![]() |
ছবি-আন্তর্জাল |
সালটা
১৯৪০ এর কাছাকাছি | বলরাজ
সাহানি(যুধিষ্ঠির সাহানি) বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি এবং ইংরেজি
সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন
| চাকরিসূত্রে বলরাজ সাহানি এবং
তাঁর স্ত্রী দময়ন্তী রাওয়ালপিন্ডি ছেড়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছালেন
| তাদের পুত্রসন্তান পরীক্ষিতের জন্মও হয়েছিল শান্তিনিকেতনে
| বলরাজ সাইনির স্ত্রী দময়ন্তীদেবী
তখন স্নাতক স্তরে পাঠরত
| বলরাজ সাহানি তখন ইংরেজি
ও হিন্দি ভাষার বেশ
নামকরা সাহিত্যিক |
বিশ্বভারতীতে
একদিন হঠাৎ বলরাজ সাহানি
সাথে দেখা হল কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের | কবিগুরু তখন এক ভাষা
সম্মেলন থেকে ফিরছিলেন | বলরাজ
সাহানি আলাপ করলেন কবিগুরুর
সাথে | সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তার পর
কবিগুরু তাকে জিজ্ঞেস করলেন
অধ্যাপনা ছাড়া তিনি আর
কি কি করতে ভালোবাসেন
| বলরাজ সাহানি বেশ গর্বের
সাথে বললেন তিনি হিন্দিতে
বিভিন্ন গল্প লেখেন এবং
তাঁর লেখা বিভিন্ন হিন্দি
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে | হিন্দি সাহিত্যে তাঁর
বেশ ভালো নামডাকও হয়েছে
| কবিগুরু তাকে বললেন কিন্তু
তিনি তো পাঞ্জাবি, তাঁর
মাতৃভাষা তো হিন্দি নয়,
তাহলে তিনি পাঞ্জাবি ভাষা
ছেড়ে হিন্দি ভাষায় কেন
লেখালিখি করছেন? কবিগুরুর আসল
উদ্দেশ্য তখন বলরাজ সাহানি
বুঝতে পারেননি | তিনি প্রথমে ভাবলেন
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন অত্যন্ত
সংকীর্ণমনস্ক এবং প্রাদেশিক মানুষ
| কিন্তু পরে তিনি বুঝেছিলেন
যে কোনও সাহিত্যিকের আসল
পরিচিতি,মান,খ্যাতি সবার
প্রথমে নিজের জাতির কাছে,
নিজের মাতৃভাষার কাছে | নিজের জাতির
কাছে স্বীকৃতি লাভের পর আসে
আন্তর্জাতিক দুনিয়া | যাইহোক সেই প্রশ্ন
শুনে বলরাজ সাহানি অজ্ঞানতাবশতঃ
বললেন হিন্দি হল ভারতের
রাষ্ট্রভাষা , সারাভারত জুড়েই হিন্দির এত
পরিচিতি | তিনি হিন্দিতে লেখেন
কারণ সারাভারতের মানুষ তাঁর লেখা
পড়তে পারেন | কবিগুরু বললেন তাঁর সকল
সাহিত্যসৃষ্টি বাংলায় কিন্তু তাঁর
সাহিত্যকর্ম কেবল হিন্দুস্তান নয়
সারা বিশ্বে সমানভাবে সমাদৃত
| বলরাজ সাহানি কবিগুরুকে বললেন
তিনি তাঁর মত অত
বড় সাহিত্যিক নন, তিনি এক
অতি সামান্য লেখক| কবিগুরু বললেন
এটা বড় ছোট এর
বিষয় নয় | প্রত্যেক লেখকের
নিজের মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষার সাথে
নাড়ির যোগ থাকে | নিজের
মাতৃভূমির থেকে যে ভালোবাসা
আর সন্মান পাওয়া যায়
সেটা পৃথিবীর আর কোনও জায়গা
থেকে পাওয়া সম্ভব নয়
| বলরাজ সাহানি কবিগুরুর যুক্তি
মানতে চাইলেন না | তিনি
বললেন তাঁর মাতৃভূমি পাঞ্জাব
সম্পর্কে কবিগুরুর কোনও সুস্পষ্ট ধারণা
নেই | পাঞ্জাবে সকলেই হিন্দি আর
উর্দু ভাষাতেই লেখালিখি করে | পাঞ্জাবি ভাষায়
কেউ লেখে না | সত্যি
কথা বলতে গেলে তিনি
পাঞ্জাবিকে ভাষা বলে ভাবেননি
কখনও, তাঁর কাছে
নিজের মাতৃভাষা পাঞ্জাবি ছিল একটি পিছিয়ে
পড়া তুচ্ছ ভাষা | কবিগুরু
বললেন তিনি এই ব্যাপারে
তাঁর সঙ্গে বিন্দুমাত্র সহমত
পোষণ করেন না, পাঞ্জাবি
আর বাংলা আমাদের দেশের
সবচেয়ে পুরোনো ভাষাগুলোর মধ্যে
অন্যতম | তিনি বলেন পাঞ্জাবি
মোটেও তুচ্ছ ভাষা নয়
| এই বলেই কবিগুরু বিখ্যাত
পাঞ্জাবি লেখক গুরু নানকের
লেখা একটি পাঞ্জাবি কবিতার
কয়েকটি পংতি গাইলেন-
"গগন
মেই থাল অভি চাঁদ
দীপক বানে
তারকা
মণ্ডল যান্কা মতি
ধূপ মাল্যচল পাবন চান্বর করে
সগল বানরায় ফুলন্ত জ্যোতি"
বলরাজ
সাহানি এটা শুনে বিহ্বলিত
হয়ে পড়েন | তিনি তখন
জানতেনই না যে এটা
গুরু নানকের লেখা | পাঞ্জাবি
ভাষায় যে এত সুন্দর
কবিতা লেখা যাই সেটা
তাঁর ধারণার বাইরে ছিল
|কথোপকথন হতে হতে বলরাজ
সাহানি তাঁর নিজের ঘর
অবধি এসে পৌঁছালেন | যখন
তাঁর নিজের ঘরে ঢুকতে
যাবেন তখন কবিগুরু তাকে
বলেন, যখন কোনও সাহিত্যিক
নিজের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে অন্য ভাষায়
সাহিত্যচর্চা করে তখন তাকে
নিজের জাতি কখনই গ্রহণ
করে না | এর পাশাপাশি
মাতৃভাষা ছাড়া যে ভাষায়
সেই সাহিত্যিক সাহিত্যচর্চা করে সেই জাতির
লোকেরাও তাকে কোনোদিনও সম্পূর্ণভাবে
গ্রহণ করে না |
কবিগুরুর
এই কথা বলরাজ সাহানির
জীবন পরিবর্তন করে দেয় | বলরাজ
সাহানি জানতেন যে যখন
ভারতবর্ষ স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করছে
তখন থেকেই কংগ্রেস হিন্দিকে
রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে লড়াই
করে যাচ্ছিল | কিন্তু কবিগুরুর কথায়
বলরাজ সাহানি নিজের মাতৃভাষার
গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেন | এরপর
তিনি পাঞ্জাবি ভাষায় লেখালেখি আরম্ভ
করেন এবং পাঞ্জাবি ভাষার
বিখ্যাত সাহিত্যিক রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ
করেন | ১৯৬০ সালে তিনি
পাকিস্তান ভ্রমণকে কেন্দ্র করে লেখেন "মেরা
পাকিস্তানী সফর "| সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
নিয়ে তাঁর লেখা বই
"মেরা রুসি সাফারনামা" সোভিয়েত
ল্যান্ড নেহেরু অ্যাওয়ার্ড এ
ভূষিত হয় | তিনি পাঞ্জাবি
ভাষায় বিভিন্ন ছোট গল্প, কবিতা
লিখেছেন | তাঁর নিজের আত্মজীবনী
"মেরি ফিল্মি আত্মকথা" অত্যন্ত
জনপ্রিয় হয় | এর পাশাপাশি
তিনি অনেক সিনেমার চিত্রনাট্য
লিখেছিলেন এবং সিনেমায় অভিনয়েও
জনপ্রিয়তা লাভ করেন | বলরাজ
সাহানি অভিনীত কিছু উল্লেখযোগ্য
হিন্দি সিনেমা হল ধরতি কে লাল
(১৯৪৬), দো বিঘা জামিন
(১৯৫৩), কাবুলিওয়ালা (১৯৬১), গরম হাওয়া
(১৯৭৩) , বিন্দিয়া, সীমা (১৯৫৫), সোনে
কি চিড়িয়া
(১৯৫৮), সুটটা বাজার (১৯৫৯),
ভাবী কি চুড়িয়া (১৯৬১),
কাঠপুতলি (১৯৫৭), লাজবন্তি (১৯৫৮), ঘর সংসার
(১৯৫৮), ওয়াক্ত(১৯৬৫) | এছাড়াও
তিনি পাঞ্জাবি সিনেমা নানক দুখীয়া
সব সংসার
(১৯৭০) এবং সাতলুজ দে
কান্দে তে অভিনয়ের জন্যে
যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেন | তাঁর বহু
লেখা পাঞ্জাবি পত্রিকা প্রীতলারই তে প্রকাশিত হয়েছে
| তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হল কামেই (পাঞ্জাবি), এক
সফর এক দাস্তান (পাঞ্জাবি),
গায়ের জাসবাতি ডাইরি
(পাঞ্জাবি) ইত্যাদি | ১৯৬৯ সালে ভারত
সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে
ভূষিত করে | ১৯৭৩ সালে বলরাজ
সাহানি মুম্বাইতে "পাঞ্জাবি কলা কেন্দ্র" প্রতিষ্ঠা
করেন | ১৯৭৩ সালের ১৩
এপ্রিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন
বলরাজ সাহানি |
আজকাল
চারদিকে তাকালেই দেখা যায় বেশ
কিছু বাঙালি বাংলা ভাষা
এবং সংস্কৃতি নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন
| বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি
নিয়ে বহু বাঙালির আত্মসম্মান
বোধের অভাব আজকাল খুবই
চোখে পড়ে | আমাদের অনেকেই
সব জায়গায় বাংলা বলি
না, আমাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা
না বললে গর্ববোধ করে
বহু অভিভাবক | মানুষের চরিত্র তৈরী হয়
তার ভাষার প্রতি ভালোবাসা
থেকে | তাই ভাষা একটা
মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশিষ্ট ভূমিকা
নেয় | যারা এটা ভুলে
যায় তারা জীবনে কিছু
জাগতিক বিষয় কব্জা করতে
পারে কিন্তু জীবনে সুখী
হয় না | এরকম উদাহরণ
অনেক আছে | কবিগুরু আজ
থেকে প্রায় ১০০ বছর
আগে এটা উপলব্ধি করেছিলেন
| তাঁর প্রত্যেকটি লেখা বাংলায় | কবিগুরু
আজও বহু বিষয়ে আমাদের
পথপ্রদর্শক | কিন্তু আজ হয়তো
আমরা ভুলে গেছি বাংলা
ভাষার প্রয়োগে তিনি কতটা উগ্র
ছিলেন | বাঙালিকে বাঙালির ইংরেজিতে চিঠি লেখা , দুই
বাঙালির কথোপকথনে ইংরেজির ব্যবহার তিনি ঘোর অপছন্দ
করতেন | কবিগুরু উগ্র সাম্প্রদায়িকতার তীব্র
বিরোধী ছিলেন | ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের
প্রস্তাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল
সবথেকে বেশী | যে ঠাকুরবাড়ির
ছেলেরা কখনো মোজা ছাড়া
জুতো পড়ত না, সেই
ঠাকুরবাড়ির ছেলে হয়ে সব
আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে কবিগুরু খালি
পায়ে রাস্তায় বেরিয়ে বিরোধী মিছিলে
অংশ নিয়েছিলেন, নাখোদা মসজিদের অভ্যন্তরে
ঢুকে রাখি পড়িয়েছিলেন মৌলবাদীদের
| ১৯৪৭ সালে সত্যিকারের বঙ্গভঙ্গের
সময় রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তাঁর
মনের অবস্থা কিরকম হত
ভাবলেও বুক কাঁপে | আর
আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে
যদি পাওয়া যেত কবিগুরুকে
তাহলে তিনি নিশ্চয়ই যোগ
দিতেন হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে
লড়াইতে |
ভুলে গেলে চলবে না
ভারতবর্ষে বহু বিখ্যাত লেখক,
সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন | কিন্তু আজ অবধি
ভারতবর্ষ থেকে কেবলমাত্র একজন
সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত
হয়েছেন| তিনি বাংলা ও
বাঙালির গর্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর| তিনি ভারতবর্ষের গর্ব
| তিনি
বাঙালিয়ানার শেষ কথা | তাঁর
লেখা আজও সমান প্রাসঙ্গিক
| কিন্তু সত্যি কথা বললে
বর্তমান প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা খুব একটা
পড়ে না| রবীন্দ্রসংগীতের চল
হয়ত আজও অনেকাংশে বর্তমান
কিন্তু রবীন্দ্রসাহিত্য পড়ার চল বর্তমান
প্রজন্মে অনেক কমে গেছে
| আজ ২৫শে বৈশাখ, কবিগুরুর
জন্মদিন| তাই আজ শপথ
নেওয়ার দিন | কবিগুরুর লেখা
পড়ুন ও সকলকে পড়ান|
কবিগুরুর চেতনাকে নিজের জীবনে প্রতিফলিত
করুন | জীবনকে রবীন্দ্রময় করে
তুলুন |
আর সর্বোপরি বাংলাকে ভালোবাসুন, বাংলা পড়ুন, বাংলা
বলুন, বাংলা লিখুন, বাংলা
গান শুনুন, বাংলা সিনেমা-থিয়েটার দেখুন, বাংলার বই
পড়ুন, বাংলা ও বাঙালির
ইতিহাস জানুন , বাংলার মনীষীদের আদর্শ
পালন করুন, বাংলার শিকড়ের
সাথে জুড়ে থাকুন, জীবনকে
বাংলাময় করে তুলুন।
তথ্যসূত্র-
উইকিপিডিয়া এবং অনুরাধা চৌধুরী,
শান্তিনিকেতন গ্রুপ |
লেখক-
অভীক মণ্ডল
তথ্যবহুল লেখা, আমার কাছে একেবারেই অজানা, অথচ খুব সাবলীলতার সাথে পরিবেশন করেছেন লেখক। বেশ সুন্দর।
ReplyDelete