1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, October 21, 2023

নতুন আলো

ছবি : ইন্টারনেট

নতুন আলো

ঋত্ত্বিকা দাশ 


ঘড়িতে এখন সকাল ৬.৩০। উর্বী পুবদিকের জানলার পর্দা সরিয়ে চেয়ারটায় আরাম করে বসে ডাক দিলেন--'লহরীইইঈ'। এককাপ লিকার চা নিয়ে ধীরেসুস্থে এসে ও বাড়িয়ে দিল।ওর হাত থেকে কাপটা নিয়ে একচুমুক দিয়ে একটা স্বস্তির আওয়াজ করলেন নিচুগলায়‌।মুখখানা হাসিতে ভরে গেল বছর সাতাশের টুম্পার..যে এখন লহরী নামে পরিচিতা। জলখাবারে কি হবে জানতে চেয়ে উত্তর পেল লুচি আর গরম গরম বেগুন ভাজা। হুকুম পেয়েই ও রান্নাঘরে ছুটল। অনেকদিন বাদে লুচির আদেশ দিয়েছে মাসিমা।বছর দুই আগে কাজ থেকে অবসর পেয়ে ইদানিং খাওয়া-দাওয়ায় একটু রাশ টেনেছেন উনি। 

বাষট্টি বছরের ভদ্রমহিলাকে দেখলে সমীহা জন্মায় মনেমনে। প্রতিদিন ঠিক সকাল ছটা'য় ঘুম থেকে উঠে আধঘন্টা বাগানে বেড়ানো, তারপর জানলার ধারে বসে চা, ঠিক নটায় ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়েন 'সংহিতা'-র উদ্দেশ্যে।এই সংস্থা তৈরি করেছেন নিজের হাতে--বছর দশেক আগে। এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে বিধবা হন উর্বী মাত্র ছত্রিশ বছরে।

চিরঞ্জিত বাবুর রোগটা ধরা পড়েছিল তার ও বছর তিনেক আগে।বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি জেনেছিলেন অনেক পরে। সাধ্যমত চেষ্টা ও করেছিলেন চিকিৎসার। কিন্তু মাত্র বিয়াল্লিশ বছরেই সকলের ভার উর্বীর ওপর ফেলে চলে গেলেন তিনি।সাত বছরের ছেলে,পাঁচ বছরের মেয়ে,আর সন্তানহারা শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে যে কিভাবে মনের জোরে দিনগুলো কাটিয়ে দেন সেটা শুধু নিজেই জানেন। তবে অর্থকষ্টে কোনদিন পড়তে হয়নি কারণ স্বামীর অফিসেই কিছুদিনের মধ্যে চাকরি পেয়ে যান। কিভাবে যে দিনগুলো কেটে গেছে..টেরই পাননি।একে একে শ্বশুর- শাশুড়ি চলে গেলেন.... ছেলে তখন ইউনিভার্সিটিতে আর মেয়ে কলেজে।

ছেলে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে কি সব যেন করে বিদেশে চলে গেল, উর্বী কোন বাধা দেননি কারণ উনি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী,তবে এটা কখনোই ভাবেননি যে তূর্য বিদেশী মেয়ে বিয়ে করে ওখানেই থেকে যাবে।

ভাবনায় ছেদ পড়ল লহরীর ডাকে। জলখাবার তৈরি। একসাথে খেতে বসে ও জিজ্ঞাসা করল দুপুরের খাবারে কি বানাবে। উর্বী উত্তর দিল - 'ভাত, উচ্ছে- কুমড়ো ভাজা,অল্প পাঁচমেশালী তরকারি আর পাতলা মাছের ঝোল।' লহরীকে জানিয়ে দিলেন  দুপুর বেলা দেড়টার মধ্যে ফিরে আসবেন। খাওয়া শেষে নিজে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।

ঘরকন্নার কাজ করতে করতে লহরী ডুব দিল নিজের মধ্যে।প্রায় ছ'বছর এখানে এসেছে ও। মাসীমা কি যেন একটা কাজে গিয়েছিলেন ওদের গ্ৰামে--শ্রীনাথপুরে।তখন ওর বছর একুশ কি বাইশ।পণের টাকা ওর দিনমজুর খাটা বাবা পুরোটা দিতে পারেনি বলে বিয়ের ছমাসের মাথায় ওরা ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মেয়েকে ।ওকে নিয়ে তখন কি আলোচনা, বাবা-মায়ের চোখের জল থামত না, নিজেকে তখন খুব অপরাধী মনে হতো, গাঁয়ের লোক বলত ওর জন্য ছোট বোনেদেরও বিয়ে হবেনা। মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করত। প্রায় বছর দেড়েক এভাবে কাটার পর মাসিমার দেখা পেল,কি যে ওর মনে হল ও একটা কাজ চেয়েছিল--ওর দুঃখের কথা বলে--মাসিমা ওর কথা শুনে ওর বাবা-মা র সাথে কথা বলে ওকে নিয়ে এলেন নিজের সঙ্গে। বাবা-মা ও যেন মুক্তি পেয়েছিল। গ্ৰাম ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে ও কোন কষ্ট পায়নি। বোনেদের নিয়ে বাড়ির লোকের আর কোন সমস্যায়

পড়তে হবে না ভেবেই ওর খুব-খুব ভালো লেগেছিল‌। মাসিমা আসার পথেই ওর "টুম্পা"নামটা বদলে 'লহরী' করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-'তুই ঢেউ-এর মত আমার কাছে এসেছিস'।পরে জেনেছিল 'লহরী' মানে ঢেউ।

এবাড়িতে এসে আর একজনকে পেয়েছিল ও--'জাহ্নবী' দিদি। মাসিমার মেয়ে। অনেক মোটা মোটা বই-খাতা নিয়ে পড়ত।আর মাঝে মাঝে কোথায় যেন যেত। একদিন বাড়ি ফিরে মাসিমাকে বলল যে ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে চায়।এ নিয়ে ওদের দুজনের যেসব কথাবার্তা হল তার অবশ্য ও বোঝেনি। শুধু পরদিন সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মাসিমা বললেন-'ব্যস! আমার কর্তব্য শেষ, জানি ও-ও আর ফিরবে না,এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।'বুঝতে না পেরে টুম্পা জানতে চেয়েছিল মাসিমা কি বলছেন।একটু হেসে মাসিমা মাথা নেড়ে বলেছিলেন 'পরে বুঝবি,সব বলব।এবার তো শুধু তুই আর আমি রে।' মাসিমা চুপ করে গেছিলেন। টুম্পাও আর প্রশ্ন করেনি। মাস দুয়েকের মধ্যে জাহ্নবী দিদি পাড়ি দিল বিদেশে। যাবার দিন মাসিমা শুধু বলেছিলেন--'তুইও বুঝি তোর দাদার মত আর কোনদিন--'কথা শেষ করার আগেই দিদি ওঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল-'আমি পড়তে যাচ্ছি। ফিরে আসব। দাদার মত তোমায় কষ্ট দেব না।'

