1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

সত‍্যজিৎ ~ একটি যুগের নাম

সত‍্যজিৎ ~ একটি যুগের নাম

সীমন্ত নন্দী

     আজকের দিনে যদি সারা পৃথিবীতে চলচ্চিত্র অঙ্গনে খ্যাতিমান কয়েক জন চলচ্চিত্র নির্মাতার তালিকা করা হয় নিঃসন্দেহে স্টিফেন স্পিলবার্গ, জেমস ক্যামেরন, মার্টিন স্কোরসেসে, টিম বার্টন, উডি অ্যালেন, জর্জ লুকাস এ নামগুলো তালিকার সবার উপরে অবস্থান করবে। অথচ গত শতাব্দীতেও যদি কাউকে চলচ্চিত্র অঙ্গনে খ্যাতিমান কয়েক জন চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম জিজ্ঞেস করা হতো অনেকের মুখে একজন বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতার নাম উচ্চারিত হতো সন্দেহাতীতভাবে।

     তিনি এমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র যিনি বাংলা চলচ্চিত্র তো বটেই এমনকি পুরো উপমহাদেশের চলচ্চিত্রকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কিংবদন্তি এ মানুষটি হচ্ছেন সত্যজিৎ রায়।

     সত্যজিৎ রায়ের চিত্র পরিচালক সত্ত্বাকে যদি সরিয়ে রাখা যায়, শুধুমাত্র লেখক-সাহিত্যিক হিসেবেই কি তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য স্থান অধিকার করেন না?

     বাঙালির অতি প্রিয় গোয়েন্দা ফেলুদা থেকে বৈজ্ঞানিক প্রফেসর শঙ্কু কিংবা চিরকুমার ও মজলিশি তারিনীখুড়ো, প্রতিটি চরিত্রের একটি কমন জিনিস যদি ধরা যায় তা হল সততা, নির্লোভ ও আর অনুসন্ধিৎসু মনন। সত্যজিতের লেখার ছত্রে ছত্রে থাকে সাধারণ জ্ঞান, ইতিহাস থেকে বিজ্ঞানের সহজপাঠ। খুব সহজ সরল ভাষায় যিনি পাঠককে বুঝিয়ে গিয়েছেন বড় বড় দর্শন।

     সত্যজিৎ সৃষ্ট আইকনিক 'ফেলুদা' সিরিজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সিরিজ বলা চলে নির্দ্ধিধায়। ১৯৬৫ সালে এই সিরিজের প্রথম গল্প পত্রিকায় প্রকাশ হতেই তা পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ফেলুদা সিরিজের মোট ৩৫ টি সম্পূর্ণ ও চারটি অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়। সিরিজের সমস্ত গল্পে ফেলুদাকে দেখা যায় বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বা মগজাস্ত্রের উপর ভর করে জটিল থেকে জটিলতর রহস্যের জট খুলে দিতে। শুধু কলকাতার মধ্যে নয়, রাজ্যের গন্ডি পেরিয়ে, আবার কখনও দেশের সীমানা পেরিয়ে আবার কখনও অজ পাড়া গাঁয়ে। কলকাতাবাসী শখের গোয়েন্দা প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদা তাঁর দুই সঙ্গী তোপসে ও লালমোহন গাঙ্গুলি বা জটায়ুকে নিয়ে যাবতীয় রহস্য সাফ করে যান, সেই চারমিনার হাতে চিন্তাশীল ফেলুদা’তে আজও মজে বাঙালি। ছোটবেলায় পড়া আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমসে প্রভাবিত হয়েই ফেলুদা চরিত্রের সৃষ্টি সত্যজিতের। তাই ফেলুদা সিরিজের বিভিন্ন চরিত্রের সাথে অনেক জায়গায় আমরা শার্লক হোম সিরিজের কিছু চরিত্রের মিল দেখতে পাই। সৃষ্টির এতবছর কেটে গিয়েছে, ফেলুদা আজও পাঠকের কাছে সমান সমাদৃত।

     আবার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, নির্লোভ, সৎ একজন মানুষ, জীবনের কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি সেই প্রোফেসর শঙ্কু চরিত্রের মাধ্যমে সত্যজিৎ নিত্য নতুন অভিযানের মাধ্যমে পাঠকের সামনে খুলে দেন কল্পবিজ্ঞানের  এক অবাধ জগৎ। যত বিখ্যাতই হও না কেন সততা, নির্লোভ মনন যে মানুষের আসল গুণ, ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুর মাধ্যমে সেই বার্তাই বারবার স্মরণ করিয়ে যান সাহিত‍্যিক সত‍্যজিৎ রায়। শঙ্কুকে নিয়ে লেখা মোট ৩৮ টি সম্পূর্ণ ও ২ টি অসম্পূর্ণ গল্পে প্রোফেসর বের হন নতুন নতুন অভিযানে। যিনি অদ্ভুত কিছু আবিষ্কার করেন। গিরিডির বাসিন্দা ও স্কটিশচার্চ কলেজের প্রাক্তনী শঙ্কু পদার্থ বিজ্ঞানী হলেও বিজ্ঞানের সকল শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি ৬৯ টি ভাষা জানেন, হায়ারোগ্লিফিক লিপি অবধি পড়তে পারেন। বিশ্বের প্রায় সব দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি ও বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে যাঁর অঢেল জ্ঞান। আবার ভারতের সনাতন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শঙ্কু একইসঙ্গে শ্রদ্ধা করেন সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সাহিত্য ও শিল্পকর্মকে। প্রফেসর শঙ্কু গল্পেরও পটভূমি ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। তাঁর অভিযান কলকাতার বিভিন্ন স্থান থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, মিশর, জার্মানি, জাপান, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেন, তিব্বত, সাহারা মরুভূমি থেকে সমুদ্রের তলদেশ, অজানা দ্বীপ ছুঁয়ে যায়। পুরো সিরিজ জুড়ে প্রোফেসরের মোট ৭২ টি আবিষ্কার সম্পর্কে জানা যায়।

     তেমনি ষাট পেরোনো তারিণী খুড়ো। যুবক বয়স থেকে নানা ধরনের চাকরি করতে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প তারিণী খুড়ো শোনান বাচ্চাদের। সেখানে আবার সাহিত‍্যিক সত‍্যজিৎ রায় পাঠকের কাছে উজাড় করে দেন ভূতের ও হাসির গল্পের ঝুলি। যার অধিকাংশ গল্পে দেখা যায় উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কীভাবে একের পর আসন্ন বিপদকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন তারিণী খুড়ো। সেখানেও মূল চরিত্র জীবনে অনেক রোজগার করলেও কখনও টাকার পিছনে ছোটেননি। কাজের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগলে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন স্থানে, নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন অন্যভাবে।

     তিনি এই তিনটি চরিত্র ছড়াও বহু ছোট উপন্যাস ও ছোট গল্প রচনা করেছেন। সত্যজিতের লেখার মূল লক্ষ্য ছিল কিশোর তরুণ পাঠক বর্গ, যদিও তিনি আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে বড্ড প্রিয়। সাহিত্যিক হিসেবে এরচেয়ে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে!

     আবার মোল্লা নাসিরুদ্দিন মধ্যপ্রাচ্যের সিরিজ হলেও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাকে বাংলা পাঠকমহলের কাছে পরিচিতি দেওয়ার ভার নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। হাস্যরসাত্মক চরিত্র হিসেবে পরিচিত মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে দেখা যায় একদিকে একজন প্রাজ্ঞ মানুষ ও দার্শনিক হিসেবে। আবার কোনও গল্পে তিনি হদ্দ বোকা। তাঁর কথাবার্তা যেমন হাসায় তেমনি ভাবায়ও। সত্যজিৎ রায়ের মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সিরিজও অন্য সব সিরিজের মতোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

     তার রচিত “ফেলুদা” কিংবা ‘’প্রোফেসর শঙ্কু’ এর মতো কাল্পনিক চরিত্রগুলো আজও বাংলার তরুণ সমাজের হৃদয়ে চির ভাস্বর।

     চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের ছিল বহুমুখী সৃজনশীলতা। তার কাজের পরিমাণ বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’—এই তিনটি চলচ্চিত্রকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। চলচ্চিত্র মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সংগীত স্বরলিপি রচনা, চিত্রগ্রহণ, শিল্পনির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন।

     বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি হচ্ছেন দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছিল। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার সত্যজিৎ রায়কে সে দেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার "লেজিয়ন দি অনার"-এ ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগে একাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস (অস্কার) তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত সরকার তাকে ভারতরত্ন প্রদান করে।

nandisimanta534@gmail.com

লাপুড়িয়া, গড়বেতা, পশ্চিম মেদিনীপুর


No comments:

Post a Comment