1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

গর্ভবতী

 

ছবি : ইন্টারনেট
                                                                                  অদিতি সাহু

         ওই যে পশ্চিম আকাশের এক কোণায় কেমন একটুকরো কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে দেখেছেন ? আর একটু বাদেই ও গর্ভবতী হবে, তারপর আকাশের নীল সায়রে ভীষণ যুদ্ধ বেঁধে যাবে ; সাদায় কালোয় যুদ্ধ ! ওই কালোর দলই  আসল জলধর ! চেরাপুঞ্জি থেকে কন্যাকুমারি পর্যন্ত ওরা দিব্যি দৌড়ে বেড়ায়, বাষ্পীয় লীনতাপ নিয়ে। ওরা আসলে বেনিয়ার জাত ! তাই হিসেব কষে আড়াই ঘর এগোয় ! শেষ দানে বোড়ে এগিয়ে দিয়ে কি করে কিস্তিমাত করতে হয়, তা ওরা ভালোই জানে !  ....তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে, বাগানের কলা গাছ গুলো ভিজে চুপ্পুস হয়ে যাবে,... পুরোনো শ্যাওলা গুলো আবার তাদের পাকা সবুজ রং ফিরে পাবে। ভিনদেশী বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নীলচে কাচের জানালায় অচেনা আলাপ সারবে ! আর আমি ?

অনেকদিন পরে আবার ফুসফুস বোঝাই করে সোঁদা মাটির ঘ্রাণ নেব, ছাদের অন্ধকার আলসের কোণায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে ঝিঁঝিঁ পোকার গান শুনবো আর মেঘলা আলোয় স্কুলবেলার সাত-পুরোনো সেলাই ছেঁড়া খাতায় না হয় মনপবনের নাও ভাসিয়ে দেব !

আসলে বৃষ্টি হচ্ছে তো ! বর্ষার দিনে  একটু-আধটু কাব্যি করতে সবার ই ইচ্ছে হয় ! আমার ও হয় ! আকাশের ঈশান কোণে মেঘের আনাগোনা দেখতে পেলেই আমার মনটা খুশিতে কেমন পেখম তোলা ময়ূরের মতো নেচে ওঠে ! আজকে অনেকদিন পরে আবার ইচ্ছে করলো, অনেক তো হল গল্প লেখা......আজ না হয় একটু নিজের গপ্পো বলি !

দুদ্দাড়িয়ে বইছে বাদলা হাওয়া। কাপড়গুলোর ওপর লাল-সাদা ক্লিপ দিয়ে আটকানো। যেন ছোট্ট ছোট্ট রং-বেরঙের প্রজাপতি ! পিঠের ওপর রঙিন ডানা উঁচিয়ে চুপটি করে বসে আছে ! আধা-শুকনো কাপড়গুলো ও তাল মিলিয়ে হাওয়ার সাথে দিব্যি ওড়ে ! বেশ লাগে শুনতে ! আজকাল আমি আর বেশি কথা বলি না, ওসবে ঝঞ্ঝাট অনেক ! তার চেয়ে বরং দু-চোখ ভরে দেখা, শোনা আর লেখায় অনেক আরাম ! তাছাড়া এখানে আমার কর্মখালি ! তাই মুখেও কুলুপ।  এত বড় বাড়ি ! আমি দিব্যি ঘুরে বেড়াই !

আমার ভারী বাগানের শখ ! বাড়ির সামনের দিকে যে জায়গাটা নিষ্কর্মার মতো পড়ে থাকতো, তাতে কতগুলো বোগেনভিলিয়ার চারা লাগিয়েছি। পাতাবাহার ও আছে কয়েকটা। রোজ সকাল-সন্ধ্যে নিয়ম করে জল দিই। এই তো হপ্তা দুয়েক আগেই যখন ওদের ঘরে আনলাম, তখন ওরা একেবারে ছোট্ট ! এখানে এসে বেশ নধর হয়ে উঠেছে !  পাতাগুলোও দিব্যি চিকন হয়েছে !

সময় পেলেই এখন আমি ওদের সাথে কথা বলি। এমন অনেক কথা থাকে, অকথিত ; এমন অনেক ব্যথা থাকে.....অমন্থিত.., সেগুলো ওদের কাছে উপুড় করে দিই। ওরা কান পেতে শোনে, ওদের কলিজার মধ্যে দিয়ে কুল-কুল করে নদী বয়ে যায়, বাঁধ ভাঙে। আমি কান পেতে শুনি ! ওদের ও মুখ ফুটেছে বেশ ! একটু আদর পেলেই কলকল করে কত কথা বলে । এখন বর্ষায় ওরা বেশ আয়েশ করে ভিজছে। ভিজুক !

অ্যাকোরিয়ামের টলটলে জলে মাছ গুলো ডুব সাঁতার দিয়ে বেড়ায়। নীল-লাল-সাদা.....কত রকমের মাছ ! অ্যাকোরিয়ামের নীচে সবসময় একটা নীলচে সাদা আভা..... খানিকটা সাইকেডেলিক আলোর মতো.....বৃত্তাকার পরিধির ভেতরে কৃকলাশ বহুরূপীর মতো রং বদলায় ! মাছগুলো খেলা করে, কখনো বা ভয় পেয়ে রঙিন পাথরের ঝুটো গুহার মধ্যে ভীতুর মতো আত্মগোপন করে। করাতের মতো আঁশগুলো থেকে থেকে ঝিকিয়ে ওঠে ! যখন ওদের খাবার দিই, লেজ নেড়ে নেড়ে সবকটা হ্যাংলার মতো ওপরে উঠে আসে। খাবারের ছোট ছোট দানা....তাই নিয়ে মারামারির শেষ নেই ! যত দিই তত মারামারি করে ! তারপর পেট ভরলেই আবার যে যার মতো। স্বার্থপর ! বাইরে বৃষ্টি হলে ওরা কিন্তু বেশ টের পায়, জানেন তো ? তখন ওরা জলের মধ্যেই লেজ নেড়ে, পাখনা ঝাপটিয়ে দিব্যি নাচানাচি করে !

ওই যে ওই নীল-সাদা মাছটা দেখতে পাচ্ছেন ? ওই যে মাথায় লাল-টুকটুকে ঝুঁটিওয়ালা.....ও কিন্তু ভারী সুন্দরী ! তবে বড্ড একা, অনেকটা আমার মতো,... অন্য মাছ গুলো যখন দল বেঁধে লুকোচুরি খেলে, তখন ও লুকিয়ে লুকিয়ে  দেখে ! মনখারাপ হলে  জলের তলায় গিয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকে আর কবিতা পড়ে। পূর্বজন্মে ওর ও বোধ হয় কোনো প্রেমিক ছিল। তার কথা মনে করে আর বিবর্ণ প্যাপিরাসে অভিমানী প্রেমপত্র লেখে !

আমি যখন শব্দ করে সংকেত পাঠাই, ও ঠিক বুঝতে পারে ! কাছে আসে। চোখে চোখ রেখে অপলক তাকিয়ে থাকে, এক পৃথিবী প্রতিশ্রুতি নিয়ে। লাল-লাল ঠোঁট দুটো অল্প অল্প নড়ে ! তারপর আস্তে আস্তে চলে যায়, বুঝতে পারি.... ওর বুকের মধ্যেও চিরহরিতেচ্ছু হলদে একটা পাতা লুকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ! খাল-যমুনার পাড়ে, নীলাম্বরী রাধার সিংহী-কটির বাঁকে সাইকেডেলিক বৃত্ত নীল সংকেত পাঠায়...লাল ঝুঁটি ফেরে না...খলবল করে জল কেটে ঠিক এগিয়ে চলে।

এখন আমার অখন্ড অবসর। নিজের ঘরে দোর দিয়ে কবিতা পড়ি, ছোট্টবেলার কবিতার খাতাগুলোর ধুলো ঝেড়ে সাফ করি,.....এরা আমার শৈশবের ভুর্জপত্র,.... তারুণ্যের পাণ্ডুলিপি ! দীর্ঘ সাতবছর তিনতলার সিঁড়িঘরে বস্তাবন্দী হয়ে নির্বাসিত ছিল....দিন-দুই আগে সব শৃঙ্খল মোচন করেছি !

হলদে পাতার দীর্ঘশ্বাস আবার ঝাপটা মারে ! আমার অবচেতনের অবয়বশূন্য অমানিশারা চন্দ্রাহতের মতো চেয়ে থাকে ! বিরুদ্ধ-বাতাসে ভাসানের গান ভাসে ! যৌবনের প্রবল জোয়ারে, রাতের আঁধারে সূতপুত্রের মতো যাদের বিসর্জন দিয়েছিলাম, তাদের আবার প্রবল আলিঙ্গনে বুকে চেপে ধরি ! হোক না তারা কবিতার ব্যাঙ্গচিত্র....তবু তো আমারই....আমারই আত্মজ !

বর্ষা নামে। খাল-যমুনার দু-কূল ভেসে যায় ! পলি জমে। দু-দিকের অববাহিকারা বহুদিনের 'বন্ধ্যা' তকমা ঘুচিয়ে আবার সুজলা-সুফলা হয়ে ওঠে। রাশভারী শহুরে খিলান ভেঙে পড়ে....কচুরিপানার নিশ্ছিদ্র আস্তরণ সরিয়ে ধীরে ধীরে আবার মাথা তোলে কবিতার সাম্রাজ্য !

আসন্ন কবিতার নেশাড়ু আতরে চেতনারা কানামাছি খেলে....দেরি হয়ে যায়। ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে অজগর রাত্রি।

আজই ফেরার দিন। পড়ি মরি করে যখন স্টেশনে আসি, বৈদ্যুতিন পর্দায় তখন আসন্ন ট্রেনের আগমন বার্তা। এঁকে-বেঁকে সরীসৃপের মতো ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢোকে।  দিকভ্রান্তের মতো উঠে পড়ি। অবাক হয়ে দেখি, চারপাশে মানুষ নেই.....শুধু কবিতা আর কবিতা...কালো কালো অক্ষরগুলো বর্ষার মরা জোছনায় আদিবাসী নাচ ধরে। চেনা আতরের নেশা শাঁসালো করোটির কোষে কোষে বায়ু-বেগে অভিস্রাবিত হয়...। ক্রমে শ্বাস-রোধ হয়ে আসে...বিহুর গান অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়। আমার চেতনা আবার খুন হয়।

কি করে যে তেলেনাপোতা, দিকশূন্যপুর, ভুবনডাঙ্গার মাঠ..... তিনপ্রহরের বিল পেরিয়ে বকুলবাটি এসে পড়ে, টের পাই না ! ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। ওই তো দূরে মৃদুল দাঁড়িয়ে, হাতে মোড়ক, মুখে মৃদু মৃদু হাসি...চোখে লাল-ঝুঁটির প্রতিশ্রুতি ! টলমল পায়ে এগিয়ে যাই...আতরের নাগপাশ ছিঁড়ে। শুধোই,

  - " হাতে ওটা কী ?"

  - " তোমার তুমি !"

  - " মানে ?"

  - " খুলেই দেখো না !"

মোড়ক টা শেষে খুলেই ফেলি...। বুক ভরে ঘ্রাণ নিই !  সূতপুত্রের মতো ভেসে যাওয়া কবিতারা আবার হৃত-রাজসিংহাসনে আরোহণ করে। এবারে আর হলদে নয় ; সতেজ, সদ্যোজাত পাতার লাজুক গন্ধ সুড়সুড়ি দেয় নাসারন্ধ্রে...। চেনা কবিতারা অচেনা,পিচ্ছিল পাতায় মোহরকুঞ্জ সাজায়। ভীরু ম্যান্ডোলিনে কোলাহল পড়ে যায়।

মৃদুলের অবয়ব স্পষ্টতর হয়....লাল পাঞ্জাবি...আমার ঝারোখায় আবার বসন্ত এনে দেয় !

  - " তোমার তুমি ফিরিয়ে দিলাম, এবার আমি চলি !"

মৃদু প্রতিবাদধ্বনি ভেসে আসে। ক্রমে ওর ঠোঁট আমার নাভিমূল স্পর্শ করে। আমি লাজুক হাসি। ফিসফিস করে ও শুধোয়,

- " মেঘেরাও গর্ভবতী হয় ?"

aditi.sahoophymc1245@gmail.com
হলদিয়া



1 comment:

  1. খুব ভালো লাগল , স্বাভাবিক - চিরাচরিত গল্প গুলোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের গল্প .... লেখাটির মধ্যে এক গভীর অর্থ রয়েছে , যেটা লেখার মান বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে ...😊😊

    ReplyDelete