...পল্লব পত্রকার
'তুই জাস্ট ভাবতে পারবি না, কি দারুণ লাগছে আমাদের স্কুলটা! কাল সন্ধেবেলা
আমিতেশ স্যারের কাছে টিউশন নিয়ে ফিরছিলাম। স্কুলের পাশ দিয়েই তো ফিরি! বাপি রাস্তার
ধারে স্কুটারটা দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর প্রায় দশ মিনিট ধরে দুজনে দেখতে
লাগলাম। ঠিক যেন একটা প্যালেস! কার্টুনে যেমন দেখায়। বাপি তো সেলফোনে বেশ কয়েকটা ছবিও তুলে
নিল। বলল, ফেসবুকে দেবে।…' উচ্ছ্বসিত অদ্রিজা হাত নেড়ে নেড়ে বলে
চলে।
তিতলি তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বন্ধু যতি টানলে বিষন্ন মুখে শুধু বলে,
'তাই !'
'হ্যাঁ রে বিশ্বাস কর, চারপাশে আলোয় আলো! ফুল দিয়ে গেটটা সাজিয়েছে। আর গোটা বিল্ডিংটা মুড়িয়ে দিয়েছে মিনিয়েচারে। ওঃ কি দারুণ! কি দারুণ! আজও তো আমিতেশ
স্যারের কাছে যাব। ফেরার পথে আবার দেখব!'
একটু থেমে
বলে, 'সন্ধ্যেবেলা তুইও আয় না! দেখতে পাবি! খুব মজা হবে!'
তিতলি উদাস চোখে বলে, ' আমি আর কার সঙ্গে যাব!'
' কেন! তুই তোর মাকে সঙ্গে যেতে বলবি!'
তিতলির বাবা বেঁচে নেই, অদ্রিজা জানে। কিন্তু মাও যে কত ব্যস্ত থাকে,
তা তো জানেনা!
তিতলি বলে, ' মা কাজ থেকে ফেরে অনেক দেরিতে। মাঝে মাঝে রাতও হয়ে যায়! যা টায়ার্ড
থাকে, আসতে বললে হয়তো রেগে গিয়ে মারতে শুরু করে দেবে!'
'হি হি হি ! তোর মা তোকে মারে ?'
'মারে না আবার! লজ্জায় মাথা নিচু করে তিতলি।
'আমার বাপি মা কিন্তু আমার গায়ে কোনওদিন হাত তোলে না। তবে রেগে গেলে খুব বকাবকি করে। এবার অ্যানুয়ালে কম নাম্বার পেয়েছি বলে
সারাদিন ধরে চেঁচামেচি!' একটু থেমে অদ্রিজা বলে, 'আচ্ছা, তুই তো পড়াশোনায় এতো ভালো,
ফার্স্ট সেকেন্ড
না হলেও দশের মধ্যে রোল থাকে! আর গত বছর একাই আমাদের স্কুল থেকে বেঙ্গল ট্যালেন্ট হান্ট-এ
স্ট্যান্ড করলি! স্যারেরা কত প্রশংসা করল! তবু তোর মা তোর ওপর এত রেগে যায় কেন?
আমার বাবা
মা হলে …'
কোনও উত্তর খুঁজে পায় না তিতলি। কি বলবে সে! তার বাবা যে কারখানায় কাজ
করত, বছর পাঁচেক আগে সেটা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর শুধু অভাব আর অভাব! বাবাও অসুস্থ
হয়ে পড়ল। প্রায় বিনা চিকিৎসায় গত বছর মারা গেল।
আগে কি ভালো কাটত তাদের! বাবা মা দুজনেই সব সময় পড়াশোনায় উৎসাহ
দিত। ইমলি তখন একেবারে ছোট। কিন্তু সে আর তার মেজো বোন মিতলি যখন যা
চাইত, কিনে দিত। ছুটিছাটাতে চিড়িয়াখানা,
মিউজিয়াম,
বি গার্ডেন,
সায়েন্স
সিটি, ইকো পার্ক… কোথায় না গেছে তারা! পরীক্ষা শেষ হলে পাঁচ সাত দিনের জন্যে
দীঘা পুরি বা দার্জিলিং-এও ঘুরে আসত। তখন বাড়িতে এসে পড়াতেন এক টিচার। আর একজন গান শেখাতে আসতেন।
আর এখন পেট ভরে রোজ খাবারও জোটে না! এর ওপর পোশাক আশাক,
বই খাতা পেন্সিল!
কোত্থেকে কিনবে তার মা! এক বাড়িতে রান্না, আর কয়েকটা বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে
সাকুল্যে হাজার পাঁচেক টাকা রোজগার। এই বাজারে এই টাকায় চলে! তাই হয়ত তারা
তিন বোন কেউ কিছু চাইলে মাঝে মাঝে মা রেগে যায়।। মারধোর করে। তবে ঠাকুমা সামনে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে আগলায়। বুকের কাছে টেনে নেয়।
গত মাসেই তো! এক সন্ধ্যায় মা ফিরলে তিতলি যখন বলতে গেল,
'মা আমাদের
স্কুলের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসব। সব ছাত্র ছাত্রীকে একশ টাকা করে চাঁদা
দিতে হবে।' মিতলি পাশে ছিল। সে ও বলল,
' হ্যাঁ,
আমাদের ক্লাসেও
নোটিশ এসেছে।' মা সঙ্গে সঙ্গে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। 'সব সময় টাকা আর টাকা! টাকা কি গাছের
ফল! কদিন পরেই নতুন ক্লাসে ভর্তি করতে হবে! তারপর বই খাতা কেনা! ড্রেস বানানো! এরকম
যদি করিস, আর ইস্কুল যেতে হবে না! পড়া ছেড়ে দিয়ে আমার সঙ্গে রোজ কাজে বেরোবি। '
মার কথা শুনে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে তিতলির। এর চেয়ে
মা তাকে দু
ঘা কষিয়ে দিতে পারত!
কিছুদিন আগে মার শরীর খারাপ হওয়ায় স্কুল কামাই করে মার কাজগুলো
সে করতে গিয়েছিল। দুটো বাড়িতে কোনও অসুবিধা হয়নি। একটা বাড়িতে গিয়ে কি ঝামেলা! বিচ্ছিরি
একটা লোক একা বাড়িতে ছিল। তার বউ সেদিন ছিল না। তিতলির কাজ সারা হলে তাকে একটা মিষ্টি
খেতে দিয়ে লোকটা কি সব নোংরা কথা শুরু করল। তারপর খুব বাজেভাবে তার গায়ে হাত দিতে
এল। কোনও রকমে তিতলি সেদিন পালিয়ে এসেছিল। বাড়ি ফিরে মার কাছে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিল
অনেকক্ষন।
সেই ভয়ঙ্কর দিনটার কথা ভাবতে ভাবতে তিতলি আনমনা হয়ে গিয়েছিল। সম্বিৎ ফিরল অদ্রিজার ডাকে। 'এই শুনছিস! কাল তাড়াতাড়ি আসবি
কিন্তু! আমিও আসব।'
তিতলি কোনও উত্তর দেয় না। চিলতে হাসে।
তার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে অদ্রিজা বলে,
'নাইন টেনের
সবাইকে হেডস্যার অফ হোয়াইট লাল পাড় শাড়ি পরতে বলেছেন। তুই পরবি তো?
শোভাযাত্রায়
সব্বাই একসঙ্গে হাঁটব। যা মজা হবে না! এই চলি রে! আর দেরি করলে
মা চিন্তা করবে। টা টা।' বলতে বলতে সাইকেলের প্যাডেলে পা দেয়।
সুজন স্যারের কাছে সকালে পড়ে তারা ফিরছিল। বছরের শেষ কদিন স্কুল ছুটি বলে তাড়াহুড়ো
নেই। সাহাপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে তাই দুই বন্ধুর গল্প কিছুক্ষন। এখান থেকে রাস্তাটা দুদিকে চলে গেছে। একটা সাহাপুরে,
অদ্রিজাদের
বাড়ির দিকে। আর একটা ঘোষালচকে, তিতলিদের পাড়ায়।
তিতলিও সাইকেলে চড়ে বসে। কিছুদিন আগে তার সাইকেলে ছিল না। হেঁটেই সে যাতায়াত করত। সরকার গত মাসে কিছু ছাত্রীকে সাইকেল দিয়েছে। তিতলি তাদের মধ্যে আছে। তাই সুবিধা হয়েছে।
খুব খিদে পেয়েছিল তিতলির। বাড়ি ফিরে ব্যাগটা রেখে,
হাতমুখ ধুয়েই
সে রান্নাঘরে ঢুকলো। যে কৌটোয় মুড়ি থাকে,
সেটা খুলে
দেখল অল্পই আছে। একটা বাটিতে সব মুড়িটা ঢেলেও একমুঠো তুলে রাখল। তারপর একটা লঙ্কা আর একটা পিয়াঁজের একটু
কেটে মুড়িতে মিশিয়ে তেলের শিশি থেকে এক পলা তেল নিতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ঢুকল মিতলি। 'দিদি তুই তেল নিচ্ছিস?
মা না বারণ
করেছে, তেলের এত দাম!'
'লক্ষী সোনা বোন আমার, মাকে বলিস না,
প্লিজ!'
'আচ্ছা বলব না! তাহলে মুড়ি খেয়ে আমার সঙ্গে খেলতে হবে! ইমলি একটুও
খেলতে পারছে না!'
'কিন্তু আমার যে একগাদা হোম টাস্ক,
প্রজেক্টের
কাজ -- সব বাকি পড়ে আছে!'
'তাহলে আর কি! মাকে বলে দেব!' উত্তরের অপেক্ষা না করে মিতলি আবার উঠোনে
যায়। সেখানে ছক কাটা ঘরে পাঁচ বছরের ইমলি একটা ঘুটি নিয়ে কিত কিত খেলার
ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আর তাদের ঠাকুমা একটা টুলে বসে রোদ পোহাতে
পোহাতে নাতনির সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করছেন।
মুড়ি খাওয়া শেষ হলে তিতলি বাড়ির দাওয়া থেকে উঠোনে নামে। মিতলিকে খুশি করতে খেলা শুরু করে। মুখে কিত কিত বলতে বলতে এক পায়ে লাফাতে
লাফাতে এক একটা ঘর পেরিয়ে যেতে হয়। পা পড়ে গেলে অন্য জনের সুযোগ। কিছুক্ষণ খেলার পর ঠাকুমা বললেন,
'ও তিতলি ভাতটা
তুই আজ বসিয়ে দে ভাই। আমার শরীর ভালো নেই। '
তিতলি জানে শরীর ভালো না থাকাটা ঠাকুমার অজুহাত। সে বাড়ি থাকলে ঠাকুমা আর রান্নাঘরের দিকে
এগো য় না। কথা না বাড়িয়ে মিতলিকে সে বলল, 'শুনলি তো! ভাত বসাতে হবে। আমি এখন যাই।'
মিতলি ঘাড় নেড়ে দিদিকে অনুমতি দেয়।
রান্নাঘরে গিয়ে তিতলি দেখল, আনাজের ঝুড়িতে শুধু কটা আলু। কেরোসিনের স্টোভ জ্বালিয়ে,
হাঁড়িতে
জল দিয়ে সেটা স্টোভে চাপিয়ে দিল। তারপর পরিমাণ মতো চাল আলু ধুয়ে,
ঢেলে দিল
তাতে। এই কাজটা ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় থেকেই সে মাঝে মাঝে করে। দীর্ঘদিনের অভ্যেসে এখন আর কোনও অসুবিধা
হয় না। দিনের বেলা তাদের বাড়িতে বেশির ভাগ দিন
ভাতে-ভাত হয়। মাঝে মাঝে ঠাকুমা পাড়ায় ঘুরে ঘুরে এর ওর ডাঙ্গা থেকে শাক পাতা এনে
রান্না করে। আর রাতে বাড়ি ফেরার সময় মা কিছু
না কিছু আনাজ কিনে এনে তরকারি করে। সবাই তারা রুটি দিয়ে খায়। ডাল বা মাছ মাংস হয় কালেভদ্রে। তবে প্রতি রবিবার ডিম রান্না হয়।
ভাতের ফ্যান ঝরানোটা বেশ ঝামেলার কাজ। প্রথম প্রথম তিতলি একদম পারত না। বার কয়েক হাতও পুড়িয়েছে। তবে মা শিখিয়ে দেওয়ায় এখন আর কোনও অসুবিধা
হয় না।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া মিটলে মিতলি,
ইমলি ঠাকুমার
পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। আর তিতলি সুজন স্যারের দেওয়া হোম টাস্কগুলো
খুব মন দিয়ে করছিল। স্যার বলেছেন,
তুই অঙ্ক
বিজ্ঞানে ভালো বলেই তোকে ফ্রিতে পড়াই। যেদিন দেখব পড়াশোনায় আর মনোযোগ নেই,
সেদিন থেকে
আর পড়াব না। তিতলি সব সময় চেষ্টা করে সুজন স্যার যাতে অসন্তুষ্ট না হন। রমেশ স্যারও তাকে ফ্রিতে বাংলা ইংরেজি
পড়ান। খুবই স্নেহ করেন। তিতলিও তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করে। কক্ষনো তাঁর দেওয়া বাড়ির কাজে ঢিলেমি
করে না।
হোমটাস্ক করতে করতেই তিতলি ভাবছিল,
আজ তো মাসের
শেষ। কাল পয়লা। মাসের প্রথম দিকে মার হাতে টাকা থাকে। তখন আর একবার চাঁদার ব্যাপারে ট্রাই করলে
হয়। সেদিন বলে খুব বোকামি হায়েছে। মা সত্যি সত্যিই যদি তার পড়া ছাড়িয়ে
দেয়! হে ভগবান! তুমি একটু দয়া করো। তিতলি কপালে একবার হাত ঠেকায়। তারপর কি মনে করে ঠাকুরঘরে যে সব দেবতারা
আছে - লক্ষী, নারায়ন, রাধা কৃষ্ণ,
কালি - সবাইকে
সাষ্টংগে প্রণাম করে আসে।
হোমটাস্ক শেষ হলে এবার হিস্ট্রির প্রোজেক্ট। এই কাজটা যে কি করে সে করবে! তাদের বাড়িতে
না আছে কম্পিউটার! না কোনও ল্যাপটপ ! মোড়ের মাথায় সাইবার ক্যাফেতে যাবার খরচও মা
দেবে না! সবাই কি সুন্দর সুন্দর জিনিস গুগল সার্চ করে ডাউনলোড করে। সে তো কিছুই পারে না! তাই ভালো নাম্বারও
জোটে না। তিতলি তার সমস্যার কথা সুজন স্যারকে বলেছিল একদিন। স্যার বললেন,
' আমার মেয়ের
তো গত বছর মাধ্যমিক হয়ে গেল! নাইনের খাতাগুলো পড়েই আছে! ঠিক আছে,
খুঁজে রাখব। তুই আর একদিন মনে করে বলিস। সব খাতা তোকে দিয়ে দেব।'
যদি ওগুলো পাওয়া যায় কি ভালো যে হবে! স্যারের মেয়ে জয়তিদি খুব
ভালো ছাত্রী। তার প্রজেক্টের কাজও নিশ্চয়ই দারুণ হবে। তিতলি সেগুলো থেকে শুধু ডাউনলোড করা জিনিসগুলো
কেটে নেবে। আর নোটস পেলে তো সব মুখস্ত করবে। মাধ্যমিকে তাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে।
বিকেলে একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তিতলির মাথায়। আচ্ছা সন্ধের আগে একবার স্কুল ঘুরে এলে
কেমন হয়! জোরে সাইকেল চালালে যাতায়াতে এক ঘন্টাও লাগবে না। মা আসার আগেই ফিরে আসতে পারবে। ঠাকুমাকে একটু মিথ্যে বলতে হবে। অদ্রিজাদের বাড়ি আর্জেন্ট একটা নোট নিতে
যাচ্ছি। মিতলিকে সঙ্গে নিতে হবে। বুঝিয়ে বলতে হবে যেন ব্যাপারটা কিছুতেই
লিক আউট না হয়!
