1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Saturday, August 1, 2020

দিগন্তের চিঠি

...সৌরিন ভট্টাচার্য্য

(১)

          কাশটা মেঘে মেঘে ভারাক্রান্ত । কয়েকদিন ধরে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে । দিগন্তব্যাপী ঘন কালো মেঘের চাদরে শহর কলকাতার তিলোত্তমারূপ মলিন হয়ে এসেছে । ঢাকুরিয়াতে রাস্তার গর্তগুলি ভারী লরির চাপে আরো বর্ধিত হয়েছে, কোথাও কোথাও বেশ বিপদজনকভাবে ফাটল দেখা দিয়েছে । এখানে ওখানে জল জমে গেছে, নিকাশি ব্যবস্থার দৈন্যতার জন্য আজ বিকেলেও রাস্তা-অলিগলি জলময় । এখনও তীব্রভাবে বৃষ্টি পড়ছে, দৃষ্টিগোচরতা গুরুতরভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত । ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শ্যামলবাবু । তাঁর বলিরেখা সমন্বিত মুখটিতে আরো কিছু অতিরিক্ত রেখা এসে জড়ো হয়েছে । স্পষ্ট চিন্তার ছাপ । এই বর্ষারদিনে ছাতা মাথায় করে ছেলেটা ছলাৎ ছলাৎ করে নোংরা ঘোলা জলে সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে মোড়ের মাথার ফার্মেসিতে গেছে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেলো । মাঝে সাঝে দু-চারটে সাইকেল বা মোটরবাইকে করে আপাদমস্তক বর্ষাতিতে ঢাকা সওয়াররা যাচ্ছে বাঁদিকে-ডানদিকে । হেডলাইটের আলোয় বৃষ্টির নিম্নগামী অভিকর্ষজ ত্বরণ স্পষ্টায়িত হচ্ছে । কদাচিৎ দু'একটা ছাতা মাথায় দেওয়া লোককে চোখে পড়ছে । কিন্তু না, কাছে আসতেই তারা অচেনা মুখের আদলে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে ।

পুরোনো মলিন হয়ে যাওয়া একটা পাঞ্জাবী আর পাজামা পরে আছেন শ্যামল বাবু । পোশাকটি বরাবরই তাঁর খুবই প্রিয় । পঁয়ত্রিশ বছর পূর্বে তাঁর বিয়ে হয় কবিতার সাথে । কবিতা বিয়ের বছর দুই পর একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকার চাকরি পেয়েছিলেন । এই পোশাকটি ছিল বিবাহবার্ষিকীতে কবিতার নিজের উপার্জন থেকে প্রদত্ত প্রথম উপহার । ত্রিশ বছরের ওপরেও তিনি এই পোশাকটি পরে আসছেন । কখনো তা তাঁর মনে পুরোনো হয়না । বরং পোশাকটি পড়লেই মনে হয় যেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে সুসজ্জিতা কবিতা এসে তাঁর হাত ধরবে সিনেমায় বা ঢাকুরিয়া লেকে যাওয়ার জন্য । পার্কে বসে দুজনেই একমনে দূরদিগন্তে চেয়ে থাকতে খুব ভালোবাসতেন । কবিতা দিগন্ত নিয়ে কবিতাও লিখতেন, তা পাঠ করে শোনাতেন স্বামীকে । পরবর্তীকালে ছেলে শমীক ও মেয়ে সুচরিতাও বাবা-মার সাথী হতো । ভাবনার স্রোতে নিজেকে এমনভাবে শ্যামলবাবু ভাসিয়ে ফেলেছিলেন যে ঘর থেকে একটা চাপা গোঙানির শব্দ আসছে তা প্রথমে তিনি একদমই খেয়াল করেননি । পরে ঘর থেকে সজোরে মেঝেতে কিছু একটা পড়বার শব্দ হলো । সেই আওয়াজ শুনে তিনি সচেতন হন । নিশ্চই স্টিলের কোনো গ্লাস ঝোড়ো হাওয়াতে মেঝেতে পড়ে ওরকম শব্দ তুলেছে ।

দ্রুতপদে ঘরে আসবার চেষ্টা করলেন শ্যামল বাবু । তাঁর হাঁটুতে আর্থ্রাইটিস ধরা পড়েছিল বছর পাঁচেক আগে । তড়িঘড়ি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনার সময় মোক্ষম বেদনা অনুভব করেন । বেকায়দায় অস্থিসন্ধিতে চাপ পড়ে তাঁর মুখ দিয়েও একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে এলো । ব্যাথা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চললেন বেডরুমের দিকে । নিশ্চই কিছু অঘটন ঘটেছে । শঙ্কায় তাঁর বুক দুরুদুরু করে ওঠে । সজোরে ধাক্কা মেরে বেডরুমের দরজার দুই পাল্লা ফাঁক করে দেন, চোখের সামনে যা দেখছেন তা তাঁকে স্তম্ভিত করে দেয় ।

(২)

কবিতা কয়েকদিনের জ্বরে শয্যাশায়ী । ক্ষণে ক্ষণে তাপমাত্রা ১০২-১০৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট ছাড়াচ্ছে । স্থানীয় হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষায় কিছু ধরা পড়েনি । ডাক্তার বাবু এটিকে অজানা জ্বর হিসেবেই  ধরে নিয়ে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা চালাচ্ছেন । শুশ্রূষা করতে গিয়ে বছর একষট্টির শ্যামল হালদার কাহিল । মেয়ে থাকে ব্যাঙ্গালোরে । বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হলো । ওখানকার এক অধস্তন আদালতে ওকালতি করে ইতিমধ্যেই বেশ পসরা গুছিয়ে নিয়েছে । স্বামী শ্রীরঙ্গনাথন সরকারি অফিসার, রাজ্য সরকারের পরিবহন দফতরে উচ্চপদে কাজ করেন । বিয়ের পর মেরেকেটে মাত্র পাঁচবার এসেছিলো সে । শেষের দুবার মেয়ে সুচরিতা আসতে গিয়েও আসেনি । আজকাল মাসে দুবারের বেশি মেয়ে ফোনও করেনা, করলেও মিনিট তিনেকের কুশল-মঙ্গল জিজ্ঞেস করেই দায়িত্ব সমাপ্ত । বাবা-মায়ের অহেতুক ফোন করা বারণ রয়েছে, ব্যস্ত মেয়ের । অত সময় নেই পিতৃভার-মাতৃভার বহন করবার । কবিতার জ্বর ও ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারানোর ব্যাপারটা একতরফ চেপেই রেখেছেন তিনি । ছেলে শমীক একটা আইটি কোম্পানিতে কাজ করে, একটু বেশি রগচটা, বাবার সাথে ঠিকঠাক বনিবনা নেই । কয়েকমাস আগে সে একটা ফ্ল্যাট দেখেছে, ১২০০ বর্গফিটের মতন কার্পেট ক্ষেত্রফল, সে হ্যান্ডওভারের পর গিয়ে উঠবে তার গার্লফ্রেন্ড তনিমাকে নিয়ে । তনিমাকে কবিতা বা শ্যামল বাবু, কারোরই ঠিক পছন্দ নয় । এই নিয়ে নানা সাংসারিক অশান্তির ঝড় বয়ে গেছে গত তিন বছরে । আবার ছেলে শমীক যখন মাঝরাত্রে ফোনে ঝগড়াঝাটির পর ক্লান্ত হয়ে চোখের জল গড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, তখন দরজা খোলা থাকলে কবিতা সন্তর্পণে এসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, গায়ে চাদর টেনে এসি চালিয়ে দিতেন । ছেলে চলে যাওয়ার পর তারা দুজনে একা হয়ে যাবেন, বড়োই একা ।

 কবিতার বিছানাটা ফাঁকা । চাদরটা লন্ডভন্ড করা । যেন কেউ বেদনায় কুঁকড়ে উঠে আঁকড়ে ধরেছিলো চারিপাশে যা কিছু ছিল ! মেঝের ওপর একটা স্টিলের গ্লাস গড়াগড়ি খাচ্ছে, জল ছিটকে পড়েছে মার্বেলের চকচকে নকশায় । পাশের ডেস্কের ওপর রাখা টেলিফোনের রিসিভারটা ঝুলছে ঠিক জঞ্জালের বাস্কেটটার ওপরই । কিছু ওষুধের খালি ফাইল পরে আছে বাস্কেটটায় । ঘরের চারপাশে দেখলেন শ্যামল বাবু । কবিতা কোথাও নেই । গোটা ঘরে যা যা সরঞ্জাম, আসবাবপত্র ছিল সবই পরে আছে । শুধু একটা জ্বলজ্যান্ত আটান্ন বছরের মহিলা উধাও ।  "কবিতা ! কোথায় গেলে তুমি ? কবিতা ? সাড়া দাও ! ", দুই হাত মুখের কাছে অর্ধচন্দ্রাকার ভাবে নিয়ে কণ্ঠনিঃসৃত শব্দের প্রাবল্য বর্ধিত করে হাঁক ছাড়েন শ্যামল বাবু । দিশেহারা ভাবে তাকান এদিক ওদিক । নিচের তলায় এসে সদর দরজা ও পেছনের দরজা পরখ করেন । দুটোতেই ইয়েল লক টিপে দেওয়া । কবিতা যদিওবা এই দুর্যোগে দুর্বল শরীর নিয়ে কোনো কারণবশত কোথাও যান ভেতর থেকে ইয়েল লক টিপে বাইরে গিয়ে দরজা টেনে দিয়ে; তাহলে তিনি স্বামীকে জানাবেননা কেন ? সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নামতে ভীষণ কষ্ট হয় তাঁর, দোতলার বাথরুমগুলো চেক করে ফের বেডরুমে ঢোকেন । কবিতার ফোনটা খেয়াল করেন যে পরে আছে খাটের ওইপাশে, সেটা ভাইব্রেশন হয়ে চলেছে । একটা কোনো কল আসছে । হাঁচোড়পাঁচোড় করে খাটের ওপর উঠে দেহ বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নেন তিনি । কানে দিয়ে বলে ওঠেন, "হ্যালো..." ।

(৩)

চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে বেরিয়ে আসতে চায় শ্যামল বাবুর । কি শুনছেন সেটা বিশ্বাস করে উঠতে পারেননা । দ্রুত বেগে তাঁর নিশ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহিত হতে শুরু করে । ফোনটা করেছে তনিমা । উৎকণ্ঠায় শ্যামল বাবুর হৃদকম্প হতে শুরু করে দে । ত্রিশঙ্কুর মতন অবস্থায় পরে গেছেন তিনি । আরথ্রিটিসের ব্যাথার জন্য এমনিতেই তাঁর চলনশক্তি হ্রাস পেয়েছে, তার ওপর ঘরের মধ্যে কোথাও কবিতার দেখা নেই, যেন ম্যাজিক করে কেউ কবিতা উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে ঘরের মধ্যে থেকে, এখন ফোনে তনিমার দ্বারা প্রদত্ত দুঃসংবাদ । সবমিলিয়ে তাঁর মাথাটা ভোঁভোঁ করতে শুরু করে । ধপ করে খাটে বসে পড়েন । ড্রয়ার থেকে একটা প্রেশারের ট্যাবলেট বের করে জিভের তলায় রাখেন । একটুক্ষণ বসবার পর ধাতস্থ হয়ে বৈঠকখানায় গিয়ে জলপান করে নিজেকে সুসংযত করেন । মাথা ঠান্ডা করে ভাবেন যে কি করবেন । আলমারি খুলে বর্ষাতিটা বের করেন, পাজামার তোলাটা গুটিয়ে নেন প্রায় দেড় ফুটের মতন । সদর দরজার পশে রাখা স্ট্যান্ড থেকে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দরজা ভেজিয়ে । তখনি বিদ্যুৎ ঝলসানি হয় তাঁর থেকে মাত্র পনেরো হাত দূরে । কড়কড়াত শব্দে বাজে পড়েছে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় । অর্ধদগ্ধ গাছটার উপরের দিকটা ঝলসে গেছে । কানে তালা লেগে যায় শ্যামল বাবুর । ইষ্টনাম জপ করতে করতে প্রায় হাঁটুজলে নামেন । কুলকুল করে দুর্গন্ধময় জল বয়ে যাচ্ছে পায়ের নিচ দিয়ে । বৃষ্টির ঠান্ডা ঝাপ্টা বর্ষাতি সম্পূর্ণভাবে আটকাতে পারছে না, কাঁপছে তাঁর সমগ্র শরীর বাঁশপাতার মতন । ধীরে ধীরে টলায়মান পা ফেলে খোলা ম্যানহোলগুলো এড়িয়ে এগিয়ে চলেন অতিধীর বেগে । তাকে পৌঁছতেই হবে তনিমার কাছে । দশ মিনিট দূরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে তনিমা, তাঁর চেয়ে কম বিস্ময় নয় তার । কিছুক্ষণ আগে শমীক ফোন করেছিল তাকে । নেটওয়ার্ক দৃঢ় ছিল না, কথাগুলো খুব কেটে কেটে আসছিলো । আকাশপাতাল প্রায়ই কিছু বুঝতে পারেনি তনিমা । শুধু শুনতে পেয়েছিলো, "বাবলুদের দোকান...এক্সিডেন্ট...আঘাত...মা...এসো..." । বৃষ্টির দিন কোথাও না বেরিয়ে কফির কাপ হাতে করে প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করছিলো তনিমা । সেসময় সমেঘে বজ্রপাত ঘটে ঠিক এইভাবেই । বাবলুদের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে সে । শ্যামল বাবু তনিমার স্বভাবটা ভালো করেই বোঝেন, সে একটা কোলাহল করে লোক জড়ো করবেই এবং যেকোনো ব্যাপারে উপর প্রতিক্রিয়া করবার বেলায় তার কোনো জুটি নেই । এইসব কথা ভাবতে ভাবতে গলির মুখে এসে দেখেন একটা রিকশা । এই দুর্যোগের দিনের সে এভাবে বেড়িয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে চলেছে । "ও ভাই যাবে ? খুব আর্জেন্ট!", ডাক ছাড়েন শ্যামল বাবু । গলাটা ফ্যাঁসফেঁসে শোনায় । লোকটা শুনতে পেলো কিনা কে জানে ! এগিয়ে যাচ্ছে সুন্দর জল কেটে মোড়ের দিকে । এবার দৌড়ানো শুরু করেন শ্যামল বাবু । রিকশার গতিটা হ্রাস পেয়েছে, থামছে, থামলো এবার । রিকশার কাছে এসে উঠেই নির্দেশ দিয়ে দেন তিনি । রিকশাওয়ালা পঞ্চাশ টাকা দাবি করে । পকেট থেকে একটা নতুন নোট বের করে বিনা বাক্যব্যায়ে গুঁজে দেন তার হাতে । সে প্যাডল ঘোরায়, তরতর করে এগিয়ে যায় উভচক্রযান । এমন সময় পাশ দিকে একটা গাড়ি যেতে গিয়ে জলের ছাঁটে খানিকটা ভিজিয়ে দেয় তাঁকে । রিক্সার পর্দা ফেলে দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে থাকেন তিনি ।  

(৪)

বাবলুদের দোকানের সামনেই জটলা বেঁধেছিলো, সেটার অবশিষ্টাংশরূপে কিছু লোক এখনো ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে কালভার্টের একদম সামনে । উত্তেজিত হয়ে তারা কথা বলছে নিজেদের মধ্যে । শ্যামল বাবুর বুঝতে এতটুকুও অসুবিধা হলনা যে এই জটলাটা শুরু করেছিল তনিমাই । তিনি কোথাও তনিমাকে দেখতে পেলেন না । ফোনটা বের করে নম্বর ডায়াল করলেন, একবার পুরো রিং হয়ে কেটে গেলো, ধরলনা সে । অগত্যা তিনি দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের তটস্থ হলেন । জিজ্ঞাসাবাদ চললো দুপক্ষের মধ্যেই । পুরো ব্যাপারটা যেন আস্তে আস্তে মিলে যেতে লাগলো শ্যামলবাবুর কাছে ।

 তনিমা শ্যামল বাবুর আসবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেনি । আরেকটা ফোন এসেছিলো তার কাছে, সেটা পেয়ে সে একগাদা লোক নিয়ে প্রায় উড়েই চলে এসেছে এখানে সরকারি হাসপাতালটার কাছে । শমীকের গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে । সম্ভবত বা পায়ে ফ্র্যাকচার । মায়ের ওষুধ কিনে সে ফিরছিলো একটা শর্টকাট পথ দিয়ে । বাবলুদের দোকানের পাশে একটা বিরিয়ানি হোটেল খুলেছে, সেটার পেছন দিক দিয়ে একটা সরু আঁকাবাঁকা গলি চলে গেছে শমীকদের পাড়া অবধি । দুদিকে ঘাস, আগাছা, পুরোনো কিছু বাড়ির পাঁচিল । বাড়িগুলো তে কেউই থাকেনা । শোনা যাচ্ছে এইখানে পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙে প্রমোটররা বড় বড় এপার্টমেন্ট তুলবে । মাঝে সাঝে এখানে মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বাড়ে । পুলিশের নজরে বেশ কিছুদিন ধরেই আছে গলিটা । সেখান দিয়ে আসবার সময় একটা মোটরবাইক প্রবল বেগে তাকে আঘাত করে দিয়ে বেরিয়ে চলে যায় বর্ষণমুখর আবহাওয়ার ছন্দ হর্ন বাজিয়ে খানখান করে দিয়ে । সম্ভবত ইঞ্জিনের অশ্বশক্তি একটু বেশিই ছিল, জলের ভেতর দিয়েও সশব্দে ওরকম বেগে ছুটে আসছিলো তার দিকে । ধাক্কা লাগবার পরেও গতিবেগ লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পায়নি । পড়ে গিয়ে কাতরাতে কাতরাতে শমীক দু-তিনটে নম্বর ডায়াল করে । ওই গলিতে আছড়ে পরে ঝড়ে জলে তার বুক অবধি ডুবে গেছিলো মাটিমাখা দূষিত জলে । সেখানথেকে কে তাকে নিয়ে এসে হসপিটালে এডমিট করিয়েছে সেটা এখনো স্পষ্ট নয় । হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ।

