![]() |
ছবি-আন্তর্জাল |
জীবনবাবু দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। টিউশনির কোনো দরকার পরেনি।অবসর সময়ে তার প্রিয় অভ্যাস ছিল বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশিদের নিয়ে আড্ডা দেওয়া, নানান রকম উৎসব আয়োজন করা আর ছিল যেকোনো ছুটিতে নিজের স্ত্রী পুত্রদেরনিয়ে কাছে দূরে ঘুরতে যাওয়া। পাড়ায় সকলের খুব প্রিয় মানুষ তিনি। বাড়ি সংলগ্ন তালতলা মাঠে রোজ বিকেলে তার যাওয়া চাই। সেখানে তখন কচিকাঁচার দল খেলছে। ইদানীং মার্শাল আর্টেরও ক্লাস হচ্ছে। এর উদ্যোক্তাও জীবনবাবুই। সব কিছু চলছিলবেশ। তার দুই ছেলে আবির আর আকাশ বেশ কৃতী ছাত্র । যুগের নিয়মে তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে থিতু হলো। তাদের মা-রও বোধ হয় ছুটির দরকার ছিল। বিনা নোটিশে সে ও একদিন জীবনবাবুকে ছেড়ে চলে গেল। জীবনবাবু তখন সত্তর ছুঁয়েছেন।কিছুদিন তার ঘোরের মতন কাটল। ছেলেরা জোর করে নিয়ে গেল সাথে।তিনি যেতে চান নি। তার এই বাড়ী, বন্ধুর দল, প্রতিবেশীদের ছেড়ে মন কোথাও টিকবে না, তা তিনি জানতেন। তবু ছেলেদের মন রাখতে যেতেই হলো কিছুদিনের জন্য।মন তারপড়ে থাকলো যোধপুর পার্কের এই বাগান ঘেরা একতলা বাড়ীতেই।
কানাডা বেশ সুন্দর দেশ। কিন্তু জীবনবাবু কলকাতাতেই বেশী ভালো থাকেন।আবির কে বলে শিখে নিয়েছেন অনলাইনে বাংলা সংবাদপত্র পড়া। কিন্তু প্রতিদিন যে সব খবর পড়ছেন , মনটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। সবাই কেমন একলা হয়ে যাচ্ছে।ঘরে মরে পড়ে থাকলেও পাশের বাড়ীর লোক টের পাচ্ছে না। আসলে সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। কাল আবার তার নিজের পাড়ার ঘটনা পড়লেন। স্থির থাকতে পারলেন না। ফোন করলেন এক পড়শী কে।তিনি তো কথাই বলতে চান না এ বিষয়ে।আশ্চর্য! এই ক বছরে এতো বদল ঘটল কলকাতার! লোকজন এতো স্বার্থপর হয়ে গেল! বদলে গেল তার নিজের পাড়াও! তার পাড়াতে বেশীরভাগই বয়স্ক মানুষের বাস। ছেলে মেয়েরা দূর দূরান্তে থাকে। পয়সার অভাব কারোই নেই। কিন্তু নিসঙ্গতা তোঅর্থ দিয়ে মেটানো যায় না। জীবনবাবু কলকাতায় ফিরতে চান।ছেলেরা আপত্তি করে, কিন্তু তিনি কিছুদিনের জন্য হলেও ফিরতে চান। তার অন্চলের মানুষদের নিয়ে আবার আগের মতন হই হই করে বাঁচবেন। পাশে দাঁড়াতে হবে অসহায়মানুষগুলোর। পাশাপাশি খোঁজ নিতে হবে তার আত্মীয় স্বজনদেরও। নিজের শোক তাপে তিনি ভুলেই ছিলেন তার নিজের সামাজিক কর্তব্য।
এক সকালে ফিরে এলেন নিজের শহরে, নিজের পাড়ায়। যোধপুর পার্কের এই একতলা পুরোনো বাড়ীখানায় জমানো তার সব আনন্দ।
তাঁর স্ত্রীর স্মৃতী, ছেলেদের বড় হওয়া, সবই তো এই বাড়ীতেই।।এবার কানাডা থেকে ফিরে তাই ঠিক করলেন এখনকবছর এখানেই থাকবেন। চারপাশে যা সব ঘটনা ঘটছে, মানুষ নাকি আর একে অন্যের খোঁজ খবর রাখছে না। এ ভারী অন্যায়। সামাজিক অন্যায়। তিনি সবার খোঁজ রাখবেন। পাড়াপড়শী থেকে শুরু করে,তুতো ভাই বোন এমন কি তাদেরনাতীপুতিদেরও খবরাখবর নেবেন।
যা ভাবা তাই কাজ। সন্ধ্যেবেলায় বিনোদ বাবুর বাড়ীর দিকে রওনা দিলেন। বুড়োবুড়ি একলা থাকে। একমাত্র কন্যা বিদেশে এবং নিজের সংসারে হাবুডুবু খাচ্ছে। কলকাতা আসে কয়েক বছর পর পর।জীবন বাবু কে দেখে বিনোদবাবু একগাল হেসেআপ্যায়ন করলেন। বেডরুমে গিয়ে নিজের গিন্নি কে জীবন বাবুর আসার সংবাদ দিলেন। গিন্নি ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন, পিসি নম্বর ওয়ান টা সবে দেখতে বসেছি, এখনই বুড়ো কে আসতে হলো। এখন চা করো , টা দাও। ভাল্লাগেনা। বিনোদবাবু অসহায়ভাবে বলেন, নাহয় ব্রেকে দিওখন।জীবনবাবুর কানেও কিছুকথা ঢুকলো বই কি!
পরের দিন জীবনবাবু চললেন তার পরমাত্মীয় খুড়তুতো ভাই অভয়ের বাড়ীর দিকে। বেহালা। সকাল সকাল বেরোলেন। দুপুরের খাওয়াটা ভাইয়ের বাড়ীতেই সারবেন। বারোটা নাগাদ অভয়ের বাড়ীর দরজার বেল বাজালেন।বাড়ীর কাজের মেয়ে দরজাখুলে দিয়ে জিগ্গেস করে , কাকে চাই? জীবন বাবু বোঝেন তাকে চেনেনা মেয়ে টি। দোষ নেই তার , বহুদিন পর এলেন বইকি! অভয়ের স্ত্রী মিতা আর তার স্ত্রী শুক্লার মধ্যে মোটে ভাব ছিলোনা। ছেলেদের পড়াশোনা ,কেরিয়ার সবকিছু নিয়েই দুই জনেরমধ্যে প্রতিযোগিতা কম ছিলনা। জীবনবাবু পুরোনো কথা মনে রাখতে চান না।তিনি হাসিমুখে হাঁক পারলেন, কই রে অভয় , মিতা সব কোথায় গেলি? অভয়বাবু দাদার গলা চিনতে পেরে বেরিয়ে এলেন এবং যারপরনাই খুশী ও হলেন।মিতা কাষ্ঠহাসি টেনেবল্লেন, সেকি, এন আর আই ছেলেদের বাবা এদেশে কেনো! জীবন বাবু মিতার ক্ষোভ বোঝেন। তার ছেলেরা বিদেশে গেলেও মিতার ছেলে স্বদেশে থাকাই মনস্থ করে। সে যদিও কম কৃতী নয়। আর্য। খুব সহজ আর সুন্দর মনের ছেলে। ছেলের এই সিদ্ধান্তেমিতা মনে করে সে শুক্লার কাছে পরাজিত হয়েছে।জীবনবাবু হাল্কা কথায় পরিবেশ হাল্কা করতে বলেন, বুঝলে মিতা, আমার কাছে ভারত মাতা আর অন্য সব দেশ বিমাতা। সকলে হেসে উঠলো সে কথায়।জীবন বাবু ও হাঁফ ছাড়লেন।দুপুরের খাওয়াসেরে দুই ভাই বসলেন শৈশবের স্মৃতী চারনায়। বিকেলে অভয়বাবু মিতা কে চা করতে বলতে গেলেন ভেতর ঘরে। মিতা হিস্ হিস্ করে বলে উঠলো, বেশী আদিখ্যেতা করো না। রোজ এসে হাজির হবে। আমি কি ভাতের হোটেল খুলে বসেছি? জীবনবাবুবুঝলেন, আসাটা কমাতে হবে এবং বিকেলে আসাই মঙ্গল হবে
এর পর কিছুদিন এ পাড়া , ও পাড়া সব ঘুরে সবার খবরাখবর নিতে লাগলেন। কারও কারও বাড়ী সপ্তায় দু তিনদিনও যাওয়া হয়ে গেলো। লোকজন বেশীর ভাগই খুব একটা খুশী হলো না । কেউ কেউ তাকে আসতে দেখলেই ঘরের লাইট অফ করে দিতেলাগলো। ব্যাপার স্যাপার দেখে, জীবনবাবু লোকের বাড়ী যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। অনেকেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। জীবনবাবু র এই সব রকম সকম যে খেয়াল রাখতো , সে তার পাড়ার ইস্ত্রীওয়ালা , মহাদেও প্রসাদ।
জীবনবাবু সকালে বাজারে যান, তারপর বাড়ী ফিরে কাজের মেয়ে মালতী কে রান্নার কথা বলে নিজের ঘরে আরাম করে খবরের কাগজ পড়তে বসেন তার সখের বেতের চেয়ারে। কাগজ খুলতে যদিও এখন ভয় হয় , কি পড়তে হয় কে জানে! খবরেরজায়গা দখল করেছে দুঃসংবাদ । তাও অভ্যেস! মালতী এক কাপ চা রেখে যায় সামনে। এরপর রান্নাবান্না সেরে, টেবিলে খাবার সাজিয়ে তবে বাড়ী যায়। রাতের খাবার দুধ খই দাদু নিজেই জোগাড় করে নেয় । পরদিন আবার সকাল সাতটায় দাদুর বাড়ীচলে আসে মালতী। আজ বুধবার, কাল ছুটি নেবে মালতী। ওর ছেলের ইস্কুলে ডেকে পাঠিয়েছে । কি বদমাশি করেছে কে জানে! মালতী চা দিয়ে বলে, দাদু ফিরিজে বেশী করে রান্না করে রাখতিছি। কাল আসবো না নে। ছেলের ইস্কুলে যেতি হবে, ডাকপাঠাইছে। জীবনবাবু খবরের পাতায় চোখ বেলাতে বোলাতে বলেন, ঠিক আছে । সে একদিন আমি চালিয়ে নেবোখন।চলে যায় মালতী, এই কাজের বাড়ী তার খুবি ভালো।
বৃহস্পতিবার মহাদেওর ছুটি। মোটামুটি এই অন্চলের সব ছোটোখাটো দোকান বন্ধ থাকে।শুক্রবার সকাল সাতটায় মালতী আসে জীবনবাবুর বাড়ী। কলিংবেল বাজায়। একবার , দুবার , তিনবার। অবাক হয় । দাদু তো রোজ কাক ভোরে উঠে পরেরামদেবের মতো ব্যয়াম করে। আজ আবার কি হলো! মহাদেও দোকান সাজাচ্ছে আর মালতী কে দেখছে। মালতী মহাদেওর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে , কি করি বলো দিকিনি! দরজা খুলছে না দাদু। একদিন আসিনি ,ডাস্টবিন টা ভরি গিছে বোধ হচ্ছে,গন্ধ ছাড়তিসে। মালতীর কথা শুনে মহাদেও ছুটে আসে। ভেঙ্গে ফেলে দরজা জীবনবাবুর বাড়ীর। তারপর? সেই যেমন ব্রেকিং নিউজে দেখায়, পুলিশ , সাংবাদিক ,পাড়ার লোক, মনবিদ, সমাজবিদ সবাই ব্যস্ত সমস্ত হয়ে পরেন।
সবার খবর নিতে চাওয়া জীবনবাবু , এখন নিজেই খবর!
লেখিকা - মৌসুমী চক্রবর্তী
No comments:
Post a Comment