অপ্রতিদ্বন্দ্বী
সত্যজিৎ
ড.অচিন্ত্যকুমার
মাইতি
ঊনবিংশ
ও বিংশ শতকে বাংলা সাহিত্য ও বঙ্গজীবনে
শিল্প সংস্কৃতির যে জোয়ার এসেছিল,তার নেপথ্যে যাঁদের উল্লেখযোগ্য
অবদান ছিল তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে ঠাকুর পরিবারের পর নাম করতে হয় কিশোরগঞ্জ জেলার
মসূয়ার রায়চৌধুরী (বা রায়
)পরিবারের।উপেন্দ্রকিশোর-কুলদারঞ্জন-প্রমদারঞ্জন-সুকুমার-সুবিনয়-এঁদের নিয়ে যে
বিশাল রায়চৌধুরী পরিবার গড়ে ওঠেছিল,সে পরিবারের সকল সদস্যই অসামান্য
প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।এঁদের মধ্যে কেউ লেখক,কেউ
চিত্রশিল্পী,কেউ
শিশু সাহিত্যিক,
কেউ সঙ্গীত শিল্পী, আবার কেউ
গীতিকার ছিলেন।
বাংলা শিশুসাহিত্যে উপেন্দ্রকিশোর এক কিংবদন্তী
লেখক।তাঁরই সাহচর্যে রায়চৌধুরী পরিবারে এক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল গড়ে
ওঠেছিল।সেই পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠতে ওঠতে তাঁর পুত্র-কন্যারাও সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত
হয়ে পড়েন।সুখলতা-পুণ্যলতা-শান্তিলতা-সুকুমার-সুবিনয়-সুবিমল সকলেই লেখালেখিতে
অভ্যস্ত ছিলেন।এঁদের মধ্যে জেষ্ঠ্যপুত্র সুকুমারের লেখনীতে একটা মৌলিকত্বের ছোঁয়া
থাকত।উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদনায় ১৯১৩ সালের এপ্রিল সর্বপ্রথম ছোটোদের জন্য এক
অনবদ্য পত্রিকা ‘সন্দেশ’ প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয়তে উপেন্দ্রকিশোর লিখলেন-‘ উহা
খাইতে ভাল লাগে,আর
উহাতে শরীরে বল হয়।আমাদের এই পত্রিকাখানি ‘সন্দেশ’নাম লইয়া সকলের নিকট উপস্হিত
হইতেছে,ইহাতেও
যদি এই দুটি গুণ থাকে,অর্থাৎ ইহা পড়িয়া যদি সকলের ভাল লাগে আর কিছু উপকার হয়,তবেই
ইহার ‘সন্দেশ’ নাম সার্থক হইবে’। পত্রিকাটি প্রকাশনার ফলে সেসময়ে বাংলা
শিশুসাহিত্যে এক বলিষ্ঠ দিক সূচিত হয়েছিল।
উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সম্পাদনার দায়িত্ব
আসে সুকুমারের ওপর।পিতার মতো তিনিও ভাল ছবি আঁকতেন।হাস্যরসাত্বক মজার মজার
ছড়া-কবিতা লিখতেন, শিশুদের খুব হ্রদয়গ্রাহী হত।ছড়া-কবিতাগুলোর মধ্যে
অন্তর্নিহিত থাকত গভীর অর্থ,এক নির্মম সত্য,লুকিয়ে
থাকত সমাজজীবনের এক বাস্তব চিত্র।‘আবল-তাবল’, ‘খাই
খাই’-এর মতো কাব্যগ্রন্থ,’হযবরল’-এর মতো কাহিনী,’রামধন
বধ’,’ঝালাপালা’, ‘লক্ষ্মণের
শক্তিশেল’,
‘অবাক জলপান’-এর মতো নাটকে সুকুমারের স্বকীয় প্রতিভার পরিচয়
পাওয়া যায়।ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে রায় পরিবারের যোগ-বন্ধন বহুকালের।উপেন্দ্রকিশোর
তাঁর প্রথমা কন্যা সুখলতার নাম রেখেছিলেন ‘হাসি’এবং প্রথম পুত্র সন্তান সুকুমারের
নাম রেখেছিলেন ‘তাতা’।এদুটি নামই রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি থেকে নেওয়া।ঠাকুর
পরিবারে পিতা উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে পুত্র
সুকুমারের যাতায়তের সুবাদে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।রবীন্দ্রনাথের
কাছ থেকে সুকুমার পেয়েছিলেন অকৃত্রিম স্নেহ।কবিগুরু শিলাইদহে তাঁর জরুরী কাজ
উপেক্ষা করে সুকুমারের সঙ্গে সুপ্রভার বিয়েতে অংশগ্রহণ করেন।কবিগুরু সুকুমারের
অধিকাংশ কাব্যগ্রন্থ,নাটক নিয়মিত পড়তেন।এমনকি কবিগুরুর জন্মদিনে সুকুমারের নাটক
বিশ্বভারতীতে মঞ্চস্থ হয়েছিল,মঞ্চায়নের দায়িত্বে ছিলেন স্বয়ং
সুকুমার।১৯৪০ সালের ১লা জুন কবিগুরু সুপ্রভাদেবীকে একটি চিঠিতে লেখেন- ‘সুকুমারের
লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা
২
অতুলনীয়।তাঁর সুনিপুণ
ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি,তাঁর ভাব সমাবেশের অভাবনীয়
অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে।...বঙ্গ সাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত
আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর
প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তাঁর ঠিক সমশ্রেণির রচনা দেখা যায় না।....’
মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে তাঁর জীবনদীপ নিভে যায়,পুত্র
সত্যজিতের বয়স তখন বছর আড়াই।কবিগুরু শোকাতুরা সুপ্রভাদেবীকে একটি গানের মাধ্যমে
সান্ত্বনা দিলেন-
শেষ নাহি যে,শেষ
কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিলে,
আগুন হয়ে জ্বলবে।
১৯২১ সালের ২রা মে কলকাতায়
জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ। একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে সুকুমার রায় এই আনন্দ সংবাদটা
জানিয়েছিলেন,
তিনি টেলিগ্রামটিতে লেখেন “KHOKA BORN LAST NIGHT. ALL
WELL.” মা সুপ্রভা ছেলের নাম দেন মানিক আর পিতা সুকুমার তাঁর নাম
দেন সত্যজিৎ।স্বামী সুকুমারের মৃত্যুর পর সুপ্রভাদেবীকে প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টের
ভিতর দিয়ে আড়াই বছরের শিশুকে লালন পালন করতে হয়। প্রথমেই তাঁদের ছাপাখানা হাতছাড়া
হয়ে যায়। আর্থিক অনটনের জন্য সুপ্রভাদেবী চলে আসেন তাঁর ভাইয়ের বাড়িতে। মামার আশ্রয়ে দৃঢ়চেতা মাতার তত্ত্বাবধানে
সত্যজিতের শৈশব-কৈশোর অতিবাহিত
হয়।প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর মায়ের কাছে। ১৯২৯ সালে ৮ বৎসর বয়সে সত্যজিৎ বালিগঞ্জ সরকারি
উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি ভর্তি হন কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রেসিডেন্সি কলেজে। সত্যজিৎ প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে
পড়েছিলেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। পড়তে চেয়েছিলেন ইংরেজি সাহিত্য, কিন্তু
শেষ পর্যন্ত বিষয় নির্বাচন করতে হয়েছিল পিতৃবন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের
পরামর্শে। পরবর্তীকালে এপ্রসঙ্গে নিজেই
বার বার বলেছেন,
অর্থনীতির ডিগ্রিটা তাঁর কোনও কাজেই আসেনি। এই সময়ে ইনি
পাশ্চাত্য চিরায়ত চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত নিয়ে এতটাই আগ্রহী হয়ে উঠেন যে, তাঁর
মূল পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৪০ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
থেকে অর্থনীতে বিএ অনার্স নিয়ে পাশ করেন। ১৯৪০ সালে সত্যজিতের মা তাঁকে
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
হবার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন এবং অবশেষে মায়ের ইচ্ছার জন্যই তিনি সেখানে
ভর্তি হন |
সত্যজিৎ প্রথমদিকে
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ সম্বন্ধে খুব উঁচু ধারণা পোষণ করতেন
না | কিন্তু
পরে, সেখানে
পড়াশোনা করার পর তাঁর এই ধারণা পুরোপুরি ভুল বলে প্রামণিত হয় | চারুশিল্পের মতো চিত্রকলা তাঁকে
বিশেষ টানত না । কলেজে পড়াকালীন বিজ্ঞাপনের খুঁটিনাটি নিয়ে কিছুটা আগ্রহ তৈরি
হয়েছিল,
ফলে চেয়েছিলেন কমার্শিয়াল আর্ট শিখতে। শান্তিনিকেতনে এ সব
শেখার সুযোগ ছিল না। তবু সত্যজিৎ শেখা শুরু করলেন নন্দলাল বসুর কাছে, আয়ত্ত
করলেন ছবি আঁকার প্রাথমিক
৩
কলাকৌশল।বিনোদবিহারী
মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিখলেন ক্যালিগ্রাফি।
তিনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেননি ।
১৯৪২ সাল। কলকাতায় জাপানি
বোমা পড়বে,
এই ভয়ে ফিরে আসেন
কলকাতার বাড়িতে এবং ১৯৪৩ সালে কলকাতায় ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘ডি জে
কিমারে’ মাত্র ৮০ টাকা বেতনের বিনিময়ে “জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার” হিসেবে কাজ করতে
শুরু করেন |বিজ্ঞাপনের
ভাষা ও ডিজাইনে তিনি নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত
কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসাবে তিনি বারবার তাঁর মৌলিকত্বের পরিচয় দেন।প্রায়
একই সময়ে তিনি বইয়ের প্রচ্ছদ এবং পত্রিকায় ছবি আঁকা শুরু করেন। সুধীন্দ্রনাথ
দত্তের কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ অঙ্কণের জন্য দিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রচ্ছদ
প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক পান।জীবনানন্দের রূপসী বাংলা,বনলতা
সেনের প্রচ্ছদ,বিভূতিভূষণের
‘আম
১৯৪৯ সালে সত্যজিৎ তাঁর দূরসম্পর্কের বোন ও বহু দিনের বান্ধবী
বিজয়া দাসকে বিবাহ করেন। বিজয়া দেবীই ছিলেন একমাত্র সঙ্গিনী যিনি সত্যজিতের সর্বদা পাশে থেকে তাঁকে উৎসাহ জুগিয়েছেন এবং সত্যজিতের
সিনেমাগুলোর উপযুক্ত সমালোচকের ভূমিকা নিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে কয়েকজন বন্ধুর
সহায়তায় গঠন করেন কলকাতা চলচ্চিত্র সংসদ। পরবর্তী বছরে তাঁর সুযোগ ঘটে ফরাসি
চলচ্চিত্রকার রেঁনোয়ার সঙ্গে পরিচিত
হওয়ার। রেঁনোয়া তাঁর পরিচালিত ‘দ্য রিভার’ ছবির কিছু অংশ কলকাতায় শুটিং করেন
এবং সত্যজিৎ তা মনোযোগ দিয়ে প্রত্যক্ষ করেন।সত্যজিতের আগ্রহ দেখে তাঁকে তিনি তাঁর
চলচ্চিত্র নির্মাণে সহকারী হিসাবে
নিয়েছিলেন । অনেকে মনে করেন, বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের
ক্ষেত্রে সত্যজিতের জীবনে রেঁনোয়ার ভুমিকা ছিল উল্লেখষোগ্য| তাঁর
কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন সিনেমা নির্মাণের সঠিক দিশা। এক সময় তিনি সিগনেট প্রেসে
বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইনের কাজ করতেন । তখনই হাতে পায় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের
পথের পাঁচালীর ছোটদের সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’।’আম আঁটির ভেঁপু’-র চিত্র অঙ্কণ
করতে গিয়ে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্রায়ণ করার ভাবনা তাঁর মাথায় প্রথম
আসে।প্রায় দশ হাজার টাকার বিনিময়ে
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা পত্নী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে
তিনি ‘পথের পাঁচালী’ গ্রন্থ স্বত্ত্ব কেনেন সিনেমা তৈরীর জন্য। বইটির চিত্রনাট্য
লিখে সুটিংপর্ব শুরু হল।অর্থের অভাবে সুটিং মাঝপথে থেমে যায়।মা সুপ্রভাদেবী হাল
ছাড়লেন না,ছুটে
গেলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে সরকারী আর্থিক সাহায্যের জন্য।আবার
শুরু হল ‘পথের পাঁচালি’-র সুটিং।অবশেষে ১৯৫৫ সালের ২৬ অগাস্ট কলকাতার সমস্ত সিনেমা
হলে ছবিটি মুক্তি পায়। সত্যজিতের চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে পথ চলা শুরু, তাঁকে
আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।একটা সিনেমা করেই
কেবল ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের বিভিন্ন
দেশে ছবিটি প্রদর্শন করে মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছিনিয়ে
৪
এনেছিল।তারপরের দুটি
চলচ্চিত্র ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ নিয়ে-এই তিনটি চলচ্চিত্র বিশ্বদরবারে ‘অপুর
ত্রিলজি’ নামে পরিচিত।‘অপরাজিত’ছবির সাফল্যই তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে এক বিশিষ্ট
জায়গা করে দিয়েছে।তিনিই সাদাকালো ছবিতে বাংলা সিনেমার নতুন প্রেক্ষাপট রচনা
করেছিলেন।তাঁর হাত ধরেই বাংলা সিনেমায় প্রথম রঙীন বাংলা ছবি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র
সৃষ্টি।সাঁইত্রিশ বছরের কর্মময় জীবনে চিত্রপরিচালক হিসাবে তাঁর অনবদ্য অবদান ৩৬টি
ছবি, এদের
মধ্যে ২৯টি পূর্ণদৈর্ঘের,৫টি তথ্যচিত্র ও ২টি স্বল্প
দৈর্ঘের ছবি।তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- পরশপাথর (১৯৫৭), জলসাঘর
(১৯৫৮),
অপুর সংসার (১৯৫৯), দেবী
(১৯৬০),
তিন কন্যা (১৯৬১), কাঞ্চনজঙ্ঘা (১৯৬২), অভিযান
(১৯৬২),
মহানগর (১৯৬৩), চারুলতা (১৯৬৪), কাপুরুষ
ও মহাপুরুষ (১৯৬৫), নায়ক (১৯৬৬), চিড়িয়াখানা (১৯৬৭), গুপী
গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৯), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), প্রতিদ্বন্দ্বী
(১৯৭০),
সিকিম (১৯৭১), সীমাবদ্ধ (১৯৭১), অশনি
সংকেত (১৯৭৩),
সোনার কেলা (১৯৭৪), জন অরণ্য
(১৯৭৫), শতরঞ্জ কি খিলাড়ি (১৯৭৭), হীরক
রাজার দেশে (১৯৮০), পিকু (১৯৮২), সদগতি (১৯৮২), ঘরে
বাইরে (১৯৮৪), গণশত্রু (১৯৮৯), শাখা
প্রশাখা (১৯৯০),
আগন্তুক (১৯৯১)। এছাড়াও তিনি বহু ছবির চিত্রনাট্য রচনা ও
সঙ্গীত পরিচালনা করেন। কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি গানও লিখেছেন।‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’
ও ‘হীরক রাজার দেশে’-এর গানগুলো তাঁর অমর সৃষ্টি।‘মহারাজ তোমারে সেলাম’ ও ‘আহা কী
আনন্দ আকাশে বাতাসে’ আজও বাঙ্গালির মুখে মুখে উচ্চারিত হয়।
শুধু চলচ্চিত্রই নয়।
সাহিত্য জগতেও তাঁর অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।সত্যজিতের সব থেকে প্রাপ্তি
পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর ও পিতা সুকুমারের তৈরি করা সাহিত্য ঘরানা। শিশু ও কিশোরদের
জন্য তিনি সৃষ্টি করে গেছেন অসংখ্য ছোটো গল্প। কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লেখা তাঁর গল্প
গুলো পাঠক হৃদয়ে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। তাঁর সৃষ্টি ‘ফেলুদা’, ‘প্রফেসর
শঙ্কু’,
‘তারিণী খুড়ো’ – এর মতো সৃষ্ট অনবদ্য চরিত্রগুলি বাঙালির
মনে আজীবন গাঁথা থাকবে। ফেলুদাকাহিনীর আসল বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়
সামগ্রিক কাহিনীর একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছে চুরিধরা বা চোরধরাকে কেন্দ্র
করে।উদাহরণস্বরূপ, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘গোলাপী মুক্ত রহস্য’, ‘শেয়াল
দেবতা রহস্য’,
‘কৈলাশে কেলেঙ্কারী’, ‘গোলকধাম
রহস্য’,
‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’, ‘গোরস্থানে
সাবধান’ – প্রতিটি কাহিনী গড়ে ওঠেছে চোরধরাকে নিয়ে,কিন্তু
কোনোটির ভাবনার সাথে অপরটির ভাবনার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।পিতা সুকুমারের
সম্পদনায় ‘সন্দেশ’ নিয়মিতভাবে বেশ কয়েক বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায়।১৯৬১ সালে, রবীন্দ্র
শতবর্ষে সত্যজিতের উদ্যোগে ‘সন্দেশ’ আবার প্রকাশিত হয়।পুনঃপ্রকাশিত ‘সন্দেশ’-এর
সূচনাপর্বে সত্যজিৎ লিখলেন-‘পাগলা গোরু সামলানো যা ঝক্কি/আমার শুনবে কোনো লোক কী?/কাছে
যখন পড়বে এসে /বলবে তারে মিষ্টি হেসে,/ ‘আমার ওপর রাগ কোরো না
লক্ষ্মী’।সম্পাদনাকার্যে সত্যজিতের সঙ্গী হলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
৫
সত্যজিৎ তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে অজস্র সম্মান
ও পুরস্কার পেয়েছেন। ভারত সরকারের কাছ থেকে ৪০টি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৬০টি
পুরস্কার লাভ করেন। এসবের মধ্যে রয়েছে দেশ-বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি
ডক্টরেট ডিগ্রি,
বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, ১৯৮৪ সালে
ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার, ‘ম্যাগসেসে(Magsaysay)’ পুরস্কার, ১৯৮৭
সালে ফ্রান্সের ‘লিজিয়ন অব অনার’ , ১৯৯২ সালে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক
সম্মান ‘ভারতরত্ন’ ইত্যাদি।
১৯৯২ সালের এপ্রিল হৃদরোগে
আক্রান্ত হয়ে সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি
হন।অস্কারের ইতিহাসে নিয়ম বদলে যায় শুধু তাঁর জন্যই। অসুস্থতার জন্য পুরস্কার নিতে
যেতে পারেননি তিনি। অস্কার কমিটি এগিয়ে এসেছিলো তাঁকে সম্মানিত করতে। মৃত্যুর কিছু
সপ্তাহ আগে হাসপাতালে অত্যন্ত অসুস্থ ও শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি তাঁর জীবনের শেষ
পুরস্কার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড‘অনারারি অস্কার’ গ্রহণ করেন। ১৯৯২
সালের ২৩ এপ্রিল এহেন প্রবাদ পুরুষের জীবনাবসান ঘটে।
একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র
নির্মাতার পাশাপাশি চিত্রনাট্যকার,শিল্প নির্দেশক,গীতিকার,সঙ্গীত
পরিচালক,সুসাহিত্যিক, সুদক্ষ
গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসাবে সত্যজিতের
চরিত্রে এতগুলো গুণের সমন্বয় বিশ্বে বিরল এবং সেকারণেই তিনি ভারতবর্ষ তথা বিশ্বে
অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক হিসাবে চিরদিন চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।২০০৪ সালে বিবিসির
‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ তালিকাতে সত্যজিৎকে ১৩তম স্থানে রাখা হয়েছে।এ কথা
নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রামমোহনে শুরু হয়ে রবীন্দ্রনাথের
সান্নিধ্যে উৎকর্ষ লাভ করে বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল তার শেষতম অধ্যায় হল
সত্যজিতের বহুমুখী প্রতিভা।
তথ্যঋণ: ১) আত্মবিকাশ,সাহিত্য
পত্রিকা,তৃতীয়
বর্ষ:প্রথম সংখ্যা,মার্চ ২০১১
২)উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী:
লীলা মজুমদার.
akmaity2012@gmail.com
বেলকুলাই,হাওড়া
No comments:
Post a Comment