যেমন ভাবা তেমনই কাজ। মিতলির সঙ্গে কিছুক্ষণ শলা পরামর্শ চলল। মিতলি এই ধরণের কাজে সব সময় এক পায়ে
খাড়া। পড়াশোনায় তার মন নেই। এ বছর সিক্সে উঠেছে বটে,
তবে অধিকাংশ
দিন শরীর খারাপের অজুহাতে স্কুল কামাই করে। তারপর টো টো করে পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। এর ওর টুকটাক কাজ করে দিয়ে ভাল মন্দ একটু
খেতে পায়।
সাইকেলের পিছনে বোনকে বসিয়ে তিতলি চলল প্যালেস দেখতে। স্কুলের সামনে যখন পৌঁছাল,
সূর্য ডুবু
ডুবু। লাল আবির ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। অদ্রিজা একটুও বাড়িয়ে বলেনি। সত্যিই স্কুলটা মনে হচ্ছে একটা রাজপ্রাসাদ। চারপাশে দিনের আলো যত কমে আসছে,
তত বেড়ে
যাচ্ছে সৌন্দর্য। কালকের অনুষ্ঠানের জন্যে স্কুলের সামনের
মাঠে খুব সুন্দর করে মঞ্চ করা হয়েছে। দু বোন অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
দেখল। চোখে মুখে ফুটে উঠল অপার মুগ্ধতা। তাদের স্কুলটা এত সুন্দর! না জানি কাল
কি দারুণ অনুষ্ঠান হবে! চাঁদা দিতে না পারায় তিতলির একটুও আসার ইচ্ছা নেই। প্রায় সব স্যার বলে দিয়েছেন,
'যারা চাঁদা
দিচ্ছ না, তারা কেউ প্যাকেট পাবে না। তবে প্রভাত ফেরিতে বা বিকেলের অনুষ্ঠানে
থাকতে পার। আমাদের কোনও অাপত্তি নেই। '
কি লজ্জার কথা!
মিতলির অবশ্য চক্ষু লজ্জা নেই। সে বলল, 'দিদি, কাল আমরা তাড়াতাড়ি আসব। কত কিছু দেখতে পাব।'
তিতলি হ্যাঁ
না-র মাঝামাঝি মত জানিয়ে একবার শুধু ঘাড় নাড়ল। খুবই দ্বিধায় আছে সে। সব স্যার ওভাবে বললেও সুজন স্যার আর রমেশ
স্যার শুধু বলেছেন, 'চাঁদা দিতে পারিসনি তো কি হযেছে! অবশ্যই আসবি। '
এঁদের কথার
কক্ষনও অবাধ্য হয়না তিতলি। স্যারেরা আরও বলেছেন,
'যারা এখনও
চাঁদা দিতে পারেনি তারা পরে দিলেও হবে। '
ভাবতে ভাবতে ফেরার পথে বেশ জোরে সাইকেলে চালিয়েছিল তিতলি। চেষ্টা করছিল যাতে মা বাড়ি ফেরার আগেই
পৌঁছাতে পারে।
কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। অন্য দিনের চেয়ে মা একটু আগেই ফিরে পড়েছে। শুধু তাই নয়,
মিতলি যে
কাজগুলো করে, সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো, শাঁখ ঘন্টা বাজানো,
ঠাকুরকে প্রণাম
করা - সেগুলো নিজেই শুরু করে দিয়েছে। প্রণাম শেষ হলে তিতলিদের মা আরতি জানতে
চাইলেন, 'কোথায় গিয়েছিলি?'
তিতলি কোনও উত্তর দেবার আগেই মিতলি গড় গড় করে বানানো কথাগুলো
বলে গেল।
'কি রে! ও সত্যি বলছে?' মা এবার তিতলির চোখে চোখ রাখেন । তিতলি চোখ সরিয়ে নিয়ে শুধু ঘাড় নাড়ে। অন্যদিন আরতি চোখ দেখেই সব বুঝতে পেরে
চুলের ঝুঁটি ধরে পিটুনি শুরু করেন। আজ কিন্তু স্বাভাবিক গলা। 'কিচ্ছু বলব না,
সত্যি কথা
বল।' তখন তিতলি আনুপূর্বিক সত্যি ঘটনাটা জানাল। এটাও বলল,
'মিতলিকে কিছু
বলো না। ওর কোনও দোষ নেই। আমিই ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম।'
আরতি আর কিছু না বলে রান্নাঘরে ঢোকেন।
এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছে বুঝে তিতলি পড়তে বসে। মিতলি, ইমলিও তাকে অনুসরণ করে। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা ঘটে একটু পরে। তিনটে বাটিতে মুড়ি আর একটা করে সিঙ্গারা
এনে মা তাদের সামনে ধরে। ঠাকুমাও পিছনে পিছনে এসে অন্য আর একটা
বাটিতে মার সঙ্গে মুড়ি খেতে শুরু করে।
তিতলি বুঝতে পারে মার মুডটা আজ ভাল। তাই সে বলেই ফেলে,
'মা কাল আমরা
স্কুল যাব? কত কিছু হবে!
