1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

হৃদস্পন্দন

ছবি  : ইন্টারনেট 


হৃদস্পন্দন

সংঘমিত্রা রায় 

এক

  “ এটা আপনার প্রথম ইস্যু এরকম ডিসিশন নেওয়ার কারণ কি ?” 

 “ আসলে আমি জীবনটাকে এনজয় করতে চাই তাই এতো তাড়াতাড়ি ঝামেলায় জড়াতে চাই না !”

  “  প্রটেকশন নিতে পারতেন এখন তো কত ধরনের সুবিধা আছে । তাহলে  তো আর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হত না !“ 

  “ আসলে এত তাড়াতাড়ি  এরকম হবে ততটা বুঝতে পারিনি না হলে প্রটেকশন নিতাম সেটাই আমার ভুল হয়েছে । এবারের কাজটা হয়ে গেলে বুঝে শুনে  চলব  আর এরকম সিচুয়েশনে পড়তে হবে না । আপনি এবার কাজটা করে দিন যত টাকা লাগে আমি দেব । “

  “ টাকার ব্যাপার নয় আসলে আমি এরকম কাজ করি না ! “

  “ প্লিজ  ম্যাডাম  এবারের মতো উদ্ধার করুন ।  আমি এখন অন্য কোথাও যেতে পারব না । নইলে কোন নার্সিং হোমে করিয়ে নিতাম ।“   

  ‘’ ঠিক আছে আপনার অনুরোধে  না হয় করব কিন্তু আপনার এমন সিদ্ধান্তের কথা আপনার স্বামী  জানেন ?”  

    “ এখনও জানে না তবে আমি ওকে বলব । আমার ডিসিশনের উপর ও কিছু বলবে না !“ 

   “ বেশ আপনি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তাহলে আর কি করা যাবে। তবে আমি কাজটা দুদিন পর করতে চাই । তার আগে আমার একটা শর্ত আছে ! “

  “ দুদিন পর হলে দেরী হয়ে যাবে না তো মনে হচ্ছে তিন  মাস হয়ে গেছে  আমি আগে খেয়াল করিনি !  বেশ বলুন আপনার কি শর্ত । এখানে তো আর কাউকে পাব না তাই আপনার শর্ত মানতে  হবে ! “

   “ আমার লেখা বই  আপনাকে পড়তে দিলাম ওটা পড়ে দুদিন পর আসুন কাজটা হয়ে যাবে । “

   “ আপনি আবার বই লেখেন নাকি কত গুন আপনার !  আমার আবার বই পড়তে খুব একটা ভালো লাগে না । বইটা কোন ভাষায় লেখা ?”

   “ কেন বাংলায় আপনি পড়তে পারেন না ?” 

   “ পারি কিন্তু আমার কাজের সঙ্গে আপনার বই পড়ার কি সম্পর্ক বুঝলাম না ! “

   “ আসলে আপনার মতো যারা এখানে আসে তাদের আমি এই বইটা পড়তে দিই । “

  “ বেশ বইটা  দিন পড়ে আসি  দেখি কি লেখা আছে বইয়ে ?“

   “ সেটা আপনাকে পড়ে জানতে হবে !” 

    বর্ধমানের  তালপুকুর  গ্রামীণ হাসপাতালের  ডাক্তার  সোমজা লাহিড়ীর বয়স প্রায় পঞ্চাশ এর কাছাকাছি হবে । উনার বর পার্থসারথি  লাহিড়ীও  এই হাসপাতালের ডাক্তার । উনার বয়স বাহান্ন  এর কাছাকাছি হবে । এই নিঃসন্তান ডাক্তার  দম্পতি না থাকলে এখানকার মানুষ কক্ষনও ভালো চিকিৎসা পেত না । গ্রামের হাসপাতালে  শহরের পাশ করা ডাক্তার  কেউ এসে থাকতে চায় না । সরকারের তরফ  থেকে কাউকে এখানে পাঠালেও চলে যায় কিছুদিন পর । কিন্তু গত দশ বছর ধরে এই হাসপাতালকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন এই  দম্পতি  । উনারা আসার পর থেকে এখানকার  লোকেদের  কঠিন রোগ না হলে বাইরে কোথাও যেতে হয় না । তালপুকুর সহ আশেপাশের গ্রামের লোকেরা সবাই উনাদের খুব ভালোবাসে , শ্রদ্ধা করে ।

      আহেলি   ফরেস্ট  অফিসারের  অনিকেত  চক্রবর্তীর    স্ত্রী । তালপুকুর গ্রামের  পাশেই ফরেস্ট বাংলাতে  ওরা  থাকে । পাঁচ বছর ভালোবাসার পর দুই  পরিবারের ইচ্ছেতেই তাদের ধুমধাম করে বিয়ে হয়। দুজনের বাড়ি কলকাতাতেই চাকরির জন্যই এখানে তাদের আসা । ওদের বিয়ের  পাঁচ মাস হয়েছে  এর মধ্যেই আহেলি কনসিভ  করেছে। ওর তিন  মাস  চলছে কিন্তু আহেলি  এখনই বাচ্চা নিতে চায় না । বাবা মায়ের একমাত্র আদুরে সুন্দরী  মেয়ে সে , খুব স্মার্ট আর আধুনিকা ।    ছোট থেকেই  প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হয়েছে সে যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে  আর কিছু না পেলেই ওর জেদ বেড়ে যায় । আহেলি  সারাক্ষণ আমোদ প্রমোদ , হৈ হুল্লোড়  করতেই ভালোবাসে ।  তাই ভালোবাসতেও এমন একজনকে  ভালোবেসেছে যার সঙ্গে সে আমোদ প্রমোদ করেই জীবন কাটাতে পারবে । অনিকেত  বাবা মায়ের একমাত্র  ছেলে তার বাবা ,মা দুজনেই উঁচু পদে সরকারী   চাকরি করতেন প্রচুর টাকা উনাদের । অনিকেত যে  চাকরী পেয়েছে তাতে প্রচুর কালো টাকা রোজগার করে আহেলী যেমন খুশী তেমন করে চলতে পারবে । আহেলি এখনও বিয়ের আগের মতো চলাফেরা করে ,খুব ছোট পোশাকে ঘুরে বেড়ায় , শাখা – সিঁদুর কিছুই পড়ে না ,ওর যখন যা মন চায় তাই করে তাকে কেউ বাধা দেয় না ।  বিয়ের পর ওরা কাশ্মীর ঘুরে এসেছে কিন্তু আহেলির ইচ্ছে সে  ইউরোপের কোন জায়গায় যাবে  অনিকেতকে নিয়ে।  অনিকেত  ছুটি পায়নি তাই যেতে পারছে না । কিন্তু এর মধ্যে আহেলি  কনসিভ  করায় মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে আহেলির সে এখনই  বাচ্চার কথা ভাবতে চায় না । কয়েক বছর  এনজয় করে তারপর এসব নিয়ে ভাববে ! 

   আহেলি কথাটা কাউকে না জানিয়ে চুপি চুপি  ঝামেলা শেষ করে ফেলতে চায় । অনিকেত , আহেলির  বাবা , মা , শ্বশুর ,শাশুড়ি কেউ জানতে পারলে হয়ত বাচ্চাটা রাখার জন্য অনুরোধ  করবে । তাই আহেলি খোঁজ নিয়ে জেনেছে  সোমজা  লাহিড়ী খুব ভালো গায়নোকলোজিষ্ট । তাই সে চুপিচুপি তাঁর কাছেই এসেছে বাচ্চাটা নষ্ট করার জন্য ! অনিকেত  অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে সে এই ব্যাপার সে বুঝতেই পারবে না  । 

   আহেলী বইটা নিয়ে বাংলায় ফিরে এল  । বাংলাতে কাজের লোকেরা সব কাজ করে তার কোন কাজ নেই । সে অনেক বেলা অবধি ঘুমিয়ে , টিঁভি দেখে ,ফেসবুক নিয়ে মেতে থাকে , বন্ধুদের সংগে ফোনে কথা বলে সময় কাটায় । মাঝে মাঝে অনিকেতের কলিগদের স্ত্রীদের সংগে আড্ডা দিতেও যায় ,কিটি পার্টি করে ,কখনও কখনও গাড়ি নিয়ে লঙ  ড্রাইভে যায়।  এসব করেই তার সময় কাটে ।

   আষাঢ় মাসের দুপুরবেলা । আহেলী  সোমজা  লাহিড়ীর ওখান থেকে আসার পরই বেশ জাঁকিয়ে বৃষ্টি  নেমেছে । বাংলায় কাজের লোক দুজন ছাড়া আর কেউ নেই । আহেলী ব্যালকনিতে  এসে দোলনায় বসল । বাংলার আশেপাশে প্রচুর ছোট, বড় গাছ । বৃষ্টিতে গাছ গুলো দুলছে নানা ভাবে মনে হচ্ছে তারা বিভিন্ন ভঙ্গিতে নৃত্য করছে ।  বৃষ্টি কিছুটা ব্যালকনির  দিকে ছিটিয়ে ছিটিয়ে ঢুকছে আহেলির পায়ের কাছ অবধি!   বেশ ভালো লাগছে তার একা একা বসে বেশ রোম্যান্টিক হয়ে পড়েছে ভাবছে এখন যদি  অনিকেত  বাংলায় থাকত তাহলে দুজনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজত  একা একা ভিজতে তার মন চাইছে না ।

   রঘু এসে তাকে কফি দিয়ে গেছে । দোলনায় বসে কফি খেতে খেতে আহেলী ফোন টিপছিল । কিন্তু এরপরই  তার মনে পড়ল সোমজা লাহিড়ী তাকে বইটা পড়ে দুদিন পর যেতে বলেছেন কি লেখা আছে ঐ বইটাতে ! কৌতূহল হল তার তাই ঘরে গিয়ে বইটা নিয়ে এল পড়ে দেখতে হবে কি লেখা আছে বইটিতে ! 

দুই 

    বইটা খুব একটা বড় নয়  । আহেলি বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকে । ভাবল  কি আশ্চর্য  ব্যাপার না সে গেল  এবরশন করতে আর ডাক্তার তাকে  বইটা পড়ে দুদিন পর যেতে বলল !  এমন কাণ্ড সে বাপের জন্মেও শুনেনি !  যাই হোক আহেলি  বইপত্র খুব একটা পড়ে না তার ভালো লাগে  না সে সবসময় পার্টি ,বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ,হৈ  হুল্লোড় , ঘুরে বেড়ানো এসব করতেই ভালোবাসে । কোথা থেকে বাচ্চার ঝামেলা শুরু হয়ে গেল তাড়াতাড়ি এই ঝামেলা তাড়াতাড়ি  শেষ করতে হবে । তারপর অনিকেতকে নিয়ে ইউরোপ ঘুরে আসবে ।  কিন্তু এখানে বাচ্চার ঝামেলা মেটাতে হলে তাকে বইটা পড়তে হবে ব্যাপারটা বড় রহস্যময় । আর বইটা না পড়ে গেলে যদি উনি বইটা সম্পর্কে কিছু জানতে চান তাহলে আহেলি কিছু বলতে পারবে না । একটু কষ্ট করে পড়ে নেবে চুপিচুপি কাজটা করতে হলে এই শর্তটা মানতেই হবে ।  কলকাতায় হলে কোন বড় নার্সিং গিয়ে চুপচাপ কাজটা করিয়ে নিত কেউ কিছু বুঝতেই পারত না কিন্তু এখানে  চুপিচুপি কাজটা করাতে গেলে  সোমজা  লাহিড়ী ছাড়া কোন উপায় নেই ।  

   আহেলি বইটা পড়তে শুরু করে । “ সোমজা   দত্ত আর পার্থসারথি লাহিড়ীর বন্ধুত্ব সেই স্কুলে  পড়ার সময় থেকে । দুজনের বাড়ি এক পাড়াতেই , দুজনের বাবা  সহকর্মী ছিলেন সেই সঙ্গে দুজন ভালো বন্ধু ছিলেন । দুই বাড়ীতেই খুব যাতায়াত ছিল কোন  অনুষ্টানে  দুই বাড়ীর লোকেরা একসঙ্গে আনন্দ করতেন , একসঙ্গে বেড়াতে যেতেন । 

    সোমজা  থেকে  পার্থসারথি  দুই  বছরের বড় । দুজনেই পড়াশোনায় খুব ভালো আর ভালো বন্ধুও । পার্থসারথির মা বাবা খুব ভালোবাসতেন সোমজাকে  ভাবতেন বড় হয়ে গেলে সোমজাকেই  তাদের ঘরের বউ করে আনবেন । একদিন গল্পস্থলে পার্থের বাবা পরিতোষ বাবু বন্ধু সোমনাথকে বলে ফেললেন ,” সোমজা  আর পার্থ দুটিতে খুব ভালো বন্ধু। সোমজা খুব ভালো মেয়ে  আমার কি মনে হয়  ভবিষ্যতে যদি দুটিকে বেঁধে  দেওয়া যায়  তাহলে ওরা খুব ভালো সংসার  করবে ! “

   “ তুই আমার মনের কথা বলেছিস পরিতোষ । আমি আর সুপর্ণা মাঝে মাঝে  এই কথাটাই ভাবি পার্থকে আমারও খুব পছন্দ । কিন্তু ভাই আজকালকার ছেলেমেয়ে আমাদের কথাতে কি হবে  বড় হোক । তাদের যদি ইচ্ছে হয় তাহলে আমরা ওদের চারহাত এক করে দেব !“ 

  “ সেই ভালো সময় আসুক এখন এসব ভেবে  লাভ নেই । বড় হোক দেখা যাক কি হয় ।“

     একই স্কুল থেকে দুজনে মাধ্যমিক  পাশ করে সায়েন্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয় । তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে পার্থসারথি  খুব ভালো রেজাল্ট করে জয়েন্ট এন্ট্রাসে  বসে এবং প্রথমবারই  মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায় । তাকে দেখে সোমজার  উৎসাহ আরও বেড়ে যায় এবং  সেও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করে জয়েন্ট   এন্ট্রাসে  বসে এবং  মেডিকেলে চান্স পেয়ে যায় ।  দুই পরিবারের লোক খুব খুশী দুজনেই কলকাতা  মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় । ততদিনে দুজনের  বন্ধুত্ব ভালোবাসায়  পরিণত হয়ে গেছে  । সময়ের সাথে  সোমজা  বেশ সুন্দরী হয়ে উঠেছে । তার  গায়ের রং  শ্যামলা মুখটা পানপাতার মতো , চোখ দুটো ভাসা ভাসা , উচ্চতা স্বাস্থ্য মাঝারী গোছের । সাজগোজ খুব একটা করে না কখনও দুই বেণী, কখনও একটা বেণী বেঁধে থাকে আবার কখনও  খোঁপাও বাঁধে  । কপালে ছোট একটা টিপ দেয়  চুড়িদার পড়তেই বেশী ভালোবাসে । সারাক্ষণ পড়াশোনা নিয়ে থাকে তবে  হাসি খুশী মিশুকে স্বভাবের । কিন্তু সোমজা মনে মনে  বেশ  উচ্চাঙ্খাঙ্খি তবে এটা বুঝা যায় না ।     

   পার্থসারথি  লম্বা চওড়া চেহারার মানুষ ,চেহারা খুব একটা খারাপ নয় । সে খুব ভালো মানুষ চেহারায় একটা ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে । দুজনেই ডাক্তারি পাশ করে  সোমজা  গায়নোকলিজিষ্ট   আর পার্থ মেডিসিনের ডাক্তার হয়। কলকাতার বড় হাসপাতালে দুজনেই জয়েন করে । দিন দিন ওদের ভালোবাসা গভীর হতে থাকে । কয়েক বছর পর ওরা ওদের ভালোবাসার কথা বাবা মাকে জানায় । তাদের ভালোবাসার কথা শুনে দুই পরিবারের লোকেরা খুব খুশী তারা এতদিন থেকে তাই চেয়েছিলেন । খুব ধুমধাম করে ওদের বিয়েটা হয় । আত্মীয় ,স্বজন , পাড়া প্রতিবেশী সবাই তাদের বিয়েতে এসেছে খুব আনন্দ করেছে । 

                                                

তিন 

     সোমজা , পার্থসারথি দুজনেই নামকরা ডাক্তার  খুব ব্যস্ত থাকে তারা।  বিয়ের আগেই  ওদের পসার অনেকটা জমে গেছে । দুজনেই খুব মিষ্ট স্বভাবের ,নরম মনের এটাই ওদের পসার জমার চাবিকাঠি । তবে দুজনের খুব ভালোবাসা আর মনের মিল খুব , তাছাড়া একে  অপরের বোঝাপড়া খুব ভালো । কিন্তু ব্যস্ততার কারণে একে অপরকে সময়  দিতে পারে না । তবে সারাদিন  এক জায়গায় দুজনে কাজ করে রাতে ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীরে পাশপাশি শুয়ে দুজনে একটু নিজেদের মতো একটু সময় কাটায় , কখনো   আবার জরুরী ফোন পেলে মাঝ রাতেই ছুটে যেতে হয় হাসপাতালে। কাজের জন্য ওরা  আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে কিন্তু কাজের মাঝেই সময় বের করে বাবা মায়ের কাছে যায় , উনারাও আসেন মাঝে মাঝে । 

    বিয়ের সাত মাস পর সোমজা কনসিভ  করে ।  তখন দুজনে খুব ব্যস্ত দুদণ্ড বসার সময় নেই । তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি  বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছে সোমজার  নেই । এর মধ্যে আরেকটা সুযোগ এসে যায় সোমজা  বিদেশ থেকে একটা স্পেশাল  কোর্স  করার  জন্য এপ্লাই  করেছিল আর ঠিক সেই সময়েই  তার  সুযোগটা আসে । সোমজার কনসিভ  করার ব্যাপারটা তখন দুই পরিবারের কেউ তখন  জানেন না তখন তিন  মাস চলছে সোমজা ভাবছিল কিছুদিন পর বলবে । সোমজা  এত বড় গায়নোকলিজিষ্ট  দিন দিন তার ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। তাই ওদের পরিবারের লোকেরা খবরটা জানলে তাকে এত পরিশ্রম করতে মানা করবে সেই কারনেই সে বলতে চায়নি । তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি নেওয়ার ইচ্ছে তারও ছিল না কিন্তু সে কোন প্রটেকশন নেয়নি তাই ঘটনাটা ঘটে গেছে । পার্থসারথিকে  বলার পর  সে  খুব খুশী হয়ে  বলেছিল ,”  যাক আমাদের মধ্যে আরেকজন আসছে সে আমাদের বন্ধনটাকে আরও মজবুত করে দেবে । আমি যত ব্যস্তই থাকি না কেন জুনিয়রের জন্য কিছু সময় রাখব।  আমি এই সময়টা ওর সঙ্গেই কাটাব । আমাদের সন্তান যেন বলতে না পারে বাবা ,মা  ডাক্তার তাই ওকে একটুও সময় দেয়নি ।“ 

   “ সব ঠিক আছে পার্থ কিন্তু তাড়াতাড়ি বাচ্চা না হলেই ভালো হত ! “ 

  “  ও এসব কথা বল না একজনকে আমাদের মাঝে আসতে দাও ।পরের ইস্যু না হয় কয়েক বছর পর নেবে ।“ 

  “  উফ তুমিও পারো পার্থ একজন আগে আসুক তারপর আরেকজনের কথা ভাববে ! “

   “  তুমি এত চিন্তা করছ কেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলি   ডাক্তার ছিলেন উনার  বেশ  কয়েকটা সন্তান ছিল তারা কি মানুষ হয়নি ! শোন আমি একটা প্ল্যান করেছি রবিবার বাবা ,মা ,কাকু  ,কাকীমাকে আমাদের ফ্ল্যাটে  ডেকে খবরটা  দেব  সবাই  খুব খুশী হবে !” 

    “ সেই ভালো ।“ 

     কিন্তু রবিবারের আগেই বিদেশের খবরটা আসে । সোমজা  বেশ কিছুদিন ধরে এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল । কোর্সটা দুবছরের তাই সে সিদ্ধান্ত  নিল  বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিতে হবে । 

  পার্থসারথি  ওকে মানা করেছিল । বলেছিল ,” এটা তোমার প্রথম ইস্যু সোমজা বাচ্চাটা নষ্ট কর না ! বিদেশে কোর্স করার সুযোগটা তুমি পরেও হয়ত পাবে !  “

  “ কি বলছ আমার কতদিনের  স্বপ্ন  লন্ডনে গিয়ে ডাক্তারি পড়ার । ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে মাত্র দুজন সুযোগ পেয়েছে তার মধ্যে আমি একজন । বাচ্চা জন্ম দেবার জন্য এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করব । বাচ্চা দুবছর পর এসে নেব আমি তো আর বুড়ি হয়ে যাচ্ছি না । “

  “ পরে যদি কোন কমপ্লিকেশন হয় !”

 “ কিসের কমপ্লিকেশন পার্থ !  আমি একজন ডাক্তার আমি কি আমার সমস্যা বুঝব না ।“

  “ ঠিক আছে তোমার যখন এটা ইচ্ছে তাই হবে ।“ 

    সোমজা  প্রথমে মেডিসিনের দ্বারা বাচ্চাটা নষ্ট করতে চেয়েছিল কিন্তু তাতে কাজ হয়নি কারন দেরী হয়ে গেছে তাই সে  না এবরশন করল । কথাটা পার্থসারথি  ছাড়া তাদের পরিবারের কেউ জানে না । দুবছর পর ফিরে এসে তার ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায় ।  আসার পর  দুজনেই চাইছিল ওদের মধ্যে কেউ আসুক সোমজার বয়স বত্রিশ হয়ে গেছিল ।  কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও  সোমজা আর কনসিভ  করতে  পারেনি পরীক্ষা করে জানা যায়  সোমজা  গর্ভধারনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে প্রথমবার  এবরশনের সময় নিজে ডাক্তার হয়েও  সোমজা তা বুঝতে পারেনি ! একেই  হয়ত বলে বিধির বিড়ম্বনা !  

     খবরটা শুনে পার্থসারথি  আর দুই  পরিবারের মধ্যে যেন বাজ পড়ল । সোমজা নিজেও খুব মর্মাহত হল সে নিজেও এখন মা হতে চায় । পার্থসারথি  , সোমজা দুজনে  চেন্নাই , ব্যাঙ্গালুরের  যত বড় বড় গায়নোকলিজিষ্ট ছিলেন  তাদের কাছে গেল ।  সোমজার  নানা পরীক্ষা হয় কিন্তু সবারই এক কথা সোমজা প্রথমবার  এবরশনের   সময় তার গর্ভাশয়ে চোট পায় তার ফলে সন্তান ধারনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে । ওরা বিদেশেও গেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি । এর মধ্যে একে একে দুবছরের মধ্যে দুজনের বাবা ,মা এরা চলে গেলেন । প্রচুর সম্পত্তি  ,ওরা প্রচুর টাকা রোজগার করছে কিন্তু ভোগ করার কেউ নেই । পার্থসারথি  তখন খুব দান দক্ষিণা করত আর সোমজার মনে একটাই অনুশোচনা   সবসময়  থাকত তার নিজের  ভুলেই তার জীবনটা  এমন হয়েছে । সে একজন গায়নোকলিজিষ্ট  প্রতিদিন কত বাচ্চা তার হাতে জন্ম হয় কিন্তু তার নিজের কোল শূন্য । তার নিজের ভুলেই বিধাতা তার উপর হয়ত  রুষ্ট হয়েছেন এটা  সোমজা বুঝতে পারে  ! বাচ্চাটা তখন জন্ম দিলে কি এমন ক্ষতি হত বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়ত পরেও মিলত ! 

     কেটে যায় বেশ কয়েকবছর দুজনে একই ছাদের নীচে থাকে কিন্তু তারপরও একটা দুরত্ব রয়েছে তাদের মধ্যে । কথা খুব কম হয় ওরা একটা বাচ্চা দত্তক নেবে  কিন্তু তাতেও তারা সিদ্ধান্ত নিতে  পারেনি । দুজনে দুঃখ ভুলে রাখতে নিজেকে খুব ব্যস্ত রাখে ।

       পার্থসারথির একসময় মনে মনে অনীহা এসে যায় কি হবে এত টাকা রোজগার করে বাকী জীবনটা  সে অসহায় মানুষের  পাশে দাঁড়াতে চায় । গ্রামের ডাক্তারের বড় অভাব  সেখানে এখনও মানুষ ঠিকমতো চিকিৎসা পায় না তাই সে গ্রামেই চলে যেতে চায় । পার্থসারথি  তালপুকুর গ্রামে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় । পার্থসারথি  তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় সোমজাকে ।  “ আমি গ্রামে চলে যাচ্ছি সোমজা । বাকী জীবনটা তালপুকুরেই কাটাতে চাই । তুমি তোমার অর্থ ,সুনাম ,প্রতিপত্তি নিয়ে থাক কলকাতায় !” 

  “ না পার্থ আমারও আর এখানে ভালো লাগছে না কি হবে এসব দিয়ে আমিও তোমার সঙ্গে গ্রামে চলে যাব । “

  “ না তোমার যাবার দরকার নেই  সোমজা তুমি কি করবে ওখানে গিয়ে।  আমি ওখানে হাসপাতালে যোগ দেওয়ার সাথে সাথে কিছু অনাথ বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চাই । আমার  সন্তানের জায়গাটা আমি ওদের দিয়ে পূরণ করব ।“ 

   “ আমিও তোমার মতো ওদের পাশে দাঁড়াতে চাই পার্থ ।  প্লিজ তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না । আমি  বাচ্চা জন্ম দিতে পারব না বলেই আমাদের মধ্যে দুরত্ব বেঁধেছে কিন্তু আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি পার্থ তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না ।“ 

   “  আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না  সোমজা । শুধু অভিমানে কথাগুলো বলেছি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না  সোমজা  হয়ত বাচ্চা পাওয়া আমাদের ভাগ্যে নেই । আমরা ডাক্তার কত লোকের চিকিৎসা করি কিন্তু নিজের ভাগ্যটাই বদলাতে পারলাম না ।“

  “ সব আমার ভুলেই হয়েছে পার্থ কিন্তু আমি এমন ভুল আর কাউকে করতে দেব না ।“

   প্রায় দশ বছর হয়ে গেল  সোমজা আর পার্থ  তালপুকুর  গ্রামে আছে । কলকাতার বাড়ি বৃদ্ধাশ্রমের জন্য দান করে দিয়েছে তারা । তালপুকুরে তারা একটা অনাথ আশ্রম চালায় । সোমজা  তার জীবনের বিপর্যয়ের কথা নিয়ে ছোট একটা বই ছাপিয়েছে কেউ প্রথমবার এবরশন করাতে এলে তাকে বইটা পড়তে দেয় যাতে তার মতো কেউ ভুল না করে । সে নিজে ডাক্তার হয়েও তার এত বড় বিপর্যয় আটকাতে পারেনি কিছু বুঝতেই  পারেনি কিভাবে তার সন্তান ধারণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে । কি ভুল হত  যদি বিদেশের ডিগ্রীটা না নিত বা পরে নিত তার জীবনে তেমন কিছু হত না ! 

      আহেলি খুব মন দিয়ে সোমজার  জীবনের সব কথাগুলো পড়ল । ততক্ষণে বৃষ্টি কমে দুপুর গড়িয়ে গেছে । রঘু  এসে  তাকে  খাবারের কথা বলল  আহেলি পরে খাবে বলে দিল । তার ভাবনা শুধু সোমজার লেখা বইয়ের কথাগুলো নিয়ে ।  কি মারাত্মক ভুল করেছে ডাঃ  সোমজা  তিনি বইয়ের শেষে একটা অনুরোধ  করেছেন প্রথম বাচ্চাটা যেন কেউ নষ্ট না করে । আর কোন বাচ্চাই নষ্ট  করার দরকার কি প্রটেকশন নিয়ে চললেই হয় !  

    আহেলি ভাবতে থাকে  সোমজার  মতো সেও যদি আর কক্ষনো মা হতে না পারে তাহলে কি হবে !  আহেলি  যতই আধুনিক হোক একটা বাচ্চা ছাড়া সে জীবন কাটাতে পারবে না । মায়েরা সন্তানের জন্য কত সেক্রিফাইস করে আর সে তার আনন্দ ফুর্তিকে  বিসর্জন  দিতে পারবে না।  আহেলি তার পেটে হাত দেয় মাত্র তার তিন  মাস চলছে কিন্তু আহেলি যেন একটা কচি হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পায় । যে তাকে বলছে “ মা আমি পৃথিবীর আলো দেখতে চাই আমাকে তুমি দেখাবে না ! “ 

    আহেলির চোখে জল এসে যায় । বলে , “ হ্যাঁ সোনা আমি তোকে পৃথিবীর আলো দেখাব ।“ 

     রাতে সব কথা আহেলি অনিকেতকে বলল  । অনিকেত  খুব খুশী হয় আহেলি বাচ্চাটা জন্ম দেবে ভেবে ।

   পরদিন অনিকেতকে নিয়ে আহেলি হাসপাতালে  যায় । সোমজা তাকে দেখেই বললেন , “  বইটা পড়েছেন কি সিদ্ধান্ত নিলেন ? “ 

   “ আপনার জীবনে যে বিপর্যয়  ঘটেছে আমি  চাই না তেমনটা আমার জীবনে ঘটুক   আমি বাচ্চাটা জন্ম  দিতে চাই । আমি ওর হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পেয়েছি  ! “

  “ যাই হোক আমার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে ।“

  “ ম্যাডাম আপনার কারণেই আহেলি  ভূল সিদ্ধান্ত  নিতে নিতে বেচে গেছে । আমি চাই আহেলি আপনার  চিকিৎসায় থাকুক । আমাদের সন্তান আপনার হাত ধরেই পৃথিবীর আলো দেখুক ! “ – অনিকেত বলল ।

  সোমজা হেসে বললেন , “ অবশ্যই !”      

  ...সমাপ্ত ...

No comments:

Post a Comment