1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, September 28, 2019

ধূসর স্মৃতি

স্মৃতি , স্মৃতি …
কেউ যেন ডাকছিল স্বপ্নের মধ্যে । 
আজকাল এই এক হয়েছে । বারবার ঘুম ভেঙ্গে যায় । স্বপ্নের মধ্যে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াকে কি স্বপ্নভঙ্গ বলে । 
স্মৃতি ঠিক বুঝতে পারেনা । 
ঠিক যেমন বুঝতে পারেনা , কোন কুক্ষণে সন্দীপদাকেপ্লেন কি করে হাওয়ায় ভাসে দেখাতে বলেছিল । 
তা প্রায় কত বছর হোল । প্রায় চল্লিশ বছর । 
স্মৃতির তখন একুশ বছর বোধ হয় । 
সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া ছটফটে তরুণী । বাড়ি জেলা শহরে । তাই হস্টেলে ওঠা । 
বেশ কেটে যাচছিলো দিনগুলো ।হই হই করে।বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর পড়াশোনা করে।
   এই সময়েই সন্দীপদার সাথে আলাপ।বিদিশাদের বাড়িতে।
    বিদিশাদের বাড়ি সিঁথিতে।সন্দীপদা কমার্শিয়াল পাইলট।বিদিশার পিশতুতো দাদা।বাড়ি বোম্বাই।বোম্বাই তখনও মুম্বাই হয়নি।
দমদমে দু এক দিনের জন্য ট্র্যানসিট পেলেই,সন্দীপদা হোটেলের বদলে ,বিদিশাদের বাড়িতে উঠত।
 পাইলটরা সাধারনত হ্যান্ডসামই হয়।সন্দীপদা ছিল অসাধারন সুন্দর।পুরুষালি সৌন্দর্য যেন উপচে পরছে।প্রথম দেখাতেই ,স্মৃতির একুশ বছরের সারা শরীরে শিহরণ লাগল।বুকের মধ্যে পায়রা দুটো,পরস্পরের ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে বললো-এই তোমার পুরুষ।
    তারপর তো স্মৃতির শয়নে স্বপনে শুধুই সন্দীপদা।বিদিশাকে তো ফোনের ঠেলায় অস্থির করে তুললো।সন্দীপদা আবার  কবে আসবে,কবে ভালো করে আলাপ করিয়ে দিবি,ইত্যাদি প্রশ্নে জর্জরিত বিদিশা প্রতিশ্রুতি দেয় ,এরপর সন্দীপদা এলেই,ওঁকে জানিয়ে দেবে আর ভাল করে আলাপ করিয়ে দেবে।স্মৃতি আশ্বস্ত হয়।
    তারপর একদিন বিদিশা হঠাৎ  হোস্টেলে ফোন করে বলল,-‘ধর,সন্দীপদা কথা বলবে।’
বিদিশা সন্দীপদাকে কি বলেছিল কে জানে, স্মৃতি এ প্রান্ত থেকে ‘হ্যালো’বলতেই সন্দীপদা বলল-‘কাল কলেজের পরে চলে এসো।একটু আড্ডা মারব।’
    স্মৃতির কিশোরী মন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছিল ,ভালবাসার মানুষের এই আহ্বানে।সেদিন সারারাত ঘুম হয়নি।
পরদিন কলেজ শেষ হতেই দৌড়েছিল বিদিশার বাড়িতে।বিদিশা বাড়ি ছিলনা।হয়তো ইচ্ছে করে।স্মৃতির তাই মনে হয়েছিল।আর স্মৃতিকে আশ্চর্য করে দরজা খুলে দিয়েছিল সন্দীপদা।
     বেশিক্ষণ বিদিশাদের বাড়িতে বসেনি ওরা।
      সন্দীপদা হঠাৎ করে বলেছিল-‘চল একটু ঘুরে আসি’।
       সেদিন অনেকক্ষন, পাশেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের মরকতকুন্জ ক্যাম্পাসে বসেছিল ওরা।স্মৃতি মনোযোগী ছাত্রীর মত শুনছিল সন্দীপদার কথা।তার পেশাগত জীবনের কথাতেই ভরে ছিল বেশিরভাগ সময়।স্মৃতির কাছে প্লেন আকাশে ওড়া একটা বিস্ময়।ভীষন ইচ্ছে ককপিটে বসে আকাশে ওড়া।তাই লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলল.’আমি আপনার সাথে প্লেনে করে আকাশে চড়ব।’
     সন্দীপ বুদ্ধিমান ,তাই স্মৃতির এই অসম্ভব প্রস্তাবটাকে সরাসরি নাকচ না করে বলল-‘কিন্তু তুমি পাশে বসে থাকলে যদি মনোযোগ বিঘ্নিত হয়?’ 
     -‘তো?’বোকা স্মৃতি কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থ না বুঝেই জিজ্ঞেস করে।
     -‘যদি দুর্ঘটনা ঘটে?’সন্দীপের এই কথা শুনে স্মৃতি বিষন্ন হয়ে পরে।
    স্মৃতির বিষন্নতা দেখে সন্দীপেরও কষ্ট হয়।সে তখন আসল কথায় আসে।
     -‘নিয়ম অনুযায়ী,টারম্যাকে একমাত্র স্টাফরাই ঢুকতে পারে।ককপিটে ঢোকা তো আরও অসম্ভব।তার বদলে,তোমায় একদিন ডেকে নেব।ভিসিটরস্ গ্যালারিতে দাড়িয়ে দেখবে প্লেনের টেক অফ্।তোমার কথায় হাওয়ায় ভাসা।ঠিক আছে?’
      স্মৃতি সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে।
-‘চলো,এবার তাহলে উঠি।’সন্দীপ হঠাত করেই স্মৃতির হাতটা টেনে নেয়। করপৃষ্ঠে  এঁকে দেয় চুম্বন।স্নেহের না ভালবাসার স্মৃতি ঠিক বুঝতে পারে না।শুধু এক অদ্ভুত তীব্র অনুভূতি নিয়ে,স্মৃতি হোস্টেলে ফেরার জন্য বাসে ওঠে।
    সন্দীপদা বিদিশাকে কিছু বলেছে ,নাকি বিদিশা নিজেই কিছু ভেবে নিয়ে বন্ধুদের হয়ত কিছু বলেছে,পরের দিন কলেজে স্মৃতিকে দেখে সবাই খুব মুখ টেপাটিপি করে হাসছিল।ইজ্ঞিতবহ হাসি।তাতে,স্মৃতির বয়েই গেছে।ওর হৃদয় জুড়ে তখন সন্দীপদা।

    রিটায়ারমেন্টের পরে ,এই ষাট বছর বয়সে ঘুম খুব কমে গেছে স্মৃতির।আর বেড়েছে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখার অভ্যেস।সারাজীবন তো কুমারীই থেকে গেলেন।শহরতলীতে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট কিনে সবসময়ের কাজের মেয়ে রাধি কে নিয়ে থাকেন স্মৃতি ।প্রাক্তন শিক্ষিকা।
     বিকেলের দিকে একটু গড়াগড়ি দিতে গিয়ে ,বিছানায় আধো ঘুমে তলিয়ে গেছিলেন স্মৃতি।সেই ঘুম ভাঙল অদ্ভুত এক স্বপ্নে।চারিদিকে বিরাট,বিরাট আগুনের গোলা,তার  ওপর একটা চিঠি ভেসে যাচ্ছে।
   চমকে উঠে ঘুম ভেঙে গেল।রাধি কে এক গ্লাস জল দিতে বলে ,আলমারী খুলে হাতে নিলেন তার জীবনের সেই অমুল্য সম্পদ।একটা চন্দন কাঠের ছোট বাক্স।আর তার মধ্যে মুখ বন্ধ একটা চিঠি ।চিঠিটা মুখ বন্ধ হয়ে পড়ে আছে আজ চল্লিশ বছর।চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্মৃতি পিছিয়ে গেলেন চল্লিশ বছর আগের এক দিনে।

   সেদিন,সন্দীপদার কথামত,হোস্টেল ওয়ার্ডেনের কাছ স্পেশাল পারমিশন নিয়ে ঠিক সকাল ছটায় স্মৃতি হাজির এয়ারপোর্টে।কিছুক্ষণ বাদেই সন্দীপদার সাদা আ্যম্বাস্যাডার,মাথায় নীল বাতি জ্বালিয়ে দাঁড়াল স্মৃতির সামনে।সন্দীপদা তাকে তুলে নিল গাড়িতে।গাড়ি ভি আই পি  গেট দিয়ে ঢুকে সোজা দাঁড়াল ক্রু  মেম্বারদের জন্য তৈরী ওয়েটিং লাউন্জে।লাউঞ্জ ফাঁকাই ছিল।সন্দীপদা,স্মৃতিকে নিয়ে একটা সোফায় বসল।আজকের ফ্লাইট যাবে বোম্বাই।সন্দীপদা,অনেকদিন বাদে বাড়ি যাবার সুযোগ গাচ্ছে।সেজন্য খুব খুসী ছিল,স্মৃতির এখনো মনে আছে।কিছুক্ষন বাদে,নিজের লাগেজ থেকে ছোট্ট একটা সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের বাক্স স্মৃতির হাতে দিয়ে বলল,
এটা গতবার কোচি থেকে এনেছি।চন্দন কাঠের।এর মধ্যে একটা চিঠি আছে।আমার বিমান আকাশে উড়লে সেটা খুলো।যাও ভিজিটার্স গ্যালারিতে যাও।আমাকে চেক ইন করতে হবে।
    স্মৃতির কপালে আলতো করে চুম্বনের রেখা এঁকে দিয়ে,সন্দীপদা গেটের দিকে পা বাড়াল।
     গ্যালারিতে আরো কয়েকজনের সাথে স্মৃতি দাড়িয়ে ছিলো।কিছুক্ষন বাদেই দেখল , সেই দৃপ্ত পুরুষ পাইলটের পোশাকে হেটে যাচ্ছে প্লেনের দিকে।কিছুক্ষন বাদেই,মই সরে গেল।বিমান গড়াতে শুরু করল টেক অফের জন্য।
খুব আস্তে আস্তে যখন গ্যালারির কাছে এলো,সন্দীপদা হাত নাড়ল স্মৃতির দিকে তাকিয়ে। স্মৃতিও হাত নাড়ল।বিমান গতি বাড়াল ফাইনাল টেক অফের জন্য।টেক অফ করার সাথে,সাথে আঁকাশে ছড়িয়ে পড়ল অসংখ্য আগুনের বল।তারপর স্মৃতির আর কিছু মনে নেই।

ষাট বছরের স্মৃতি দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই ছোট্ট কাঠের বাক্সটা নিয়ে। আজো জানেন না,চিঠিটার মধ্যে কি আছে।আমন্ত্রণ না প্রত্যাখ্যান। জানতে চানওনা।




লেখিকা - মালবিকা বাহুবলীন্দ্র(কুন্ডু)

5 comments:


  1. ভীষন ভালো... শেষটা আন্দাজ করা যায়নি...

    ReplyDelete
  2. ওঃ। ....এখনো গল্পের আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি, মন এখনো স্মৃতির স্মৃতিতেই।..গল্পের বুনন, বাঁধুনি সত্যি অসাধারণ। ...কোনো খানেই অতিরিক্ত বা অপ্রাসঙ্গিক কিছু নেই।গল্পের স্মৃতিতে ভাসতে ভাসতে দুম করে শেষ হয়ে গেলো। লেখার মধ্যে দিয়ে গল্প বলা এক কথায় অনবদ্য। লেখিকার সমৃদ্ধি কামনা করি ,লেখিকার আরো গল্প পাড়ার আশায় রইলাম

    ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য। -------অরুনাংশু শীল

    ReplyDelete