![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
শাশ্বত
শুভদীপ চক্রবর্তী
বিকেল চারটে যখন বাজলো , সুমতি বেশ ব্যস্ততার সঙ্গে ঘড়িটা দেখে তড়িঘড়ি উঠে বসলো চেয়ার ছেড়ে । আজ তাকে অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে । আজ একটা বিশেষ দিন । মনে মনে কিছু একটা ভেবে ছোট্ট মুচকি হাসি হেসে অফিস কলিগদের বিদায় জানিয়ে ঠিক চারটে দশে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো। তার ফেরার ট্রেন পাঁচটায় , কিন্তু এতোটা আগে বেরোনোর উদ্দেশ্য আলাদা । কিছু কিনতে হবে । আজকের মতো একটা বিশেষ দিনের বিশেষ মুহূর্তটাকে সেলিব্রেট করতে হবে । আজ সুমতি ও আকাশের প্রথম বিবাহবার্ষিকী বলে কথা । ঠিক একবছর আগে আজকের দিনেই খোলা প্রশস্ত নীল আকাশের নীচে আকাশ সুমতির সিঁথি লাল সিঁদুরে রাঙিয়ে দিয়েছিল ।
ফুটপাত দিয়ে আসতে আসতে সুমতির সেই পুরোনো কথাগুলো মনে পড়ছিল । দেখতে দেখতে একবছর হয়ে গেল তাদের বিয়ের । হঠাৎ একটা চেনা ডাকে পাশের দোকানের দিকে ফিরে তাকালো ।
দোকানদার রাজু হাত দেখিয়ে বলছে , " দিদিমণি , আপনার অর্ডার দেওয়া ফুলের বাকেটটা রেডি । " আজ অফিসে ঢোকার আগেই এই দোকানেই একটা স্পেশাল ফুলের বাকেট আর একটি মালা অর্ডার দিয়ে গেছিলো সে ।
সে দেখে এসেছে প্রতিবছর কলিগরা তাদের বিবাহবার্ষিকীতে এইভাবে সেলিব্রেট করে । তাই তারও ইচ্ছা । দাম মিটিয়ে বাকেট ও মালাটি নিয়ে সে পাশের দোকানে ঢুকলো অর্ডারের কেকটা নিতে ।
তারপর আকাশের জন্য উপহার হিসেবে পছন্দ করে একটা ঘড়িও কিনলো সুমতি । সমস্ত দোকানের কাজ মিটিয়ে চটজলদি একটা রিকশা ধরে স্টেশনে পৌঁছালো সে । তার মনে যেন আনন্দ ও রোমাঞ্চের জোয়ার ভাটা চলছে ।
বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় ছ'টা বাজলো তার ।
বাড়িতে ঢুকে টেবিলের ওপর ফুল,মালা আর কেকটা নামিয়ে রাখতে রাখতে সে বললো , " তুমি তো ভুলে যাও , কিছুই মনে থাকে না তোমার । আজ আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী। আজ কিন্তু তোমার গোমড়া মুখ করে থাকা , আমার প্রতি বিরক্তি দেখানো , কথা না বলা , এসব কিছুই মানবো না আকাশ । "
কথাটা বলে ফ্রেশ হতে বাথরুমে চলে গেল ।
আকাশের প্রিয় সেই নীল কালো শাড়িটা বাছাই করে পড়েছে সে । ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পাশে একটা সুন্দর রোমান্টিক গান চালিয়ে সেটা গুনগুন করতে করতে একমনে সেজে চললো । বড়ো সুন্দর লাগছে তাকে । শাড়ির সঙ্গে রং মিলিয়ে টিপ , খোঁপায় বেলি ফুলের মালা , ঠোঁটে লাল লিপস্টিক , ঠিক আকাশের যেমনটা পছন্দ।
আয়নায় নিজেকে দেখে একটু লজ্জা পেল সুমতি ।
বেশ খানিকটা রাত হয়ে গেছে । উঠে সমস্ত আয়োজন করতে গেল সে । একটা থালায় কেক , তার পাশে ছুরি , কেকের চারদিকে গোল করে অজস্র মোমবাতি।