তাও দেখতে দেখতে প্রায় তিন বছর, 

শুনেছে দিদিও নাকি বিয়ে করেছে বছর দুই আগে। দাদাকে ও কোনদিন দেখেনি, দিদিকেও মাস দুয়েক দেখেছে, মাসিমাও আত্মীয় স্বজন খুব একটা পছন্দ করেন না, কিন্তু প্রতিবেশী,দুস্থ,দুঃখী,অনাথ-- কাউকে কটুকথা বলেন না, প্রয়োজনে সাহায্য করেন, স্কুলে ছোটেন,পাশের বস্তির প্রায় পনেরো-ষোল জনকে বিনা পয়সায় পড়ান, ওদের বইপত্র কিনে দেন, কারো ডাক্তার-ওষুধ কিনে দেন। শুধু নিজের ছেলেমেয়ের ব্যাপারে কিছু বলেন না,ওরা ফোন করলে কথা বলেন কিন্তু কোনদিন আসতে বলেন না। লহরী একদিন জিজ্ঞেস করেছিল,উনি বলেছিলেন "যারা আমার জন্য ভাবেনি, কোনদিন আসতে চায় না তাদের কাছে নিজেকে ছোট করব না রে--তোরা তো আছিস--আমার কোন কষ্ট নেই। তোদের নিয়ে ভালো আছি রে।"কিন্তু লহরী ওনার চোখে জল দেখেছিল।

পর্ব-২

ডোরবেল বাজল---উর্বী ঘরে ঢুকে টুকটাক নির্দেশ লহরীকে দিয়ে কলঘরে ঢুকে গেলেন।লহরী খাবার টেবিল সাজালো, দুজনে একসাথে খেতে খেতে কথা বলতে লাগলো। উর্বী জিজ্ঞেস করলেন  যে লহরী বাড়িতে ফোন করেছিল কিনা।ওর বাড়ির লোকের খবর কি? বোনেদের বিয়ে ঠিক হয়েছে কিনা?লহরী জানাল যে কোন খবর নেই। উর্বী বললেন দরকার হলে যেন ওনাকে জানাতে কোন লজ্জা না পায়, কারণ ওর মাইনে জমা আছে,লহরী এবার জোরের সাথে জানাল যে কোন মাইনে ওর বাকি নেই, ও ওর মাসির কাছে থাকে।

উর্বী একটু হাসলেন। লহরী ঘাবড়ে গেল এবার। বাড়ি থেকে কেউ কি ফোন করেছিল?ও বারবার  জিজ্ঞেস করতে লাগলো। উর্বী বললেন যে খেয়ে উঠে ওঁর ঘরে আসতে, কারণটা জানাবেন।

টুম্পা কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ভয়ে ভয়ে মাসিমার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ঘরে ঢুকে দেখল মাসিমা দুটো খাম নিয়ে খাটে বসে আছেন। টুম্পা আবার ভয় পেল,দেশ থেকে কি কেউ মাসিমাকে কোন চিঠি দিয়েছে?তাই মাসিমা ওকে এইসব প্রশ্ন করলো, ওকে কি মাসিমা মাইনে দিয়ে ছুটি দিয়ে দেবে?

সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মাসিমা ওকে দেখতে পেয়ে কাছে ডাকলেন। কাছে যেতে উনি ওকে খাটে বসতে বললেন।এই সময় তো উনি একটু বিশ্রাম নেন---কাগজ পড়েন,বই পড়েন।আজ সব উল্টোপাল্টা হচ্ছে কেন? আবারও চিন্তিত হল ও।

পরম নিশ্চিন্তে খাটে বসা মাসিমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতে তাকাতে ও এগোলো খাটের দিকে... মাসিমা জানালেন বিকেলে

দুজন আসবেন-- তাঁদের আপ্যায়নে যেন কোন ত্রুটি না থাকে। ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে টুম্পা পেছন ফিরতেই মাসিমা আবার ওকে ডেকে হাসতে হাসতে বললেন--'জানিস-একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। তোর দাদা আর দিদি আমাকে নিয়ে হঠাৎ চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আমার শরীর নিয়ে ওদের দুশ্চিন্তা। আসলে বয়স হচ্ছে তো।লহরী উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল--'ওরা আসছে বুঝি? কবে গো?'ওকে থামিয়ে দিয়ে উর্বী বললেন-'বোস। ওদের চিঠিগুলো পড়ি।' লহরী বসল। উর্বী পড়তে শুরু করলেন। প্রথমেই দাদার চিঠি। কারণ দাদা বড়। চিঠিটা শুনতে শুনতে ভারী অবাক হয়ে গেল টুম্পা। দাদা লিখেছে-"তোমার শরীর নিয়ে খুব চিন্তা হয়। তোমার বৌমাও এবিষয়ে বেশ চিন্তিত, যদিও বেশ কয়েকবছর যাব-যাব করে যাওয়া হয়নি,দেখাও হয়নি। কবে যেতে পারব এ বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা নেই।তাই চিন্তা বেশি হয়, তুমি বুঝবে না,কেন আমরা বারবার তোমার সাথে হোয়াটসঅ্যাপ-এ কথা বলি, তুমি হয়তো অভিমান করো যাই না বলে, বিশ্বাস করো 

আমরাও কষ্ট পাই, তোমার গলার আওয়াজে বুঝি তোমার অভিমান।যাই হোক গত হপ্তায় ঊর্মির সাথে এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল,ওই তখন বলল যে তুমি তো একলা থাকো কাজের লোকের সাথে,বয়সও যথেষ্ট হলো, শরীরের কথা তো আর বলা যায় না,তাই একটা উইল যদি করে রাখো তাহলে ভালো হয়। আপাতত একটা করে জেরক্স কপি পাঠিয়ে দাও তাহলে ভালো হয়। নিজেকে ভালো রেখো, ভীষণ চিন্তা হয়।আর একটা কথা তোমার কাজের লোককে খুব একটা বিশ্বাস কোরোনা।খবর নিশ্চয়ই দেখো। যাই হোক ভালো থেকো, আমরাও ভালো আছি।"

একগাল হেসে উর্বী দ্বিতীয় চিঠিটা খুলতে খুলতে লহরীকে চোখ মুছতে বললেন। তারপর মেয়ের চিঠিটাও গড়গড় করে পড়ে গেলেন, বিষয়বস্তু একই, শুধু মেয়ে লিখেছে উইল তৈরির পরিকল্পনা তার দাদার।বাকি সব এক।চিঠি শেষ করে লহরীর দিকে তাকালেন  উর্বী। দেখলেন ভয়ার্ত চোখমুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে  ও। উর্বী মজা করে ওকে জিজ্ঞাসা করলেন---'কি রে! এবার কি হবে? কি করে তোকে বিশ্বাস করব? যদি কিছু খাইয়ে মেরে ফেলিস?' টুম্পা এবার থাকতে না পেরে কেঁদে ফেলল।বলল--মাসিমা তোমার মনে হয় -- আমি -- ???আর বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। উর্বী লহরীর মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল 'পাগলী মেয়ে---যা---তোকে বোঝালাম যে তোর দলে আমিও।' বলে মাসিমা কাগজ নিয়ে বসলেন, তবে খবরের কাগজ নয়,বেশ কয়েকটা সাদা কাগজ আর পেন--- টুম্পা নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো নিজের ছেলে মেয়ে বুঝি এমন হয়! তাহলে তার বাবা মা তো কোন ভুল করেনি। 

বিকেলে আবার ডোরবেল বাজলো সাড়ে-পাঁচটা নাগাদ। লহরী দরজা খুলে দেখল দুজন ভদ্রলোক--বললেন 'এটাই তো উর্বী মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি? বলুন অনিমেষ এসেছে।'লহরী ওদের বসার ঘরে বসতে বলে মাসিমাকে ডাকল। ওকে চায়ের জল বসাতে বলে ওদের সঙ্গে বসলেন কাগজগুলো নিয়ে। রান্নাঘরে চা বসিয়ে চপ ভাজতে ভাজতে টুম্পা ভাবতে লাগলো কি হতে পারে! মাসিমা যদি ওকে আর কাজে না রাখে কি হবে? সত্যিই তো খবরে দেখায় কাজের লোক কত কি করছে! কিন্তু ও তো ওরকম নয়, মাসিমা তো জানে। এইসব ভাবতে ভাবতেই ও চা চপ আর মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। শুনতে পেল যে ভদ্রলোক ওকে মাসিমাকে ডেকে দিতে বলেছিল সে মাসিমাকে ভালো করে ভাবতে বলছে, কিন্তু মাসিমা নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। বললেন--'ভেবেছি তো! দেখো অনিমেষ তোমরা তো সব শুনলে,আর আমি মাস ছয়েক আগে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তখনই ভাবনাটা এসেছিল,তবে হয়ে ওঠেনি নানা কারণে। তবে তূর্য আর ঊর্মির কাছে আমি কৃতজ্ঞ কারণ ওদের জন্য আমি এবার সত্যি সত্যি কাজটা করতে বদ্ধপরিকর হয়েছি। সত্যিই তো বয়স হচ্ছে!' একটা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন উর্বী। তারপর লহরীকে দেখিয়ে বললেন 'যতদিন অবশ্য ও আছে ততদিন আমি নিশ্চিন্ত।' টুম্পার মনে আবার খটকা-- যতদিন মানে কতদিন? মাসিমা ওদের জানিয়ে দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজটা করে ফেলতে, উনি আর বেশি দিন অপেক্ষা করবেন না। ওরা চলে যেতে মাসিমা ওকে রাতে কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুর দম করতে বললেন।


পর্ব-৩

 টুম্পা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মাসিমা টি.ভি র সামনে। খবর শুনছেন। এককাপ লিকার চা বানিয়ে দুটো ক্রিমক্যাকার বিস্কুট নিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ মাসিমার কাছে গেল টুম্পা। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই

খবরে দেখাচ্ছে কাজের লোকের হাতে খুন  

হয়েছে বৃদ্ধ দম্পতি। অজানা ভয়ে লহরী শিউরে উঠল।কি কুক্ষণে যে আজকের দিনটা শুরু হয়েছিল, কার মুখ দেখেছিল কে জানে? নিজের মনেই আওড়াতে থাকে টুম্পা। পড়ুয়াদেরও আজ মাসিমা ফিরিয়ে দিয়েছেন ,একটু বেশিই গম্ভীর।ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় মাসিমা ডাকলেন-- 'কি রে!আজ তোর সিরিয়াল নেই?মুখভার কেন?পেঁচীর মত মুখ কেন?' লহরী শুধু বলল--'কচুরি বানাতে সময় লাগে।' উর্বী ফিক করে হেসে বললেন -- তাই বুঝি? আসলে আগে তো তুই আমায় কচুরি বানিয়ে খাওয়াস নি....তখন কিন্তু সিরিয়াল দেখায় কোন খামতি ছিল না। 

অবশ্য আমি তো আর বেশিদিন' ....লহরী এবার দৌড়ে এসে মাসীমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল--বলল--'কেন এমন বলছ? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।তোমার কিছু হবে না। উর্বী মজা করার লোভ সামলাতে পারলেন না,বললেন--'অনেক ভেবে দেখলাম যে তূর্য আর ঊর্মি ঠিকই বলেছে --ওদের চিন্তার কারণ আছে।তাই ওদের কাছেই চলে যাব,ওরাও আর চিন্তা করবে না।'লহরী অবাক হয়ে বলল--'তুমি চলে যাবে? আমার কি হবে? আমি কোথায় যাব?' উর্বী বললেন-'তোর বাবাকে খবর দিয়ে দেব।এসে তোকে নিয়ে যাবে।আর তোর মাইনেও তো জমেছে অনেক।সেটা পোস্ট অফিসে রাখবি,তোর চলে যাবে।' টুম্পা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, একথাগুলো মাসিমা বলছেন..ও মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করল - 'তোমার বাড়িটার কি হবে?? বস্তির ছেলে মেয়েগুলোকে আর পড়াবে না? 'সংহিতা' -র কি হবে? মাসিমা বললেন -- দেখি --ওদের সাথেও কথা বলতে হবে। অনেক কাজ বাকি--বিকেলে যাঁরা এসেছিলেন ওঁদের সাথে তো এই পরামর্শই করছিলাম।' টুম্পা এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল--'ও! আমরা তোমার কেউ নই তাই তো? যে দাদা-দিদি একবারও তোমায় দেখতে আসে না তুমি তাদের কাছে চলে যাবে আর আমরা তোমায় ভালোবাসি, তাদের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে না! লাগবে না আমার মাইনে --ওটাও তুমি ওদের দিও--'বলতে বলতে ও দৌড় দিল রান্নাঘরে। উর্বী মুচকি হেসে টি.ভি.র পর্দায় চোখ রাখলেন, জানেন এখন ডাকলেও আর টুম্পা আসবে না। কখন যে দুচোখ ভরে গেল জলে.. বুঝতে পারেন নি..আজ এত বছর পর চোখে জল এল!!সেকি দুঃখের না আনন্দের!! 

হঠাৎ চমক ফিরল লহরীর ডাকে --  'তোমার চা'--ঘড়ির দিকে চেয়ে  দেখলেন সাড়ে-আটটা। উর্বী এসময় এককাপ চা খান‌।'লহরীঈঈঈ---'ডাক শুনে দরজায় এসে দাঁড়ায় টুম্পা।'তোর চা কই?' 'আমি খাব না-ভালো লাগছে না'- উত্তর দিয়েই পেছন ফিরেছে মেয়ে! আপনমনেই ফিক করে হাসলেন উর্বী।রাতে খাবার টেবিলেও টুম্পা বেশ গম্ভীর, উর্বীর টুকটাক কথার জবাব দেওয়া ছাড়া মেয়ে চুপচাপ।ওর পছন্দের খাবার হলেও ও সেভাবে খেলোনা। জিজ্ঞেস করে উত্তর পেলেন-এমনিই ওর শরীর ভালো লাগছে না। লহরী কে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলে 

নিজের ঘরে চলে গেলেন উর্বী। চেয়ারে বসে কত কথা ভাবতে লাগলেন, ফিরলেন অতীতে--কখনো চোখে জল..কখনো বুকে কষ্ট।