মোটামুটি দশ-বারো মিনিট পর শ্যামলবাবু ও আরো তিনজন লোক গিয়ে উপস্থিত হন হসপিটালে । হাসপাতালের সামনের সমবেত জনতা শমীকের খবর তাঁকে জানায় উত্তেজিতভাবে । একজন গাইড করে নিয়ে চলে বেড অবধি । একটা জেনারেল বেড পেয়েছে শমীক । তনিমা মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ।  ডাক্তারবাবুর সাথে কথা হল । তিনি বেশ অমায়িক লোক । পুরো ব্যাপারটার গুরুত্ব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিলেন শ্যামলবাবুকে, "দেখুন আপনার ছেলের একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটেছে । ওর ডান পায়ের থাইবোন অর্থাৎ ফিমারে ফ্র্যাকচার হয়েছে, খুবই আনফর্চুনেট এটা । আজ ওর পায়ে প্লেট ও রড বসানো হবে ওপেন রিডাকশন কাম ইন্টারনাল ফিক্সেশন সার্জারি করে । এটার রিকভারি টাইম মিনিমাম ৬ মাস । আজকেই ওটি করা হবে সন্ধ্যার দিকে ।" স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন শ্যামলবাবু । তনিমাকে ধন্যবাদ জানালেন হসপিটালে শমীককে নিয়ে আসবার জন্য । তনিমা কিছু না বলে করিডোরের দিকে ইঙ্গিত করলো । তনিমার আঙুলের দিক বরাবর তাকালেন শ্যামলবাবু । মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন সেই দিকে । নিজের চোখ যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি । গটগট করে হেটে অগ্রসর হলেন সেই দিকে । মুখে নিজের অজান্তেই ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি ।

(৫)

