1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

পিছুটান

 

ছবি : ইন্টারনেট 

                                                                                                      রণিত ভৌমিক


                                                                   ----১----

         অনেকদিন ধরেই পৌলমী কাজটা করবে ভাবছিল, কিন্ত সেইভাবে ওর সুযোগ হয়ে উঠছিল না। আজ অবশেষে সুযোগটা হল। তবে, এর জন্য ওকে অবশ্যই অভিরূপকে ধন্যবাদ দিতে হবে। অভিরূপের অফিস ট্রিপটা হঠাৎ না এসে পড়লে এই সুযোগটা ওর কাছে আসত না। গতকাল রাত দশটার ফ্লাইটে অভিরূপ মুম্বাই গেছে, ফিরবে সেই দু-দিন পর। আর এদিকে, ওদের একমাত্র মেয়ে শালিনীও পরীক্ষার পর পিসির বাড়ি গেছে ঘুরতে সুতরাং পৌলমীর কাছে এখন ফ্ল্যাট পরিষ্কারের জন্য এটাই আদর্শ সময়। 

মাস পাঁচেক হল ওরা বালিগঞ্জের এই নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে। আগের ফ্ল্যাট থেকে আসার সময়, সমস্ত জিনিসের সঙ্গে অনেক কাগজপত্র ও টুকটাক জিনিস বোঝাই চারটে বড়ো সুটকেসও ছিল। অভিরূপ তখন বলেছিল ওতে নাকি অনেক প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস থাকতে পারে, তাই সেই মুহূর্তে ওইগুলো স্টোররুমে রেখে দেওয়া হলেও, পৌলমী মনে মনে ঠিক করেছিল দরকারি জিনিস ছাড়া বাকি আবর্জনা সে কিছুতেই ফ্ল্যাটে রাখবে না। ফলে, এতদিন পর সেই সুযোগ হওয়ায়, পৌলমী সক্কাল-সক্কাল ওই ধূলো পড়ে যাওয়া সুটকেসগুলো নিয়ে বসল।

একটার পর একটা সুটকেস খুলছে আর বেশিরভাগ অপ্রয়োজনীয় ফালতু জিনিস দেখে, সে অভিরূপের ওপর রাগে নিজের মনে গজরাচ্ছে। পৌলমীর তিনটে সুটকেস দেখতে দেখতেই প্রায় বেলা ২টো বেজে গেল। এদিকে, একটানা বসে কাজ করার ফলে ওর কোমরটাও ভীষণ যন্ত্রণা করছিল কিন্তু তখনো একটা সুটকেস বাকি থেকে যাবে ভেবে, পৌলমী মনস্থির করল কাজটা সে একেবারে শেষ করেই উঠবে। আর সেই মত লাস্ট সুটকেসটা এগিয়ে এনে ডালাটা খুলল।

ওই সুটকেসেও যে বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল, সেটা বলাবাহুল্য। কিন্তু স্কুলের খাতা, কলেজের নোটস, ইত্যাদি ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা ছোট ডায়রি ওর চোখে পড়ল। ভুঁরু কুঁচকে ডায়রিটা খুলে দেখল ফাঁকা, এক বর্ণও তাতে লেখা নেই। ডায়রিটা যেই না জঞ্জালের ব্যাগে ফেলবে, ওমনি ডায়রির ভেতর থেকে ওর কোলে এসে পড়ল কিছু মলিন হয়ে যাওয়া ভাঁজ করা কাগজের টুকরো। ফাঁকা ডায়রির একপাশে রাখা ওই কাগজের টুকরোগুলো দেখে পৌলমী একটু অবাক হল এবং কাগজের ভাঁজগুলো খুলতেই মিলল এক অজানা সত্য। 

পৌলমী ভালো মতোই বুঝতে পেরেছিল যে এটা এক নারীকে নিয়ে কোনও এক পুরুষের লেখা। কিন্তু এটা কার লেখা আর কীভাবেই বা সেটা অভিরূপের সুটকেসে এল, সেই কৌতুহল নিজের মন থেকে দূর করতে ওই কাগজগুলো মলিন হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সে শব্দগুলো কিছুটা অনুমান করে নিয়ে পড়তে আরম্ভ করল।

                                                                      ----২----

             চাকরি সূত্রে আমি তখন চেন্নাইতে। প্রত্যেকদিন অফিস ফেরত মেরিনা বিচ দিয়ে যাওয়ার সময়, বঙ্গোপসাগরের কাছে বসে একা কিছুটা সময় কাটানোটা আমার অভ্যাসের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উপরে ঘনও কালো আকাশ, নীচে সমুদ্র সৈকত, ঢেউয়ের গর্জন, মাঝেমধ্যে ধেয়ে আসা জোলো হাওয়া আর পিছন থেকে ক্রমাগত ছুটে চলা গাড়ির শব্দ, সব যেন আমার কাছে একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম চাকরি ও প্রিয় শহরটা ছেড়ে এতো দূরে চলে আসাটা হয়ত আমার মন এখনো মেনে নিতে পারেনি। ফলে, নিজের অজান্তেই এই বিষয়গুলো আমার কাছে ধীরে ধীরে ভালো লাগায় পরিণত হয়েছিল। 

কলকাতা ছেড়ে এই নতুন শহর ও নতুন মানুষগুলোর মাঝে এসে আমি যেন বড্ড চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম। সব নতুনের মাঝে কোথাও যেন আমি দিনে দিনে নিজের পুরনো আমিকে হারিয়ে ফেলছিলাম। প্রিন্সেপ ঘাটে বসে পরন্ত বিকেলগুলো যেভাবে পর্ণার হাতে হাত রেখে যেই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা আমরা একসঙ্গে গুনগুন করতাম, এখনো একইভাবে রোজ নিয়ম করে আমি ওই একই গান গুনগুন করি, তবে একা। আমাদের গানের তখন সাক্ষী থাকত গঙ্গা। আর এখন থাকে বঙ্গোপসাগর, আমার একার গানে। 

সেদিনও অফিস থেকে ফেরার পথে বঙ্গোপসাগরকে সাক্ষী রেখে আমি নিজের মনেই গানটা গুনগুন করছিলাম এবং কখন যে নিজের চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গিয়ে চুপ করে গিয়েছিলাম, তার টেরও পাইনি। কিন্তু পিছন থেকে হঠাৎ একটি মেয়ের কণ্ঠস্বর আমার উদ্দেশ্যে ভেসে এল,

- কী হল গানটা থামিয়ে দিলেন যে?

অচেনা নারীর কণ্ঠস্বর শুনে আমি চমকে উঠলাম! প্রতিদিন একই জায়গায় এইভাবে বসে আপন খেয়ালে আমি এই গানটা গুণগুন করি কিন্তু সেদিন ওই আগন্তুক হঠাৎ গান থামানোর কারণটা জানতে চাওয়ায়, আমার মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। আসলে চেন্নাই আসার পর থেকে যে কেউ এমন ভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে কখনো এগিয়ে আসেনি। 

মেয়েটি আমার বয়সী হবে, পড়নে সাদা কুর্তি আর নীল জিন্স, চোখে ঘনও করে দেওয়া কাজলটা দিনের শেষে ঘেঁটে গেছে, ঠোঁটের লাল লিপস্টিকটাও ফিকে হয়ে এসেছে, হাওয়ায় খোলা চুলগুলো উড়ছে। তবু ওই এলোমেলো অবস্থাতেও মেয়েটিকে আমার অপরুপ সুন্দর লাগছিল। আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটি বলল,

- আপনি হঠাৎ গানটা থামিয়ে দিলেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।

- না!না! মনে করার কি আছে। অচেনা শহরে আজও যে এক বাঙালি আরেক বাঙালির গান শুনে এগিয়ে আসে, এই পরন্ত বিকেলে এটাই তো পরম প্রাপ্তি।

- এর জন্য কিন্তু কবিগুরু-কে আপনার একটা ধন্যবাদ দিতে হবে। 

- হ্যাঁ! অবশ্যই।

- নমস্কার। আমি জুন। কলকাতায় বেড়ে ওঠা। এখানে পিজি-তে থাকি। 

- (কথাটা শোনা মাত্রই আমি বললাম) আপনি এখানে চাকরি সূত্রে? 

- হুমম। (জুনের ছোট্ট একটা উত্তর)

- আলাপ করে ভালো লাগল। আমার নাম অভিরূপ সরকার, আমিও চাকরি সূত্রে এখানে।

- সেটা আপনাকে অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করেই বুঝেছি। আসলে অফিসের পর আমিও প্রতিদিন পিজি-তে ফেরার আগে এখানে একটু বসে তবেই ফিরি। আর কিছুদিন ধরে আপনার এই গুনগুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া এবং দিনের শেষে মাকে ফোন করে দিনের প্রত্যেকটা ডিটেলস অত নিখুঁত ভাবে দেওয়া দেখে, বলতে পারেন আমি আপনার ফ্যান হয়ে গেছি। এটা বোধহয় শুধু বাঙালিরাই পারে, তাই না?  

- বাঙালিদের স্টেরিওটাইপ করছেন?

- না! ইউনিক করছি। আমি আজ পর্যন্ত আমার কোনও অবাঙালি কলিগ-কে দেখিনি তার মাকে সে ফোন করে সব ডিটেলস এতো নিখুঁত ভাবে দিচ্ছে।

- আসলে তিন মাস হল চেন্নাই-তে শিফট হয়েছি। তাই মায়ের চিন্তাটা অনেকটাই বেশি। 

- তা কেমন লাগছে চেন্নাই?

- সব ভালো, শুধু ঘুমটাই যা কেড়েছে। তা আপনি কি চেন্নাই-তে অনেকদিন?

- (হেসে জুনের উত্তর) দু-বছর। প্রথম চাকরিই এখানে, তাই মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়নি।

- আমি এতদিন কলকাতায় চাকরি করেছি। এখন নতুন কোম্পানি, নতুন শহর, তাই মাঝেমধ্যে একটু বাড়ির লোকজনের জন্য মনটা কাঁদে বটে।

- কেমন আছে শহর কলকাতা? 

- (উত্তরে বললাম) শহরটা একই রয়েছে কিন্তু মানুষগুলো খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে।

সূর্যাস্ত তখন প্রায় হয়ে এসেছে, পাখিরা যে যার বাড়ি ফেরার পথ ধরেছে এবং আকাশের ওই নীল রঙটাও ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে। অবাক দৃষ্টি-তে চেয়ে জুন জিজ্ঞেস করল,

- আর ভালোবাসা? 

- (আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম) এক রাশ ব্যস্ততার ভিড়ে সে নিজেকে হারাতে বসেছে। 

- (জুন রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল) আমার আর কলকাতায় ফিরতে মন চায় না।

- কেন, পিছুটান নেই বলে?

কথাটা শোনার পর জুন কোথাও একটা হারিয়ে গিয়েছিল। আমি তখনো ওর দিকে চেয়ে ছিলাম। হ্যাঁ! পর্ণা পর, এই প্রথম আমি কোনও মেয়ের চোখের দিকে এতক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলাম। জুনের চোখ দুটো যেন ওর মুখের চেয়েও অনেক বেশি কথা বলে। 

                                                 ----৩----

            সেই দিনের পর অফিস ফেরত রোজ মেরিনা বিচে যাওয়ার আরও একটা কারণ পেয়ে গেলাম। জুনের সঙ্গে দিনের শেষে দেখা করাটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হল। এমনকি আমাদের কথোপকথনগুলো ফোনে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। আমাদের 'আপনি'টাও এখন 'তুমি'তে পরিবর্তন হয়েছে। আর এরকমই একদিন বিচে বসে গল্প করতে করতে কখন যে সন্ধ্যে হয়ে গেছে, তার মালুম পায়নি। সমুদ্রর দিকে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে বলে উঠল জুন,

- রাতের সমুদ্র তোমার কেমন লাগে?

- (উত্তরে বললাম) রাতের সমুদ্র আমার বেশ লাগে। অন্ধকারটাই আসলে আমার খুব পছন্দের, বেশি আলোয় যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

- তোমার কথার অর্থ আমি বুঝেছি। 

- (আমার প্রশ্ন) কী বুঝলে?

- আসলে ভাঙ্গা মনগুলো একে-অপরকে খুব সহজেই চিনতে পারে। 

- তোমার কথা কিছু বলো জুন, আমি তোমাকে চিনতে চাই। 

- আমাকে চিনতে? কিন্তু কেন? আমার কাছে আমি এখন শুধুই ভাঙ্গা মনের ধ্বংসস্তূপ। 

- এই অল্প দিনের বন্ধুর কাছে তোমার মন ভাঙ্গার কারণটা বলতে পারো। তাতে হয়ত কিছুটা জোড়া লাগতেও পারে। 

- (হেসে জুনের উত্তর) পারে? সত্যি? তবে, এক ভিক্ষুক আরেক ভিক্ষুকের খিদে বুঝলেও, সেটা কখনোই মেটাতে পারে না।

দুজনেই প্রাণ খুলে হেসে উঠলাম। এতদিন চেন্নাইতে নিজেকে একজন বোবা মানুষ বলেই মনে হত কিন্তু এখন আবারও যেন মন খুলে কথা বলতে পারছিলাম। বিগত কয়েকদিনের আলাপে জুনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছিল। 

একদিন কথায় কথায় জানতে পারলাম যে জুন ছোট থেকেই অনাথ। খুব অল্প বয়সে নিজের বাবা-মাকে হারানোর পর কলকাতার একটি হোমেই ওর বেড়ে ওঠা। নিজের পড়াশোনা শেষ করে, একটা চাকরি জুটিয়ে জুন চলে আসে চেন্নাই। 

ওই দিন বাড়ি ফিরে জুনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের দিনটার কথা চিন্তা কতে করতে আমার মনে পড়ল জুন সেদিন শুধু নিজের নামটুকুই বলেছিল, পদবীটা উল্লেখ করেনি। এখন ওর এই সত্যটা জানার পর, কেন জানি না আমি ওর প্রতি আরও দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু জুন?

না! ও ভাবলো, আমি ওর সত্যটা জানার পর হয়ত ওকে সহানুভূতি দেখাব আর তাই নিজেকে ক্রমাগত আমার কাছ থেকে সে সরিয়ে নিতে লাগল। দেখাসাক্ষাৎ কমিয়ে দিল, আর তাই ফোনে একদিন আমি ওকে বললাম,

- জুন, নিজেকে এইভাবে সরিয়ে রেখো না। বন্ধুত্বের মধ্যে এইসব ব্যাপার খুবই তুচ্ছ। কার কি ধর্ম, কার কি জন্ম পরিচয় এইসব দেখে বন্ধুত্ব হয় না। প্রকৃত বন্ধুত্বে শুধুমাত্র দুটো মন লাগে। কখনো ভেবে দেখেছ, যে যন্ত্রণাগুলো তোমার মনে কাঁটার মতো ফোটে, সেগুলো-কে দূরে সরিয়ে যদি এক পলকের জন্য হলেও, নিজেকে ভালবাসতে শেখো, তাহলে দেখবে পুরো বিষয়টা কতটা সহজ হয়ে গেছে। 

- কিন্তু তোমার যন্ত্রণা আর আমার যন্ত্রণা এক নয়, অভি। তুমি প্রেমে ব্যর্থতার কারণে যন্ত্রণা পেয়েছ আর আমি পেয়েছি নিজের অস্তিত্ব হারানোর।

- এটা ঠিক যে আমাদের কারণগুলো আলাদা কিন্তু যন্ত্রণাটা এক। পর্ণা চলে যাওয়ার পর কোনোদিনও ভাবিনি কোনও মেয়ের সঙ্গে আমি এইভাবে কথা বলব। কিন্তু তোমার সঙ্গে বিচে দেখা হওয়ার পর থেকে আজ অবধি, বলতে দ্বিধা নেই যে সেই পুরনো যন্ত্রণা আমি ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। আর সেটা তোমার জন্য জুন। তোমার সঙ্গে মিশে আজ আমি এই অচেনা শহরে মুক্ত বাতাসের সন্ধান পেয়েছি। তোমার কি সেইরকম কোনও অনুভূতি হয়নি?   

কোনও উত্তর না দিয়ে ফোনটা কেটে দিয়েছিল জুন এবং তারপর কয়েকটা দিন আমার কাছ থেকে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখল। তবে, বেশি দিন সেটা সম্ভব হল না। কারণ শহরের প্রথম বৃষ্টির আগেই আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে জুনের অফিসের সামনে গিয়ে হাজির হলাম এবং ছুটির পর অফিসের গেট দিয়ে বেরনোর মুহূর্তে আমাকে দেখে জুন চমকে গিয়েছিল। আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম,

- কি হয়েছে তোমার? পরিবর্তন? কোন অজানা ঝড় এসে তোমায় বারবার ধাক্কা মারছে? রোজ বিকেলে বিচে বসে আমাদের গল্প-গানে মেতে থাকা, আমাদের বন্ধুত্বটা কি তাহলে মিথ্যে ছিল?

জুন চুপ করে থাকলেও, ওই নিস্তব্ধতা ভাঙ্গল মেঘের গর্জনে। আকাশ ভেঙ্গে বাজ পড়ল কাছেই কোথাও। আর এক রাশ দমকা হাওয়া এসে লাগল ওর মুখে এবং ঠিক প্রথম দিনটার মতো সেদিনও ওর খোলা চুলগুলো উড়ছিল। ওই মুহূর্তে ওর মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, কিছু বলতে গিয়েও হয়ত মনের অনেক কথাই জুন বলতে পারল না।  

                                                          ----৪----

         ওই ঘটনার পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল। কিছুটা বেখেয়ালে হারিয়ে গিয়ে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন সকালে বিচের ধারে গিয়ে চুপ করে বসেছিলাম। কত কিছুই না ছেড়ে এসেছিলাম কলকাতায়, নিজের পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শহরের গন্ধটা, বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে আড্ডা। কিন্তু এইগুলো ছাড়তে এক মুহূর্ত কষ্ট হয়নি, যতটা না হয়েছিল পর্ণাকে ছাড়তে। সেই প্রিন্সেপ ঘাটে বসে আমার কান্না, আমাকে ছেড়ে না যাওয়ার অনুরোধ। প্রতিদিন সেই বিকেলটা আমাকে তাড়া করে বেড়াত কিন্তু জুনের বন্ধুত্বটা আমাকে সেই ঘোর থেকে অনেকটাই বের করে এনেছিল। তবে, আবার সেই ভালোবাসা ছেড়ে যাওয়ার ওই পুরোনো দমবন্ধ করা অনুভূতিটা এখন প্রায়ই অনুভব করছি। আর এইসব চিন্তার মাঝেই হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা হাত আমার হাতটা চেপে ধরল এবং পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল,

- মন খারাপ করে বসে থাকতে নেই, অভি।

হ্যাঁ! 'অভি' কথাটা শোনা মাত্রই পিছন ফিরে দেখি জুন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি কোনও উত্তর দিলাম না। সমুদ্রের দিকে স্থির ভাবে চেয়ে রইলাম। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল তখন। মাত্র কয়েক মাসের বন্ধুত্বে এতটা পিছুটান কী করে তৈরি হল, তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না।

সময়ের সঙ্গে আবারও আমাদের মধ্যে সবকিছু ঠিক আগের মতোই স্বাভাবিক হতে শুরু করল। আবারও রোজ অফিস ফেরত মেরিনা বিচে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গুনগুন করা সেইসঙ্গে দেদার আড্ডা, এভাবেই চলছিল জীবন। কিন্তু মায়ের ওই একটা ফোন সবকিছুর যেন ইতি টেনে দিল। আমার চোখ মুখের অবস্থা দেখে জুন আমাকে জিজ্ঞেস করল,

- তোমার কী কিছু হয়েছে, অভি? অ্যান্টি কী বলল?

- (জুনকে সংক্ষেপে বললাম) আমার বিয়ের কথা। 

- (আচমকা বিয়ের খবরটা শুনে জুন বলল) তোমার যে দেখাশোনা চলছে, কৈ আমাকে জানাওনি তো? 

- (উত্তরে বললাম) আমি নিজেই এখনও সবটা বুঝে উঠতে পারলাম কৈ! কোনোদিন ভাবিনি বাবা-মায়ের দেখা কোনও অচেনা অজানা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।

- (কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জুনের প্রশ্ন) মেয়েটাকে দেখেছ? নাম কি?

- না! দেখিনি। সব ঠিক করার পরই মা ফোন করেছিল।

- বাহ! মেয়েটার মুখ দেখনি, নামও জানা নেই। এমন মেয়েকে বিয়ে করবে?

- (আমার উত্তর) কিছু করার নেই যে! ভালোবাসা হারিয়ে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে এতটা সময় লাগিয়ে ফেললাম যে অন্য কাউকে আর ভালোবাসার সেই সময়টাই পেলাম না।

- যাক ভালো। তা বিয়েটা কবে?

- ঠিক এক মাস বাদে।

- এই শহর তাহলে একেবারে ছেড়ে দিচ্ছ? 

- হ্যাঁ! সেই ব্যথার শহরেই ফিরতে হচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে জুন চুপ করেছিল দেখে আমি ওকে বললাম,

- এই একমাস অন্ধকারটা একসঙ্গে উপভোগ করলে কেমন হয়?

- (আমার দিকে চেয়ে জুনের উত্তর) একটা শর্তে।

- কী?

- (হাসতে হাসতে জুন বলল) যদি তোমার বিয়েতে আমায় নিমন্ত্রণ করো।

সত্যি! জুনকে দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয় আমাদের চেনা ছকের বাইরে গিয়েও, কিছু মানুষ থাকে যারা নিজেদের এইভাবেই মেলে ধরে এবং সেটা খুব একটা অন্যায় নয়। তবে, এই মানুষগুলো এখন শহুরে জাতাকলে পড়ে যেন ক্রমশই হারিয়ে যেতে বসেছে।  

                                             ----৫----

বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে, গাড়ির জানালার কাচে এসে আছড়ে পড়ছে বৃষ্টির জল। এইসবের মাঝেই জুন বলে উঠল,

- সময় হয়ে এল তোমার, আবার আমায় এই বিশাল শহরে একলা চলতে হবে।

- তুমিও চলো না কলকাতা, ওখানে একটা চাকরি দেখো। তাহলে আমরা এক শহরেই থাকতে পারব।

- এক শহরে থাকলেও যে দেখা হবে না।

- কেন?

- তুমি সংসার নামক কারাগারে বন্দি হতে চলেছ যে।

- আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?

- না! অভি। বাস্তবটা দেখাচ্ছি।

কথাটা শুনে আমার কেমন যেন একটা খটকা লাগল। তাই জুনকে আবারও বললাম,

- আমার বিয়েতে তুমি সত্যি আসবে তো?

- (আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো করেই জুন বলল) তোমার ফ্লাইট পরশু তো? আমি কিন্তু ছাড়তে আসব।

- (একটু রেগে বললাম) ছাড়ার হলে এখানেই ছেড়ে দাও না। 

বৃষ্টিটা ততক্ষণে থেমে গেছে তাই গাড়ি থেকে নেমে আমরা পাশাপাশি হাঁটা শুরু করলাম। তবে, মাঝখানে দুটো মন জুড়ে ছিল এক অদৃশ্য দ্বিধা'র দূরত্ব। 

- (পিজি-র সামনে এসে জুন আমার দিকে তাকিয়ে বলল) আমরা শুধু বন্ধুই তো, অভি?

- (ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম) মানে?

- না! কিছু না। গুড নাইট। (উত্তরটা না দেওয়ার মতো করে বলে, চলে গেল জুন)

বাড়ি ফেরার মুহূর্তে মেরিনা বিচে ঢেউয়ের আওয়াজটা যেন একটু বেশি মনে হল। অন্ধকারটাও বেশি গাঢ় লাগল। হয়ত প্রকৃতি কিছু বোঝাতে চেয়েও, বোঝাতে পারছিল না।

দু-দিন পর অবশেষে ওই মুহূর্ত এসে হাজির, আমাকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছিল জুন এবং ওকে দেখে কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগল।

- আমি আসছি, জুন। 

- বলো, যাচ্ছি। আসছি বললে মনে হবে তুমি আবার ফিরবে।

- বিদায়টা সবসময় বেদনার, তাই না?

- হ্যাঁ! অভি। তবে, এভাবেই এগিয়ে চলে জীবন।

- (জুনের কথায় সহমত প্রকাশ করে বললাম) তাও কেন জানি না আজ শহরটা ছাড়তে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

- আর আমায়? (মজা করে বলল জুন)

- (মজার ছলে আমিও উত্তর দিলাম) সেটা কলকাতায় ফিরে গিয়ে বুঝবো। আচ্ছা! জুন, তুমি কি আমার মতো পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় আর কখনো ফিরবে না?

- কলকাতায় আমার কে আছে যে পাকাপাকি ভাবে ফিরতে হবে?

- কেন? আমি নেই? কলকাতায় একটা চাকরি নিয়ে চলে আসো।

- ওসব কথা এখন বাদ দাও। তোমার সামনে আসতে চলা নতুন জীবনটার দিকে এবার মন দাও। 

- ভালো থেকো, জুন।

- তুমিও অনেক অনেক ভালো থেকো। 

কথাটা শেষ করেই জুন চলে গেল। একবারও আর পিছন ফিরে তাকালো না। ফ্লাইটে উঠে আমিও নিজের সিটটায় দেহটা-কে ছুঁড়ে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, আর আমার চারিপাশটা তখন ঘিরে একরাশ শূন্যতা।  

                                      ----৬----

লেখাটা এখানেই শেষ নয়, কিন্তু কাগজের উল্টো পৃষ্ঠার বাকি অংশটা মলিন হয়ে যাওয়ায় পৌলমীর পক্ষে আর পড়া সম্ভব হল না। ফলে, শেষ অংশটুকু না পরেই ও রেখে দিল এবং অভিরূপের ফেরার অপেক্ষায় রইল। 

মুম্বাই থেকে অভিরূপ ফেরার পর, সেই রাতে ডিনার টেবিলে বসে খেতে খেতেই কথাটা পারলো পৌলমী,

- তোমার যে বিয়ের আগে জুন বলে কোনও বান্ধবী ছিল, কৈ আমাকে বলোনি তো?

- (অভিরূপ খানিক অবাক হয়েই বলল) হ্যাঁ! কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন?

- বলছি। তার আগে বলো তো, আমাদের বিয়েতে ওকে নিমন্ত্রণ করা হলেও, ওর না আসার কারণ কি? 

এবার অভিরূপ সম্পূর্ণ হতভম্ব। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ-ই হো-হো করে অট্টহাসি হেসে উঠল সে। পৌলমীর মুখেও ছিল হাসি, 

- কি মনে পড়েছে? 

- হ্যাঁ! হ্যাঁ! বাবা। মনে পড়েছে।

- (কাগজের টুকরোগুলো অভিরূপের হাতে দিয়ে বলল) এটা তোমার হাতের লেখা তো?

- (অনেক কষ্টে হাসির বেগ খানিকটা কমিয়ে অভিরূপ বলল) হ্যাঁ! এটা আমার-ই হাতের লেখা। উফ! সে এক অধ্যায় ছিল। তখন সবে চেন্নাইতে গেছি। প্রথম প্রেমে ব্যর্থতা এবং নতুন শহরে অচেনা লোকের মাঝে পরে, সে এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ওই সময় জুনের মতো বন্ধু পাশে পেয়েছিলাম বলেই হয়ত নিজেকে অনেকটা ফিরে পেয়েছিলাম।

- কিন্তু তোমার দেওয়া ওই সময়ের বর্ণনা পড়ে, আমি এক অন্য অর্থ উপলব্ধি করেছি। 

- (মুচকি হেসে প্রশ্ন করল অভিরূপ) কি উপলব্ধি করেছ শুনি?

- (এবার একটু সিরিয়াস হয়ে বলল পৌলমী) তোমাকে জুন ভালোবেসে ফেলেছিল।   

-মানে? কি বলছ তুমি?

- হ্যাঁ! আমার মনে হয় জুন তোমাকে ভালোবাসত কিন্তু আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার কথাটা শুনে, ও নিজেকে সংযত রেখেছিল এবং চায়নি ওর জন্য তোমার জীবনে কোনও সমস্যা তৈরি হোক। কারণ জুন মনে করেছিল, এক অনাথ পরিচয়হীন মেয়েকে অনেক পরিবারের লোকজনই তাদের পুত্রবধূ হিসাবে মেনে নেয় না সুতরাং পরবর্তী সময় জীবন জটিল হয়ে ওঠার চেয়ে, তখনই সরে যাওয়াটা সে শ্রেয় বলে মনে করেছে। এমনকি আমাদের বিয়েতে ওর না আসার এটাও একটা কারণ হতে পারে।

অভিরূপ খুব মন দিয়ে পৌলমীর কথাগুলো শুনছিল, ওর হাতে থেকে খাবার চামচটা কখন যে প্লেট স্পর্শ করেছে, তা বুঝতেও পারেনি। কিন্তু পৌলমীর একটা প্রশ্ন, ওর স্বামীর চারপাশটা যেন নাড়িয়ে দিল,

- অভি, ওই কাগজের উল্টো পৃষ্ঠার বাকি অংশটায় কি লেখা ছিল?

- (এই প্রথম হয়ত মিথ্যের আশ্রয় নিল অভিরূপ) ওই আমাদের বিয়ে আর তারপর নতুন জীবনের সূচনা, ইত্যাদি। শেষ অংশটা এই নিয়েই ছিল। 

হাসতে হাসতেই টেবিলের অপর প্রান্ত থেকে উঠে এসে অভিরূপের গলাটা জড়িয়ে ধরে গালে একটা মিষ্টি চুমু এঁকে পৌলমী বলল,

- ভাগ্যিস, তোমাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের ছিল, নইলে আজ আমার এই হাসবেন্ডটা অন্য কারোর হত।

এই অবধি বলে থামল পৌলমী। কিন্তু টেবিলের ওপর পরে থাকা ওই কাগজের উল্টো পৃষ্ঠার বাকি অংশে লেখা অভিরূপের সেই কবিতাটা পৌলমীর কাছে অজানাই থেকে গেল।

হ্যাঁ! যেই কবিতার প্রথম দুটো লাইন-

"কে বলে তোমায় চোখ বুজলে ছোঁয়া যায়, পিছুটানের হিসেব কি তবে মিটে যায়?

ভুলে থাকা কি এতটাই সহজ? তবে কেন রাতের শেষে দুঃখগুলো ভিজে বালিশে খোঁজে আশ্রয়।"

এই লাইন দুটো মনে পড়তেই, আবারও সেই পুরনো প্রশ্নটা অভিরূপের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। কী কারণে জুন এইভাবে হারিয়ে গেল? যদি পৌলমীর অনুমান সঠিক হয়, তাহলে ওর যোগাযোগ না রাখার সেটাও একটা কারণ হতে পারে। 

তবে, বলতে দ্বিধা নেই যে জুনের প্রতি অভিরূপের পিছুটানটা এখনো রয়েছে গেছে। কিন্তু সেই পিছুটান কি শুধুমাত্র বন্ধুত্বের কারণে, নাকি নিজের অজান্তেই নিজের অন্তরে একটা গভীর স্থান জুনকে দিয়ে ফেলেছিল অভিরূপ? এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র অভিরূপই দিতে পারবে, কারণ সে আজও সবার আড়ালে দিনের শেষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আকাশের দিয়ে চেয়ে আপন মনে বলে ওঠে,

- যেখানেই থাকো জুন, ভালো থেকো। 

bhowmikranit1@gmail.com
হাওড়া



No comments:

Post a Comment