বাংলা গানে সত্যজিৎ
অভিষেক ঘোষ
"ওরা যত বেশি পড়ে
তত বেশি জানে
তত কম মানে ।" - এমন অনবদ্য সংলাপের রচয়িতা যিনি, তিনি যে গীতিকার হিসেবেও
কতটা তুখোড় ছিলেন, 'হীরক রাজার দেশে' -র গানগুলির প্রত্যেক
শ্রোতাই সে সম্পর্কে অবগত আছেন । "দেখো রে, নয়ন মেলে..." -র
মতো গানে কয়েকখানা শব্দই বারবার ঘুরেফিরে আসে, তাও আমরা যে বারেবারে
মুগ্ধ হই, এতেই গীতিকার ও সুরকার হিসেবে তাঁর দক্ষতা প্রমাণিত হয় ।
‘রবীন্দ্রনাথ ও বাঙলাভাষা’
প্রবন্ধে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক
অদ্ভুত সমন্বয় দেখতে পাই—তিনি শাব্দিকও বটেন, কবিও বটেন । শব্দ আর অর্থ, উচ্চারিত ধ্বনি আর তার ভিতরের ব্যঞ্জনা, এই দুইয়ের সম্বন্ধেই কবির
মনে স্পর্শকাতরতা ছিল ।" এ জিনিস আমার মতে সত্যজিতের মধ্যেও ছিল - সীমাবদ্ধ
ক্ষেত্রে হলেও ছিল ।
"মোরা সাদাসিধা মাটির
মানুষ দেশে দেশে যাই,
মোদের নিজের ভাষা ভিন্ন আর ভাষা জানা নাই !" - সত্যজিৎ রায় রচিত এই দুটি
পংক্তিই প্রমাণ, আমাদের বাংলা ভাষা তথা বাংলার ক্ষীণজীবী সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য ও শ্রদ্ধা
কতটা । সেই সঙ্গে অদ্ভুত গর্ব ও । না জেনেও সেই গর্ব দেখাতে দ্বিধা নেই !
একই গানে এরপরেই বলা হচ্ছে, -
"তবে জানা আছে ভাষা অন্য...";
তাহলে কী সেই ভাষা ? উত্তরে বলা যায় - 'হৃদয়ের ভাষা' । কবিগুরু রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, -
"আমি হৃদয়ের কথা বলিতে
ব্যাকুল, / শুধাইল না কেহ ।"
তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই । কারণ "মোরা সেই ভাষাতেই করি গান !" এই
ভাষা সুরের, ছন্দের, তালের, আনন্দের - অন্তত গীতিকার সত্যজিতের মতে তাই । এই ভাষা এমনই যে তা অনায়াসে,
"... বোঝেরে সকলে / উঁচানিচা
ছোটো-বড়ো সমান ।" সুতরাং নিশ্চিন্ত হওয়া গেল ! কিন্তু তাই কি ?
"তবে জানা আছে ভাষা অন্য /
তোমারে শুনায়ে ধন্য /
এসেছি তাহারি জন্য... রাজা.. মহারাজ ।" - এই পংক্তিগুলিতে কেমন যেন
অস্বস্তির ইঙ্গিত ! কেন ? কারণ, আমার ভাষা আমাকে কোনো মহারাজের কাছে মাথা নত করতে
শেখাক, তা আমি চাই না । যিনি সত্যিই শ্রদ্ধেয়, তাঁকে অবশ্যই প্রণাম
জানাবো, কিন্তু তাঁর পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত পদমর্যাদা দেখে নয় । এই বিষয়গুলি আমরা
অনুভব করি না এমন নয়, কিন্তু পাত্তা দিই না । যাই হোক্ সিনেমার গানে চরিত্র
ও চিত্রনাট্যও দেখতে হয় সমানতালে - গানে স্বভাবতই তার প্রভাব পড়ে ।
কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 'শাশ্বতী' কবিতায় যেমনটা লিখেছেন (যদিও ভিন্ন অনুষঙ্গে), আমি চাই আমার ভাষা হোক তেমনই -
"একটি কথার দ্বিধাথরথর
চূড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;
একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি;"
ভাষার ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমরা খুঁজে নেব নতুন নতুন দ্বীপ, সেখানে নতুন পলিমাটিতে রোপণ করব নতুন শব্দের বীজ । খুঁজে নেব নতুন সাজিমাটি, ভাষার ক্ষয়প্রাপ্ত পোশাক সেই মাটিতে রাঙিয়ে নেব । আমাদের সাধ্য কম হতে পারে, সাধ নয় । তাই গানেই থামিয়ে দেব সময়কে । সত্যি... কবি শামসুর রহমান চমৎকার
লিখেছিলেন, -
"বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে
নিকানো উঠোনে ঝরে
রোদ, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন । বাংলা ভাষা
উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে
উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর
বাঁকে বাঁকে, নদীও নর্তকী হয় ।"
"He who knows no foreign languages knows nothing of his own."
- স্বয়ং Johann Wolfgang von Goethe এই কথা বলেছিলেন । তেমনই সত্যজিতের বিভিন্ন দেশের
গান-বাজনার প্রতি আগ্রহ ও জ্ঞান তাঁর গানে সৃষ্টি ও কৃষ্টির মেলবন্ধনে সহায়ক
হয়েছিল । ভাষার ধর্ম হল নদীর মতো । সেই সংস্কৃত ভাষা-রূপ নদীর উচ্চগতি থেকে, জল বইতে বইতে আজ মাগধী প্রাকৃত-অপভ্রংশের মধ্যগতি পেরিয়ে, গত হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষার নিম্নগতি চলছে । সুতরাং অবিশ্বাস্য নয় যে, হয়তো এতদিনে তা সাগরে মিশে হারিয়ে যেতে বসেছে । ভাষা সত্যিই আবদ্ধ করে রাখার, সিন্দুকে গচ্ছিত রাখার মতো নিষ্প্রাণ বস্তু নয় । তার প্রাণ আছে, এবং তা রূপান্তরিত হয় । যে কোনো নদীর নিম্নগতিতে তার গতি কমে, নদী হয়ে পড়ে চওড়া । তখন নদীর স্থানে স্থানে জল কমে গিয়ে বালুচর জেগে ওঠে ।
বাংলা ভাষা-ও তার ব্যতিক্রম নয় আর বর্তমান বাংলা গান তার প্রমাণ। কোনো দীর্ঘ নদীর
জলে যেমন শাখানদী, উপনদীর জলস্রোত মেশে, মেশে ড্রেনের জল-ও ।
সুতরাং বাংলা ভাষায় আরবি, ফার্সি, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষা কিছু কিছু মিশতে থাকবে, এ আর আশ্চর্য কি ! না মিশলে সেই ভাষা তো মরা নদীর মতো শুকিয়েই যাবে, পরিণত হবে বদ্ধ জলাশয়ে ! তাই জল মিশতে থাকুক । আমাদের নিয়মিত অবগাহন প্রয়োজন
। জল কম থাকলে যে ঘটি-ও ডুববে না । ভাষার ধমনী-তে অমার্জিত বা, অশিষ্ট অপভাষা-ও কিন্তু আসলে শোণিত-প্রবাহের কাজ করে । তাই ভাষার তুচ্ছতম
অণু-পরমাণু-কেও অবহেলা করার উপায় নেই । স্বধর্মে সকলেই গ্রহণযোগ্য । ঠেলে সরিয়ে
দিলে পথের পাথর জমতে জমতে বহতা নদীর প্রবাহ-পথটাকেই অবরুদ্ধ করে দেবে । আমাদের
ভাষা হোক মুক্ত, স্বাধীন - আমাদের গানে ভর করুক সাতটি অমরাবতী । কথা হোক খেয়ালের, প্রলাপের ।সেখানেই তো সত্যি সত্যি স্বাধীনতা ।
কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় -
"স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা ।"
সত্যজিতের উপর সেক্ষেত্রে যেন ভূতের রাজার আশীর্বাদ ছিল । নইলে তিনি এমন সহজে
বাঙালির শাশ্বত আকাঙ্ক্ষাকে ধরলেন কী করে গানের পংক্তিতে !
"যা চাই পরতে, খাইতে পারি,
(এক নম্বর২)
যেখান খুশী যাইতে পারি।
(দুই নম্বর২)
সানিধাপামাগারে-সা গাইতে পারি,
(তিন নম্বর২)
কেমন সুন্দর !"
আর এমনটা হলে যা হয়, তা সত্যজিতের ভাষায় -
"তাইরে নাইরে নাইরে
আর ভাবনা কিছু নাইরে...
তাক ধিন ধিননা ধিনতা..
আর নাইকো মোদের চিন্তা ।"
'ওরে বাবা দেখো চেয়ে' গানে সেনাদের কাটাকুটি দেখো খেদ-তিক্ত মন্তব্য "তোরা যুদ্ধ করে করবি কী
তা বল ?" যেন চিরকাল প্রাসঙ্গিক । মিথ্যে অস্ত্র-শস্ত্র ধরে
প্রাণটাই যে বেঘোরে যায়, তা মোটেই সুবিধার নয় - নিজের পক্ষে যেমন, দেশের পক্ষেও তেমনই - এ এক ক্ষতিকর খেলা - সত্যজিৎ গানে তা জানাতে ভোলেন না ।
"দুনিয়ায় কতো আছে দেখবার / কত কী জানার, কত কী শেখার / ... ঘরে
কেন বসে রয়েছি বেকার ?" - এ প্রশ্নও হয়তো হীরক রাজার দেশে দেখতে বসে শৈশবেই
আপনার মাথায় এসেছিল, আর এখানেই সত্যজিতের সার্থকতা - ছেলেবেলাতেই তিনি
গানে গানে শিখিয়ে দেন বদ্ধ ঘরে আটকে থাকতে নেই । হায় ! আজ আর কেউ এভাবে ভাবেন না ।
বাংলা গানে এমন প্রাণের কথা ও সুর যেন একেবারে হারিয়ে গেল !
ঋণ :-
এক ।। 'মহারাজা ! তোমারে সেলাম' : কথা ও সুর সত্যজিৎ রায় (চলচ্চিত্র : গুপি গাইন বাঘা বাইন)।
দুই ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ('আমি হৃদয়ের
কথা বলিতে ব্যাকুল' - গান)
তিন ।। 'শাশ্বতী' : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ।
চার ।। 'বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে' ও 'স্বাধীনতা তুমি' : কবি শামসুর
রাহমান ।
পাঁচ ।। 'ভূতের রাজা দিল বর !' : কথা ও সুর সত্যজিৎ রায় (চলচ্চিত্র : গুপি গাইন বাঘা
বাইন)।
abhisek1988ghosh@gmail.com
No comments:
Post a Comment