পর্ব-৪

ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ যে কেটে গেছে উর্বী বুঝতেও পারেননি--হঠাৎ মনে হল কেউ যেন গুমরে গুমরে কেঁদে চলেছে... একটানা। অবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন দু'টো পাঁচ। টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে পরে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন... বোঝার চেষ্টা করলেন কোন দিক থেকে  কান্নাটা আসছে---মনে হল যেন লহরীর ঘর থেকে আসছে আওয়াজটা। ভয় পেয়ে জোরে জোরে দরজাটা ধাক্কাতে শুরু করলেন উর্বী। লহরী দরজা খুলে দিলে ভেতরে ঢুকে উর্বী দেখলেন ওর দুটো চোখ  জবাফুলের মত লাল--নাক টেনেই চলেছে--জিজ্ঞেস করে জানলেন যে ওর নাকি ঠান্ডা লেগে গেছে, উর্বী বললেন যে আর মিথ্যে কথা বলতে হবে না কারণ উনি জানেন ও কাঁদছিল।লহরী চুপ করে রইল। উর্বীর খুব কষ্ট হল, সঙ্গে পরম মমতা। লহরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন 'বোকা মেয়ে! কাঁদছিস কেন? আমি কি বলেছি যে তোর দায়িত্ব আমি নেবোনা? দাদা-দিদি কে দেখেও তো শিখতে পারিস! শোন--এত নরম মনের হোসনা, লোকে সুযোগ নেবে। অনেক রাত হলো,এবার আর না কেঁদে ঘুমিয়ে পড়। আমিও যাই।' পিছন ফিরতেই শুনতে পেলেন লহরীর কথা--'আমি তো আর দাদা-দিদি-র মতো অতো লেখাপড়া করিনি,কেবল মাধ্যমিক পাস। তাই আমি অত কিছু বুঝিনা, কিন্তু যে লেখাপড়া মাকে দূরে সরিয়ে দেয়, সেই লেখাপড়ার দাম নেই আমার কাছে।'

উর্বী প্রচন্ড চমকে গেলেন লহরীর কথা শুনে, অবাকও হলেন। নিজের কাছে নিজেকে আর লুকোতে পারলেন না। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে হেলান দিলেন চেয়ারে। ঘড়িতে এখন তিনটে কুড়ি। উর্বী ভাবলেন বুঝি সাধারণ গ্ৰাম্য মেয়েটার কাছে ধরা পড়ে গেলেন,এই অতি সাধারণ মেয়েটা কি অক্লেশে সত্যি কথাটা বলে দিল। যে যন্ত্রণা উনি অতি সঙ্গোপনে নিজের বুকের মধ্যে তালা দিয়ে আটকে রেখেছেন তাকে এক ঝটকায় টান মেরে খুলে দিল লহরী!!

পরের দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ অনিমেষকে ফোনে ধরলেন, জানিয়ে দিলেন দিন তিনেকের মধ্যে যেন উইলের খসড়াটা লিখে আনে,কোন সংশোধনের দরকার থাকলে তখন দেখা যাবে। 

লহরী কে ডেকে বললেন 'শোন--আজ আমার সাথে তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব ন'টার সময়, তৈরী থাকিস।' লহরী জিজ্ঞেস করল 'দুপুরের খাবার?' উর্বী বললেন সে পরে দেখা যাবে।

ঠিক ন'টার সময় লহরীকে নিয়ে উর্বী  বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। গাড়িতে যেতে যেতে লহরী জিজ্ঞেস করল যেওরা কোথায় আর কেন যাচ্ছে? উর্বী ওকে ধৈর্য ধরতে বললেন। প্রায় একঘন্টা পরে গাড়িটা একটা পাঁচিলঘেরা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। দু'জনে নেমে বাড়িতে ঢুকলো। লহরী অবাক হয়ে দেখল কি সুন্দর বাড়িটা!কত বড় বাগান! কত্তো ফুলগাছ !

উর্বী লহরী কে বললেন-'এই আমার সংহিতা---বড় আশা নিয়ে গড়েছি,আয় ভেতরে আয়--আরো ভালো লাগবে। একটু এগোতেই একটা বছর চারেকে'র মেয়ে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো-- 'দিম্মা এসে গেছে,কি আনন্দ!'লহরী দেখল মেয়েটার চোখে-মুখে আনন্দ যেন উপছে পড়ছে। মাসীমা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন-'পড়তে বসিস নি?'মেয়েটা বললো-'বা রে! তুমি এলে তো আমি পড়তে বসি।' 'তাহলে এতক্ষণ কি করছিলি?' 'আমিতো ফুল তুলেছিলাম গো তোমার জন্য'--একগাল হেসে মেয়েটা বললো। 'ঠিক আছে',এখন সবাইকে গিয়ে বল যে একটা নতুন দিদি এসেছে--যা পালা--'।শুনেই মেয়েটা একছুট দিল.... উর্বী এবার একগাল হেসে লহরীকে বললেন--'জানিস তো ওর নাম রেখেছি বসুন্ধরা, দু'বছর আগে যে বন্যা হয়েছিল তাতে ওর গ্ৰাম ভেসে গিয়েছিল সঙ্গে ওর বাবা-মা ও। এখানকার এক সদস্য ওকে এখানে নিয়ে এসেছিল,তখন ওর ভালো করে কথাও ফোটেনি।ওর নাম জিজ্ঞেস করায় বলেছিল--টুনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে যুদ্ধজয় করে ও এসেছে তাতে ওর নাম হওয়া উচিৎ বসুন্ধরা কারণ সব বাধা একমাত্র বসুন্ধরা ই বুক পেতে নিতে পারে,সে সর্বংসহা। বসুন্ধরা মানে জানিস তুই?' উর্বীকে অবাক করে লহরী বললো--'পৃথিবী'। চমৎকৃত হলেন উর্বী। দু'জনে বাড়ির ভেতরের দিকে চললেন। লহরী ঢুকে দেখল অনেকগুলো ছোট শিশু ... বিভিন্ন বয়সের। উর্বীকে দেখে ওদের কি আনন্দ!

লহরীর সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন উর্বী, বললেন যে ওরা বড় অসহায়, কোন পরিস্থিতি থেকে উনি ওদের নিয়ে এসেছেন সেকথা পরে বলবেন। ফুলের মত বাচ্চাগুলোকে দেখে লহরীর খুব ভালো লাগল, সঙ্গে কোথাও একটু কষ্টও লাগছিলো। মাসিমা প্রত্যেক কে জিজ্ঞেস করলেন তারা কেমন আছে, উত্তর এল একসঙ্গে--'ভালো আছি'।

