পথের পাঁচালী -এর উৎস সন্ধানে
সৌমিক ঘোষ
‘সাদা – কালো পটভূমিকায় দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুলের মাঝে ধাতব রেলপথ যেন সুদূরে মিলিয়ে গেছে । দূরে ধূসর সাদা আকাশের নীচে কয়েকটি মাত্র যাত্রীবাহী বগি নিয়ে একটা রেল ইঞ্জিন কালো ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে আসছে । এই যান্ত্রিক সৌন্দর্যে বিস্ময়ে মোহাবিষ্ট একটি ছোট্ট ছেলে আর একটি ছোট্ট মেয়ে ওই কাশফুলের মাঝখানে ছুটে এসে দাঁড়ায় । তাদের সামনে দিয়ে ঝম্ ঝম্ করে রেলগাড়ি নির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে যায়’ ।-------
১৯৫৫ সালের ২৬শে আগস্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পথের পাঁচালী’ ছায়াছবিতে প্রদর্শিত গ্রাম বাংলার প্রকৃতির বাস্তব উপস্থাপনা ছিল । ভারতের অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্রদ্ধেয় শ্রী সত্যজিত রায় দীর্ঘ তিন বছরের ইনডোর – আউটডোর শ্যুটিং-এ নির্মাণ সম্পূর্ণ করেন । স্বাধীন ভারতে ‘পথের পাঁচালী’ ছিল প্রথম চলচ্চিত্র
যা ১৯৫৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক স্তরে ১৯৫৬ সালে কান
চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল পুরস্কার লাভ করে । ১৯২৯ সালে পুস্তকাকারে
প্রকাশিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসে অপু ও দূর্গার ট্রেন দেখার জন্য
কাশফুলের মাঝে দৌড়ানোর কোনও উল্লেখ ছিল না । কিন্তু চলচ্চিত্রে এই অবিস্মরণীয়
দৃশ্যায়ন দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছে । যদিও পথের পাঁচালী ভারতীয় চলচ্চিত্র
ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি , তবু নানা বাধা ও পরিশ্রমের মাঝে এটি বাস্তবায়িত
হয়েছিল ।
কাশফুলের মাঝে অপু ও দূর্গার উপস্থিতির উৎস সন্ধানে ,- ঝাড়খন্ড রাজ্যের পূর্ব
সিংভূম জেলায় ,
সুবর্ণরেখা নদীর তীরে , ১০৩ মিটার (প্রায় ৩৩৮ফুট) গড় উচ্চতাবিশিষ্ট ঘাটশিলায়
যেতে হবে ।
কলকাতা থেকে সড়কপথে ২৪০ কিলোমিটার ও হাওড়া থেকে রেলপথে ২১৫ কিলোমিটার দূরে
ঘাটশিলা । স্টেশনের আশেপাশে হোটেল ও হলিডে হোমে থাকার ব্যবস্থা থাকলেও , পথের পাঁচালীর প্রাকৃতিক রহস্য সন্ধানে ‘দহিগোরা’ বা ‘মৌভান্ডার’ –এ আস্তানা
নিতে হবে । যে কোন সময়ে নয় , জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত । সুবর্ণরেখার
বিস্তৃতি ঘাটশিলা শহরকে বিভিন্ন দিকে ঘিরে রেখেছে । জনশ্রুতিতে সোনা পাওয়া যায়
নদীর তীরে ,- তাই নাম সুবর্ণরেখা । সেই সুবর্ণরেখার
ঘাটে বা তীরে নানা আকারের মসৃণ বাদামী , কালচে - খয়েরী , কালচে – সবুজ শিলা থাকার
জন্য ,- জায়গাটির নাম হয়েছে ‘ঘাটশিলা’ । নদীর তীরে বেড়ানোর মাঝে , এই লম্বাটে গোলাকার পাথরের টুকরোগুলি দেখে মনে হয় ,- অনেক হাতি পা মুড়ে বসে
বিশ্রাম নিচ্ছে । দহিগোরা থেকে অস্তগামী সূর্যের রঙে সুবর্ণরেখা নদীর কমলা – হলুদ
আভায় জলরাশির সৌন্দর্য অপরূপ ।
এই দহিগোরায় আছে লাল মাটির ঢালু ‘অপুর পথ’ । অপুর পথে বেশ কিছুটা হাঁটলে ‘অপুর
বাড়ি’ । সাধারণ গঠন কাঠামোর সাদা দেওয়াল ও টালির চালের বাড়িটিতে তিরিশের দশক থেকে
কখনও বিভূতিভূষণ এসে থাকতেন । সরকারী অনুদান নয় ,- সাধারণ মানুষের আর্থিক
সহযোগিতায় বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ চলে । দহিগোরাতে বর্ষাকালে সবুজ ঘাসের মাঝ রেল
লাইনের দুই পাশে ঘন কাশফুলের সমারোহ চোখে পড়ে । রেলপথের দুই ধারের জমি বেশ উঁচু ।
এখানে সড়ক পথের মাঝে রেল লাইন থাকায় ‘লেভেল ক্রসিং’ আছে । সব ট্রেন হর্ণ দিয়ে যায়
। অপুর বাড়ির খোলামেলা আঙ্গিনা থেকে সবুজ ঝোপঝাড়ে ভরা বিস্তীর্ণ প্রান্তরের প্রায়
আড়ালে থাকে রেল লাইন । এখনও মনে হয় কাশবনের ফাঁকে চলমান ট্রেন যেন হারিয়ে গেলো ।
কিন্তু ঢালু এই জমিতে দাঁড়িয়ে কয়েকটি মাত্র ট্রেনের যাতায়াত ও ইঞ্জিনের হর্নের
আওয়াজ শুনলেই – স্মৃতির পর্দায় অপু-দূর্গার সেই উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে আসার দৃশ্যটি যেন
দেখা যায় । এই জায়গার বিশেষ ঋতুকালীন স্নিগ্ধ প্রকৃতির রূপকে চলচ্চিত্রায়িত করতেই
উপন্যাসের সীমানা ছাড়িয়ে হয়তো সত্যজিত রায় ‘বোড়াল গ্রামে’ কাশফুলের মাঝে দৃশ্যটি
গ্রহণ করেছিলেন ।
এখনও ঘাটশিলার দহিগোরাতে এসে অপু-দূর্গার ‘সাদা-কালো’ স্মৃতি যেন রঙিন হয়ে ওঠে
।
soumikghosh57@gmail.com
স্রীরামপুর -হুগলী
No comments:
Post a Comment