ছবি : ইন্টারনেট |
নতুন ইনিংস
প্রসেনজিৎ দত্ত
শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় পনেরো নম্বর প্ল্যাটফর্মে হঠাৎ হল্লা দেখা গেল। কয়েকজন ' চোর চোর ' বলে ছুটে গেল। আর বাকিরা একজনকে ঘিরে ধরে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। ছেলেটা অন্ধ। মায়ের সাথে গান গেয়ে ভিক্ষা করে সংসার চালায়। নিত্য যাত্রী যারা ওকে চেনে, তাঁরা জানে মা-ছেলে কতটা পরিশ্রমী। সারাদিন বারুইপুর লোকালে প্রতিটা কামরায় ঘুরে ঘুরে গান শুনিয়ে কয়েক পয়সা উপার্জন করে। দরাজ গলা ছেলেটার। কোনোরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই এত ভালো গান গায়, যে সকলে ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ওর মা হারমোনিয়াম বাজায়। এই জগত সংসারে দুজনে মিলে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এইভাবে দশ বছর। মায়ের কষ্ট দেখতে পারে না সুভাষ। ইদানিং হাঁপানির কষ্ট বেড়েছে দেখে ওর মাকে সঙ্গে আসতে বারণ করে দেয়। তার ফলে নিজেকেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরতে হয় ইদানিং। ট্রেনের গতি কমতেই আজ হারমোনিয়াম ও পয়সার ব্যাগটা পাশে রেখে একটু জল খাচ্ছিল, এমন সময় কেউ এসে ওকে ধাক্কা মারে। মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। তারপর উঠে দাঁড়াতেই খেয়াল করে ওর ব্যাগ চুরি গেছে। হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙে পড়ে ওর মাথায়। এই ঘটনাতে ধীরে ধীরে উত্তেজনা ছড়ায়। রেল পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। ওকে প্রতিশ্রুতি দেয় প্রকৃত ছিনতাইকারীকে খুঁজে বার করার। কিন্তু সুভাষের মাথায় তখন অন্য চিন্তা। মা'কে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। অগত্যা ভিড় সরিয়ে হেঁটে যায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে।
স্টেশন চত্বরে আজ সারাদিন কাটিয়ে দেয়। উপার্জন হয় যৎ সামান্য। মনে মনে ভাবে পরের দিন অনেক সকালে বেরিয়ে পড়বে।
একটু বেশি সময় থাকবে বাইরে। অনেক দূর যাবে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় মেঘ ভাঙা বৃষ্টি। অবিরাম ঝড়তেই থাকে। অথচ ঘরে বসে থাকলে যে কিছু হবে না। তাই বৃষ্টি মাথায় করে চলতে শুরু করে। গাড়ি ধরার জন্য যখন সুভাষ স্টেশনে পৌঁছায়, ভিজে একাকার। কিন্তু এ নিয়ে খুব একটা না ভেবে শুরু করে কবিগুরুর গান - " আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে...." ভিতরের তাগিদ, মনের জোর, প্রকৃতি পরিবেশ মিলিয়ে সেদিন ওর গান সকলের মন জয় করে নেয়। অনুরোধ আসে গানটা আরও কয়েকবার গাওয়ার। ও তাই করে। ট্রেন থেকে নামার আগে সকলে ওকে খুশী হয়ে হাতে নোট গুঁজে দেয়। একজন জনৈক ভদ্রলোক একটা দশ হাজার টাকার চেক ধরিয়ে বলে যায় - " এটা তোমার পুরষ্কার। সল্টলেকে আমার রেকর্ডিং স্টুডিওতে কাল চলে এসো। আমি তোমাকে দিয়ে গান গাওয়াতে চাই অ্যালবামের জন্য। "
আনন্দে কেঁদে ফেলে সুভাষ । ও জানে এখন ওর কাছে টাকাটা কতটা দরকারি। ভাবে সত্যি তো! জীবনে কিছু হারিয়ে মুষড়ে পড়লে চলবে না। ও নাছোরবান্দা হয়ে চেষ্টা করেছিল বলেই এই সুযোগ এল। শারীরিক বা মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী হলেও, লক্ষ্য অটুট থাকলে ; তবে সব সম্ভব। এরপর, ও মাকে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে তোলে। গানের রেওয়াজ শুরু করে । শুরু হয় জীবনের নতুন ইনিংস।
No comments:
Post a Comment