লহরী জানল যে আজ রবিবার তাই পড়ার ছুটি, নাহলে প্রতিদিন ওদের ক্লাস হয়,বছর শেষে পরীক্ষা হয়,ওরা রবীন্দ্র জয়ন্তী,১৫ ই আগস্ট, সরস্বতী পুজো সব করে। সংহিতা'র সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭৫, সবাই মনপ্রাণ ঢেলে এই সংস্থাকে ভালোবাসে।লহরী অবাক হয়ে সব শুনছিল আর ভাবছিল মাসিমা এর আগে কখনো এইসব নিয়ে ওর সাথে কোন কথা বলেননি তাহলে আজ কেন? হঠাৎ একটা মাঝবয়সী মহিলা এসে ওদের চা আর বিস্কুট দিল। মাসিমা পরিচয় করিয়ে দিলেন-- 'ওর নাম মাধবী,বর অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছে ওর কোন সন্তান নেই বলে, বরের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ও নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল,এক সদস্য ওকে এখানে নিয়ে এসেছিল, সেই থেকেই ও এখানে আছে,এই বাচ্চাগুলোকে দেখাশোনা করে, ওদের খেয়াল রাখে।' লহরী জিজ্ঞেস করল 'ও নিজের বাড়িতে ফিরে যায় নি কেন?' এবার মাধবী বললো যে ওর মা-বাবা দুজনেই মারা গেছে ছোটবেলায়, দাদাও বিয়ে দিয়ে আর কোনও যোগাযোগ রাখেনি--তাই আর ওদের বোঝা হইনি,একটু হেসে আরো বললো কেউ জানেই আমি কোথায়, বেঁচে আছি কিনা তাও জানেনা। কিন্তু আমি তো খুব ভালো আছি, আনন্দে আছি এদের মধ্যে।ওরা যখন "মামনি"বলে আমায় ডাকে তখন খুব ভালো লাগে। আগের কোনো কষ্ট আর কষ্ট মনে হয় না।' লহরী দেখল মাধবীর সারামুখ জ্বলজ্বল করছে।ওরও খুব ভালো লাগছিল। ও সারা বাড়িটা মাধবীর সাথে ঘুরে দেখল,জানল যে আরো তিনজন আছে বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য। ঘুরেফিরে ও যখন উর্বীর কাছে এলো তখন উনি বললেন যে আবার পরে একদিন ওকে নিয়ে আসবেন যদি ওর ভালো লেগে থাকে,আজ আর সময় নেই। ওরা যখন ওখান থেকে বেরিয়ে আসছে ঠিক তখনই বসুন্ধরা বলে উঠল---'নতুন মা আবার কবে আসবে গো

দিম্মা?' নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না লহরী,ওকে 'নতুন মা' বলে ডাকল! জলভরা চোখে ও জানাল যে খুব তাড়াতাড়ি আসবে।তারপর দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

গাড়িতে উঠে উর্বী জিজ্ঞেস করলেন যে 'সংহিতা'ওর কেমন লাগলো?লহরী উত্তরে জানালো যে ও যেন এক নতুন জগৎ খুঁজে পেয়েছে আজ।ওর আনন্দ হয়েছে এটা জানাতেও ভুললো না। উর্বী বললেন---'দেখলি তো, আমি কেন এত ভালো থাকি।' তারপর ড্রাইভারকে বললেন একটা রেস্টুরেন্টে দাঁড়াতে। লহরী জিজ্ঞেস করল যে ওরা কি রেষ্টুরেন্টে খাবে? উত্তর এল--'হ্যাঁ,এখন বাড়ি গিয়ে আর রান্না চাপাতে হবে না। অনেক কাজ আছে,কথা আছে।' লহরীর খুব আশ্চর্য লাগছিলো, মাথার মধ্যে নানারকম প্রশ্ন খেলা করছিলো। রেষ্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ি ফিরে উর্বী বললেন যে একটু বিশ্রাম নিয়ে তারপর ওর সাথে কিছু কথা বলবেন।

লহরী একরাশ চিন্তা নিয়ে ঘরে গেল। বিকেলে মাসিমা ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন ও কি 'সংহিতা'য় কাজ করবে? লহরী বললো-- 'তাহলে তুমি চলেই যাবে দাদা-দিদির কাছে?আর কখনো আসবে না?'উর্বী বললেন যে সেটা তিন-চার দিন পরে বলবেন,এখন প্রশ্নের উত্তর দিতে। টুম্পা জানালো যে ও একদিন গিয়েই ওদের ভালোবেসে ফেলেছে। তাই ওদের জন্য, ওদের সাথে কাজ করতে পারলে ও খুব খুশি হবে। উর্বীর মুখ দেখে মনে হলো উনি খুব নিশ্চিন্ত হয়েছেন।

 দিন কয়েক পরে সকালে জলখাবার খেতে খেতে উর্বী টুম্পাকে জানালেন যে উনি 'সংহিতা'র ভার আর বস্তির নিচু ক্লাসের বাচ্চাদের পড়াশোনার দায়িত্ব ওকেই দেবেন বলে ঠিক করেছেন। টুম্পা বলল - 'মানে? আমি কি করে!! তোমার মাথা খারাপ নাকি? আমি কি করে এত দায়িত্ব নেব? তুমি কি বলছ? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।' উর্বী বললেন - 'আমি তো আছি, তোকে আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে দেব।'সংহিতা'র ট্রাস্টি বোর্ডও আছে, ওদের সাথে কথা বলে নেব, ওরাও তোকে সাহায্য করবে। আমি চাই আমার পর তুই দায়িত্ব নিবি।' খাওয়া শেষ করে উর্বী তৈরী  হয়ে বেরিয়ে গেলেন। আর টুম্পা অথৈ জলে পড়ল, মাসিমা কি বলে গেলেন,ও কি পারবে? ভাবতে ভাবতে রান্নাঘরে গিয়ে মনে পড়ল কি রান্না হবে সেটাই ও জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে। আবার বসার ঘরে এসে ফোন করলো ও। ফোন বেজে গেল, মাসিমা ধরলেন না। টুম্পা ওর পছন্দমত খাবার তৈরী করে নিল। টুকটাক ঘরের কাজ করতে করতে টুম্পা ভাবতে লাগল নিজের কথা,ওর লহরী হয়ে ওঠার কথা, মাসিমার কথা, দাদা-দিদির কথা, বাড়ির কথা ---- সঅঅঅব। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় দু'টো। চমকে গেল লহরী!এত দেরী তো মাসিমার হয়না!!ও আবার ফোন করল, এবার উর্বী জানালেন যে উনি দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই ফিরছেন। নিশ্চিন্ত হল লহরী।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডোরবেল বাজল। উর্বী ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। দেরী,ফোন না ধরার কারণ ওনাকে জিজ্ঞেস করল  টুম্পা। উনি বললেন খুব ব্যস্ত ছিলেন বলে ফোনের আওয়াজ শুনতে পাননি আর এক জায়গায় গিয়েছিলেন বলে আসতে একটু দেরী হল। লহরীকে টেবিল সাজাতে বলে উনি স্নানে ঢুকলেন। খেতে খেতে ওকে জানালেন যে সেদিন যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা আজ আবার আসবেন। লহরী বলল--'আবার কেন? সেদিন কথা শেষ হয়নি?' উর্বী মজা করে বললেন -- 'আজ ওনারা তোকে দেখতে আসবেন। ভালো করে সেজেগুজে থাকবি।' মাসিমার কথা শুনে মুখটা হাঁ হয়ে গেল লহরীর আর চোখদুটো রসগোল্লার মতো। কোনোমতে বললো--' আমায় দেখতে আসবে মানে?'উর্বী বললেন-'তখনই সব বুঝতে পারবি,আমি সব কথাবার্তা বলে এলাম আজ।'বলে উর্বী টেবিল ছেড়ে উঠে হাতমুখ ধুয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন। লহরী সব পরিষ্কার করতে করতে ভাবল যে ছেলে-মেয়ে দুজনের কাছ থেকে আঘাত পেয়ে মাসিমার মাথাটা বোধহয় বিগড়ে গেছে নাহলে ওর আবার বিয়ে দিতে চাইছেন কেন? তাছাড়া ওর বাবা-মা কাউকে বোধহয় এখনো কিছু জানাননি, তাহলে ওরা নিশ্চয়ই ফোন করে ওকে জানাতো। এইসব ভাবতে ভাবতে ওর নিজের মাথাটাই ঝিমঝিম করতে লাগলো,সব কাজ সেরে ও পায়ে পায়ে মাসিমার ঘরে এলো,দেখল মাসিমা কাগজ পড়ছেন বালিশে হেলান দিয়ে। ওকে দেখে বললেন-'কি রে! আবার কি হল?'লহরী মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করল-'তুমি কি আমার আবার বিয়ে দিতে চাও? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে একেবারে? মা-বাবা জানে?'এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ও উর্বীর দিকে তাকালো। উর্বী হেসে বললেন-'হ্যাঁ,দেব--তবে সে খুব ভালো-তোর অবশ্য পছন্দ হবে কিনা   জানিনা! তবে তোর বাবা-মা অমত করবে না। এখন ঘরে যা, আমি এখন একলা থাকব।' লহরী জিজ্ঞেস করল -'তোমার কি হবে?' উর্বী বললেন-'এখন ঘরে যা, পরে দেখা যাবে ।'লহরী মাথা নিচু করে ঘরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলতে বলতে গেল 'আমি তোমায় ছেড়ে কিছুতেই যাবোনা।মরে গেলেও না।' ও চলে গেলে উর্বী একটু হাসলেন জলভরা চোখে।

পর্ব-৫

উর্বীর কথার মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে না পেরে টুম্পা একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে গেল। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে মাসিমার কথা ভাবতে লাগলো।

কখন যে বিকেল হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি। সম্বিৎ ফিরল মাসিমার ডাকে -- 'কি রে! এখনো শুয়ে আছিস?ওঠ, চোখে মুখে জল দিয়ে তৈরী হয়ে নে, ওনাদের আসার সময় হয়ে গেল তো।'

লহরী ধড়মড়িয়ে উঠে শেষবারের মতো বলতে চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলো উর্বী চলে গেছেন।এই প্রথমবার টুম্পার ওনাকে খুব নিষ্ঠুর মনে হলো,রাগও হলো,ও নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ভাবতে লাগল কিভাবে কি করবে।

হঠাৎ ডোরবেল বাজল--লহরীর মনে হলো -আওয়াজটা ওর ভবিষ্যতের অশনিসংকেত!! দরজা খুলে দেখল সেদিনের দুই ভদ্রলোকের সাথে আরো দু-তিনজন রয়েছে। ওদের বসতে বলে উর্বীকে ডাকতে গিয়ে দেখলো উনি নিজেই আসছেন। টুম্পাকে দেখে অতিথি আপ্যায়নের আয়োজন করতে বলে উনি বসার ঘরে ঢুকে গেলেন।লহরী ও রান্নাঘরে ঢুকলো মনে এককাঁড়ি রাগ নিয়ে।ওর একবার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে বিয়ে করে তারপর আর কোনো ভক্তি নেই বিয়ের প্রতি।আর তাছাড়া ওর তো ডিভোর্সও হয়নি, সেটা তো মাসিমার অজানা নয়। তাহলে??? ভাবতে ভাবতে চা তৈরী করে ট্রে-এর ওপর সাজিয়ে পা বাড়ায় বসার ঘরের দিকে...বাইরে থেকে ও শুনতে পেল  মাসিমা বলছেন যে উনি অনেক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,আর উনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে উনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে ওনার কোন আক্ষেপ নেই,বরং আনন্দ আছে প্রচুর। টুম্পাকে ঢুকতে দেখে উর্বী ওকে নিজের কাছে ডাকলেন।লহরী ট্রে টেবিলে নামিয়ে মাসিমার কাছে যেতেই উনি ওকে পাশে বসিয়ে সবার সাথে ওর আলাপ করিয়ে দিলেন। ও সবাইকে নমস্কার জানালো। উর্বী ভবতোষ বাবুকে বললেন--'দেখুন আমি একদমই মনে করিনা যে নিজের সন্তান হলেই সে সবকিছুর অধিকারী হবে, যে সন্তান তার মা-বাবার কথা ভাবে না--তাদের প্রয়োজনে কাজে লাগেনা,বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করেনা, এমনকি তাদের ত্যাগের কথা ভুলে যেতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ  করেনা, সেই সন্তানের কোন অধিকার থাকতে পারে না সম্পত্তির ওপর।উনি আরও বললেন আপনি জানেননা দাদা তূর্য আর ঊর্মি বিদেশে যাবার পর কোনদিন সেভাবে আমার খোঁজ-খবর নেয়নি, এমনকি তূর্য তো বিয়ে করে জানিয়েছিল,আর ঊর্মির তো নাকি সময়ই নেই এদেশে আসার। আচ্ছা জীবনবাবু... ভাবতে পারছেন যাদের আমি এত কষ্ট করে মানুষ করেছি বলে মনে করতাম তারা আসলে শুধুমাত্র লেখাপড়া জানা অশিক্ষিত অমানুষ। আপনারা তো জানেন ওদের বাবা মারা যাওয়ার পর সবাইকে নিয়ে কি কষ্ট করেছি দিনের পর দিন,আর আজ???ওরা সম্পত্তির চুলচেরা হিসেব চেয়ে উইল তৈরী করে তার জেরক্স কপি চেয়ে পাঠিয়েছে??এত স্পর্ধা!!!'--বলতে বলতে উনি হাঁফাতে লাগলেন।লহরী তাড়াতাড়ি একগ্লাস ঠান্ডা জল এনে দিয়ে বলল-'এটা খেয়ে নাও।আজ  প্রেশারের ওষুধটা খেয়েছিলে?এত কথা বোলোনা মাসিমা, তোমার কষ্ট হচ্ছে।' জলটা খেয়ে অবিনাশবাবুকে প্রশ্ন করলেন উর্বী--'কে বেশি আপন আমার বলুনতো? আমার ছেলে-মেয়ে না এই মেয়েটা? যতবার আমার শরীর খারাপ হয়েছে ততবার দেখেছি ও রাতেও আমার খেয়াল রাখে, ডাক্তার ডাকে, সময়মতো ওষুধ খাওয়ায়। মাঝেমাঝে শাসনও করে। কখন যে ও আমার মেয়ে হয়ে গেছে তাই জানিনা।তাহলে বলুন আমি কি সঠিক বিচার করিনি? ছেলেমেয়ের প্রতি আমার কর্তব্য শেষ,তারা নিজেদের নিয়ে ভালোই আছে। এদেশে ওদের আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।ওরা আসবে আমার মৃত্যুর পর ওদের সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিতে। বাড়িটা তো ভাগ করতে পারবে না, হয়তো বেচে দিয়ে টাকা গুনে নেবে। আমার শ্বশুরের খুব প্রিয় বাড়ি---আমিও এই বাড়িতেই নতুন  বউ হয়ে এসেছিলাম একদিন, ওদের বাবা ও এই বাড়ি থেকেই চিরবিদায় নিয়েছেন। যাবার আগে উনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন আমি যেন প্রাণ দিয়ে এবাড়ি টাকে আগলে রাখি, শ্বশুরমশাই-এরও একই কথা ছিলো। আমি জানি লহরী আমার পর এই বাড়ির দেখভাল করবে, আমার আর এক সন্তান 'সংহিতা'র যত্ন নেবে। তাই আমি আমার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি আমি লহরী ওরফে টুম্পা কেই দিয়ে দিলাম,ও যা ভালো বুঝবে তাই করবে, তবে আমার বিশ্বাস ও কোনোদিন আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না।'

পর্ব-৬

টুম্পা অবাক হয়ে শুনছিল কথাগুলো, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না, শুধু কান্না দলা পাকাচ্ছিল গলার ভেতর,আর বুকের মধ্যেটা কষ্টে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল। উর্বী ওকে আর এক গ্লাস জল আনতে বললেন। টুম্পা প্রায় দৌড়ে রান্নাঘরে গেল।জল এনে দেখল সবাই চুপচাপ বসে আছেন। ভবতোষবাবু,অবিনাশবাবু মাথা নীচু করে বসে আছেন। টেবিলের চায়ের কথা কারোরই মনে নেই,চা তো কখন জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে। উর্বীকে জল দিয়ে ও সোফায় বসে পড়ল। জল খেয়ে উর্বী বললেন--'আর একটা কথা --আমার মৃত্যুর পর আমার মুখাগ্নি করবে লহরী। ওকে আমি পেটে ধরিনি একথা ঠিক কিন্তু আজ আমার নিজের সন্তানের চেয়েও ও আমার বেশি কাছের, শুনতে খারাপ লাগলেও আমার বেশি প্রিয়জন।আর আমার শ্রাদ্ধ হবেনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওসব পছন্দ করিনা। মৃত্যুর পর আমার দেহের যেসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মানুষের কাজে

 লাগবে, সেগুলো চিকিৎসকরা নিয়ে নেবেন, আর তারপর বাকি সৎকার করবে লহরী।'এবার টুম্পা আর থাকতে না পেরে কেঁদে উঠলো, বললো-'তোমার কিছু হবেনা মাসিমা,কেন এমন পাগলামি করছ? চুপ করো। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।'হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো  টুম্পা,আর কিছু বলতে পারলোনা।উর্বী ওকে শান্ত হতে বললেন। তারপর আবার বললেন 'আগের দিন আমি অনিমেষ আর জয়ন্তকে বলেছিলাম এই কথাগুলো স্পষ্ট করে লিখে উইল তৈরী করতে যাতে আমার মৃত্যুর পর আর কেউ কোনো কথা ওকে বলতে না পারে, কোনোভাবেই দোষারোপ না করতে পারে। ওরা সেইমতোই লিখেছে। আমি দেখেছি উইলটা। আজ আপনাদেরও বললাম। অনিমেষ এবার বলো কোথায় কি সই করতে হবে? এরপর উইলটা রেজিস্ট্রেশন করিয়ে জেরক্স কপি করে দুজনকে পাঠিয়ে দিতে পারলেই আমার শান্তি।'

বলে উর্বী একটা নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেললেন।

এতক্ষণে মুখ খুললেন অবিনাশবাবু... 'ঠিক করেছেন বৌদি... একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার সম্পূর্ণ সায় আছে, আমি যা করতে পারিনি--আপনি করে দেখালেন। আপনার চিন্তাধারা অনেক সন্তানকে শিক্ষা দেবে। জানেন বৌদি আমার ছেলেও বৌমার কথায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে একমাত্র নাতিটাকে নিয়ে। আজ মনে হচ্ছে বৌমাকেই বা দোষ দেব কেন? নিজের ছেলের কি কোনো দোষ নেই? বৌমা তো পরের বাড়ির মেয়ে, নিজের ছেলের যখন তার বাবা মা-কারো ওপর টান নেই, তখন তার কেন থাকবে? কলকাতাতেই তো থাকে,আসেও না.. এমনকি একটা ফোন পর্যন্ত করে না কেমন আছি জানার জন্য। সত্যিই তো আমরা তো আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছি। তবে আজ বুঝতে পারছি একটা বড় ভুল করে ফেলেছি -- বাড়িটা, ব্যাঙ্কব্যালেন্স সব ওদের নামে করে দিয়েছি‌। দেখি..ব্যাঙ্ক আর পোষ্ট অফিসের বই থেকে ওদের নাম বাদ দিয়ে দেব..'সংহিতা'র নামে করে দেব। আর দেহদান করে দেব হাসপাতালে। কিছু নতুন ডাক্তারদের তো কাজে লাগবে। সত্যি বৌদি আপনার থেকে আজ নতুন শিক্ষা পেলাম।' ভবতোষবাবু বললেন-- 'আজ বুঝতে পারছি নিজের ভুল... সত্যিই তো দুই ছেলে কেন এত তাড়াহুড়ো করে উইল বানিয়ে নিল। আচ্ছা অনিমেষ উইল পাল্টানো যায়?? তাহলে আমিও উইল পাল্টাবো।' অনিমেষ জানালো যে উইল পাল্টানো সম্ভব। জীবনবাবু বললেন -- 'এতদিন সন্তান না হওয়ার জন্য একটা চাপা কষ্ট ছিল আমাদের।আর সম্পত্তি কাকে দেব,কাকে দেব না,কার ভাগে কম,কার ভাগে বেশি হয়ে যাবে সেই সব ভাবতাম।তবে একটা চিন্তা আমার নেই কারণ আমি তো ভাড়াবাড়িতে থাকি। আমার সম্পত্তিও ভাবছি 'সংহিতা'কে দিয়ে যাব,দেখি বাড়ি গিয়ে গিন্নির সাথে কথা বলে। তবে সত্যি বৌদি আপনি আমাদের এক নতুন আলোর দিশা দিলেন। আপনার চিন্তাধারাকে হাজার হাজার কুর্ণিশ।আর আমি ও দেহদান করে যাব, গিন্নিও আশা করি অমত করবে না।' 

উর্বী বললেন আবার চা করে আনতে। এতক্ষণে সবার খেয়াল হলো যে চা খাওয়া হয়নি। ঘড়ির কাঁটা প্রায় ন'টার কাছাকাছি।তবে সবাই আনন্দ করে বলল যে আজ চা খেয়ে তবে যাবে। দারুণ একটা অভিজ্ঞতা সবাই অর্জন করেছে আজ উর্বীর কাছ থেকে.. সন্তানের অবহেলার পাত্র না হয়ে নিজেদের আনন্দ খুঁজে নিতে শিখেছে। 

পর্ব-৭

সবাই টুকটাক গল্প করছে। লহরী চা বানাতে বানাতে ভেবে রাখলো যে পরে সবাই চলে গেলে মাসিমার কাছে থেকে ভালোভাবে সবকিছু শুনবে, অনেক কথাই ও বুঝতে পারেনি।সবার সব কথা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে।

চা আর বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকে ও সবার হাতে কাপ-প্লেট দিল।সবাই এবার একসাথে চা খেতে খেতে গল্পগুজব করতে লাগলো। কথা হল অবিনাশ বাবু আর জীবনবাবু দুজনে উর্বীর সাথে রেজিস্ট্রেশন অফিসে যাবেন উইল রেজিস্ট্রি করতে।প্রায় সাড়ে ন'টার সময় সবাই চলে গেলে টুম্পা উর্বীকে জিজ্ঞেস করল রাতের রান্নার কথা। উর্বী জানালেন যে আলু আর ডিম সেদ্ধ দিয়ে ভাত খাবেন।লহরী জানে যে খাবার সময় উর্বী ঘি অথবা মাখন চাইবে,তাই আগেই জানিয়ে দিল যে বাড়িতে ঘি-মাখন কিছু নেই।উর্বী বললেন -'শুধু আজকের দিনটা একটু অন্যরকম হোক।কাল থেকে তোর সব কথা শুনে চলব।'টুম্পা বলল---- 'ডাক্তারবাবু তোমায় না ঘি-মাখন-চর্বী জাতীয় খাবার খেতে বারণ করেছে,আর তুমি আজ সারাদিন উল্টোপাল্টা খাচ্ছ,কেন গো?' উর্বী উত্তর দিলেন-'আনন্দে!!কি খুশি যে লাগছে আজ! কাল থেকে আবার সব নিয়ম মেনে চলব,দেখিস তুই। যা তাড়াতাড়ি,রাত অনেক হলো।' লহরী আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। উর্বী টিভির সামনে বসলেন। মনে আজ আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। উনি নিজের মতো করে নিজের মতামত জানিয়েছেন,উইল তৈরী করেছেন, মনেমনে তূর্য আর ঊর্মিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালেন, ওরা না বললে হয়তো এত তাড়াহুড়ো উনি করতেন না। তবে উইলের জেরক্স কপি পেয়ে ওরা কি করবে, ওদের মুখের অভিব্যক্তি কেমন হবে সেটা আন্দাজ করে ওনার ভারী ভালো লাগলো। উইলের জেরক্স কপির সাথে দুজনকে দুটো চিঠিও লিখতে হবে, তাতে স্পষ্ট করে লিখে দিতে হবে যে কেন উনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।   সন্তান কেবলমাত্র সম্পত্তির অধিকারী হবে, কোন দায়িত্ব পালন করবে না,তাই হয়না। ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী উর্বী যেমন ওদের কোন ইচ্ছায় বাধা দেননি, তেমনি ওনার ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ওরাও যেন কখনো কোন বাধা না দেয় সেটা স্পষ্ট করে লিখে দিতে হবে। আরও জানিয়ে দিতে হবে যে উনি ওদের প্রতি ওনার যে কর্তব্য ছিল তার সঠিকভাবে পালন না করলে আজ ওরা নিজেদের জীবন নিজেদের ইচ্ছেমতো গুছিয়ে নিতে পারতো না। তাই ওনার কোন আক্ষেপ নেই। আর চিঠিও বা উইল পাওয়ার পর এদেশে এসে  কোন লাভ নেই কারণ উনি উইল বদলাবেন না কোনোমতেই। এতদিন যখন ওদের ছেড়ে থাকতে পেরেছেন বাকি জীবনটাও ঠিক ছেড়ে থাকতে পারবেন।

ভাবনায় ছেদ পড়ল লহরীর ডাকে -- 'খাবার তৈরী।' খেতে খেতে উর্বী বললেন লহরীকে---'তুই একটুও ভয় পাস না। আমি তো আছি, তোকে আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে দেব, দেখিস তোর জীবনটাও খুব সুন্দরভাবে কেটে যাবে। কখনো নিজেকে একলা মনে হবেনা।আর হ্যাঁ আর একটা কথা..আমায় আরো বেশি যত্ন করবি -- বুঝলি? যখন যা খেতে চাইবো খেতে দিবি কেমন?এখন তো সবকিছুর মালকিন তুই!অবশ্য তুই যদি এখন আর আমাকে -- ' উর্বীকে এবার এক ধমকে চুপ করিয়ে  দিল লহরী, বলল--'তুমি যদি আর কোনোদিন এসব বলো তাহলে আমিও বাড়ি ফিরে যাব।আর কোনোদিন ফিরব না।' উর্বী ফিক করে হেসে ফেললেন। বললেন--'যাক বাবা। এতদিনে একটা মা ও পেলাম মেয়ের  সাথে। আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে গেল রে।'

 টুম্পা কটমট করে একবার উর্বীর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল... বললো। -- ' জানোতো! আমার না খুব রাগ হচ্ছিল কদিন ধরে তোমার ওপর, ভেবেছিলাম তুমি বোধহয় সত্যিই আমার বিয়ে দিতে চাইছ, আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না, মনে হয়েছিল তোমার বোধহয় মাথাখারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু তুমি কেন সব আমার নামে করে দিলে?'

উর্বী বললেন যে উনি অনেক ভেবেই কাজটা করেছেন।আর যা করেছেন ঠিক করেছেন। কথা বলতে বলতে খাওয়া শেষ। উর্বী টুম্পাকে নিজের  ঘরে আসতে বলে হাতমুখ ধুয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। লহরী সব কাজ সেরে ওনার ঘরে ঢুকে দেখল মাসিমা বসে আছেন।ওকে দেখে কাছে ডেকে হেসে বললেন-'কিরে এবার বর পছন্দ হয়েছে?জানিস তো "বর"মানে শুধু স্বামী নয়,"বর"মানে আশীর্বাদও। আমি আমার সব আশীর্বাদ তোকে দিয়ে সত্যিই খুব শান্তি পেয়েছি রে, আমি তো সত্যিই একদিন থাকবো না,  কিন্তু তোর কাজের মধ্যে দিয়ে  আমি থাকবো সবজায়গায়---' আমার সংহিতা-য়'। বলে পরম স্নেহে লহরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন--'শুধু সন্তানরাই বাবা-মা কে দূরে ঠেলতে পারে? আমি দেখিয়ে দিলাম -- বাবা-মা ও সন্তানকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। সমাজ বদলাচ্ছে, আমরাও আধুনিক হচ্ছি.. ছেলেমেয়েরা যদি তাদের কর্তব্য পালন না করে তাহলে তারাও যেন বাবা-মার কাছে থেকে কিছু আশা না করে।' লহরী উর্বীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো--'আমিও যে এক নতুন আলোর পথে পা বাড়ালাম তোমার হাত ধরে। আমার আর কোনো দুঃখ নেই, 'সংহিতা'কে পেয়ে আমি সত্যিই নিজের প্রতি গর্ব অনুভব করছি। আমি তোমার সব গাইডলাইন মেনে চলব। মাসিমা তুমি হলে 'নতুন আলোর দিশারী!'

রাতের তারা আর আঁধার ঘেরা পৃথিবী নীরব সাক্ষী হয়ে রইল এই স্নিগ্ধ-মনোরম সম্পর্কের। আগামী দিনের সকাল সকলকে এক নতুন আলোর সন্ধান দেবে।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment