![]() |
ছবি : ইন্টারনেট উত্তম কুমার পুরকাইত |
মফস্বল থেকে বেরিয়ে বাসটা ফাঁকা মাঠ ছাড়িয়ে সবুজ
গ্রামের চুমু পেতেই স্বপনদার হাতের স্টিয়ারিং শক্ত হয়। রাত আটটা বাজলেই এদিকের
রাস্তাঘাট শুনশান লাগে। স্বপনদা এসময় কোনো খানাখন্দ মানে না। যেন ভূতে পায়।
সিঁদুর আঁকা কপালে তান্ত্রিকের মত কঠিন চোখ কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। অথচ রাস্তাটা
বুকের পাঁজরা বের করে কঙ্কালের চেহারায় অবিরত ছোটে, ধরা যায় না।
রাস্তার তালে গাড়িটাও যখন হেলেদুলে ছুটছে, বয়স্ক
প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে একটা আর্তি। রমেন মজা পায়। পাঁচ বছরের বেশি ও স্বপনদার
সঙ্গী। স্বপনদার নাড়ি-নক্ষত্র যেমন জানে, তেমনি স্বপনদাও
ওরটা জানে। পেটে এক পেগ পড়লেই স্বপনদার গোঁয়ার্তুমি বাড়ে।
কিন্তু আজ তো মদ জোটেনি। তপু শালা দোকান বন্ধ
করে কোথায় যে গেল! গেট থেকে সরে ও স্বপনদার কাছে গিয়ে বসে। ইয়াং ছেলেগুলো দুলছে
হিন্দি গানের সঙ্গে। ও উপভোগ করে। আস্তে করে স্বপনদাকে বলে, একটু আস্তে চালাও, বয়স্করা ভয়
পাচ্ছে।
স্বপনদা ওর দিকে তাকায়, রাত্রে আর গাড়ি
চালাতে ইচ্ছে করে না, তোকে কে বলেছিল বরযাত্রীর গাড়ি করতে?
আরে দাদা পাশের গ্রামের লোক। একটু কম রেটে পাবে
বলে ধরল, না করতে পারলুম
না।
শালা কবে থেকে মালিকের এত কাছের হয়ে গেছিস রে? তোর কথায় গাড়ি
ছাড়ল। সব কাজে এত পাকামি কোরো না, আগে আমাকে জানিও। মেয়েটার বিয়ে হওয়ার পর বউ
আজকাল রাতে ছাড়তে চায় না। বুঝলে?
কিন্তু মালিক যদি ডাকে তখন? কাছে জম্পেশ হয়ে
বসতে বসতে রমেন বোকার মতো বলেই ফেলে।
তোর কাছে আমি, না মালিক? আমি তোকে ছাঁটতে চাইলে পারবি তো বাঁচতে? স্বপনদা ধারালো
চোখে বলে একটু থামে।
শালা তোমার বউ তো ভেগেছে, তুমি কি চাও
বুড়ো বয়সে আমারটাও ভাগুক?
পলকে ঝিম মেরে যায় রমেন। বউটা চলে যাওয়ার পর
থেকে প্রত্যেকদিন তাকে শুনতে হয়। কী-জানি হয়তো সারা জীবন শুনতে হবে। স্বপনদা ওর
মেঘঝোলা মুখখানা দেখে হাসে, শালা এই নরম-শরম মুখ মেয়েরা পছন্দ করে না, বুঝলি?
ওর মাথায় বাঁ হাত ছুঁয়ে বলে, রাগ করেছিস নাকি? তোর সঙ্গে লেগে
মজা পাই রে বোকা।
রমেন উঠে যায় নিজের জায়গায়। খালাসি করেই তার
জীবন। কন্ডাক্টরিটা করে ওঠা হলো না। স্টিয়ারিং-এ হাত দেওয়া তো দূর। মনটা খারাপ
হয়। বহুদিন পরে এত বড়ো সুগন্ধি ভরা ভিড়ে নিজেকে আপেঙক্তেয় মনে হয়।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বড়ো অসহায় সে। যতবার নামতে
চেয়েছে বউয়ের অতলে, ততবার ভেসে উঠেছে। তার বউ হেসেছে, হেসে লুটোপুটি
খেয়েছে। শরীরটা আড়াপাল্লায় বড়ো ছিল তার। কতবার চোখে চোখ রেখে ডাঁটো কন্ঠে বলেছে, বাপের টাকা থাকলে
তোমার হাতে পড়তাম নাকি? তোমার স্বপনদার মতো মরদ হলে আমার চলে।
শিউরে উঠেছে রমেন। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলেছে, বেশ্যা কোথাকার!
কেন এসেছিস এখানে? যা স্বপনদার কাছে।
হেসেছে সুফলা, অক্ষম মরদের রাগ দেখো।
সেই সুফলা চলে গেল পাঁচ মাস। বছর চারের ছেলেটাকে রেখে রমেনের নিজের ভাই দেবেনের সঙ্গে।
রাত ন'টার দিকে গাড়িটা এসে দাঁড়ায় মস্ত মস্ত
গাছগাছালির ঝুপসি অন্ধকার মোড়ে। দরজা খুলে রমেন লাফিয়ে পড়ে। বাঁ-হাতে গাড়ি রাখার
জায়গা দেখায়। স্বপনদার হাতে শেষ দম ছেড়ে গাড়িটা কেঁপে উঠে স্তব্ধ হয়। সামনের
মারুতি ভ্যান থেকে বর নেমেছে। একটা চার্জার লাইট হাতে কনেপক্ষের কয়েকজন লোক
এগিয়ে নিতে এসেছে, সঙ্গে শাঁখ হাতে কয়েকজন তরুণী। শঙ্খধ্বনি আর
উলুধ্বনিতে সারাপথ মুখরিত করে তারা বরকে নিয়ে এগোয়।
বাস থেকে বরযাত্রীরা নামতেই পাড়ার শিবুদা
সামনে দাঁড়ায়। মানুষটা সম্পর্কে বরের পিসতুতো ভাই। তারই অনুরোধে একটু অল্প
ভাড়ায় এই গাড়িটির বন্দোবস্ত। মানুষটা হাসতে হাসতে বলে,
চল আমাদের সঙ্গে।
ড্রাইভার সিট ছেড়ে লাফিয়ে নামে স্বপনদা, যেতে পারিস, আমার কোনো
অসুবিধে নেই।
রমেন মাথা নাড়ে, না না শিবুদা, বলেছ এই যথেষ্ট।
এ লাইনে থাকার দরুন বিয়েবাড়ি জীবনে অনেক
দেখেছে রমেন। অনেকবার শুনেছে, যদিদং হৃদয়ং তব। এসব পলকা হয়ে গেছে। সবাই
বোঝে এই মন্ত্র, রেজিস্ট্রি বা সাতপাক মানুষকে খাঁচাবন্দি করার ছল। আজকের সমাজে এর কোনো
সারবত্তা নেই। রমেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
স্বপনদা ওকে ডাকে, দেখ কাছাকাছি কোথাও ঠেক আছে কি না।
ঠেক বলতে মদের। অন্তত দু'পেগ না পড়লে চলবে
না লোকটার। কিন্তু এই অন্ধকারে, তাও পাড়াগাঁয়ে... চায়ের দোকানে যায় ওরা।
প্রত্যন্ত এসব গ্রামে প্রায় সময় লোডশেডিং। বয়স্ক লোকটা ইশারায় অন্ধকারের পথটা
দেখিয়ে দেয়। তবে সতর্ক করে। পাড়ায় এখন মাঝেমধ্যে পুলিশ হানা দেয়। অনেক ঝুঁকি।
হতাশ হয়ে বেঞ্চে বসে স্বপনদা। পুলিশ আজকাল
বাসেও সার্চ করে। এই ভয়ে আসার পথে রিস্কটা নেয়নি। নইলে তপুর দোকান ছাড়া অন্য দোকান
যে পেত না তা নয়। শালা যেখানে বাঘের ভয়...
স্বপনদাকে খুব হতাশ এবং অস্থির দেখায়। কিন্তু বিপদ আঁচ করে বেশি এগোনোর সাহস দেখায় না। বাধ্য হয়ে খান্তি দেয়। বুড়োর কাছ থেকে দু'কাপ চা নেয়।
রমেন মদ খেত না আগে। তবু সুফলা সহ্য করত না।
স্বপনদার পাল্লায় পড়ে একটু-আধটু খেয়ে যখন কাছে যেত, মেয়েটা ঠেলে দিত, উ! বাবা গো, ওলাউঠো মদ খেয়ে মর্দানি দেখাতে এসেছে।
রমেন কখনো বোঝাতে পারত না যান্ত্রিক জীবন থেকে
একটু জুড়োতে এই নেশাটুকু না করলেই নয়। সারাদিন স্ট্যান্ডে ওঠানামা, পাবলিকের সঙ্গে
কিচাইন। স্বপনদা কিংবা কন্ডাক্টর হরিদার থেকে হালকা খিস্তি খাওয়া ছাড়াও আর একটা
কাজ তাকে সামলাতে হয়। প্যাসেঞ্জার বমি করলে কোথায় বালি পাও আনো, নতুবা জল
ঢালো। এসব করতে করতে বাংলা খাওয়াটা
অভ্যাসে এসেছিল। সারাদিন একটা চলন্ত গাড়ির সঙ্গে যুদ্ধ করার ধকল সামলানোর সস্তা
ওষুধ আর কোথায়? শরীর-মনের তাগদ জিইয়ে রাখতে এ লাইনের সবাইকে তাই দু-এক পেগ মারতেই হয়। দেশি
বাংলা।
জায়গাটা এখন ফাঁকা। দোকানগুলো ঝাঁপ ফেলছে।
খদ্দেররা পিছনঝাড়া দিতে শুনশান। রাত ন'টা মানে শহর থেকে দূরের এই এলাকাগুলোতে ভুতুড়ে
ছায়া নেমে আসে টুপ করে। আকাশে জ্যোৎস্নার দেখা নেই। মেঘলা। দোকানদার বুড়োটা আজকের
মতো গুছোতেই থাকে। চায়ের কাপ রেখে দাঁড়ায় রমেন। স্বপনদা দাম মিটিয়ে গাড়িমুখো
হয়। রমেনও। লাইট জ্বেলে গাড়ির ভেতরটা একটু দেখে। বিরক্ত হয়, কেন যে এরা আসে!
এখন এই নিরুদ্দেশে বালি পাব কোথায়?
স্বপনদা বলে, থাক এখন, আবার তো উগরোবে।
দুজনে পছন্দের সিট দেখে নিজেদের এলিয়ে দেয়।
স্বপনদার একটা হাই ওঠে। গতকাল একটা বিয়েবাড়ি
খেটেছে। গলার স্বর ঢলে পড়ে।
বিয়েবাড়িটা মিস করলি কেন? যেতে পারতিস।
রমেন জবাব দেয় না। জবাব দিলেই তার ব্যক্তিগত
জীবনের অনেক কিছু এলোমেলো হওয়ার আশঙ্কা। স্বপনদাকে সে চেনে। একটু খিঁচড়ে গেলেই
পাকা জুয়াড়ির মতো তার ভূত-ভবিষ্যৎ ধরে ফেলবে। তারপর সেগুলো নিয়ে লোফালুফি খেলবে।
জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে স্বপনদার। নাক ডাকছে।
রমেন রেহাই পায়। বউ-প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য সে খুব সাবধানে থাকে। ছলাকলা করে অন্য
কথায় জাল পাড়ার অছিলায় থাকে সারাক্ষন।
সে স্বপনদার দিকে তাকায়। মানুষটা তাকে
ভালবাসলেও আলটপকা কখন যে আঘাত দেয়। ইয়ার্কি, ঠাট্টা, টিপ্পনীতে কখন যে খুঁচিয়ে বসে। অনেকবার ভেবেছে
মানুষটাকে ছেড়ে পালাবে। পারেনি। মানুষটা তার জীবিকা জোগানোর রাস্তা। তার
দয়া-মায়া সে অস্বীকার করতে পারে না।
মনে মনে সে বলে, কেউ বোঝে না স্বপনদা, কেউ বুঝবে না। বিয়েবাড়িতে পা রাখলেই সে নিজের
খেলাঘরের ভাঙচুর দেখে। উথাল-পাতাল সুফলা কত রাত ভরাট করে দিয়েছিল তাদের শূন্য
মেটে ঘর। সেসব দৃশ্য আজকাল সে সহ্য করতে পারে না।
তোর ছেলেটা কেমন আছে রে?
রমেন চমকে ওঠে। ছেলেটা স্পষ্ট যেন সামনে
দাঁড়িয়ে। খবরের মিশর-ব্যাবিলনের বাপ-মা হারা মরু বালকের মতো অন্ধকারে চেয়ে। নিজেকে
সামলায় সে। বলে, এই তো নাক ডাকছিলে।
একটু ঢুলুনি এসেছিল বটে। কিন্তু মানুষটার
কৌতূহল মরে না। বলে, হ্যাঁ রে, ছেলেটা মা'র জন্য কাঁদে না তো?
কাঁদে, কিন্তু কী করব বলো।
কত বয়স হলো যেন?
চার বছর। কাঁপা কন্ঠে বলে রমেন।
স্বপনদা সোজা হয়ে গুটিসুটি মেরে বসে, শালা তালে তো এ
আর এক বিপদ। পাঁচ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত মায়েরা ছেলেকে নিজের হেফাজতে নিতে
পারে। মানুষটা হাসে, অদ্ভুত নিয়ম বুঝলি। বাবা হওয়ার কোনো মানে
নেই।
রমেনও বিষণ্ণ হাসে, কোন কথা থেকে যে কোথায় যাও তুমি!
ভাবনার খেইতে বেসামাল হয়ে স্বপনদা নিজেও অবাক
হয়, আসলে কী জানিস, তোর বৌদিটা ও
ঝগড়া-অশান্তি হলে প্রায় ভয় দেখায়, ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবে। এখন দেশের
সব আইন মেয়েদের ফরে বুঝলি।
রমেন মনে মনে বলে, কিচ্ছু করতে পারবে না স্বপনদা। হাজার বছর
মেয়েদের দাবিয়ে রাখার সাজা।
কাজ না থাকলে স্বপনদার কথায় পায়। রমেন মুক, জড় পদার্থের মত
জেগে থাকে। বাড়িতে ঢুকলে ছেলেটা কাঁদে। দু'হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে ঘ্যান-ঘ্যান করে, মাকে এনে দাও, মাকে এনে দাও।
অসহ্য রমেন তেড়ে উঠলে বাচ্চাটা দূরে সরে গিয়ে খেদানো বালকের মতো টলটলিয়ে চেয়ে
থাকে। মা বলে, এবার একটা বিয়ে কর।
আবার বিয়ে! আবার কেউ নিয়ে ভেগে যাক।
মা বাচ্চাটাকে বুকের কাছে আগলে বলে, আমি আজ আছি, কাল নেই। এটাকে
কে দেখবে?
ওর মা যদি ওকে নিয়ে যায়, তুমি বাধা দিতে
পারবে?
মা কেমন ভয় পায়। ছেলেটাকে শক্ত করে চেপে ধরে
বলে, তুই বাবাকে ছেড়ে
চলে যাবি বাপ? ঠাকমাকে ছেড়ে চলে যাবি?
আমার মাকে এনে দাও, তোমরা সবাই আমার কাছে থাকো।
বাচ্চাটা সবার সঙ্গে থাকতে চায়। কিন্তু ওর
চাওয়ার কোনো মূল্য নেই। আইন, মানবাধিকার, রাস্ট্র কেবল নামেই। এদেশে বাচ্চারা বড়ো অনাথ।
রমেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার এই পান্থজীবন নিয়ে
ছেলেটার কাছে পড়ে থাকা অসম্ভব। মনটা খিচড়ে যায়। কতবার বলেছে সুফলাকে, ফুর্তি যদি করতেই
হয় বাড়িতে কর, দু-চার কথা লোকে বলে বলুক। কিন্তু এখন সব অথৈ জলে।
স্বপনদার নাক ডাকে। সে চোখ বোজে। বিয়েবাড়ি
থেকে খাবার আসার কথা। কখন যে আসবে! ড্রাইভার-হেল্পারদের জীবন সমাজ-সংসারে বড়ো ফাউ।
সুফলা বড়ো অবহেলা করত তাকে। তার ঘাম ঝরানো
নেশাতুর, শ্রান্ত জীবনকে
সহ্য করতে পারত না। দেবেনটা হঠাৎ করে যখন লম্বা ঢ্যাঙা হয়ে উঠল, তার মধ্যে সে সব
খুঁজে নিল। রমেন অবশ্য আঘাতটা সয়েছিল। পাড়া-গাঁয়ের ফুসুর-ফুসুরকে সে পাত্তা দিত
না। সেও তো রোশনাই করার নাম করে স্বপনদার সঙ্গে বেশ কয়েকবার ঢুকে গেছে
বেশ্যাপটিতে। আড়ালে-আবডালে পুরুষত্বের পরীক্ষায় যখন নিজেকে ফেল্টু ছাড়া কিছুই
ভাবতে পারল না, তখন ভাইটাকে সে আটকাবে কোন আক্কেলে? মায়ের পেটের ভাই, ভীম-অর্জুনের মতো তাদের বেড়ে ওঠা। না-হয় একটা
মেয়েকে নিয়ে তাদের জীবনযাপন। কিন্তু সংসারের এত জনকে নির্মমভাবে ঠকিয়ে যখন তারা
পালিয়ে গেল খুব কেঁদেছিল রমেন। প্রাপ্তবয়স্কদের রাজত্বে মানবাধিকার কি এভাবে
ছুরি মারে? এ কেমন প্রেম!
তাদের সঙ্গে কাজ করে এক বিহারী খালাসি। ছেলেটা
দেড় বছরের উপরে ঘরমুখো হয়নি। এক মাস আগে তার মেয়ে হলো। ঘটা করে মিষ্টি খাওয়ালো
ছেলেটা। স্ট্যান্ডের সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। বেচারার এই নিয়ে কোনো হেলদোল
নেই।
স্ট্যান্ডের সবাই ছেলেটার পিছনে লাগে। রমেন সেখানে
দাড়ায় না। ব্যাপারটা যেন তাকে ধাওয়া করে। কেউ কেউ তো শুনিয়ে দেয়, বউ গেছে তো কী
হয়েছে? আগে কি যেত না? তাই বলে কি পুরুষ
মানুষের ভিত নড়ে যাবে? স্বপনদা প্রায় বলে, যখন আমাদের দেশে বিবাহব্যবস্থা ছিল না, এক নারীর একাধিক
সঙ্গী, কে যে কার বাবা!
ওসব নিয়ে ভাবিস কেন? আবার বিয়ে কর।
লোকটার উপর যতই অভিমান হোক, তার জ্ঞানকে
তারিফ না করে পারে না রমেন।
দুটো লোক টর্চ লাইট জ্বেলে হনহন করে এদিকে
আসছে। বোঝাই যাচ্ছে বিয়েবাড়ির ভাত-তরকারি। বাসের গায়ে টোকা পড়ার আগে রমেন
দরজাটা খুলে দেয়। স্বপনদাকে ডেকে খেতে বসে। কালে-ভদ্রে রমেনের ভাগ্যে এমন খাওয়া
জোটে। ইনকামটা এতটাই সীমিত যে সংসারে কাউকে সে কোনোদিন মন খুলে খাওয়াতে পারল না।
এই নিয়ে সুফলা তাকে কম শোনায়নি। খেতে খেতে ছেলেটার জন্য কষ্ট হয়। ছেলেটাকে
বোধহয় আর ধরে রাখা যাবে না। একদিন-না-একদিন সুফলা তাকে নিয়ে যাবে। তারপর নিরন্তর
ছেলেটা প্রভাবিত হবে। কাকাকে বাবা বলবে। মদ-মাতাল খালাসি রমেনের কথা মুখে আনবে না।
না, ছেলেটাকে নিয়ে মিছিমিছি ভাবছে। খেয়েদেয়ে মুখ
হাত ধুতে সে নিচে নামে। এবার একটু শুতে পারলে বেশ হয়। কিন্তু মদ পেটে না পড়লে
ঘুমটাও আজকাল চোখে আসে না। দূর থেকে একটা কুকুরের ডাক ক্রমাগত ভেসে আসে। সে
নিস্তরঙ্গ গ্রামের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে। হিম নামা রাতে নিজেকে বড় ফকির মনে
হয়। জানলা দিয়ে মুখটা ধুয়ে নেয়
স্বপনদা। তাকে ডাকে, ওভাবে ভূতের মত দাঁড়িয়ে কেন?
রমেন বাসে ওঠে। তার কেউ নেই। নিজের সব দাবি-দাওয়াকে ঝটকা টানে সে পিছনে ফেলে।
রাত দুটোর সময় বরযাত্রীদের তারা ফিরিয়ে আনে।
সবাইকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটাকে রাস্তার সাইড করে স্বপনদা। রমেনকে বলে, কী রে তোর বাড়ি
তো কাছে, ছেলেটার কাছে যা।
রমেন মাথা নাড়ে, গেলে আর ছাড়তে চাইবে না। তুমি গাড়ি ঘোরাও।
গাড়ি রাতটার মতো এখানে স্ট্যান্ড করছি, তুই ভোর ভোর ফিরে
আসিস।
তুমি একা থাকবে?
তুই কি আমাকে মুনবি? ছেলেটাকে দেখে আয়। আমি শুয়ে পড়ি। বড়ো ঘুম
লাগছে।
বাঙ্কার থেকে বিছানা নামিয়ে প্যাসেজে লম্বা
হয়ে শুয়ে পড়ে স্বপনদা। রমেন যায় না। গেটের পাশে একটা সিটে ঝিম মেরে বসে থাকে।
স্বপনদা শেষবারের মতো বলে, ছেলেটার থেকে মুখ
ফেরাসনি রে, যার মা নেই, দুনিয়ায় তার কেউ নেই। তুই যা। ওই তোর জীবনের পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।
স্বপনদা ঘুমিয়ে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে রমেন
ভাবে, ছেলেটা ঠাকমার
বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। পুরুষত্ব হারিয়ে গেলে একজন পুরুষের কী বা থাকে!
না সে স্বামী হতে পারে, না কারো বাবা। সে এখন ফকির।
গেটটা বন্ধ করে ড্রাইভার সিটের পিছনে
অপেক্ষাকৃত লম্বা সিটে পা দুটো গুটিয়ে শুয়ে পড়ে রমেন। স্বপনদার নাক ডাকছে। আর
রমেনের চোখের সামনে কাঁদছে তার ছেলেটা। তার পড়ে পাওয়া জীবনের চোদ্দ আনা। হঠাৎ
গলা ছেড়ে তার কাঁদতে ইচ্ছে করে। সে কান্না যেন পৌঁছে যায় সুফলার কাছে। দেবেনের
কাছে।
No comments:
Post a Comment