাড়াতাড়ি করতে। নাহলে অক্ষরধাম মন্দির বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই খুবই তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাড়ি ঘুরে দেখলাম। তাড়াতাড়ি দেখলাম মানে এই নয় যে সব দেখি নি। আমরা সবকিছু খুঁটিয়ে দেখেছি যেখানে ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করা হয়েছিল সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তখন আট কি নয় বছর বয়স হবে আমার। রেডিওতে বারে বারে বলছে যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গুলি করা হয়েছে। সেই দিনটা ভুলিনি কোনদিন। ছোটবেলার স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। এবার গেলাম দিল্লির কুতুবমিনার দেখতে। মেরামতির কাজের জন্য উপরে ওঠা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের কপালটা খারাপ তাই আর ওপরে ওঠা হলো না। সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বেশ কটা কুতুব মিনারের ফটো তুলে নিলাম । তারপর আমাদের গাড়ি গিয়ে থামল দিল্লি লোটাস টেম্পল। এত মানুষের সমাগম হয়েছে যে ভিড় ঠেলে আমাদের এগিয়ে যেতে হল । কত রকমের গাছ দেখলাম সব কি আর লিখে বোঝানো যায়। চোখে না দেখলে মানুষ বিশ্বাসই করতে পারবে না। তারপর লোটাস টেম্পল এর ভিতরে প্রবেশ করলাম বাইরে যে মানুষের এতো কোলাহল তার বিন্দুমাত্র ভিতরে নেই। একটা পিন পড়লে হয়তো তার শব্দ শোনা যাবে এমন নিস্তব্ধতা সেখানে। এখানে কিছুক্ষণ বোসতে মন যেন শান্ত হয়ে গেল। যখন বাইরে বের হলাম তখন তিনটে বেজে গেছে । তাই সেখানেই দুপুরের আহার সেরে নিলাম। এরপর আমাদের গাড়ি ছুটে চলল অক্ষরধাম মন্দিরের দিকে। পার্কিং জোন থেকে মন্দির পৌঁছতে ভালোই সময় লাগলো। অক্ষরধাম মন্দিরের লাইন ছিল বেশ বড়।  চেকিং পর্ব সেরে যখন মন্দিরে পৌছালাম তখন মন্দির এর ভেতরটা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমাদের কল্পনারও অতীত যে এমন মন্দির দেখব। অক্ষরধাম মন্দির যে চাক্ষুষ দেখেছে সেই বলতে পারবে অকল্পনীয় জিনিস এটা।  মন্দির ঘুরতে অনেক সময় লেগে গেল। গাড়ির কাছে যখন এলাম তখন আমরা গাড়ির টাইম পার করে গেছি । তাই আরো কিছু টাকা দিয়ে আমাদের হোটেলে ফিরতে হলো।


              পরদিন খুব ভোরে রেডি হয়ে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম স্টেশনের উদ্দেশ্যে । 4 ঘণ্টার জার্নি আগ্রা পৌঁছতে। ট্রেন একটু লেট করায় প্রায় দুপুরে আগ্রা পৌছালাম। সোজা অটো ধরে তাজমহলের কাছে চলে গেলাম। সেখানে একটা হোটেল পছন্দ করে তাতে উঠে পড়লাম। আমাদের হোটেল থেকে তাজমহল মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। আমাদের হোটেলের ছাদ থেকেই তাজমহল দেখা যাচ্ছে। স্নান সেরে বেরিয়ে পড়লাম সবাই মিলে। একটা হোটেলে দুপুরের আহার সেড়ে নিয়ে সোজা তাজমহলে প্রবেশ করলাম। তাজমহল যে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি তা চোখে না দেখলে জীবন যেন ব্যর্থ হত। এই অপরূপ সৌন্দর্য হাত দিয়ে অনুভব করতে চাইছিলাম। সেই মহান শিল্পীদের কথা মনে পড়ে গেল;যারা এটি বানিয়ে ছিলেন। সম্রাট শাহজাহান নাকি তাজমহল বানানোর পর এই শিল্পীদের হাত কেটে দিয়েছিলেন যাতে আর না বানাতে পারে। মনে মনে ভাবছি কেমন নিষ্ঠুর সম্রাট ছিলেন। যারা তার জন্য এমন সুন্দর সৌধ বানালো তাদের কি  করে এত কষ্ট দিলেন। ইতিহাসের পাতা থেকে বেরিয়ে নিজের মুঠোফোনে কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর গেলাম আগ্রা ফোর্ট দেখতে।খুব সুন্দর ;না দেখলে বোঝা যায় না। আকবরের সিংহাসন এর কাছে দাঁড়িয়ে আবার ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ডুবে গেলাম। আকবর আর  যোধাবাঈ এর কাহিনী মনে পড়ছিল । সন্ধ্যা হয়ে আসছিল তাই একটু তাড়াতাড়ি ঘুরে দেখলাম।  তারপর হোটেলে ফিরে পুরো বিশ্রাম । পরের দিন গেলাম মথুরা-বৃন্দাবন দেখতে। বৃন্দাবনে একটা গাইড ঠিক করে পায়ে হেঁটে সোনার তাল গাছ; নিধিবন থেকে শুরু করে যা যা মন্দির ছিল সব দেখলাম। বিন্দাবনে বাঁদরের উৎপাতে নিজেদের ব্যাগ সামলে রাখতে হচ্ছিল । এরপর গেলাম মথুরা। কংসের কারাগারে বসে ভাবছি যে এই জায়গায় শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। 

এই পবিত্র স্থানে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। মথুরায় আর কিছু দেখার নেই তাই এরপর সোজা আগ্রা ফিরে পড়লাম। সেদিন রেস্ট নিয়ে পরের দিন আবার গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে গেলাম ফতেপুর সিক্রি দেখতে। পৌঁছতে প্রায় দশটা বাজল। পার্কিং থেকে ওদের বাসে করে ফতেপুর সিক্রি পাহাড়ে উঠতে হল। অত্যধিক গরম ছিল কিন্তু জানার কৌতূহল তার থেকেও বেশি ছিল। তাই গাইডের সাথে ঘুরতে লাগলাম । যোধাবাঈ যেখানে বসতেন সেখানে বসে ছবিও তুলে নিলাম । উত্তম কুমারের লাল পাথর সিনেমার যেখানে শুটিং হয়েছিল তাও দেখলাম। যোধাবাঈ গ্রীষ্মকালে কোথায় থাকতেন; শীতকালে কোথায় থাকতেন সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। ঐতিহাসিক স্থান ঘুরতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই মনের আনন্দে সব দেখে বেড়ালাম। সেখান থেকে নামতে তিনটে বেজে গেল। তারপর হোটেলে ফিরে চোখে মুখে জল দিয়ে শেষবারের মতো আবার তাজমহল দেখতে চলে গেলাম । কারণ এ জিনিস  একবার দেখে মনের তৃপ্তি হয় না। সন্ধ্যার পর হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম। খাবার দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম । কারণ পরের দিন সকাল ছটায় আমাদের ট্রেন ছিল বাড়ি ফেরার।পরেরদিন নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন ছেড়ে ছিল আর ফিরতেও কোন অসুবিধা হয়নি।

দমদম । কলকাতা
                                                           sunny.chat1212@gmail.com


No comments:

Post a Comment