আরতি কোনও উত্তর না দিয়ে মুড়ি চিবাতে থাকেন।
তিতলি বাধা না পেয়ে উৎসাহের চোটে বলে যায়,
'আমাদের প্যাকেট
দেবে না। নাই দিক! বাড়ি ফিরে খাব।'
মুড়ি খাওয়া শেষ হলে আরতির ঘোষণা,
'ঠিক আছে যেও,
এতই যখন ইচ্ছা
তোমাদের!'
'আমি তোমাদের সঙ্গে যাব দিদি!' পুঁচকে ইমলি আদুরে গলায় তিতলির কাছে আব্দার
করে।
'না না তোকে নিয়ে যাব না! অনেকটা হাঁটতে হবে। তুই পারবি না! তাছাড়া খিচুড়ি স্কুলে
পড়িস! ওয়ানেও উঠিসনি এখনও! '
'আমি যাব! আমি যাব!…' বলে কান্না জুড়ে দেয় ইমলি। যতই সে খিচুড়ি স্কুল অর্থাৎ অঙ্গনওয়ারির
প্রি প্রাইমারিতে পডুক। তার কি ইচ্ছা করে না!
মধ্যস্থতা করতে আরতিকে এবার এগিয়ে আসতে হল। 'তোরা কি নিষ্ঠুর রে! দিদি হয়ে ছোট্ট
বোনটাকে নিয়ে যেতে পারবি না! শুধু নিজেদের স্বার্থটাই দেখবি ?'
সত্যিই তো! এ কি বলছিল তিতলি! তারা দুজন যাবে,
আর তাদের
মিষ্টি সোনা বোনটা যাবে না! কি করে সে ভাবল এটা! ইমলিটা ঠিক যেন একটা তুলতুলে মিনি
বেড়াল। এই সেদিন পর্যন্ত পাড়ার সবাই তিতলি মিতলির সঙ্গে মিলিয়ে তাকে বিল্লি
বলত। কেউ কেউ এখনও বলে। আগে তো তার কোনও নাম ছিল না। যে যা খুশি ডাকত। যে দিদিমনির বাড়ি মা রান্না করে,
তিনিই তাদের
নামের সঙ্গে মিলিয়ে বলেন ইমলি।
'ঠিক আছে! তুই কাঁদিস না! তোকে নিয়ে যাব।'
তিতলি বোনকে
আশ্বাস দিয়ে কোলে তুলে নেয় ।
ইমলি আনন্দের চোটে দিদিকে জাপটে ধরে দিদির বুকে মুখ লুকায়।
পরের দিন বেশ সকাল সকাল সাজগোজ করে তিতলি মিতলি ইমলি বেরিয়ে
পড়ল। তাদের মায়ের কোনো লালপেড়ে শাড়ি নেই। পাশের বাড়ির কৃষ্ণা কাকিমার আছে । রাত্তিরে কাকিমাদের বাড়ি গিয়ে মা চেযে
এনেছে। সেটাই পরেছে তিতলি। ঠিক দুগ্গা ঠাকুরের মতো লাগছে তাকে। ভালো খেতে পরতে না পেলে কি হবে! তার উঠতি
বয়স। আর তাকে দেখতেও ভারি মিষ্টি। হরিণীর মতো টানা টানা চোখ,
ডিম্বাকৃতি
সুডৌল মুখ। টিকালো নাক। কাঁচা সোনার মতো গায়ের রঙ। আর সে বেশ লম্বাও হয়েছে। মিতলিটা মোটেই তার মতো নয়। আর ইমলি তো একেবারেই পুঁচকে। মা ঠাকুমা এক দৃষ্টে তিতলির দিকে তাকিয়ে। দেখে দেখে সাধ মিটছে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা টা টা করলেন।
তিনজন একটা সাইকেলে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। চালাতেও খুব কষ্ট হচ্ছিল। তবু হাসতে হাসতে স্কুলে ঢুকল তিতলি। ইমলি মিতলিকে নামিয়ে সাইকেলটা গ্যারেজে
জমা দিয়ে এগিয়ে এসে দেখল তারা ঠিক সময়েই এসেছে। অনুষ্ঠান এবার শুরু হবে। প্রথমে জাতীয় পতাকা তোলা হবে। সেখানে সবাই জড়ো হযেছিল। তিতলিরাও এগিয়ে গেল। প্রাক্তন এক এয়ার ফোর্স অফিসার বিশেষ
অতিথি হিসাবে পতাকা তুললেন। তাঁকে সাহায্য করলেন প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য
শিক্ষকরা। তারপর সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হলো।
এরপর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রী
সমরেন্দ্রনাথ মজুমদারের মূর্তি উন্মোচন।
সাদা মার্বেল পাথরের সুন্দর মূর্তি। কোন এক বিখ্যাত ভাস্কর গড়েছেন। কয়েকদিন আগে মূর্তিটা যখন বসান হচ্ছিল
তিতলিরা দেখেছে। পরে সাদা পর্দা দিয়ে চারপাশটা ঘিরে দেওয়া হয়েছে। পর্দা সরিয়ে মূর্তি উন্মোচন করলেন স্থানীয়
অঞ্চল প্রধান। এবার প্রধান শিক্ষক ও বিশিষ্ট অতিথিদের সংক্ষিপ্ত ভাষণ। বিদ্যালয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উৎসবের তাৎপর্য
এবং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার সংগ্রামী জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
তারপর শুরু হল পদযাত্রা। একদম সামনে থাকলেন প্রধান শিক্ষক ও বিশিষ্ট
জনরা। তাঁদের পিছনে অন্যান্য শিক্ষকরা, প্রাক্তনীরা এবং ছোট ছোট ফেস্টুন বা পতাকা
হাতে বর্তমান ছাত্র ছাত্রীরা। একদল ছেলে-মেযে গানের দিদিমনির নেতৃত্বে
খালি গলায় গান গাইছিল। বৃক্ষ রোপণ,
নিরক্ষরতা
দূরীকরণ, জাতীয় সংহতি ইত্যাদি বিষয়ে কয়েকটা ম্যাটাডোরে ট্যাবলো সাজানো হয়েছে। সেগুলো একেবারে শেষের দিকে। লাউড় স্পিকারে পদ যাত্রার ধারা বিবরণী
দেওয়া হচ্ছিল। আর তুলে ধরা হচ্ছিল স্কুলের সাফল্য।
কি ভালো যে লাগছিল তিতলির! মাঝে মাঝে অবশ্য ইমলিকে কোলে নিয়ে
হাঁটতে হচ্ছিল বলে একটু কষ্ট হচ্ছিল।
প্রায় ঘন্টা খানেক পরিক্রমা করে সবাই আবার স্কুল প্রাঙ্গনে উপস্থিত
হল। তখন মাইকে ঘোষণা করা হল, ' প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান এখানেই শেষ। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে বিকেল তিনটেয়
। বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীরা নাচ গান আবৃত্তি পরিবেশন করবে। গুণীজনদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হবে। আর থাকবে বিশিষ্ট জাদুকর এ সি সরকারের
ম্যাজিক শো। সবাইকে বিকেলের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে। আর একটা কথা। এখন সবার জন্য টিফিনের ব্যবস্থা আছে। নির্দিষ্ট জায়গা থেকে টিফিন সংগ্রহ করুন।…'
টিফিনের ব্যাপারটা ঘোষণা হওয়া মাত্র তিতলির মুখ শুকিয়ে গেল। মিতলি ছোঁক ছোঁক করলেও সে দু বোনের হাত
ধরে টানতে টানতে বেরিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ধূমকেতুর মতো সেখানে সুজানবাবু এসে হাজির। 'এই তোরা টিফিন না নিয়ে চলে যাচ্ছিস
কেন? আয় আমার সঙ্গে।' বলে তিতলি মিতলির হাত ধরে যেখানে টিফিন
দেওয়া হচ্ছে, টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। তারপর দুটো প্যাকেট তাদের হাতে দিয়ে বললেন,
' তিনজনে ভাগ
করে খাস। আর বিকেলে অবশ্যই আসবি। দেরি করবি না একদম!'
লজ্জায় কৃতজ্ঞতায়
তিতলির মুখ লাল হয়ে গেল। কোনওক্রমে সে শুধু সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ল।
বিকেলে পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠানগুলো পরপর হতে লাগল। প্রায় ঘন্টা খানেক চলার পর মাইকে জানানো
হল, 'আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে আজকের প্রধান আকর্ষন ম্যাজিক শো। সবাই ধৈর্য ধরে বসুন। তার আগে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান। বিশিষ্ট জনদের সম্বর্ধনা জ্ঞাপন।'
প্রাক্তন এক ছাত্রী মাধ্যমিকে গত বছর জেলায় ফার্স্ট হয়েছিল। তার গলায় উত্তরীয় পরিয়ে,
অনেক কিছু
উপহার দিয়ে সম্বর্ধনা জানালেন স্থানীয় এম এল এ। আর এক ছাত্র কিছুদিন আগে ব্যায়ামে রাজ্য
স্তরে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। তাকে সম্বর্ধিত করলেন বাংলার এক নামি ফুটবলার। তারপর ঘোষণা করা হল,
'নবম শ্রেণীর
ছাত্রী তিতলি ভূইঞা, তুমি স্টেজে উঠে এস। অল বেঙ্গল ট্যালেন্ট হান্ট কম্পিটিশনে
তোমার অসাধারণ কৃতিত্বের জন্যে আমরা গর্বিত। তোমাকেও আমরা সম্বর্ধনা দেব।'
ঘোষণাটা আবার
হলো। 'নবম শ্রেণীর ছাত্রী…'
তিতলি ঘোষণাটা শুনে নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না। মিতলি ফিস ফিস করে বলল,
'এই দিদি মাইকে
তোর নাম বলছে রে! যা তুই স্টেজে।'
থতমত খেয়ে তিতলি এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। কি করবে কিছুই ভেবে পেল না। হঠাৎ কোথা থেকে অদ্রিজা এসে তার হাত ধরে
টানতে টানতে স্টেজের কাছে নিয়ে গেল। 'চ চ তোকে সবাই ডাকছে। '
সুজনবাবু, রমেশবাবু ছিলেন সেখানে। তাঁরাও তিতলিকে বললেন,
'কোনও ভয়
নেই। তুই স্টেজে উঠে যা!' তিতলি কাঁপা কাঁপা পায়ে স্টেজে উঠল। হাত ধরে তাকে একেবারে স্টেজের সামনে নিয়ে
গেলেন হেডস্যার। সবার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন। এটাও বললেন,
'তিতলিকে সম্বর্ধনা
জ্ঞাপন করবেন জাদুকর এ সি সরকার। ' হেডস্যার বলা মাত্রই প্রায় ভোজবাজির মতো
তিতলির পাশে এসে দাঁড়ালেন জাদুকর। তাঁর বিচিত্র সাজ পোশাকের দিকে হাঁ করে
তাকিয়ে থাকল তিতলি। তিনি হঠাৎ শূন্য থেকে একটা উত্তরীয় এনে
তিতলির গলায় পরিয়ে দিলেন। গোটা প্রাঙ্গণের দর্শকরা উল্লাসে ফেটে
পড়ে হাততালি দিতে থাকল।
একে একে আরও অনেক কিছু তুলে দেওয়া হল তিতলির হাতে। একটা ফুলের বোকে,
মেমেন্টো,
মিষ্টির প্যাকেট।…
তিতলি কাঁদবে না হাসবে কিছুই ভেবে পেল না।
pallabkumarparui@gmail.com
বেশ ভালো লাগলো।
ReplyDelete