ছবি : ইন্টারনেট |
স্বপ্ন
অরুণা চক্রবর্তী
"স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন --- স্বপ্ন দেখে মন ", মনের অতলে যে চুপটি করে ঘাপটি মেরে বসে থাকে --অবচেতন স্তরে; দিনের বেলা সেই ঘটনাগুলোর সাথে তাল মেল করে নিশুত রাতে হানা দেয় চোখের পাতায়, ঘুমের দেশে।নচিকেতার গানের এই কথাটা খুব সত্যি ----মন স্বপ্ন দেখে!
কদিন ধরেই বাক্স প্যাটরা বাধা হচ্ছে ।মা-বাবা ভাই তিনজন মিলে দায়িত্ব নিয়ে করছে ।ওদিকে দিদির মুম্বাই থেকে ঘন ঘন ভিডিও কল হচ্ছে। এটা ভুলো না দিতে,ওটা ভুলো না দিতে;তার সাথে উপদেশ "এটা করবি না ,ওটা করবি না" যেন কোন ছোট বাচ্চা চলেছে যুদ্ধে দূর দেশে! কিন্তু কোথায় ?সে মনে করতে পারছে না ।সে তো চাকরি করতে চলেছে। মা কুলের আচার, আমের হিঙের আচার থেকে আরম্ভ করে নারকোলের নাড়ু দিয়ে ছোট ছোট কাচের অনেকগুলো বয়াম ভরেছে। বিরাট লট বহর নিয়ে যখন এয়ারপোর্ট চেকিং-এ পৌঁছল তখন মাথায় হাত। তার জিনিসপত্রের ওজন নির্ধারিত ওজনের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। কী আর করে, গজ গজ করতে করতে তাকে বেশ মোটা টাকা দক্ষিণা গুনতে হল নিজের পকেট থেকে!
প্লেন উড়ে চলল মেঘের দেশ দিয়ে। সাদা সাদা তুলোর পাহাড়ের মত মেঘ ,স্বচ্ছ কাঁচের মত ঝকঝকে গাড় নীল আকাশ--- তার মধ্য দিয়ে ভেলায় ভাসতে ভাসতে চলেছে সে।মাঝে রোদের কিরণ জানালার কাঁচ ভেদ করে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে
"মেঘের ভেলা, আকাশ নীলা;
রোদের কিরণ ,হৃদয় হরন ;
ভাসিয়ে নিয়ে আকাশ পথে ;
চলেছে সে যে সপ্তাশ্বের রথে"...ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেল সে এক অচিন দেশে ।চারিদিক নিস্তব্ধ ফাঁকা রাস্তাঘাট, কী সুন্দর বাড়ি ঘর ফুলে ফুলে সাজানো। অনতি দূরে ছোট পাহাড়ের সারি ঘিরে রেখেছে জায়গাটিকে আর সে চলেছে তার লট বহর নিয়ে। চলছে তো চলছেই। বিরাট এক বাগানের মধ্যে দিয়ে চলেছে সে-- দুই দিকে লাল গোলাপি সাদা হলুদ কত শত রঙের টিউলিপ ফুল । ফুলের বাগান পেরিয়ে একটি বিশাল দীঘি -- দীঘি না বলে ছোট হ্রদ বললেও অত্যুক্তি হবে না। তার মাঝখানে দূরে দেখতে পাচ্ছে ছোট সবুজ মত জায়গা গাছ গাছালি ভরা।কিছু ঘরও দেখতে পাচ্ছে। গাড়ি থেকে সব লট বহর নিয়ে একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকো নিয়ে চলল সে ওখানে । নৌকোর মাঝি মাথায় চোঙা মতো টুপি পরে নৌকো বাইছে। তাঁর থুতনিতে অল্প লাল দাড়ি,পোষাকও কেমন অন্যরকম ।গান গাইছে অদ্ভুত সুরে ---তার ভাষাও বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু কী যেন মাদকতা আছে সুরে!
সূর্য প্রায় ঢলে এসেছে ।পাখির দলেরা দল বেঁধে চলেছে নিজেদের কুলায়। চারিদিক নিশ্চুপ শুধু নৌকোর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর গুনগুন করে অচেনা ভাষায় অদ্ভুত মিষ্টি সুরের মাঝির গান, কেমন যেন স্বর্গীয় মনে হচ্ছিল তার ।আচ্ছা স্বর্গ কি আরো সুন্দর? আরো ভালো জায়গা ?এটা কি স্বপ্ন না সত্যি! ওর হৈমন্তী শুক্লার গানের কলি মনে পড়ল ..."অস্ত সূর্য আকাশে এঁকেছে ছবি ,কোন প্রেরণায় মন হয়ে গেছে কবি। মুগ্ধ দুচোখ স্তব্ধ হৃদয় ,সময় তো গেছে থামি ।এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি ,মাটিতে যে আজ স্বর্গ এসেছে নামি!" সত্যি স্বর্গ এখানেই যেন মাটিতে নেমে এসেছে আর সময়ও থমকে গেছে!
ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং মোবাইলের তীব্র রিংটোনে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল ।বিরক্ত হয়ে ওঠে টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে কানে দিতেই রনিতার ঝাঁঝালো গলা শুনতে পেল,"তুই ঘুমিয়েই থাক কুম্ভকর্ণ ,তখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি তোকে । এখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে!"একটু দম নিয়ে বলল ,"শোন আমরা কাশ্মীর যাচ্ছি, কাল সকালেই ফ্লাইট , তাই তৈরি হয়ে নে... আমি ট্রাভেল এজেন্সি কে সব পেমেন্ট করে দিয়েছি ।এখন আমরা ওখানে টিউলিপ গার্ডেন দেখব বুঝলি ,এই সময় টিউলিপ হয়। আমরা ডাল লেকে হাউসবোটে থাকবো, শিকারা করে প্রায় তিন কিলোমিটার গিয়ে ওখানে পৌঁছাতে হয়."... আমার কানে ঝাপসা হয়ে এল ওর কথা---নিজের মনেই ডুবে গেলাম।
আচ্ছা ---আমি কি এটারই স্বপ্ন দেখছিলাম! কোথায় ছিলাম !বাবা-মা.. সেই ছোটবেলা বড় বেলা যেন সব একাকার হয়ে গেছে স্বপ্নে! আর সেই স্বপ্ন থেকে কিছু টুকরো টুকরো চেনা ছবি বাস্তবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে যেন..
-জাগিয়ে রাখে মোরে,
জলজ্যান্ত বাস্তব সে যে---
পার্থিব পটভূমিকায়
নিয়ত সংগঠিত হবার চেষ্টায়
অবিরত চিন্তার আলতো ছোঁয়ায় পায় যে প্রাণ
স্বপ্ন বাস্তব মিলেমিশে নতুন আখ্যান।...
ড্রয়িং রুমে সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভিতে
টিউলিপ গার্ডেনের খবর দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম ।
মোবাইলে হৈমন্তী শুক্লার "এমন স্বপ্ন..." গানটা চালিয়ে তোরঙ্গ থেকে শীতের জামা কাপড় বের করে ব্যাগ গোছাতে বসলাম। কাল সকালেই যে ফ্লাইট---!
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment