1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, September 28, 2019

সেদিন মিশরে


ছবি-আন্তর্জাল

এই গ্রামের লোকগুলো দেখছি মহা টেঁটিয়া। ওদের নাক কেটে নাও।
১৫৫০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা।
স্থান - গিজা। মিশর।
হ্যাঁ, এই সেই গিজা যেখানে আছে মিশরের সবচাইতে বড় পিরামিড।
সম্রাট খুফু এই পিরামিড তৈরি করেছিলেন কত না বছর আগে !
তারপর নীলনদ দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। বহু সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে, নতুন সম্রাট এসেছেন, পুরানো রাজার নাম কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সামাজিক পরিকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন হয়েছে সেই পুরানো মিশর , ইতিহাসের নিয়ম মেনেই , আজ আর সেইরকম নেই। পরিবর্তন হয় নি শুধু দুটি জিনিসের।
খুফুর পিরামিড আর নীলনদ।
কথাটা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক হল না।
নীলনদ প্রতিবছরই বন্যা আনে, গতিপথেও তার কিছু পরিবর্তন ঘটে। তবে মোটের ওপর নীলনদ একইরকম রয়ে গেছে - সেটা বলাই যায়।
খুফুর পিরামিডের কিন্তু অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। এই সুবিশাল পিরামিডের উচ্চতা একই রয়ে গেছে, কিন্তু তার দেহের ওপর যে সুন্দর সাদা মার্বেল পাথরের যে প্রলেপ ছিল, তার কিছুই আর প্রায় অবশিষ্ট নেই। সাদা রঙের খুফু পিরামিড কয়েক শতাব্দী আগেও দূরাগত দর্শনার্থীর মনে যে অনপনেয় ছাপ রেখে যেত তা আজ আর সম্ভব নয়। চাঁদনীরাতে পিরামিডের অপাপবিদ্ধ সৌন্দর্যের সঙ্গে কেবল তাজমহলের অসামান্য রূপের সঙ্গেই বুঝি বা তুলনা চলতে পারে কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি , সে সময় তাজের সৃষ্টিই হয় নি। যারা সেসময়ের খুফুর পিরামিড দেখেছে, তারা বলতেই পারেন - সেই পিরামিড কোথায়, তো আসলের কঙ্কাল মাত্র।
প্রশ্ন হতে পারে গেল কোথায় সেই অনিন্দ্যসুন্দর সাদা মার্বেলের প্রলেপ?
প্রকৃতির রোষে কি নষ্ট হয়ে গেছে সেই মার্বেল।
উত্তর যুগপৎ হ্যাঁ এবং না।

 ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছিল যা মিশরের এই অন্চলকে প্রায় ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল। পিরামিডের এমন গঠনশৈলী যে তার তেমন ক্ষতি হয় নি, কিন্তু মার্বেল পাথরের প্রলেপ আলগা হয়ে গেছিল। বহু পাথর নীচে পড়ে গেছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা তা নিয়ে গেছিল। কিন্তু সে আর কতটুকু ! মার্বেলের খবর পেয়ে বিভিন্ন সময়ে বহিরাগত লুঠেরারা এসে লুঠ করে নিয়ে গেছে এই মহার্ঘ মার্বেল। তা দিয়ে সাজানো হয়েছে কত না মসজিদ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কায়রোর সবচেয়ে বড় পিরামিড।
আজও ঘটনা খানিকটা এই রকম।
আজও মিশর আক্রান্ত।
আজকের আক্রমণকারীর নাম ইতিহাস মনে রাখেনি। হয়ত বা প্রতিদশকে বহিরাগতের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পৌনঃপুনিকতায় বিরক্ত হয়েই ইতিহাস এই আক্রমণকারীর নাম স্মরণে রাখে নি।
রাখা উচিত ছিল।
কারণ আজকে এমন একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে যা ইতিহাসে আগে কোনদিন হয় নি, পরেও কোনদিন হবে না। আমরা আমাদের গল্পের সুবিধার জন্য ধরে নিই- আক্রমণকারী নেতার নাম মাহমুদ।
মাহমুদ এই গিজা অন্চলে এসে বেশ অবাকই হয়েছে বলা যায়।
জায়গাটা বেশ সমৃদ্ধ
নীলনদের পাশেই, কাজে কাজেই চাষ আবাদ ভালই হয় লোকজন বেশ সুখী আর পয়সাওলা।
সে নীলনদের ধারে আরও কত জায়গা আছে। সেখানেও চাষবাস ভালই হয়। কিন্তু সেখানকার লোকজন এদের মত এতক্ষণ ধরে মাহমুদকে ভোগায় নি। প্রায় তিনদিন তিনরাত সময় লেগেছে এদের কব্জা করতে। যেটা এইসব সুখী মধ্যবিত্তদের কাছ থেকে আশাই করা যায় না। সাধারণত এই ধরণের লোকেদের মানসিকতা পলায়নবাদী। এরা প্রতিরোধ  বিশেষ করে না। কেউ আক্রমণ করলেএই নাও বাবা আমার জিনিসপত্র, আমায় মেরো নাবলে মূল্যবান সবকিছু বার করে দেয়। ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতিতে প্রচুর লাভ হয় এই ধরণের অভিযানে।
কিন্তু গিজায় একদম অন্যরকম অভিজ্ঞতা হল মাহমুদের।
এরা সম্পদশালী আবার যুদ্ধবিদ্যাতেও নিপুণ।
আর নিপুণ মানে যা তা রকমের নিপুণ।
এই অন্চলে মেরেকেটে চার পাঁচশ লোক থাকে, আর মাহমুদের সৈন্যসংখ্যা ছয়শ। আর এদেরকেই কব্জা করতে গিয়ে কিনা প্রায় চল্লিশজন যমের দক্ষিণ দুয়ারে চলে গেল !
কী আশ্চর্য।
রাগে মাহমুদ দাঁত কিড়মিড় করছিল।
এই, কে আছিস ? মালগুলোকে সব ধরে নিয়ে আয় ত। আজ এমন শিক্ষা দেব এদের……
মাহমুদ একজন অধস্তন কর্মচারীকে হুকুম করলেন।
সে চলে যাবার পর একজন অমাত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন - এদের কতজন পটল তুলল ?
আজ্ঞে, সত্তর আশি জন হবে - অমাত্যটি বিগলিত হয়ে বলল।
মাত্র ! মাহমুদ আরো ক্ষেপে গেল।
ইতিমধ্যে গ্রামবাসীদের সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মাহমুদের সৈন্যরা।
গ্রামবাসীদের প্রত্যেকের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। প্রত্যেকেই কমবেশী জখম। এমনকি মহিলারাও।
বেশ। বেজায় গম্ভীর মুখে মাহমুদ বলল- এদের ভীষণ বাড় বেড়েছে। যুদ্ধে হেরে গেছে কিন্তু চ্যাটাং চ্যাটাং কথার কোনও শেষ নেই। ভয়ানক নাক উঁচু। দাও, এদের সবার নাক কেটে দাও।
অন্য কোনও জায়গা হলে প্রবল চেঁচামেচি কাকুতিমিনতিতে কান পাতা দায় হত।
কিমাশ্চর্যম !
এখানে তেমন কিছুই হল না।
মাহমুদ মনে মনে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তবে এবার সে আর তার আবেগ বাইরে প্রকাশ করল না।
কার নাক আগে কাটা হবে? ঘোষণা হল।
আট দশটা হাত উঠল।
মাহমুদ তার মধ্যে বেছেবুছে একটা বুড়োকে পছন্দ করল - অ্যাই, তুমি এসো। তোমার নাকটাই আগে কাটব।
লোকটা বুড়ো হলেও শক্তসমর্থ বেশ গটমটিয়ে এগিয়ে এল। তারপর ডানদিকে ফিরে দূরে কার উদ্দেশে হাতজোড় করে নমস্কার করে জল্লাদের দিকে এগিয়ে গেল।
এই, কাকে নমো করল? মাহমুদ বিস্মিত হয়ে  অমাত্যকে প্রশ্ন করল - আমাকে নয়, বুঝতে পারছি। প্রথমে ভাবলাম সূর্যকে। কিন্তু সূর্য এখন ওদিকে নেই!
অমাত্যটি আবারও বিগলিত হয়ে বলল - না, না। ওরা সূর্যকে প্রণাম করবে কেন ? ওরা স্ফিংক্সকে প্রণাম করল।
ফিংস?
ফিংস না,  স্ফিংক্স জাঁহাপনা। ওই যে দূরে সিংগিমামার মূর্তিটা দেখা যাচ্ছে, ওটাকে প্রণাম করছে।
ওটাকে? কেন ?
মানে, এদের খুব বিশ্বাস ওই মূর্তিখানার ওপর।
পুজো করে?
হ্যাঁ। ভীষণ ভক্তিভরে। এদের ধারণা এই মূর্তিটার জন্যেই এদের যাবতীয় উন্নতি।
বটে?!
মাহমুদের মুখটা প্রথমে ক্রূর হয়ে গেল, তারপর একটা ফিচেল হাসি ফুটে উঠল।
শোনো, আগের অর্ডার ক্যানসেল। নাক কাটা হবেই। তবে এই লোকগুলোর নয়। ওই সিংহের ! দেখেছ , কীরকম খাড়াই নাক ?
অমাত্যরা প্রথমে বুঝতে পারে নি, মাহমুদ কী বলছে। তাই তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল - গোস্তাকি মাফ, খোদাবন্দ্। কিন্তু সব ছেড়ে পাথরের মূর্তি ! কিঁউ ?
গাধার দল। মাহমুদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল - বুঝতে পারছ না? এই লোকগুলো ভীষণ জেদী আর দর্পী প্রকৃতির। এদের নাককান কেটে কিছু করা যাবে না। এমন কিছু করতে হবে যেটা এদের মনে আঘাত করবে, মানে আঘাত করবে।
এইবার অমাত্যদের মগজে ব্যাপারটা ঢুকল।
সবাই মিলে মহানন্দে চলল স্ফিংক্সের নাক কাটতে।
অনেক সময় লাগল, বেশ কিছু লোক আহত হল। একজন অতি উৎসাহী সৈন্য ওপর থেকে পড়ে মারাও গেল।
প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল কাজটা সমাধা করতে।
তারপর শুরু হল বিজয়ীদের জয়োল্লাস আর খানাপিনা। এখনকার পরিভাষায় যাকে বলেলেট নাইট পার্টি
পিরামিডের নির্মাণের কয়েক দশক পরে এই স্ফিংক্সের মূর্তি তৈরি করেছিলেন খুফুরই এক পুত্র।
এতদিন সে রাজসিকভাবেই পাহারা দিয়ে আসছিল গিজার পিরামিডকে।
আজ তার নাক কাটা গেল।
সে নাক এখনো কাটাই রয়ে গেছে।
পিরামিড আজো আছে। আছে স্ফিংক্সও।
নেই শুধু স্ফিংক্সের নাক।
আর ইতিহাসে কোথাও নেই মাহমুদের নাম।



লেখক ঃ সুমিত চ্যাটার্জি 







3 comments:

  1. ঘটনাটা জানতাম, তবে তোমার কলমে পড়তে দারুণ লাগল।






    ReplyDelete
  2. গল্পের মোড়কে প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসকে প্রাণবন্ত করার কৃতিত্ব লেখককে দিতেই হয়। মুগ্ধ হলাম।

    ReplyDelete