দরজা খুলে আকাশের ঘরে ঢুকলো । টেবিলের ওপর কেকের থালাটা রেখে সবকটি মোমবাতি সযত্নে জ্বালিয়ে দিলো । ঠিক তার পাশে সুগন্ধি ফুলের বাকেটটা রেখে একটা চেয়ার নিয়ে আকাশের মুখোমুখি বসলো সে । হঠাৎ তার মনে পড়লো , "ওমা , দরজাটা বন্ধ করতে হবে তো । " আচমকা ধড়মড় করে উঠে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি দিয়ে দিল ।তারপর আবার চেয়ারে বসে টেবিল থেকে মালাটা নিয়ে সযত্নে পড়িয়ে দিল আকাশের গলায় । আকাশের মুখে হাত বুলিয়ে বললো , " হ্যাপি অ্যানিভার্সারি , আকাশ । ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দাও মোমবাতিগুলো । ও , না থাক , আমিই নেভাচ্ছি । "
ফুঁ দিয়ে সব বাতি নিভিয়ে লাইটটা জ্বেলে দিলো সুমতি । কেকটা কেটে খানিকটা নিজে খেয়ে বাকিটা মাখিয়ে দিলো সামনের চেয়ারে বসে থাকা মাংস গলে যাওয়া কঙ্কালটার মুখে । তারপর আকাশের পচা গলা হাতটা তুলে নিয়ে কিলবিল করতে থাকা পোকাগুলোকে ঝেড়ে উপহারের ঘড়িটি যত্নসহকারে পড়িয়ে দিলো সে ।
আকাশ --- একবছর আগে বিয়ে হওয়া , দীর্ঘ চার বছরের প্রেম , সুমতির আকাশ ।
সুমতি বললো ," কি সুন্দর লাগছে তোমাকে এই মালাতে আজ । জানো আকাশ , সবাই আমাকে পাগল বলে । আমি নাকি তোমাকে ভালোবাসি না।কত কষ্ট পাচ্ছিলে বলো তুমি । রোজ সকালে অফিস চলে যেতে । সন্ধেয় বাড়ি ফিরতে , সারাদিন আমি একা থাকতাম । জানোই তো , একা থাকতে আমার বড্ড ভয় করে । কতবার বলেছি আমাকে ছেড়ে যেওনা , সবসময় থাকো আমার কাছে । তুমি কি বলতে প্রতিদিন বেরোনোর সময় , "ধুর পাগলি।" তুমিও আমাকে পাগলি বলতে আকাশ !! জানো আকাশ , খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন । যখন তুমি অফিস থেকে এলে , জল চাইলে , আমি তাতে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দিলাম । তারপরে ওই ,ওই যে ছুরিটা , ওটা দিয়ে আস্তে করে তোমার গলাটা কেটে দিলাম । কতো রক্ত বেরিয়েছিল জানো , আমি তখন খুব কেঁদেছিলাম । সারারাত ঘুমাতে পারিনি ।
কিন্তু সে তো আজ কতদিনকার ঘটনা । তারপর থেকে তুমি তো আমার সঙ্গেই আছো বলো । কোথাও যাবে না , সারাদিন চেয়ারে বসে থাকবে । তুমি শাশ্বত । "
কথা বলতে বলতে অর্ধেক পচে যাওয়া মাথার খুলিটার ওপরে সযত্নে হাত বোলাতে লাগলো আর চোখের কোটরের অজস্র পোকাগুলো পরিষ্কার করতে লাগলো ।
সুমতি বললো , " জানো আকাশ , ওই পাশের বাড়ির কুকুরটা না প্রতিদিন আমাদের বাড়ির দিকে মুখ করে চিৎকার করতে থাকে । তুমি সারাদিন আমার সঙ্গে আমার কাছে থাকো , কেউ সেটা পছন্দ করে না। খানিকটা কেকের মধ্যে বিষ মিশিয়ে আমি এর মধ্যেই কুকুরটাকে দিয়ে এসেছি । ও আর আমাদের বিরক্ত করবে না আকাশ । "
কথা শেষ করে উঠে দরজা বন্ধ করে রুম ফ্রেশনার গোটা বাড়িতে স্প্রে করে আবার একটা সুন্দর রোমান্টিক গান চালিয়ে রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে একমুখ প্রশান্তির হাসি নিয়ে পোশাক পরিবর্তন করতে শুরু করলো সুমতি ।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment