1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

নীল আলো ভালো নয়

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
নীল আলো ভালো নয়
সৌরভ নাগ


"তুমি যাই বল হে বাপু, এরকম অদ্ভুত বিটকেল ব্যাপার আমি জীবনে কখনও দেখিনি। ছোটবেলায় পৈতৃক ভিটেতে থাকার সময় 'আলেয়া' নামক ভূতের কথা শুনেছিলাম, যদিও তা চাক্ষুষ করিনি। তবে সেটার যা বর্ণনা শুনেছিলাম এটা দেখে তো সেরকমও মনে হয়নি।" হরিনারায়ণবাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন।

"আলেয়ার ব্যাপারটা আমিও শুনেছি। কিন্তু আমি যতদূর জানি সেটা একজায়গায় স্থির থাকে না। এবং সেটা কোনও অলৌকিক ব্যাপারও নয়। বর্জ্য পদার্থ থেকে উৎপন্ন গ্যাসের কারণে আলেয়ার সৃষ্টি হয়। এ আলো তো সেরকম নয়। তাছাড়া সেটা প্রত্যেক রাতে সত্যদার বাড়ির উপরেই প্রকট হচ্ছে কেন?" সমরেশবাবু বললেন।
সমরেশবাবু হরিনারায়ণবাবুর তুলনায় বয়সে বেশ ছোট। তবে সত্যপ্রকাশবাবু ও হরিনারায়ণবাবু প্রায় সমবয়সী। এঁদের একমাত্র আড্ডার স্থান হল কমলেশের চায়ের দোকান। প্রতিদিন বিকেলে কমলেশের চায়ের দোকানে আড্ডা না হলে তিনজনেরই সন্ধেটা বেশ জমে না।
সত্যপ্রকাশবাবু আজ বেশ চুপচাপ। বেশ কয়েকদিন ধরেই অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে তাঁর সাথে। মাঝে মাঝে তাঁর শরীর অবিশ্বাস্যভাবে হালকা হয়ে যাচ্ছে। হাঁটাচলার সময় টলে পড়ে যাচ্ছেন। ডাক্তার দেখিয়েও কোনও লাভ হয়নি।
কিন্তু গত তিনদিন ধরে আরেকটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটছে প্রতিরাতে। তাঁর বাড়ির উপর একটি নীল আলো শূন্যে জ্বলে উঠছে এবং তাঁর সাথে সাথেই তাঁর বাড়ির সমস্ত ঘড়ির কাঁটাগুলো পাগলের মত ডানদিক থেকে বাঁদিক ও বাঁদিক থেকে ডানদিকে ঘুরে চলেছে। অথচ তাঁর হাতঘড়ির কাঁটাগুলি স্বাভাবিক রয়েছে। সারারাত নীল আলোটা জ্বলে থাকার পর ভোরের দিকে নাকি নিভে যায়। হরিনারায়ণবাবু প্রাতঃভ্রমণে বেরনোর সময় ব্যাপারটা চাক্ষুষ করেছিলেন। তিনি ব্যাপারটা দেখে এতটাই ঘাবড়ে যান যে তক্ষুনি হাঁকডাক জুড়ে দেন। আলোটা অবশ্য বেশিক্ষণ ছিল না আর। কিন্তু আলোটা মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বেশ কয়েকজনের চোখে পড়ে। আর তার পর থেকেই সারা অঞ্চলে এই ব্যাপারটাকে নিয়ে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। 

ইছাপুর একটি ছোট গ্রাম। অথবা একে উন্নয়নশীল মফস্বলও বলা যেতে পারে। গ্রামে যেমন অল্প সংখ্যক পাকাবাড়ি রয়েছে তেমনই গ্রামে বিদ্যুৎও খুব বেশি জায়গায় পৌঁছায়নি। ফলে অন্ধকার নামলে রাস্তায় আলো প্রায় থাকে না বললেই চলে। যেকটি হাতে গোনা বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে সেখান থেকে কিছু আলো রাস্তায় এসে মাঝে মাঝে আলো-আঁধারীর পরিবেশ তৈরি করে।
সত্যপ্রকাশবাবু একজন অবসরপ্রাপ্ত ইসরোর বৈজ্ঞানিক। তিনি তাঁর প্রায় ত্রিশ বছর জীবনে কাজ নিয়ে এতটাই মশগুল ছিলেন যে বিয়ে-থা করেননি। অবসরের পর তিনি ইছাপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটেতে চলে আসেন। এখানে এসে দিনগুলি বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ করে যদি না এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলো শুরু হত।
গ্রামের লোকেরা ধরেই নিয়েছে এ নিশ্চয়ই কোনও অপদেবতার কাজ। সত্যপ্রকাশবাবুর সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। কেউ কেউ আবার এও বলছে হয়ত তাঁর পরপারে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। এগুলো তারই সংকেত। যারা দেখেনি তাঁরা আবার এই ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে।
রাতে তাঁর বাড়ির উপর আলো জ্বলে ওঠা এবং তার সাথে সাথেই তাঁর বাড়ির ঘড়ির কাঁটাগুলোর অদ্ভুত আচরণ করা ― তিনি নিজে বৈজ্ঞানিক হওয়া সত্ত্বেও কোনও ব্যাখ্যা পাচ্ছেন না, অথচ গ্রামের লোকেরা নিজেদের মতো করে এক একটা যুক্তি ও ব্যাখ্যা সাজিয়ে ফেলেছে।
সত্যপ্রকাশবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "আজ আর ভালো লাগছে না। আমি আসছি।"
হরিনারায়ণবাবু ও সমরেশবাবু কিছু বলার আগেই তিনি  বেরিয়ে গেলেন।

দুশ্চিন্তায় সারা দিনটা কেটে গেল তাঁর। একবার ভাবলেন এখান থেকে চলে যাওয়াটাই ভালো। কিন্তু পরক্ষনেই তাঁর মনে হল ব্যাপারটা না জেনে-বুঝে পালানোর কোনও মানে হয় না। তিনি ঠিক করলেন প্রফেসর বোসের সাথে তিনি এ বিষয়ে কথা বলবেন।

প্রোফেসর বোসের বাড়িটার গড়ন বেশ অদ্ভুত। দোতলা বাড়ি। স্টিল ও কোনও এক বেগুনি ধাতু দিয়ে নির্মিত। উপরে ছাদের বদলে রয়েছে অতিকায় এক গম্বুজ। দেখে মনে হতে পারে সেটা অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে নির্মিত। কিন্তু সেটার লালচে আভা দেখে বোঝাই যায় যে অন্য কোনও ধাতুও রয়েছে সেটাতে। আরও আজব ব্যাপার এই যে, মাঝে মাঝে ওই গম্বুজটা চাকার মত ঘোরে। এবং আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, এই বাড়ি নাকি প্রোফেসর নিজে তৈরী করেছেন। 
সত্যপ্রকাশবাবুর কাছ থেকে ব্যাপারটা শোনার পর প্রোফেসর বোস বললেন, "আপনি যেরকম বলছেন সেটা সত্যিই বেশ অদ্ভুত ব্যাপার। ঘড়ির কাঁটার অদ্ভুত আচরণ করার একটাই কারণ হতে পারে ― টাইম লুপ। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনার হাতঘড়ির কাঁটা স্বাভাবিক থাকছে কীভাবে?"
সত্যপ্রকাশবাবু মাথা নেড়ে বললেন, "আমি কিছু বুঝতে পারছি না প্রোফেসর। এই অদ্ভুত ব্যাপার যে কী কারণে ঘটতে পারে তা আমার ত্রিশ বছরের বৈজ্ঞানিক জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েও ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আর এটা এভাবে চলতে থাকলে আমি উন্মাদই হয়ে যাব।"
প্রোফেসর বোস বললেন, "আচ্ছা চলুন আপনাদের বাড়িতে গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসি। তবে আমার যাওয়ার ব্যাপারে গ্রামের কেউ যেন কিছু জানতে না পারে।"
সত্যপ্রকাশবাবু বললেন, "নিশ্চয়ই। আপনি আজ রাত সাতটা নাগাদ চলে আসুন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।"

সাতটা নয়, সাড়ে ছটা নাগাদ প্রোফেসর বোস চলে এলেন সত্যপ্রকাশবাবুর বাড়িতে। সত্যপ্রকাশবাবু বললেন, "আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বারোটা নাগাদ ব্যাপারটা শুরু হবে। আপনার কথামত ছাদের দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিয়েছি।"
রাত পৌনে বারোটা বাজতেই প্রোফেসর বললেন, "ছাদের দরজাটা খুলে দিন এবার। আমি ছাদে চলে যাচ্ছি। যায়নি আপনার ঘরে গিয়ে দেখুন ঠিক কোন সময়ে ঘড়ির কাঁটাগুলো অদ্ভুত আচরণ শুরু করছে।"
ছাদে গিয়ে প্রোফেসর বুঝতে পারলেন এখানে অন্তত পাঁচ-ছয় বছর কেউ আসেনি। পাশের নিমগাছের শুকনো পাতা পড়ে প্রায় পুরো ছাদ ঢেকে গিয়েছে। 
হঠাৎই তাঁর মাথার উপর শূন্যে একটি নীল আলো জ্বলে উঠল। ঘড়ি দেখলেন তিনি। বারোটা পাঁচ। 
তিনি ভালোভাবে আলোটাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। এটা আলেয়া নয়, কোনও আতশবাজিও নয়, হলোগ্রামও নয়। এটা অন্য কিছু। নীল আলোটা স্থিরভাবে শূন্যে ভেসে রয়েছে।

সত্যপ্রকাশবাবু বললেন, "বারোটা পাঁচ নাগাদ ঘড়ির কাঁটাগুলো অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে এবং ভোর পাঁচটা পঁয়ত্রিশ নাগাদ স্বাভাবিক হয়ে যায়।"
প্রোফেসর বোস বললেন, "নীল আলোটাও এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা প্রকট থাকছে। আপনার কি গত রাতেও শরীর হালকা লাগছিল?"
"না, গত দুদিন ধরে শরীর হালকা লাগছে না আর।"
প্রোফেসর বোস বললেন, "আচ্ছা। আপনি আগামী এক সপ্তাহ কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান। আমি আগামীকাল নাসা যাচ্ছি। প্রোফেসর স্মিথকে আমি ব্যাপারটা জানিয়েছিলাম। গত রাতের অভিজ্ঞতা শোনার পর তিনি আমাকে যত শীঘ্র সম্ভব ওয়াশিংটন ডিসিতে চলে আসতে বলেছেন। আমি না ফেরা পর্যন্ত আপনি ওই বাড়িতে ঢুকবেন না।"
প্রোফেসর বোস চলে যেতেই সত্যপ্রকাশবাবু বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। 
কী যে অদ্ভুত ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লেন তিনি!

প্রোফেসর স্মিথ নাসার একজন উচ্চপদস্থ বৈজ্ঞানিক। তিনি স্পেস টাইম ও অ্যান্টিম্যাটারের উপর গবেষণা করছেন। গত বছর ইজিপ্ট ভ্রমণে গিয়ে তিনি এক অদ্ভুত পাথরের সন্ধান পান। পাথরটাতে থেকে প্রায় অস্পষ্ট এক নীল আভা দেখা যাচ্ছিল। তিনি গ্লাভস পরে পাথরটা তুলতেই বুঝতে পারেন যে সেটা সাধারণ কোনও পাথর নয়। পাথরটাতে কিছু অদ্ভুত জ্যামিতিক চিহ্ন রয়েছে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার এই যে উত্তপ্ত বালির সমুদ্রে পড়ে থাকার পরও সেই পাথর বরফের মত ঠান্ডা। তিনি ঠিক করেন যে পাথরটাকে নিয়ে তিনি দেশে ফিরে টেস্ট করবেন। 
ওয়াশিংটন ডিসিতে নিয়ে এসে টেস্ট করার পর তিনি বুঝতে পারেন যে তার সন্দেহ অমূলক ছিল না। এই পাথরে পৃথিবীতে উপস্থিত কোনও জৈবিক, আধাতব বা ধাতব পদার্থের চিহ্নমাত্র নেই। এর উপাদান তাঁর সম্পূর্ণ অজানা। 
আরেকটি ব্যাপার তিনি খেয়াল করেন দুপুর একটা পঁয়ত্রিশ নাগাদ পাথরটির উপর শূন্যে একটি নীল আলো জ্বলে ওঠে। এবং সেটা প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা প্রকট হয়ে থাকার পর নীল আলোটা নিভে যায়। এবং এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা তাঁর দপ্তরের প্রত্যেকটি ঘড়ির কাঁটা বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। 
প্রোফেসর বোসের সাথে তাঁর আলাপ হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়া সায়েন্স কনফারেন্সে। প্রোফেসর বোস সেখানে তিনি অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি সংক্রান্ত একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এরপর তাঁদের মধ্যে বিস্তর চিঠি আদানপ্রদান হলেও সাক্ষাৎ করার অবকাশ হয়নি। কিন্তু হঠাৎই প্রোফেসর বোসের কাছ থেকে নীল আলোর ব্যাপারে জানতে পেরে তিনি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অর্থাৎ আরেকটি রহস্যময় পাথর কোনওভাবে ভারতে পৌঁছে গিয়েছে। 

প্রোফেসর বোস পরদিনই ওয়াশিংটন ডিসি চলে এলেন। প্রোফেসর স্মিথের বাড়িটা শহরের প্রান্তে। একটি বহুতল বাড়ির সপ্তম তলায় থাকেন তিনি। প্রোফেসর বোসকে তিনি স্বাগতম জানানোর পর বললেন, "এখন দশটা পঁচিশ। আপনি ঘন্টাদুয়েক বিশ্রাম নিয়ে নিন। তারপর আপনাকে এক অদ্ভুত জিনিস দেখাব। দেড়টা নাগাদ দেখা হবে।"
প্রোফেসর স্মিথের ল্যাবরেটরিটা বেশ বড়। বিভিন্ন কেমিক্যাল ও ইন্সট্রুমেন্ট থাকা সত্ত্বেও যেটা সবার প্রথমেই নজরে পড়ার মত সেটা একটি কাঁচের স্ল্যাবে রাখা একটি নীলাভ পাথর।
নিজের ডিজিটাল হাতঘড়ি দেখে প্রোফেসর স্মিথ "আর এক মিনিট" বলে ল্যাবের সমস্ত আলো নিভিয়ে একটি কম পাওয়ারের নিয়ন আলো জ্বালালেন।
এবং ঠিক তখনই পাথরটির উপর একটি নীল আলো জ্বলে উঠল। প্রোফেসর বোস ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন আলোটা যেন বেশ উজ্জ্বল। ঠিক যেরকম আলো ইছাপুরে দেখে এসেছেন তিনি এটাও সেরকমই। 
"কটা অবধি প্রকট থাকে এটা?" প্রোফেসর বোস জিজ্ঞেস করলেন। 
"প্রতিদিন দুপুর একটা পঁয়ত্রিশ থেকে রাত সাতটা পাঁচ পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকে এটা। আর এর সাথে ল্যাবের ঘড়িগুলোও অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। আমার মনে হয় এটা পার্থিব বস্তু নয়।"
"মানে আপনি বলতে চাইছেন এটি মহাজাগতিক কোনও বস্তু?"
"হ্যাঁ, তবে নিশ্চিত করে কিছু বলার আগে ভারতের ওই গ্রামের ভদ্রলোকের বাড়িতে যে পাথরটি পৌঁছেছে সেটি একবার টেস্ট করতে পারলে ভালো হয়।"
"আচ্ছা, আমি সত্যপ্রকাশবাবুকে ওটাকে খুঁজে পাঠিয়ে দিতে বলছি। তবে আমার মনে হচ্ছে না ওটা কোনও মহাজাগতিক বস্তু। পাথরটির উপর যে জ্যামিতিক চিহ্ন দেখেছি তার মধ্যে দুটি ইংলিশ বর্ণও যেন দেখতে পেয়েছি মনে হয়েছে আমার। আমি পাথরটাকে একটু টেস্ট করতে চাই। খুব বেশি সময় নেব না অবশ্য।"
"আচ্ছা। আমি তাহলে লাঞ্চটা সেরে আসি। আপনার খাবারও টেবিলে রয়েছে। আপনার টেস্ট করা হয়ে গেলে লাঞ্চ সেরে নেবেন।"
প্রোফেসর স্মিথ বেরিয়ে যাওয়ার আগে ল্যাবের আলোগুলি জ্বেলে দিলেন।

সত্যপ্রকাশবাবুকে লেখা চিঠির জবাব চলে এলো দুদিনের মধ্যেই। পাথরটা ছাদেই পাওয়া গিয়েছে। সেটা খোঁজার জন্য কয়েকজন লোককে নিযুক্ত করেছিলেন সত্যপ্রকাশবাবু। অত শুকনো পাতার সমুদ্রে একটা পাথর খুঁজে বের করা সত্যিই বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু সেটা খুঁজে বের করার পরই ঘটে অঘটন। একজন সেই পাথর তুলতে যেতেই লোকটির শরীরে বেশ অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা যায়। শরীরে লোমের আধিক্য বাড়তে থাকে, আঙুলের নখও বেশ বেড়ে যায়। পেছনে একটি লেজ উদয় হয়। এবং সবশেষে লোকটি একটি বনমানুষে পরিণত হয় ও ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায়। এই অদ্ভুত কান্ড ঘটে যাওয়ার পর কেউই আর ওই পাথরের কাছাকাছি থাকতে সাহস পাচ্ছে না। শেষে অনেক ভেবে সত্যপ্রকাশবাবু সাহস সঞ্চয় করে গ্লাভস পরে পাথরটা তুলে একটি স্টিলের জারে রেখেছেন। উনি সেটা যত শীঘ্র সম্ভব পাঠানোর বন্দোবস্ত করবেন।"
প্রোফেসর স্মিথকে বিষয়টা জানাতেই তিনি ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। 
বোঝাই গেল পাথরটার কীর্তিকলাপ শুনে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

প্রোফেসর বোস বললেন, "আপনার অনুমানই সঠিক। দুটো পাথরেই কোনও পার্থিব উপাদান নেই। তবে এগুলির উৎপত্তি পৃথিবীতেই।"
প্রোফেসর স্মিথ জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি যে ব্যাপারে নিশ্চিত?"
"হ্যাঁ। তবে এগুলির উৎপত্তি হয়েছে কমপক্ষে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। ক্রেটিসিয়াস যুগের শেষের দিকে।"
"ডাইনোসরের অবলুপ্তিও তো সেই সময়েই ঘটেছিল। তাই নয় কি?"
"হ্যাঁ। সেই সময় যে গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছিল খুব সম্ভবত সেটিই এই দুটি পাথরের উৎপত্তির কারণ। এবং এতে যে উপাদানগুলো রয়েছে সেগুলোও আমাদের কিছুটা চেনা। পৃথিবীতে শুধু এদের কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব। যদিও তা অস্থায়ী। এটা বিভিন্ন নোবল গ্যাসের ও কয়েকটি ধাতুর অজানা আইসোটোপের মিশ্রণ। এই মিশ্রণটি অস্থায়ী নয়। অথচ কৃত্রিমভাবে এটা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব কারণ এটা প্রস্তুত করা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ।"
"কিন্তু আসল ব্যাপারটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। একটা পাথর কিভাবে সময়ের চাকাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে কারওর বিবর্তনের ধারাকে বিপরীতমুখী করে ফেলতে পারে!"
"হুঁ। সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে সত্যপ্রকাশবাবুর আমাদেরকে আরও কিছু জানানোর বাকি আছে। আমাদের একবার ইছাপুর যাওয়া দরকার।"
প্রোফেসর স্মিথ বোধহয় মুখিয়েই ছিলেন। বললেন, "চলুন তাহলে আগামীকালই বেরনো যাক।"
তাঁদের কথা শেষ হতে না হতেই দেয়াল ঘড়ির কাঁটা বাঁদিক থেকে ডানদিক ও ডানদিক থেকে বাঁদিকে ঘুরতে লাগল। 
বোঝাই যাচ্ছে একটা পঁয়ত্রিশ বেজে গিয়েছে।

ইছাপুর পৌঁছে তারা সত্যপ্রকাশবাবুর বাড়িতে গিয়ে বুঝতে পারেন যে সত্যপ্রকাশবাবু বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। জিজ্ঞেস করাতে বোঝা গেল যে নীল আলোর উপদ্রব নাকি এখনও বন্ধ হয়নি। এখন সত্যপ্রকাশবাবুর মনেও কুসংস্কার দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তিনিও এখন ভাবছেন এ হয়ত কোনও অশুভ সংকেত। তাঁর হয়ত পরপারে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
"আপনি এখানে আসার আগে বাড়িটা কে দেখাশোনা করত?" প্রোফেসর স্মিথ সত্যপ্রকাশবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন।
"আমি এখানে আসার আগে হরিনারায়ণবাবু বাড়িটা দেখাশোনা করতেন।"
"হরিনারায়ণবাবু কে?"
"হরিনারায়ণবাবু আমার প্রতিবেশী। এই বাড়ির ডানদিকে তিনটে বাড়ির পর থাকেন তিনি।"
"আপনার অনুপস্থিতিতে এখানে হরিনারায়ণবাবু ছাড়া অন্য কারওর কি আসা যাওয়া সম্ভব?"
"আমি যতদিন এখানে ছিলাম না তখন যদি কেউ এসেও থাকে তাহলে তা নিশ্চয়ই হরিনারায়ণবাবু বলতে পারবেন।"
"শেষ প্রশ্ন, আপনার কি কোনও শত্রু রয়েছে এ গ্রামে?"
প্রোফেসর স্মিথের কাছ থেকে হঠাৎ এরকম প্রশ্ন যেন আশা করেননি সত্যপ্রকাশবাবু। তিনি একটু থেমে বললেন, "না। সেরকম কেউ তো নেই।"

"হরিনারায়ণবাবুর পুরো নাম হরিনারায়ণ সান্যাল। ওঁর এক ভাই ছিল যাঁর নাম রুদ্রনারায়ণ সান্যাল। তিনিও সত্যপ্রকাশবাবুর সাথেই কাজ করতেন ইসরোতে। সেখানে  স্পেস টাইম সম্বন্ধিত কোনও এক রিসার্চের উপর একসাথে কাজ করছিলেন তাঁরা। রুদ্রনারায়ণ-এর অনুপস্থিতিতে নাকি সত্যপ্রকাশবাবু রিসার্চটা তাঁর নিজের নামেই প্রকাশিত করেন। চার বছরের পরিশ্রমের পর এরকম ব্যাপার ঘটায় হতাশায় ভেঙে পড়েন রুদ্রনারায়ণবাবু। এর কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি আত্মহত্যা করেন। কিন্তু কোনও সুইসাইড নোট না পাওয়ার জন্য তাঁর আত্মহত্যার কারণ গ্রামের কেউ কিছু জানতে পারেনি। হরিনারায়ণবাবুও কিছু জানতেন না যে বিষয়ে। কিন্তু কয়েকমাস আগে তিনি তাঁর ভাইয়ের ঘর পরিষ্কার করার সময় রুদ্রনারায়নের ডায়রি পান। সেখান থেকেই বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। তাঁর মনে হয় সত্যপ্রকাশবাবুই তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এরপর তিনি ঠিক করেন তিনি তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা নেবেন।"

গতরাতে সত্যপ্রকাশবাবুর বাড়িতে হরিনারায়ণবাবু গোপনে প্রবেশ করেছিলেন। সত্যপ্রকাশবাবুকে ঘুমোনোর সময় ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষপ্রয়োগ করা এবং তাঁর মৃত্যুকে নীল সংকেতের মাধ্যমে অপদেবতার গ্রাস বলে চালিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু প্রোফেসর বোস ও প্রোফেসর স্মিথ হাতেনাতে ধরে ফেলেন তাঁকে। তাঁর কাছ থেকেই ব্যাপারটা জানতে পারেন তাঁরা।

  "তারপর তিনি হঠাৎই একদিন ভোরে প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার সময় গ্রামের পাশে প্রায় মজে যাওয়া একটি নদীর তীরে একটি নীলাভ পাথর খুঁজে পান। সেটার কিছু উপরে শূন্যে একটি নীল আলো জ্বলছিল। বিষয়টা দেখে তিনি বেশ হতচকিত হয়ে যান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আলোটা নিভে যেতেই তিনি পাথরটা তুলে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসেন। তিনি একটি মোটা দস্তানা ব্যবহার করেন যাতে তাঁর আঙুলের ছাপ পাথরটাতে না লেগে থাকে।
এরপর প্রতিদিনই একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নীল আলো জ্বলে উঠত। এবং তাঁর সাথে সাথেই তাঁর বাড়ির সমস্ত ঘড়ির কাঁটা অস্বাভাবিক আচরণ করত। তিনি ঠিক করেন পাথরটা সত্যপ্রকাশবাবুর বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাবেন। সত্যপ্রকাশবাবুর হার্টের ব্যামো রয়েছে। এই অদ্ভুত ব্যাপারের জন্য যদি তাঁর মৃত্যু হয় তাহলে সেটাকে গ্রামের লোকেরা অলৌকিক কোনও ব্যাপার বলেই ভেবে নেবে। তিনি সত্যপ্রকাশবাবুর ছাদে পাথরটা রাখলেন দুটো ব্যাপার ভেবে― পাথরটা চোখের সামনে থাকলে সত্যপ্রকাশবাবুর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ব্যাপারটা ধরে ফেলবে, এবং ছাদে নীল আলো শূন্যে ভেসে থাকতে দেখে গ্রামের লোকেরাও ব্যাপারটিকে অলৌকিক ঘটনা হিসেবেই ধরে নেবে।
তিনি একজন লোক লাগিয়ে সত্যপ্রকাশবাবুর বাড়ির সমস্ত ঘড়িগুলোর মধ্যে একটি করে শক্তিশালী তড়িৎচুম্বক বসিয়ে দেন। যার ফলে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যুৎযোগ করলে তড়িৎচুম্বক চালু হয়ে যায় এবং ঘড়ির মধ্যেকার স্টিলের কাঁটাগুলি পাগলের মত ডানদিক থেকে বাঁদিক ও বাঁদিক থেকে ডানদিকে ঘুরতে থাকে। বিদ্যুৎ-এর একটি লাইন বাড়ির পেছনে একটি সুইচের সাথে যুক্ত। নীল আলো প্রকট হওয়ার সাথে সাথে হরিনারায়ণবাবুর সেই লোক সুইচ অন করে চলে যায়। এবং সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে হরিনারায়ণবাবু সেটা অফ করেন। তবে যেদিন হরিনারায়ণবাবু নীল আলো দেখে চেঁচামেচির অভিনয় করেছিল সেদিন তাঁর লোকই সুইচটা অফ করেছিল। তাঁর ধারণা ছিল খুব বেশিদিন সত্যপ্রকাশবাবু ব্যাপারটা সহ্য করতে পারবেন না। 
কিন্তু বেশ কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর যখন তিনি জানতে পারেন যে সত্যপ্রকাশবাবু একজন বিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ করেছেন তখন তিনি নিজেই সত্যপ্রকাশবাবুর বাড়িতে মাঝরাতে ঢুকে পড়েন তাঁকে মারার জন্য। কিন্তু তিনি ভাবতেও পারেননি যে বিজ্ঞানী দুজন সেদিনই ইছাপুরে চলে আসবেন।"
এসব জানা গেল হরিনারায়ণবাবুর কাছ থেকে। 
সত্যপ্রকাশবাবু ও হরিনারায়ণবাবু দুজনেই চুপ করে রইলেন। সত্যপ্রকাশবাবুর কাছে বিষয়টা এখন দিনের আলোর মত স্পষ্ট। রুদ্রনারায়ণ যে হরিনারায়ণবাবুর ভাই তা তাঁর জানা ছিল না। 

"কিন্তু আসল ব্যাপারটাই তো বোঝা গেল না। ওই অদ্ভুত পাথর দুটি আলাদা দেশে উৎপত্তি হল কীভাবে?" প্রোফেসর স্মিথ জিজ্ঞেস করলেন।
"যদি প্রাকৃতিকভাবেই পাথরটি উৎপন্ন হয় তাহলে ঐ অঞ্চলে ওইরকম আরও পাথর পাওয়া যেত। এই দুটি পাথর কোনওভাবে ইজিপ্ট ও ইছাপুরে পৌঁছেছে। এছাড়া আমার অনুমানই সঠিক ― ওই দুটো পাথরে হুবহু একই জ্যামিতিক চিহ্ন ও দুটি ইংলিশ বর্ণ অঙ্কিত রয়েছে। সি.জে। আমার মনে হচ্ছে এই ইংলিশ বর্ণ খোদাই করা হয়েছে বছরখানেকের মধ্যে।"
"অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন এই সি.জে এই পাথরগুলো খুঁজে পেয়েছিল এবং তারপর সে এই পাথরের রহস্য উদ্ধার করে এবং সেই আনন্দে তাঁর নাম সংক্ষিপ্তভাবে পাথরে খোদাই করেছে?"
"ব্যাপারটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেরকমই তো মনে হচ্ছে।" প্রোফেসর বোস বললেন।
"কিন্তু এই সি.জের সন্ধান পাব কীভাবে? সে পৃথিবীর কোন প্রান্তে রয়েছে সে ব্যাপারে কিছুই তো জানিনা আমরা।"
"সেটা জানার একটা সহজ রাস্তা আছে তবে একটু জটিল। ইজিপ্ট ও কলকাতায় গত বছরের মধ্যে এই সি.জে যাওয়া-আসা করেছেন কিনা সেটা এয়ারপোর্ট অথরিটির কাছ থেকে নিশ্চয়ই জানা যাবে। আপনি ইজিপ্ট এয়ারপোর্ট অথরিটির সাথে কথা বলুন। আমি কলকাতা এয়ারপোর্ট অথরিটির সাথে কথা বলছি।"

"ক্রিস জর্ডন। পেশায় আর্কিওলজিস্ট। ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। বাড়ি নিউক্যাসলে। আগামীকালের এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। বিকেল পাঁচটায়।" প্রোফেসর স্মিথ বললেন।
"হুঁ। ইনিই কলকাতা এয়ারপোর্টে এসেছিলেন মাসতিনেক আগে।" প্রোফেসর বোস বললেন।

নিউক্যাসলে ক্রিস জর্ডনের বাড়ি খুঁজে বের করতে মোটেই 
অসুবিধা হল না। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেস লিমিটেড থেকে তাঁর ঠিকানা পাওয়া গেল। ক্রিস জর্ডনের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে পৌনে পাঁচটা বেজে গেল।
মি. জর্ডনের চেহারা দেখে তাঁর বয়স সম্পর্কে আন্দাজ করা কঠিন। তবে চল্লিশের বেশি নয় সেটা বোঝাই যাচ্ছে। প্রোফেসর বোসের একটা কেমন যেন খটকা লাগছে। ইনিই কি ক্রিস জর্ডন?
"এই পাথর দুটিতে কি আপনিই নিজের নাম খোদাই করেছেন?" প্রোফেসর স্মিথ জিজ্ঞেস করলেন।
"হ্যাঁ।" মি. জর্ডন উত্তর দিলেন।
"পাথরগুলো ইজিপ্ট আর ভারতে ফেলে এসেছিলেন কেন?"
"ফেলে আসিনি তো। ওগুলো তো আমি দুজনকে বিক্রি করেছিলাম।"
"কাদের কাছে বিক্রি করছেন?"
"ইজিপ্টে গিয়েছিলাম এক পুরনো শহর আবিষ্কৃত হওয়ার পর। খননকার্যের সময় একজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোক আমার কাছে নীলাভ পাথরটা দেখে বেশ আগ্রহী হয়ে পড়েন। তিনি পঞ্চাশ হাজার ডলার আমাকে অফার করেন। আমার টাকার প্রয়োজন ছিল। সেইজন্য তাঁকে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই।"
"আর ভারতে?"
"ভারতে ইছাপুরে গিয়েছিলাম একটা নদীর তীরে কয়েকটি মূর্তি খননের সময়। সেখানে ওখানকার একজনের পাথরটা খুব পছন্দ হয়।"
"এবং তাঁকেও আপনি পাথরটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন?"
"হ্যাঁ।"
"আশ্চর্য মানুষ আপনি!" বললেন প্রোফেসর স্মিথ, "এরকম দুর্লভ পাথর আপনি যাঁকে তাকে বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন?"
মি. জর্ডন ঠান্ডা গলায় বললেন, "এই পাথরগুলো আমার সম্পত্তি। আমি আপনাদের পরামর্শ শুনতে যাব কেন?"
প্রোফেসর বোস বললেন, "দেখুন মি. জর্ডন, আপনি বেশ ভালোভাবেই জানেন এই পাথরগুলো সাধারণ পাথর নয়। এর থেকে ―"
"ওহ। আপনারা তাহলে পাথরগুলোর ব্যাপারে জানেন।" মৃদু হাসলেন মি. জর্ডন, "তাহলে নিশ্চয়ই এও জানেন যে এটার স্পর্শে কি পরিণতি হতে পারে―"
কথা বলতে বলতে হঠাৎই টেবিল থেকে একটি নীলাভ পাথর তুলে ছুঁড়ে মারলেন প্রোফেসর বোসের দিকে। এবং প্রোফেসর বোস সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কিটব্যাগটি তুলে ধরতেই পাথরটি ব্যাগে লেগে মি. জর্ডনের দিকে ফেরত চলে গেল। এবং পাথরটি তাঁর হাতে লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীরে পরিবর্তন শুরু হল। আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন তিনি। মুখ দিয়ে চিৎকার করতে গিয়েছিলেন হয়ত― কিন্তু এক অদ্ভুত হিসহিস শব্দ ছাড়া আর কিছু বেরল না। তাঁর মাথাটি ক্রমশ বড় হতে শুরু করল এবং বাকি শরীরটি ক্রমশ রোগা হতে লাগল। চোখ দুটি বেশ বড় হয়ে গেল এবং কানের পর্দা উধাও হয়ে গেল। সবশেষে যে মি. জর্ডন যে প্রাণীতে পরিণত হলেন তাঁর সাথে স্টিভেন স্পিলবার্গের সিনেমার ভিনগ্রহী জীব ইটির আশ্চর্য মিল। তবে প্রাণীটি চুপ করে বসে তাঁদের দেখছে। হঠাৎই পাশের ঘর থেকে গোঙানির আওয়াজ পাওয়া গেল। দরজা খুলে যে প্রাণীটা বেরিয়ে এল সেটা তাঁদের দুজনেরই চেনা। বৈজ্ঞানিক ভাষায় যার নাম 'হোমো নিন্ডারথ্যালেনসিস' অর্থাৎ নিন্ডারথ্যাল, যা মানুষের বিবর্তনের প্রথম পর্যায়।
প্রোফেসর বোস ও প্রোফেসর স্মিথ বুঝতে পারলেন এই প্রাণীটি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। আদিম মানুষটি তাঁদের দিকে কিছুটা এগোতেই হঠাৎ বসে থাকা অদ্ভুত প্রাণীটির সাথে ধাক্কা লাগল এবং সেটি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। এবং দেখা গেল তাঁর শরীরের পরিবর্তন ঘটছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল একটি বয়স্ক মানুষ সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন।

"আচ্ছা। আপনিই তাহলে মি. ক্রিস জর্ডন?" প্রোফেসর স্মিথ জিজ্ঞেস করলেন।
"হ্যাঁ। যার সাথে আপনাদের দেখা হয়েছিল সে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। ব্যাটা টাকার লোভে দু-দুটো পাথর বিক্রি করে দিয়েছিল। পরে বাকীগুলোও বিক্রি করে দিত। ভাগ্যিস পাথরগুলো আপনারা পেয়েছিলেন।" মি. জর্ডন বললেন।
"এই পাথরগুলো কি সত্যিই বিবর্তন ঘটাতে পারে?" প্রোফেসর বোস জিগ্যেস করলেন।
"হ্যাঁ। আপনারা যেকোনও ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে পাথরগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পারবেন পাথরটির দুদিকে পজিটিভ ও নেগেটিভ প্রান্ত রয়েছে। নেগেটিভ প্রান্তে হাত লাগলে বিবর্তনের পিছনদিকে ও পজিটিভ প্রান্তে হাত লাগলে বিবর্তনের সামনের দিকে যাওয়া যায়।"
"এবং কোনও প্রান্তে হাত না লাগলে?" প্রোফেসর স্মিথ জিগ্যেস করলেন।
"সেক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না। তবে দুটো প্রান্তে একসাথে হাত লাগলে সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই ব্যাপারটি শুধুমাত্র প্রাণী ও উদ্ভিদের উপরই প্রযোজ্য। জড় পদার্থের উপর এই পাথর কোনও কাজ করে না।"
"এরকম অদ্ভুত পাথরের উৎপত্তি কীভাবে হল সে বিষয়ে আপনার কোনও থিওরি রয়েছে? আমার ধারণা এটি ক্রেটিসিয়াস যুগের শেষের দিকে কোনও অতিকায় মহাজাগতিক বস্তুর পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার ফলে উৎপন্ন হয়েছে। তবে এতে এই বিবর্তন ঘটানোর উন্নত প্রযুক্তি কীভাবে এলো সে বিষয়ে কোনও ধারণা আছে আপনার আশাকরি।" প্রোফেসর স্মিথ বললেন।
"হ্যাঁ। আপনার অনুমান সঠিক। পাথরটির উৎপত্তি ক্রেটিসিয়াস যুগের শেষের দিকে। তবে এতে কীভাবে এত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হল সে বিষয়ে আমার দুটি ধারণা রয়েছে। প্রথমত, পাথরগুলো পাওয়া গিয়েছিল উত্তর আমেরিকায়, মেক্সিকোতে একটি মায়ান পিরামিডের সামনে। অতএব এমনটা হতেই পারে যে এই উন্নত প্রযুক্তি মায়া সভ্যতার কীর্তি। মায়া সভ্যতা এখনকার তুলনায় বিজ্ঞানে যে কত অগ্রসর ছিল সেটা আশা করি আপনারা জানেন।
দ্বিতীয়ত, হয়ত পাথরগুলো ওই মহাজাগতিক বস্তু বা গ্রহাণুর সাথেই পৃথিবীতে এসেছিল। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হয় ওই উন্নত প্রযুক্তি অজানা কোনও ভিনগ্রহীদের কীর্তি।"
"পাথরটি থেকে বেরনো আলো ও তার সাথে ঘড়ির কাঁটার অস্বাভাবিক আচরণের কি ব্যাখ্যা দেবেন?" প্রোফেসর বোস জিগ্যেস করলেন।
"আমি ঠিক জানি না। হয়ত ওই আলোর মধ্যে কোনও গুপ্ত মেসেজ রয়েছে। বা হয়ত ওগুলো কোনও স্পেস ক্যাপসুল। যেগুলিতে হয়ত কোনও সাহায্যের মেসেজ রয়েছে। বা হয়ত সেটাতে কোনও ডেটা সংরক্ষিত রয়েছে। তবে সেটা খুঁজে বের করা এখনকার সর্বাধুনিক প্রযুক্তির দ্বারাতেও বোধহয় সম্ভবপর নয়।"
"আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টকে দেখেই আমার কেমন যেন একটা খটকা লেগেছিল। তখন ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। তবে এখন ব্যাপারটা বেশ বুঝতে পারছি।" প্রোফেসর বোস বললেন।
"কী?" মি. জর্ডন জিগ্যেস করলেন।
"আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেস লিমিটেডের রেকর্ডে আপনার ডেট অফ বার্থটা চোখে পড়ে গিয়েছিল। অবশ্য চোখে পড়ার কারণও ছিল। ১৯৪৭; ভারত স্বাধীন হয়েছিল সেই বছরে। সেই হিসেবে আপনার বয়স হওয়া উচিত ছিল চুয়াত্তর বছর। অথচ আপনার অ্যাসিস্ট্যান্টকে দেখে মোটেই চল্লিশ বছরের বেশি মনে হচ্ছিল না।"
"অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আপনার। ওই দুটো পাথর আপনারাই রেখে দিন। ওগুলোর রহস্য উদ্ধার আপনারাই করতে পারবেন আশাকরি। এখন এঁকে নিয়ে কি করা যায় বলুন তো?" মি. জর্ডন তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে তর্জনী নির্দেশ করে জিগ্যেস করলেন।
"এঁকে আমি নিয়ে যেতে পারি। ভবিষ্যতের মানুষের বুদ্ধি দিয়ে দেখি এই পাথরের রহস্য উদ্ধার করা যায় কিনা।" প্রোফেসর স্মিথ বললেন।
"ও কিন্তু ভীষণ ধূর্ত। বুদ্ধি বেড়ে যাওয়ার ফলে কিন্তু বেশ বিপদে পড়তে পারেন আপনি।" মি. জর্ডন বললেন।
"সে বিষয়ে আমি ভেবে রেখেছি। ওঁর বুদ্ধি আমি ব্যবহার করব ওঁরই মগজের কোষ থেকে একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বানানোর পর সেটার সাহায্য নিয়ে। তাতে কোনও ইমোশন থাকবে না। সুতরাং ব্যাটার জারিজুরি খাটবে না।"
"আমার শেষ একটা জিজ্ঞাস্য ছিল ― আপনি যখন বিবর্তনের উল্টো পথে হেঁটেছিলেন সেই সময়ের কোনও ঘটনা আপনার মনে আছে কি?"
"উঁহু। একটি নিন্ডারথ্যালের বুদ্ধি আমাদের তুলনায় অনেক কম। নিন্ডারথ্যালে রূপান্তরিত হওয়ার পর থেকে কিছু মনে নেই আমার।"
"এখন বোঝা যাচ্ছে ইজিপ্ট ও ভারতের ওই দুজন ব্যক্তি তাঁদের অসাবধানতার ফলে বিবর্তনের পথে নিশ্চয়ই এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে গিয়েছে।" প্রোফেসর বোস বললেন।
"ইজিপ্টে কয়েকমাস আগে একজন বিজ্ঞানী রহস্যময়ভাবে উধাও হয়েছিলেন সেটা খবরে দেখেছিলাম। এবং একটা রহস্যময় জন্তুকে নাকি বেশ কয়েক জায়গায় দেখা গিয়েছিল। ভারতের ওই লোকটিরও নিশ্চয়ই সেরকমই পরিণতি ঘটেছে।" প্রোফেসর স্মিথ বললেন।

সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে পড়ে থাকা পাথর, প্রোফেসর বোসের হাতের কাঁচের জারে থাকা দুটো পাথর এবং টেবিলে রাখা দুটি পাথরের থেকে কিছুটা উপরে শূন্যে পাঁচটি নীল আলো জ্বলে উঠল। 
মি. জর্ডনের অ্যাসিস্ট্যান্ট মি. ফ্লেমিং ধীরে ধীরে কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করলেন। প্রোফেসর বোসের মনে হল তিনি যেন বলছেন, "নীল আলো ভালো নয়।"
sav811998@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment