1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

অভিশাপ

 

ছবি : ইন্টারনেট 
                                               
   তমাল দত্ত

          কালে ঘুম থেকে উঠে বসার ঘরের টেবিলের উপর বিয়ের কার্ডটা দেখে বউকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সুধা এই কার্ডটা কে পাঠিয়েছে?’
রান্নাঘর থেকে সুধা উত্তর দিলো, ‘জানিনা। সাথে একটা চিঠিও আছে।দেখো কে পাঠিয়েছে।’
কার্ডের সাথেই চিঠি টা ছিল। সেটা বের করে পড়তে শুরু করলাম।
প্রিয় বন্ধু অনিরুদ্ধ,

তোমার দেওয়া বুদ্ধি আর আমাদের সবার মিলিত কর্মকাণ্ডের ফলে হৃদয়পুর এখন ভালোই আছে। আমার ছেলের শরীর খারাপ না থাকলে তোমার বিয়েতে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেতাম। সত্যিই বহুদিন দেখা হয়নি। আশাকরি ওখানে সব ঠিকঠাক আছে। আগামি ১০ ই মাঘ আমার একমাত্র ভাই এর শুভ বিবাহ।তোমার এবং তোমার স্ত্রীর উপস্থিতি একান্ত কাম্য। চিঠির সাথে বিয়ের কার্ডটাও পাঠালাম।তোমাদের অপেক্ষায় রইলাম। 

ইতি

তোমার বন্ধু সুবিমল।

সুবিমল।সত্যি অনেকদিন হয়ে গেছে দেখা হয়েছে। আসলে যবে থেকে আমি বদলি হয়ে কোলকাতা এসেছি তবে থেকে ওদিককার খবর নেওয়া আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।হৃদয়পুরেই আমার প্রথম চাকরি। অনেক কিছুই অভিজ্ঞতা হয়েছে সেখানে। তবে যে ঘটনার অভিজ্ঞতা মনে পড়লে এখনও আমার ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে তা কাউকে বলে ওঠার সাহস করে উঠতে পারিনি। পাছে সবাই ঠাট্টা করে, পাগল ভাবে। তবে ঘটনার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস আমার নেই কারন ওই ভয়ঙ্কর অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে এবং যা এখনও সমান তালে ঘটে চলেছে।

বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা, আমি তখন সবে সরকারি চাকরি পেয়েছি, ভারতীয় ডাক বিভাগে। আমাকে পোস্টিং দেওয়া হয় হৃদয়পুর পোস্ট অফিসে। কলকাতা থেকে বহুদূরে প্রত্যন্ত একগ্রামে। উন্নত গ্রাম না হলেও পরিবেশ খুব মনোরম। তাই আমার খুব একটা অপছন্দ হলো না। Joining Letter পাওয়ার সপ্তাহ খানেক এর মধ্যে জিনিসপত্র বেঁধে নিয়ে চাললাম হৃদয়পুর। গ্রামটি সত্যি খুব মিষ্টি। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে মোড়ানো। গ্রামের পাশ দিয়ে দামোদর বয়ে চলেছে, দক্ষিণপ্রান্তে একটা জঙ্গলও রয়েছে। চারিদিক সবুজ মাঠে ঘেরা। পোস্ট অফিসটা গ্রামের মাঝামাঝি একটা মাঠের পাশে। সেখানে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে হৃদয়পুর স্কুল। মাঠটা স্কুলেরই। পোস্ট অফিস এ মোট কর্মচারী তিনজন। আমি, এক পিওন হরি আর একজন দারোয়ান বাহাদুর। পোস্ট অফিস থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথে আমার থাকার জন্য ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক কামরার ছোটো একটা ঘর, রান্নাঘর এবং বাথরুম। জলের জন্য বাড়ির সামনে একটা কুয়োও রয়েছে। রান্নাবান্না নিজেকেই করতে হয়। এখানকার লোকজনও খুব ভালো। আনন্দে, মিলেমিশে থাকে একসাথে। অফিসের কাজকর্ম বেশিক্ষণ থাকে না। তাই মাঝে মধ্যেই আড্ডা মারার জন্য বন্ধুর খোঁজে বেরিয়ে পরি। কখনও চায়ের দোকানে, কখনও বা হরিসভায়। অনেক এর সাথে আলাপ, কথাবার্তা হয়। একদিন সকাল বেলা পোস্ট অফিসের জরুরি কিছু কাগজপত্র শহরে পাঠানোর জন্য তাড়াহুড়ো করছি হঠাৎ পিওন হরি এসে বললো, ‘বাবু আমি কাল থেকে আর আসবো না। আমার ছুটি লাগবে।’

কাজে একটু ব্যস্ত ছিলাম, তাই কাগজ থেকে মাথা না তুলেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তা কত দিনের ছুটি চাই?’

হরি কি যেন একটা ভেবে উত্তর দিলো, ‘জানিনা বাবু, তবে ছুটি চাই। ফিরত আসতেও পারি, আবার নাও পারি।’

কাজের সময় এরকম ফাজলামি শুনে একটু কড়া ভাষাতেই বললাম, ‘সকাল সকাল নেশা করেছো নাকি? এতে কাজ চলবে কি করে? কিজন্য চাই ছুটি? এতো দিনের দেওয়া যাবে না।’

হরির যেন এসব কিছুই কানে গেলো না।

‘ছুটি বাবু আমাকে নিতেই হবে, খুব জরুরি দরকার। আপনি না ছুটি দিলে চাকরি ছেড়ে দিতে হবে আমাকে বাধ্য হয়ে।’

হরির আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো না, তবুও সে ছুটি নেবার জন্য চাকরি পর্যন্ত ছাড়তে প্রস্তুত। তাহলে নিশ্চিত কোনো জরুরি দরকার। একটু চিন্তা ভাবনা করে উত্তর দিলাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে তবে তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করো।’ 

সারাদিন কাজ খুব একটা না থাকার জন্য আলস্যটা যেন শরীরে জেঁকে বসেছে। তাই ঠিক করলাম বিকেলবেলা করে একটু হাঁটতে বেরবো। তারউপর গ্রামটাও ঘুরে দেখা বাকি আছে। সত্যিই গ্রামটাকে যতোই দেখছি ততোই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি, কি অপরূপ শোভা। কলকাতার মতো কোলাহল নেই, দূষণ নেই, মুক্ত আকাশ। হালকা সন্ধ্যে নেমেছে দেখে একটু জোরে পা চালিয়ে বড়ো রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। পাশ থেকে একজন সুদর্শন চেহারার ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনিইতো নতুন পোস্ট মাস্টার?’

দোকানদার চা দিয়ে গেছে, গরম চাটায় ফুঁ দিয়ে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ।’

লোকটি কড়জোড়ে নমস্কার করে বললো, ‘আমি সুবিমল ধর, হৃদয়পুর স্কুলের অঙ্কের মাস্টার। এই গ্রামেই থাকি।’

সৌজন্যের খাতিরে আমিও নিজের পরিচয় দিলাম, ‘আমি অনিরুদ্ধ রায়, কোলকাতায় বাড়ি। এখানে অফিস কোয়াটারে উঠেছি।’

সুবিমল চা এ একটা চুমুক দিয়ে বলল, ‘একটা কথা জানার ছিল।শহর থেকে কিছু বই খাতা স্কুলের নামে আসার কথা, সেগুলো কি এসেছে? আসলে ছাত্র-ছাত্রী দের বড় অসুবিধা হচ্ছে।’

আমি একটু ভেবে উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ। আসলে এসেছে অনেক দিনই। তবে পিওনটা এখন ছুটিতে আছে, তাই আর কি একটু দেরি.........’

আমার কথা শেষ হবার আগেই সুবিমল বলল, ‘কে হরিনাথ? সে তো আর আসবে না।’

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মানে? আসবে না মানে?’

সুবিমল নিজের অবশিষ্ট পরে থাকা চা এ শেষ চুমুক দিয়ে বলল, ‘উনি কাল রাতে পরলোক গত হয়েছেন।’

আমি চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মানে? কিভাবে হল?’

সুবিমল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘নিয়তি, এগ্রামের পোড়া কপাল।’

কিছু বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম, ‘কেন? এমন কেন?’

সুবিমল বেঞ্চ থেকে উঠে চা এর টাকা দিয়ে বলল, ‘চলুন আপনার বাড়ির পথেই আমার বাড়ি। যেতে যেতে সব বলবো।’

সবে আমাবস্যা গেছে কাল। তাই রাস্তায় অন্ধকার ছেয়ে গেছে। লাইট পোস্টের সংখ্যা খুবই কম। দুজনে দুটো টর্চ নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।

সুবিমল একটা সিগারেট ধরিয়ে টান দিয়ে বলল, ‘গলাকাটা জঙ্গল এর নাম শুনেছেন?’

আসলে এই হৃদয়পুরে একটা জঙ্গল রয়েছে, সেটারই আঞ্চলিক নাম গলাকাটা জঙ্গল। এটা আমি এখানে এসেই শুনেছি। তাই বললাম, ‘হ্যাঁ শুনেছি।’

‘ওই জঙ্গলে গেছেন কোনোদিন?’

‘না। সুযোগ হয়ে ওঠেনি।’

‘ওই জঙ্গলের শেষ প্রান্তে নদীর ধারে একটি পুরাতন মন্দির রয়েছে। রাঙা মা এর মন্দির।’ 

একটু আবাক হলাম। কারণ কোনো মন্দির বা ভগবান এর সমন্ধে বলতে গিয়ে কাউকে এতটা ভয় পেতে প্রথম দেখলাম।

কপালের ফোঁটা ফোঁটা ঘামটা রুমাল দিয়ে মুছে সুবিমল আবার বললো, ‘মা এর অভিশাপে এই গ্রামে প্রত্যেক অমাবস্যায় কোন না কোন একজনের ডাক আসে মায়ের উপাসনার জন্য।’

‘মানে?’

‘মানে, গতকাল অমাবস্যা ছিলো। আর ডাক পড়েছিলো হরিনাথ এর।’

‘তাহলে হরিনাথ?’

‘মৃত্যু। মায়ের চরণে। দেহটা হয়তো শেয়াল কুকুর এ টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু প্রাণটা মায়ের সেবায়।’

‘এরকম কবে থেকে চলছে?’

‘ঠিক কবে থেকে চলছে জানি না। তবে আমি জন্ম থেকে দেখছি। প্রতি অমাবস্যায় কারোর না কারোর ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে।’

‘আপনারা কিছু করেননি, মানে এটা কেনো হচ্ছে? কিভাবে হচ্ছে? আটকানোর চেষ্টা করা হয়নি?’

‘সব চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।’

‘এসব ঘটে কিভাবে?’ 

সুবিমল সিগারেট টা লাস্ট টান দিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে নেভাতে নেভাতে বললো, ‘অনেক বড় গল্প। এই গলাকাটা জঙ্গলে যে মন্দির রয়েছে সেখানে এক পুরাতন দেবী মূর্তি রয়েছে। এখানকার লোকজন তাঁকে রাঙা মা বলেই চেনে?’

‘কোন দেবী উনি?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

‘জানিনা। আমি একবার দেখেছি। তবে বুঝে উঠতে পারিনি। গ্রামের লোকেও তেমন জানে না। সম্ভবত ওনার চোখ এবং সম্পূর্ণ বিগ্রহটি লাল বলেই ওনাকে রাঙা মা বলা হয়।

বড়ো রাস্তা শেষ করে একটা সরু রাস্তা মাঠের দিকে গেছে। সেই রাস্তার প্রথম বাড়িটি কে দেখিয়ে সুবিমল বললো, ‘এটা আমার বাড়ি। আপনার তাড়া থাকলে কাল বলি?’

‘না না। কোনো তাড়া নেই।’

‘তাহলে শুনুন। প্রতি অমাবস্যায় ঠিক তিনদিন আগে কোনো কোনো গ্রামবাসীর বাড়ির সামনে পাথর পরে থাকতে দেখা যায়।’

‘পাথর?’

‘হ্যাঁ। মা এর বিগ্রহের নীচে একটি পাথর থাকে। সেটাই প্রতি অমাবস্যার তিন দিন আগে কোনো না কোনো গ্রামবাসীর বাড়িতে দেখা যায়। আর ঠিক অমাবস্যার দিন সেই বাড়ির কোনো না কোনো সদস্যের উপর মা বিরাজ করেন। তারপর সে আর এই জগতে থাকে না। তবে কিভাবে হয় আর কি হয় এরপর সেটা কেউ জানে না। শোনা যায় গ্রামের দুএকজন লুকিয়ে এই ঘটনাটা দেখার সাহস করে। তাদের মধ্যে কেউ মানসিক স্থিতি হারিয়েছে অথবা মারা গেছে।’

‘কি ভয়ানক।’

‘হ্যাঁ। সত্যি আর এভাবেই চলছে বহু বছর ধরে। এখন আমাদের এটা সয়ে গেছে।’

সেদিন বাড়ি ফিরে সারা রাত সুবিমল এর কথাগুলো মাথায় ঘুরতে থাকে। কি হাস্যকর। এরকম আবার হয় নাকি? নিশ্চই এর পিছনে কোনো গভির রহস্য রয়েছে। দেখতে দেখতে এরকম দুটো অমাবস্যা কেটে গেলো। আর একই রকম ভাবে গ্রামের দুজন মানুষ নিরুদ্দেশ। এখন এ গ্রামের সবার সাথেই প্রায় একটা মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আমার। একদিন বিকালা চা এর দোকানের রামবাবুর সাথে কথা বলছি হঠাৎ সেখানে এসে উপস্থিত হল সুবিমল।

‘তোমার কৌতুহল মেটানোর উপযুক্ত লোকের সন্ধান পেয়েছি বন্ধু’ সুবিমল বললো।

‘তাই নাকি? কোথায়?’

‘তারকনাথ মুখোপাধ্যায়। এগ্রামের সবচেয়ে পুরানো মানুষ। রাঙা মা সমন্ধে ওনার থেকে ভালো কেউ জানে না।’

‘তাহলে চলো। কথা বলা যাক।’

‘হ্যাঁ অবশ্যই। তবে আগে এক কাপ চা।’

চা শেষ করে আমরা দুজনেই রওনা দিলাম তারকনাথ মুখোপাধ্যায় এর বাড়ি। ইনি গ্রামের যথেষ্ট নাম করা পুরহিত। এখন বার্ধক্য জনিত কারণে আর পুজোআচ্ছা করেন না। তবে লোকজনে এখনও যথেষ্ট মান্য করে।

বাড়ি এসে কড়া নাড়তেই তারকনাথ বাবুর নাতি কমল দরজা খুলে দিলো। বসার ঘরে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর প্রবেশ করলেন প্রায় ৮০-৯০ বছরের এক বৃদ্ধ। আমাদের দেখে আসার কারন জিজ্ঞাসা করলেন। সুবিমল অত্যন্ত নম্র গলায় উত্তর দিলো, ‘ঠাকুর মশাই ইনি অনিরুদ্ধ বাবু আমাদের গ্রামের পোস্টমাস্টার। আমরা দুজনে ওই গলাকাটা জঙ্গলের রাঙা মা এর সমন্ধে জানতে এসেছিলাম।’

ভদ্রলোক একটু গম্ভীর ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শহুরে শিক্ষিত লোক বিশ্বাস করবেন? নাকি মুখরোচক গল্পের সন্ধানে এখানে এসেছেন?’

আমি সুবিমল এর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নরম সুরে বললেন, ‘না ঠাকুরমশাই আমরা সত্যিই জানতে চাই, ওই মন্দিরের রহস্য।’

তারকনাথবাবু একবার গম্ভীর ভাবে আমাদের পরিদর্শন করে বললেন, ‘বহুবছর আগের কথা। এ গ্রামে তখন মড়ক লেগেছিল। দিনদিন কলেরার গ্রাসে গ্রামের বহু মানুষ মারা যেতে লাগলো, মহামারির কবল থেকে জমিদার বাড়ির সদস্যও ছাড় পায়নি। জমিদার বাবুর একমাত্র কন্যার কলেরা। সমস্ত ডাক্তার, কবিরাজ হাল ছেড়ে দিয়েছে। যখন কন্যা সুস্থভাবে ফিরত পাওয়ার কোনো আশা দেখতে পেলেন না ঠিক তখনই পশ্চিম প্রান্তের জঙ্গলে এক সাধুর আবির্ভাব হল। সে তার নিত্যদিনের পূজাঅর্চনা, যজ্ঞ করে সেখানে। জমিদার বাবু খবর পেয়ে সেই সাধুকে ডাক পাঠান। সাধুকে দেখে জমিদার বাবুর তার উপর গভীর শ্রদ্ধার সৃষ্টি হয়। সাধুকে তিনি সমস্ত কথা জানান। সব শোনার পর সাধু তাকে উপদেশ দেন যে, এগ্রামের মহামারি দূর করতে হলে তাঁর নির্দেশ মতো গ্রামের পশ্চিম প্রান্তের জঙ্গলে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করতে হবে। তখন ওই সাধুর নির্দেশে জমিদার জঙ্গলের মধ্যে মন্দির আর রাঙা মা এর বিগ্রহ গড়িয়ে দেন। আমার প্রপিতামহ জমিদার বাড়ির কুলপুরহিত ছিলেন। তিনি সমস্ত আয়োজন দেখে চিন্তায় পরে যান। তাঁর জ্ঞানে পুরাণ অনুসারে এমন কোনো দেবীর উল্লেখ নেই। তবে কি এ তন্ত্র সাধনা? আমার প্রপিতামহ জানতেন যে তন্ত্রবলে কারোর সুফল ঘটাতে হলে উপযুক্ত প্রতিদান দিতে হয়। এক্ষেত্রেও তাই রয়েছে।’

‘এই মূর্তির নামকরণ কিভাবে হয়েছে জানো?’ হঠাৎ তারকনাথ প্রশ্ন করলেন।

আমাদের গল্পের ঘোর কাটলো। সুবিমল উত্তর দিলো, ‘ওই তো আমি যতদূর জানি মায়ের মূর্তি রাঙা তাই।’

‘ভুল জানো’ – তারকনাথ বললেন।

‘এটা তুমি না এগ্রামের সবাই জানে। কিন্তু আসল কারণ হল এ পূজার এক বিধি। দেবীর মূর্তি যদি তোমরা দেখে থাকো, তাহলে লক্ষ্য করবে মা এর পায়ের তলায় একটা গোলাকার পাথর রয়েছে। পূজার বিধি অনুসারে মাকে রক্ত দিয়ে স্নান করাতে হয়। ততক্ষণ যতক্ষণ না বিগ্রহের নিচের পাথর সম্পূর্ণ রক্তে ডুবে যায়। 

‘বলি?’ – আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

‘নরবলি।’

আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম।

তারকনাথ একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘এই নরবলির দ্বায়িত্বে থাকে রক্তদূত।’

‘রক্তদূত?’ – আমরা দুজনেই অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘হ্যাঁ। রক্তদুত। মায়ের বাহন। ভয়ানক রক্তপিশাচ। এখনও পর্যন্ত কেউ তাকে সচক্ষে দেখেনি। তবে তার গর্জন শুনেছে জঙ্গলের ভীতর থেকে। পায়ের ছাপও দেখতে পেয়েছে অনেকে মন্দির এর বাইরের মাটিতে।’

‘এর থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনো উপায়?’ – আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

‘না। যার বাড়িতে ওই লাল পাথর পড়বে তার বাড়ির কোনো একজন সদস্য অমাবস্যার রাতে ওই পাথর হাতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মন্দির এর দিকে চলে যায় আর ফেরে না।’

‘এসব কিছু জমিদার বাবু জানতেন?’

‘হ্যাঁ। আমার প্রপিতামহ ওনাকে সব জানিয়েছিলেন।’

‘তাও তিনি এত বড়ো বিপদ ডেকে আনলেন?’

‘হ্যাঁ, যদি একজন মানুষের জীবন ত্যাগের জন্য সারা গ্রাম বাঁচে তাহলে ক্ষতি কি?’ 

সুবিমল হঠাৎ বলে উঠলো, ‘তাহলে জমিদার বাবুও নিজের স্বার্থই দেখলেন।’

তাঁকে ধমক দিয়ে তারকনাথ বললো, ‘চুপ করো। তুমি জানো কত দূর। জানো সেই দিন কার নরবলি দেওয়া হয়? জমিদার বাবু নিজে তার লোকেদের বাঁচাতে নিজেকে মায়ের পায়ে সোঁপে দেন।’

আমরা দুজনেই হতবম্ব হয়ে তারকনাথ এর অশ্রু মাখা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তিনি আবার বললেন, ‘জমিদার বাবু সাধুকে কথা দেন যদি এই পূজা সার্থক হয় তবে তাঁর একমাত্র কন্যার সাথে তাঁর বিবাহ হবে। কিন্তু সম্পত্তির লোভে জমিদার বাবুর বন্ধুপুত্র তাঁর কন্যাকে বিয়ে করে নেন এবং সেই সাধুকে অপমান করে গ্রাম ছাড়া করেন।’

আমরা একসাথেই প্রশ্ন করলাম, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কি? সাধুর অভিশাপ। রাঙা মা কে আজীবন এই গ্রামে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে চলে যান।আর আমরা সেই বোঝা বয়ে নিয়ে চলেছি।’

সেদিন রাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত পোস্টঅফিসে আছি। হঠাৎ সুবিমল এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘চলো যেতে হবে’।

‘কোথায়?’

‘আজ অমাবস্যা। সচক্ষে নরবলি আর রক্তদূতকে দেখার সুযোগ। অশোক বাবুর বাড়িতে পাথর পড়েছে। চলো আর সময় নেই। ১১টা বাজতে চললো।’

লোভটা সামলাতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি অফিস বন্ধ করে অশোক বাবুর বাড়ির বাইরে একটা ঝোপের আড়ালে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রায় ১০-১৫ মিনিট বাদেই অশোক বাবুর মেয়ে হাতে কিছু একটা নিয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটা দিলো। অশোকবাবুর বাড়ির চৌকাটে বসে বৃদ্ধ অশোক বাবু আর তাঁর স্ত্রী হাউমাউ করে কাঁদছে। আমরাও আর সময় নষ্ট না করে মেয়েটির পিছু নিলাম। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা দুজনে চুপিসারে ঝোপঝাড়, কাঁটাবন, বড়ো বড়ো শাল গাছ পার করে যখন একটা ভাঙ্গা জরাজীর্ণ মন্দির এর সামনে এসে পৌঁছালাম তখন আমার ঘড়িতে ১২টা বাজে। মেয়েটি ততক্ষণে মন্দিরের ভিতরে চলে গেছে।

এই প্রথমবার আমি রাঙা মায়ের মূর্তিটা দেখলাম। কি ভয়ানক মূর্তি। সারা বিগ্রহ টকটকে লাল। চোখ দুটি দিয়ে যেন আগুন বেরিয়ে আসছে। মূর্তিটি দেখতে অনেকটা চার হাতের লক্ষি প্রতিমা তবে পার্থক্য শুধু হাতের মুদ্রায়। উপরের দুটি হাতে দুটি রক্ত মাখা খাড়া আর নিচের একটি হাতে রক্ত মাখা বাটি ও অন্য হাতে মড়ার খুলি। না কালি মূর্তি না। কারণ মায়ের জিভ বাইরে নেই আর পায়ের নীচে মহাদেবও অবস্থান করছেন না। যার উপরে নর্তকী রুপী মা বিরাজ করছেন সেটি একটা অদ্ভুত প্রাণী। মুখটি নেকড়ে, দেহ মানুষের। আরও আশ্চর্যের হল প্রাণীটির তিনটি মুখ। তিনমুখো নেকড়ে।

মেয়েটি মায়ের বিগ্রহের সামনে গিয়ে মায়ের ঠিক পায়ের নীচে একটা বাটির মতো গর্তের মধ্যে পাথরটা সশব্দে ফেলে দিলো। এর পরবর্তী দৃশ্য দেখে আর নিজেদের সামলাতে পারলাম না আমরা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। সেই অনুভূতির কথা মনে করলে আজও যেন সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। মন্দিরের ছাদ বেয়ে বিভৎস ভয়ানক এক প্রাণী অতি সাবধানতার সাথে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে এগিয়ে আসছে। হুবহু রাঙা মায়ের বাহন। তিন মুখওয়ালা একটা মানব নেকড়ে। তীক্ষ্ণ রক্ত মাখা দাঁতগুলো দিয়ে রক্ত ঝরে পরছে। প্রাণীটির দেহ মানুষের মতো হলেও তাঁর হাঁটা চলা, আদব কায়েদা পুরোটাই একটা নেকড়ের মতো। প্রাণীটি আস্তে আস্তে মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ মেয়েটিকে শুঁকে নিয়ে হঠাৎ দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তিব্র স্বরে গর্জন করে উঠলো। হাড়হিম করা গর্জন। মন্দির এর গম্বুজগুলো যেন ভেঙ্গে পড়বে সেই কম্পনে। এরপর জন্তুটা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আমাদের চোখের সামনে মেয়েটিকে তাঁর লম্বা ধারালো হাতের নখ দিয়ে মাঝখান থেকে চিড়ে ফেললো। সুবিমল এর কথা আটকে গেছে। আমিও চেতনা হারাতে বসেছি প্রায়। কি ভয়ানক নির্মম দৃশ্য। কে এই দেবী আর কে এই রক্তদূত? মেয়েটির দেহ এর দুটি খণ্ড দুপাশে পড়ে রয়েছে আমাদের হাত দশেক এর মধ্যে। তাঁর শরীর থেকে রক্ত মেঝের ঢাল বেয়ে পড়ছে সেই বাটির মতো গর্তে পাথরের উপর। বিগ্রহের মুখটা যেন এখন কেমন বদলে গেছে। কেমন যেন তৃষ্ণার পরিতৃপ্তি হাসি ফুটে উঠেছে। জন্তুটা বেশ কিছুক্ষণ ঘন ঘন মন্দিরের মধ্যে এদিক থেকে ওদিক করলো। তারপর হঠাৎ ক্ষুধার্ত এর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো মেয়েটির অর্ধখণ্ড দেহের উপর। এবার তাঁর ক্ষুধা নিবৃত্তের পালা।

এর মধ্যে আমি একটা ঘটনা ঘটিয়েছি। কারণ অবশ্য আমার একটা সন্দেহ এর যাচাই। তবে আমার সে পাগলামি দেখে সুবিমল তাঁর অবচেতন অবস্থা থেকে ফিরে এলো। আমাদের পায়ের সামনে অনেক টুকরো পাথর পড়েছিলো। তারই একটা তুলে সজোরে মন্দিরের একদিকের দেওয়ালে ছুঁড়ে মাড়লাম। শব্দ শুনে রক্তদূত সচেতন হয়ে গেল। দিশেহারার মতো এদিক ওদিক মুখ ঘোরাচ্ছে আর কিছু একটা শুঁকছে। বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টার পর সে ওই পাথরের টুকরোটার কাছে গিয়ে পৌঁছালো। এরপরের ঘটনাটা বুঝতে যাবো তার আগেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে জঙ্গলের বাইরের দিকে ছুটতে লাগলো সুবিমল। আমাকেও তার সাথে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেখান থেকে পালাতে হলো। 

জঙ্গল থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে আমরা থামলাম। সুবিমল হাঁটুর উপর দুটো হাত রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, ‘তুমি কি পাগল? জীবনের মায়া নেই নাকি?’

আমিও হাঁপাছিলাম। চারিদিকে সব নিস্তব্ধ। সারা গ্রাম রাতের অন্ধকারে নিদ্রারত। শুধু একটা বাড়িতেই আলো দেখা যাচ্ছে। সদ্য মেয়ে হারানো অশোক বাবুর পরিবার এখনও নিজেদের সামলে উঠতে পারেননি। থেকে থেকে জঙ্গলের মধ্যে থেকে রক্তদূত এর পৈশাচিক গর্জন শোনা যাচ্ছে।

আমি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম, ‘কিছুনা নিজের একটা Theory কে মজবুত করছিলাম।’

‘তা ঢিল ছুঁড়ে কি এমন Theory বের করলে তুমি শুনি?’

‘বলবো, তবে আজ না, কাল সকালে তারকনাথ বাবুর বাড়িতে দেখা করো। সেখানেই সব বলবো।’

সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম তারকনাথ বাবুর বাড়ি। প্রাতঃরাশটা ওখানেই করার পরিকল্পনা ছিল। সেখানে আমাদের মুখে গতকাল রাতের অলৌকিক অভিজ্ঞতা শুনে তারকনাথ স্তম্ভিত হয়ে গেল।

‘তোমাদের সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। যেখানে কোনো মানুষ রক্তদূত এর নাম মুখে আনতে ভয় পায় আর সেখানে তোমরা রাত কাটিয়ে চলে এলে।’

‘শুধু রাত কাটাইনি এই সমস্যার একটা সম্ভাব্য সমাধানও খুঁজে পেয়েছি।’

আমার এই কথাটা শুনে চমকে উঠে সুবিমল আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বলো কি!’

‘হ্যাঁ।’

‘ঢিল মেরে মারবে ওকে?’

‘না। ঢিল তো আমার একটা Test ছিলো।’

‘তা কেমন Test শুনি?’

‘বলবো। তার আগে, ঠাকুরমশাই আপনি কোনোদিন রক্তদূতকে দেখেছেন?’

‘তারকনাথ একটু ভেবে উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ তবে অনেক ছোটো বেলায়। তোমাদের মতোই উদ্যম সাহস নিয়ে। তবে তারপরে আর সাহস হয়নি।’

‘ভালো। তাহলে আপনি এটা লক্ষ্য করেছেন রক্তদূত চোখে দেখতে পায় না।’

তারকনাথ উত্তর দিলো, ‘দেখো ছোটো বেলার কথা অত মনে নেই। তবু যেটুকু মনে আছে যে জন্তুটির ঘ্রাণ শক্তি খুব তিব্র।’

‘কারণ ওটাই ওর একমাত্র অস্ত্র।’

সুবিমল একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলতে চাও একটু খোলসা করে বলবে?’

‘দেখো রক্তদূত কে বোকা বানানো সম্ভব। তবে সেটা একবার যাচাই করে দেখতে হবে। যদি এটা সম্ভবপর হয়ে তবে গ্রামের দুঃখের দিন শেষ। কিন্তু তার জন্য আমাদের আগামী আমাবস্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

সুবিমল ও তারকনাথ প্রায় একসঙ্গেই প্রশ্ন করলো, ‘কিভাবে?’

‘সব জানতে পারবে। তার আগে আগামী আমাবস্যার আগে আমার কিছু জিনিস লাগবে, এই যেমন দুটো বড় ধুনুচি, বেশ কিছুটা ছোবড়া, ভালো মানের সুগন্ধি ধুনো আর একটা বড় সাইজের রাম ছাগল।’

‘ছাগল?’

‘হ্যাঁ ছাগল। সাথে কিছু গ্রামের লোকের আর যার বাড়িতে পাথর পরবে তার বাড়ির সদস্যদের সাহায্য অত্যন্ত আবশ্যক। খবর রাখো রক্তদূত এর পরবর্তী শিকার কে? আর তোমরা দুজন তৈরি থেকো। সময় মতো কি করতে হবে সেটা আমি বলে দেবো।’

পরের আমাবস্যায় পাথর পড়লো আমাদের নিজেদের লোকের বাড়িতেই। তারকনাথ। সুবিমল আমাকে প্রথম খবরটা দেয়। তারকনাথ মানুষটা এমনিতে খুব শক্ত। কিন্তু এই ঘটনায় সে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। খবর পেয়ে যখন তারকনাথ এর বাড়ি পৌঁছলাম তখন তিনি বারান্দার এককোণে হতাশ হয়ে বসে ছিলেন। আমাদের দেখতে পেয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ‘আমি জানতাম তোমরা আসবে। একটু বল পেলাম তোমাদের দেখে।’

আমি তারকনাথের কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘চিন্তা করবেন না। আমরা আছি আপনার সাথে।এই সময় ভয় পেলে চলবে না’

তারকানাথ করুন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভয় আমি আমারা মৃত্যুতে পাইনা। আমার ইহজগৎ এর সব সুখ মিটে গেছে। কিন্তু আমার নাতি। তার কিছু হলে উপরে গিয়ে আমি আমারা ছেলে বউমাকে কি জবাব দেবো?’

সুবিমল বলল, ‘ঠাকুরমশাই দেখুন অনিরুদ্ধ একটা উপায় বের করেছে। আমাদের শুধু এখন ভগবান কে ডাকতে হবে যাতে আমরা এই যুদ্ধে সফল হই। তবেই আমরা আমাদের গ্রামকে বাঁচাতে পারবো।’

‘কি উপায়?’ তারকনাথ জিজ্ঞাসা করলো।

‘তেমন কিছু না ঠাকুরমশাই যেমনটা আমি আগে বলেছিলাম। রক্তদূতকে বোকা বানিয়ে আমাদের গ্রামের মানুষদের বাঁচাতে হবে। তার আগে গ্রামের দুজন লোক আপনাদের বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের উপর নজর রাখবে, যাতে বোঝা যায় এবারের পালা কার?সুবিমল যেগুলো বলেছিলাম সেগুলো জোগাড় করেছো তো?’

সুবিমল উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ। সব করেছি। দুটো বড়ো ধুনুচি, কিছু ছোবড়া, বেশ কিছুটা ধুনো, একটা বড়ো মাপের রাম ছাগল, আর বেশ কিছুটা বড়ো দড়ি।’

‘বেশ এতেই হবে। এবার শুধু কাল রাতের অপেক্ষা।’

সেই অমাবস্যায় তারকনাথের নাতির উপরই ভর হয়। আমরা সমস্ত জিনিসপত্র জোগাড় করে নিয়ে মোটামুটি সাড়ে ১১টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম তারকনাথের বাড়ি। আমি, তারকনাথ, সুবিমল ছাড়াও আরও তিনজন গ্রামবাসী ছিলো। তারকনাথের থেকে জানতে পারলাম আজ সকাল থেকেই তার নাতি কিছু খাচ্ছে না, আজব ব্যবহার করছে। 

তারকনাথ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। চোখ ছলছল করছে। কাঁদো কাঁদো মুখে আমার হাতটা ধরে বললেন, ‘যা পারো করো। আমার নাতিকে বাঁচাও।’

‘আপনি শান্ত হন। আপনাকে যেটার জোগাড় করে রাখতে বলেছিলাম সেটা করেছেন?’

তারকনাথ চোখের জল মুছে বললো, ‘হ্যাঁ।’

‘এবারে শুধু আমাদের প্রার্থনার প্রয়োজন। যেন আমাদের কাজ সফল হয়।’

আমি সবাইকে এক জায়গায় করে আমাদের পরিকল্পনাটা বললাম।

‘মন দিয়ে শোনো কোনো ভুল যেন না হয়। সুবিমল তুমি আর একজন মিলে মন্দিরের চৌকাটে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটাকে টেনে বাইরে বার করে আনবে। সামলাতে পারবে না। তাই দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলবে। ঠাকুরমশাই তার ঠিক কিছুক্ষণ আগেই ধুনুচি গুলো জালিয়ে বেশি করে ধুনো দিয়ে মন্দিরের দরজার সামনে বসিয়ে দেবেন। আর তারপরে আমার পালা।’

আজ আমাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা। সময় মতো তারকনাথবাবুর নাতি মন্দিরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো আর তার পিছন পিছন আমরা ছ-জন। মন্দিরের বেশ কিছুটা আগে থেকেই ধুনুচিটা জ্বালিয়ে পরিমান মতো ধুনো দিয়ে তৈরি হয়ে রইলেন বৃদ্ধ তারকনাথ। সুবিমল প্রস্তুত ঠিক চৌকাটে পা রেখেছে আর সে সমস্ত শক্তি দিয়ে ছেলেটিকে টেনে বের করে এনে দূরে একটা গাছের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো। আমি পাথরটা নিয়ে ওই গর্তটা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম এবং সেটা সঠিক ভাবে নিজের জায়েগায় বিগ্রহের ঠিক পায়ের নীচে গর্তের মধ্যে পড়লো। এবার এক গ্রামবাসি ততক্ষণে ছাগলটার মুখ বেঁধে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। আমি তারকনাথবাবুর দেওয়া তার নাতির তাজা রক্ত পাত্র থেকে ঢেলে দিলাম ছাগলটির গায়ে এবং সারা গায়ে মাখিয়ে দিলাম যতটা সম্ভব। তারপর ছাগলটাকে ছেড়ে দিলাম মন্দিরের ভিতরে। এবার ঘটনা লক্ষ্য করার পালা। কিছুক্ষণের মধ্যেই রক্তদূত এর আগমন হলো। তার রুপ দেখে দুজন গ্রামবাসী ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। একজন জ্ঞান হারিয়েছে। যেমন পরিকল্পনা তেমন কাজ। রক্তদূত আমাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। ধুনোর ধোঁয়া ও গন্ধে ভরে গেছে সারা মন্দির। রক্তদূতের ঘ্রাণ শক্তির উপর ভরসা এবার। ছাগলের গায়ে মানুষের রক্তের গন্ধ পেয়ে সে সেটাকেই নিজের শিকার ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তার মাতৃ আরাধনা সেরে নিজের ক্ষুধা নিবারণে মন দিলো। কাজ মিটেছে। এখানে আর একমুহূর্ত থাকা মানে বিপদ। অলৌকিক শক্তিকে বোকা বানানো গেলেও বেশিক্ষণ না। তাই সবাই দ্রুত ফিরে গেলাম গ্রামের দিকে।তখনও মন্দিরের ভিতর থেকে ভেসে আসছে মহাদানবের পৈশাচিক গর্জন।

তারকনাথের নাতির সেরে উঠতে বেশ কয়েকদিন লাগলেও সে সম্পূর্ণরূপে জীবিত। এরপর থেকে আর কোনোদিন গ্রামের কোনো মানুষের বলি দিতে হয়নি। গ্রামবাসীরা এখন পালা করে এই বিপদের সম্মুখীন হয় প্রতি অমাবস্যায় আর সফলভাবে তাদের আপনজনকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।।

johndutta17@gmail.com
হুগলী














2 comments:

  1. Lekhata khub valo laglo
    Aivabe likhe jan ar amader notun notun golpo porar sujog kore din
    Apner porer golper apekhay roilam

    ReplyDelete