এক ভদ্রমহিলা বসে রয়েছেন কাঠের বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে । চোখদুটো বোজা । একহাত মুঠি করে রাখা । পাশে এসে আস্তে করে বসলেন শ্যামলবাবু । আজ আউটডোরে ভিড়টা একটু কম অন্যদিনের চেয়ে । আস্তে করে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে ডান হাতটা মুছলেন । তারপর সেটা রাখলেন সেই ভদ্রমহিলার মাথায় । জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ভদ্রমহিলার । তিনি চোখ খুলে তাকালেন, কিছু বলবার জন্য উদ্যত হলেন । ঠোঁটের কাছে তর্জনী এনে তাকে থামিয়ে দিলেন শ্যামলবাবু । তাঁর উৎকণ্ঠা সম্পূর্ণরূপে লোপ পেয়েছে । "ওষুধটা খেয়ে নিয়েছেন তো মা?" কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তনিমা, মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন রাখে সে । প্রশান্তিময় একটা জ্যোতি যেন ছড়িয়ে যায় ভদ্রমহিলার মাথার কাছে, আকাশটা একটু পরিষ্কার হতে আরম্ভ করেছে । মাথার কাছে জানালা দিয়ে আলোর আনাগোনা বাড়ছে, ঘরটা আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ।  শ্যামলবাবুর বয়স এক লাফে ত্রিশ বছর কমে গেছে, তিনি দেখতে পারছেন তাঁর দেহের চামড়ার কুঁচকানোভাবটা আর নেই, পাঞ্জাবিটা আবার নতুন লাগছে, যেন সদ্য ইস্ত্রি করে পড়েছেন, শরীরটা অনেকটা হালকা লাগছে, উদরের অতিরিক্ত মেদ একদম উধাও । পাশে বসে আছেন বছর আঠাশের কবিতা, নীলপাড় শাড়ি, কপালে সেই লালটিপ, গোলাপের মতো ঠোঁটে নিখুঁতভাবে বসানো লিপস্টিক, চুলগুলো মাথার সামনে অবিন্যস্ত, যেন এক লাস্যময়ী রূপপ্রতিমা, ঠিক তিনি যেমন ছিলেন তিন দশক পূর্বে । তাঁর হৃদয়ে সেই উৎফুল্লতা, সেই অনুভূতি, যৌবনের পুষ্পোদ্গমের মুহূর্তের এক অনাবিল আনন্দ আবার দেখা দিয়েছে । ধীরে ধীরে হাত ধরে কবিতাকে দাঁড় করলেন তিনি । আরেকপাশে ধরে আছে তনিমা । এবার ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলেন কবিতা, "জানো তো, শমীক আমাকে ফোন করেছিল, ওর গুরুতর আঘাত লেগেছে মোটরগাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে, আমি পড়িমরি করে ...", মাঝপথে শ্যামলবাবু ও তনিমা দুজনেই তাঁর পিঠে হাত রেখে থামিয়ে দেন । এখন কথা বলবার সময় নয়, এখন অনুভবের সময়, এখন স্পর্শের সময় । এখন তিনজন একসাথে হাঁটছেন, তিনজনের একত্র হওয়ার সময় । ধীরে ধীরে তিনজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো । শ্যামলবাবু স্ত্রীকে বাড়িতে পৌছিয়ে তনিমার হেফাজতে রেখে ফিরে আসবেন ছেলের কাছে । এই একদিনের দুর্ঘটনায় কতদিনের মনোমালিন্য, ভুল বোঝাবুঝি, বিবাদ নিমেষে মিশে গেছে মৃদুমন্দ বাতাসের প্রবাহে । তনিমা মেয়েটিকে দুজনেই যা বুঝেছিলেন এতদিন, সে তা নয় । তারও রক্ত-মাংসের হৃদয় আছে । জেনারেল বেডে শুয়ে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলে শমীক । মায়ের কথা ভেবে তার মন আর্দ্র হয়ে ওঠে । তনিমাকে নিয়ে বাবা ও মার সাথে কতইনা দুর্ব্যবহার করেছে সে । বেড থেকে ছাড়া পেলে মায়ের দুপায়ে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে নেবে সে, গত পাঁচ-ছয় বছর বাবা-মাকে বিজয়াতেও প্রণাম করেনি । ধীরে ধীরে আকাশটা লাঘব হয়, সূর্যের কিরণ দীর্ঘায়িত হয়ে পৌঁছায় তিনজনের মুখমণ্ডলে । কাদাজলে ঝলমল করে ওঠে তাদের মুখ, এক অনাস্বাদিত সুখের অনুভূতি নিয়ে অগ্রসর হন নীল রং করা মেইন গেটের দিকে ।

(৬)

একজন কালো কাঁচের হেলমেট পরা মোটরবাইক আরোহী অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা আড়াল দেখে । বৃষ্টির দিনে কারোরই মনোযোগ সে আকর্ষণ করেনি । একাগ্র চিত্তে দৃষ্টিপাত না করে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে । কিছু একটা উদ্দেশ্যে সে বেশ উদ্বিগ্ন এটুকু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, একটার পর একটা নিশ্বেষিত মৃত সিগারেটের বাট লুটিয়ে পড়ছে তার পায়ের ভারী বুটের তলায়, নির্মম পিষ্টনে মিলিয়ে যাচ্ছে সোঁদা মাটির রঙে । সামনে তিনটে মুখ আসছে, মাঝখানের মুখটাকে দেখে সে সচেতন হয়ে ওঠে । এই মুখটাকে আর এর ছেলেটাকে 'এলিমিনেট' করতে হবে, তার কাছে মোবাইল ফোনে এসেছে সর্দারের কাটা কাটা ভাবে বলা স্পষ্ট নির্দেশ । সরু গলিতে অত কম সময়ে অনেক লোকজন এসে পড়ায় দলের সবাইকে মাদকপূর্ণ পেটিগুলো কোনোমতে লুকিয়ে রেখেই চম্পট দিতে হয়েছিল । পাড়াটা ক্রমশ বিপদজনক হয়ে উঠছে, স্পাইও লেগেছে হয়তো এই এলাকায় । ছেলেটা বাইকের ধাক্কাটা অনেকটাই এড়িয়ে গেছিলো, বাধ্য হয়েই আগ্নেয়াস্ত্র ফায়ার করতে হয়েছিল গলি দিয়ে বেরোতে বেরোতে । কাজ হয়নি, কানের কাছ ঘেঁষে গুলি বেরিয়ে পরিত্যক্ত একটা বাড়ির কাঁচের শার্সি ঝনঝন করে ভেঙে দিয়েছিলো । লোকজনের উত্তেজনা দেখে পল্টু ও অন্যান্য সঙ্গীরা ঝোপঝাড় দিয়ে চম্পট দিয়েছিলো, কিন্তু যাওয়ার আগে সম্ভাব্য বিপদের মাত্রা বুঝেছিলো তারা তাই একটা আত্মঘাতী সাঙাৎকে রেখে দিয়ে গেছিলো ঘটনাচত্বরে । এই মহিলা, সম্ভবত ছেলেটার মা, দশ মিনিটের মধ্যে এসে সবকিছু শুনেছিলেন ছেলেটার থেকে । দুজনেই সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন ওই স্থলেই । আট দশজন শক্তসমর্থ মানুষ মিলে দুজনকে কোলপাঁজা করে বের করে এনেছিল সেখান থেকে । যে একজোড়া বিশ্বস্ত চোখ ওখানে লুকিয়ে ছিল আত্মঘাতী বোমা বুকে করে, সেই দলের সবাইকে এই গুরুতর অবস্থার সম্পর্কে জানিয়েছিল সঙ্গেসঙ্গে ।

এবার কোমরে হাত দেয় সে, ওখানটা ফোলা । ‘টার্গেট’ এগিয়ে এসেছে অনেকটাই, বাইকটাকে স্টার্ট নেয় সে । কোমর থেকে বের হয় আগ্নেয়াস্ত্র, নিখুঁত নিশানায় আলোর তেজ ধেয়ে যায় মাঝখানের ভদ্রমহিলার দিকে । ফিরে তাকায়না সে, সেই অবসর এখন তার কাছে নেই । চটজলদি 'প্রমাণ বিলোপ' করতে হবে । অপারেশন ওয়ার্ডের সামনে বাইক থামিয়ে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় সে । মন্ত্রমুগ্ধ শ্যামলবাবু তাকিয়ে দেখেন পুরো ঘটনাটা, তাঁর স্থানকালপাত্রজ্ঞান ক্ষণিকের জন্য লোপ পেয়েছে ।   দুয়েকজন নার্সের আঁতকে ওঠবার শব্দ স্পষ্ট ভেসে আসে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নামা ঠান্ডা হাওয়ার সাথে । বীভৎস একটা রক্ত জল করা চিৎকার শোনা গেলো এবার, কোলাহল ওঠে দোতলায় শমীকের বেডের ঠিক শিয়রেই । ভারী কিছু একটা পতনের নিস্বনে পুরো তলাটা কাঁপতে থাকে । হুড়মুড়িয়ে কয়েকজন উর্দিধারী ভারী বুটের শব্দ তুলে দৌড়ে আসেন প্রবেশদ্বারের সামনে, লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান ভেতরে, ঘটমান নাটকটির যবনিকা পতনের দৃশ্যটি ত্বরান্বিত করতে । উপরের একটা খোলা জানলা দিয়ে দুটো সাদা পায়রা ভয় পেয়ে আবক্ষ ডানা মেলে দেয় । ঝটপট করে ডানা ঝাপটে মিলিয়ে যায় সূর্যের ঔজ্জ্বল্যে, বিমূঢ় হয়ে শ্যামলবাবু স্পষ্ট লক্ষ করেন পায়রাদুটোর ঠোঁটে আটকে রয়েছে কিছু খণ্ডকাগজ, যেন ঠোঁটে করে দিগন্তের চিঠি নিয়ে তারা ভেসে চলেছে যেখানে পৃথিবীর সীমানা শেষ হয়েছে সেই অজানা প্রান্তরের খোঁজে ।  
sourinrcb@gmail.com
মেদিনীপুর

2 comments:

  1. গল্পের প্রতিটা দৃশ্য যেন চোখের সামনে স্পষ্ট ফুটে উঠছিল।

    ReplyDelete